Inqilab Logo

শুক্রবার ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দুর্ভোগের ৩৩ ঘণ্টা

পরিবহন ধর্মঘট প্রত্যাহার : গাবতলীতে অবরোধ, ভাঙচুর, সংঘর্ষে নিহত ১ : যান চলাচল শুরু

| প্রকাশের সময় : ২ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

বিশেষ সংবাদদাতা : অবশেষে টানা ৩৩ ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার অবসান হয়েছে। পরিবহন শ্রমিকদের অনির্দিষ্টকালের ডাকা ধর্মঘট প্রত্যাহারের মাধ্যমে সচল হয়েছে গাড়ির চাকা। গতকাল বুধবার দুপুরে মতিঝিলের পরিবহন ভবনে অনুষ্ঠিত পরিবহন মালিক শ্রমিকদের বৈঠক শেষে শ্রমিকদের ‘কর্মবিরতি’ প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান। এর আগে বেলা সাড়ে ১০টার দিকে সচিবালয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের দফতরে পরিবহন ধর্মঘট ইস্যুতে আরেকটি রুদ্ধদ্বার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে ওবায়দুল কাদের ছাড়াও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, নৌমন্ত্রী শাজাহান খান, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙা এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ উপস্থিত ছিলেন। পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই হঠাৎ করে ডাকা পরিবহন ধর্মঘটে ঢাকাসহ সারাদেশের লাখ লাখ মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েন। টানা ৩৩ ঘণ্টা পর সেই দুর্ভোগের অবসান হয়েছে। এদিকে, ধর্মঘট চলাকালে গতকাল ঢাকার গাবতলীতে শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষে  শাহ আলম (৩২) নামে এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল বিকাল সোয়া তিনটার দিকে ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়ার পর থেকে যান চলাচল শুরু হয়। সন্ধ্যার পর তা স্বাভাবিক হয়ে আসে। দেশজুড়ে এ অরাজকতার জন্য সাধারণ মানুষ চরম ক্ষুব্ধ। সরকারের একজন মন্ত্রীর বাসভবনে এ ধরনের ধর্মঘটের সিদ্ধান্তে অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।  
পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই মঙ্গলবার সকাল থেকে সারাদেশে অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘট শুরু করে নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন। তাতে কার্যত অচল হয়ে পড়ে সারাদেশ। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ১০ জেলায় গত রোববার ডাকা অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘট মঙ্গলবার ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। যার প্রভাব পড়ে রাজধানীতেও। ধর্মঘটে সারাদেশেই দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ থাকে। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়ে দেশের সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের জন্য এ ধর্মঘট ছিল খুবই বেদনাদায়ক ও কষ্টের।
মঙ্গলবার সারাদিন অচলাবস্থার পর গতকাল বুধবারও সকাল থেকে রাজধানীর চারটি টার্মিনাল থেকে কোনো বাস ছাড়েনি। বন্ধ ছিল সিটি সার্ভিসও। টানা ৩৩ ঘণ্টার ধর্মঘটে রাজধানীর চারটি টার্মিনালে আটকা পড়েছিল হাজার হাজার যাত্রী। সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে বাস না পেয়ে গতকাল সকালেও শত শত মানুষ পায়ে হেঁটে রওনা করেছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দেখা গেছে পায়ে হাঁটা মানুষের মিছিল। এসময় মহিলা, বৃদ্ধ ও শিশুদের কষ্টের সীমা ছিল না। বাস বন্ধ থাকায় গত দু’দিন ধরেই ট্রেনে ছিল উপচে পড়া ভিড়। ঈদের মৌসুমে মানুষ যেমন ট্রেনের ছাদে ভ্রমণ করে, ঠিক তেমনি দেখা গেছে গত দু’দিন। ট্রেনের টিকেটের জন্য কমলাপুরে কাউন্টারগুলোতে ছিল লম্বা লাইন। শত শত মানুষ টিকেটের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল। কমলাপুর স্টেশনে মাস্টার জানান, মঙ্গলবার সারারাত মানুষ কাউন্টারগুলোতে ভিড় করেছে। অনেকে টিকেট পেয়েছে আবার অনেকেই পায়নি। দু’দিন ধরেই প্রতিটি ট্রেন অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে চলাচল করছে।  
এদিকে, গতকাল সকালে গাবতলী টার্মিনালের সামনে রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে মিছিল মিটিং করতে থাকে পরিবহন শ্রমিকরা। এসময় তারা বাস-মিনিবাস ছাড়াও প্রাইভেটকারসহ ব্যক্তিগত যানবাহন চলাচলে বাধা দেয়। মঙ্গলবার দিবাগত মধ্যরাত থেকে তারা গাবতলী এলাকায় তান্ডব শুরু করে। পুলিশ তাতে বাধা দিতে গেলে শ্রমিকদের সাথে সংঘর্ষ বাঁধে। সকাল ৯টা থেকে র‌্যাব-পুলিশের সাথে শ্রমিকদের কয়েক দফা ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে  পুলিশের সাথে সংঘর্ষে শাহ আলম (৩২) নামে একজন শ্রমিক আহত হয়। পরে তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ঢামেক পুলিশ ফাঁড়ির এসআই বাচ্চু মিয়া জানান, শাহ আলম শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ হয় বলে দাবি করেন তার স্বজনরা। নিহত শাহ আলম বৈশাখী পরিবহনের চালক ছিলেন বলে জানান বাচ্চু মিয়া। সকাল থেকে গাবতলীতে র‌্যাব-পুলিশের কয়েক দফা অভিযানের পর গাবতলীতে থমথমে অবস্থা বিরাজ করতে থাকে। এরই মধ্যে সচিবালয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কক্ষে পরিবহন ধর্মঘট ইস্যুতে একটি রুদ্ধদ্বার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান, এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান রাঙা ও ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে খন্দকার এনায়েত উল্যাহ জানান, পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের সাথে আলোচনা করেই ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়া হবে। এরপর মতিঝিল সড়ক ভবনে বসে শ্রমিক ফেডারেশনের নেতাদের সাথে বৈঠক। ওই বৈঠকে নৌমন্ত্রী শাজাহান খান উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে নৌমন্ত্রী ধর্মঘটকে ‘কর্মবিরতি’ আখ্যা দিয়ে শ্রমিকদের কাজে ফেরার আহ্বান জানান। ওই আহ্বানের পর টানা ৩৩ ঘণ্টা রুদ্ধশ্বাস ও ভোগান্তির অবসান হতে শুরু করে। তবে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় খবর নিয়ে জানা যায়, মন্ত্রীর এই ঘোষণার পরেও কোনো কোনো এলাকায় যানবাহন চলাচলে বাধা দেয়া হয়। গতকাল বিকাল চারটার দিকে গাবতলী এলাকার এক বাসিন্দা জানান,  ঘোষণা দেয়ার পরেও গাবতলীতে যান চলাচলে বাধা দেয় কিছু শ্রমিক। তারা গাবতলীতে থেকে বাস ছেড়ে যেতে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। এসময় গাবতলীতে কয়েক হাজার যাত্রী বাসের অপেক্ষায় সীমাহীন কষ্টে অপেক্ষা করছিল। তবে বিকাল ৫টার পর থেকে বাস ছাড়া শুরু হলে মানুষের দুর্ভোগও কমতে তাকে। ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির এক নেতা জানান, শুধু গাবতলী নয় বিকালের পর থেকে রাজধানীর সবগুলো টার্মিনাল থেকে দূরপাল্লার বাস ছেড়ে যেতে থাকে। কমতে থাকে অপেক্ষমাণ মানুষের ভিড়। একই সাথে ঢাকার বাইরে থেকেও দূরপাল্লার বাস ছাড়তে থাকে বলে জানান ওই নেতা।  
মানিকগঞ্জে তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরসহ পাঁচজন নিহতের ঘটনায় এক বাস চালকের যাবজ্জীবন সাজা হওয়ায় ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে খুলনা বিভাগের দশ জেলায় পরিবহন ধর্মঘট ডাকে সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন। সাভারে ট্রাকচাপা দিয়ে এক নারীকে হত্যার দায়ে আদালত ২৭ ফেব্রুয়ারি আরেক চালকের ফাঁসির দন্ড দিলে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নেয় ফেডারেশনের শীর্ষস্থানীয় নেতারা। যদিও সাভারের ঘটনাটি কোনো দুর্ঘটনা ছিল না। এটি ছিল ক্ষোভের বশে পরিকল্পিত হত্যাকান্ড। অভিযোগ রয়েছে, গত সোমবার নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের বাসভবন থেকেই এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এতে করে সারাদেশের মানুষকে চরম দুর্ভোগের শিকার হতে হয়। অনেকেই মনে করেন এ দুর্ভোগের জন্য শাজাহান খান দায়ী। এ কারণে অনেকে তার অপসারণও দাবি করেছেন। সরকারের ভেতরের অনেকেই শাজাহান খানের সমালোচনা করেছেন। এমনকি গতকাল জাতীয় সংসদেও শাজাহান খানের সমালোচনা হয়েছে।



 

Show all comments
  • লোকমান ২ মার্চ, ২০১৭, ১২:১০ পিএম says : 0
    সাজা থেকে বাঁচাতে গিয়ে আরেক জনের প্রাণ গেলো।
    Total Reply(0) Reply
  • রফিক ২ মার্চ, ২০১৭, ১২:১১ পিএম says : 0
    এই দুর্ভোগের জন্য দায়ি মন্ত্রীর অপসারণ চাই।
    Total Reply(0) Reply
  • সুলতাল ২ মার্চ, ২০১৭, ১২:১২ পিএম says : 0
    আশা করি আদালত আসামীদের বিরুদ্ধে যে রায় দিয়েছে, সেটা বহল থাকবে।
    Total Reply(1) Reply
    • ATM FARUQUE AHMED ২ মার্চ, ২০১৭, ৪:০৯ পিএম says : 4
      Should we do respect to our judgement.No comments any verdict. Respect to law and our constitution.

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: দুর্ভোগ


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ