হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
জামালউদ্দিন বারী : চলতি বছরের গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার থেকে ফেব্রুয়ারি মাস বিদায় নিয়েছে। আমাদের ভাষা আন্দোলন ও ভাষা শহীদদের স্মৃতি বিজড়িত মাস হওয়ায় ১৯৫২ সাল থেকে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে এই মাস এমনিতেই বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনে বড় ধরনের প্রাণাবেগ সঞ্চার করে আছে। তবে গত দশকের শুরু থেকে এই ফেব্রুয়ারি মাসে আমাদের নাগরিক জীবনে আরো নতুন নতুন উৎসবের আয়োজন সংযুক্ত হয়েছে। এরমধ্যে যুক্ত হয়েছে পহেলা ফাল্গুনে বসন্ত আবাহনের গণমাধ্যমকেন্দ্রিক নাগরিক আয়োজন এবং ১৪ ফেব্রুয়ারিতে ভ্যালেন্টাইন ডে বা ভালোবাসা দিবসের বাণিজ্যিক আড়ম্বরতা। বিশেষত ঢাকা শহরে বসন্ত আবাহন এবং ভ্যালেন্টাইন দিবসের তারুণ্যময় উৎসবমুখরতা যেন একুশের বইমেলা এবং রমনা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরেই আবর্তিত হয়। মাসব্যাপী একুশের গ্রন্থমেলাও শেষ হয়ে গেছে। এবারো প্রায় চার হাজার নতুন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে বলে জানা গেছে। গত এক দশক ধরেই এমন হারে বই প্রকাশিত হচ্ছে একুশের গ্রন্থমেলায়। যে দেশের মানুষ ভাষার জন্য সংগ্রাম করে বুকের রক্তের বিনিময়ে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করেছে, যে দেশের মানুষ ভাষাকেন্দ্রিক জাতীয়তার ভিত্তিতে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য সশস্ত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে লাখো প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। যে দেশে ভাষার সংগ্রাম ও শহীদ দিবসকে ঘিরে প্রতিবছর মাসব্যাপী বিশালায়তন গ্রন্থমেলার আয়োজন হয় এবং হাজার হাজার নতুন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়, সে জাতিরাষ্ট্র দুর্বল, ভঙ্গুর অথবা পরমুখাপেক্ষী থাকতে পারে না। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, আমরা এখনো ভঙ্গুর ও পরমুখাপেক্ষী কিনা। এ বিষয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক যা-ই থাক না কেন, যে জাতির স্বাধীনতার বীজ ভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনে নিহিত ছিল অর্ধশতাব্দীর বেশি সময়ের মধ্যে সে জাতির সাংস্কৃতিক পরিচর্যা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দর্শনের উৎকর্ষ আরো সুউচ্চ ও সুদৃশ্যমান হওয়ার প্রত্যাশা ছিল। সমাজ প্রগতি ও রাজনৈতিক অর্জনের ক্ষেত্রে আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে আছি নাকি পিছিয়ে পড়েছি তা নিয়েও এখন বিতর্ক হতে পারে। আমাদের শাসক শ্রেণি এখন শুধুমাত্র জিডিপি প্রবৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল এবং অবকাঠামো উন্নয়নের মানদন্ডের রন্ড জাতীয় উন্নয়ন-অগ্রগতির হিসাব মেলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন। পদ্ধতিগত মেনিপুলেশনের মাধ্যমে পাবলিক পরীক্ষায় সর্বোচ্চ গ্রেড এবং শতভাগের কাছাকাছি পাসের হার নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে আমরা শিক্ষা ক্ষেত্রে সাফল্যের ডুগডুগি বাজাতে দেখছি। শিক্ষা খাতে মাইক্রো এবং ম্যাক্রো পর্যায়ে অস্বাভাবিক ব্যয়বৃদ্ধির পরও আমাদের শিক্ষার মান আগের যে কোন সময়ের চেয়ে কমেছে বলেই প্রতীয়মান হয়। পক্ষান্তরে শুধুমাত্র পারিবারিক দারিদ্র্যের কারণে এখনো প্রতিবছর লাখ লাখ শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এনরোলমেন্টের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই নিচের ক্লাসগুলোতে ঝরে যাচ্ছে আরো কয়েক মিলিয়ন শিক্ষার্থী। অর্থাৎ মাতৃভাষা ঠিকমত পড়া ও লেখা শেখার আগেই স্কুল ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে বিপুলসংখ্যক শিশু। শিক্ষাসহ ন্যূনতম মৌলিক, নাগরিক অধিকার বঞ্চিত পরিবারগুলো সামাজিক বৈষম্যের শিকার। আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিকাঠামো ও ব্যবস্থাপনার পুর্নগঠন বা সংস্কারের মূল লক্ষ্য ছিল সমাজ থেকে বৈষম্য দূর করা। এখন দেখা যাচ্ছে, আমাদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ভেতর ক্ষমতাকেন্দ্রিক একটি অতিরিক্ত সুবিধাভোগী শ্রেণি গড়ে উঠেছে যারা সংখ্যায় অতি ক্ষুদ্র হওয়া সত্তে¡ও রাষ্ট্রের বেশিরভাগ সম্পদের মালিক মোক্তার ও সুবিধাভোগী। এ ধরনের বৈষম্য বাড়িয়ে কোনো সমাজ ও রাষ্ট্র শুধুমাত্র জিডিপি প্রবৃদ্ধির হিসাব দেখিয়ে বড় বড় অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের নকশা দেখিয়ে উন্নয়নের দাবি করতে পারে না।
একুশে গ্রন্থমেলায় এবারো প্রায় চার হাজার বই প্রকাশিত হয়েছে বলে জানা গেছে। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, সায়েন্স ফিকশন, অনুবাদ, ধর্ম-দর্শন ও গবেষণামূলক বই প্রকাশিত হয়েছে। তবে মেলায় প্রকাশিত গ্রন্থের বেশিরভাগই অর্থ ও প্রকাশনার অপচয় বলে মন্তব্য করছেন মননশীল পাঠক-লেখকদের অনেকেই। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি কিছুটা পরিষ্কার হতে পারে। বরাবরের মতো এবারের গ্রন্থমেলায়ও সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বেরিয়েছে কবিতার বই। একশ্রেণির তরুণ কবি প্রতি বছর দু’চারটি করে কবিতার বই প্রকাশ করছেন। প্রতি বছর শুধুমাত্র একুশের গ্রন্থমেলায় হাজারের কাছাকাছি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হচ্ছে। এ থেকে কি প্রমাণিত হয় বাংলাদেশে কাব্যসাহিত্য প্রভৃতি উন্নত হয়েছে। হাজার হাজার নতুন কবিতার বই কি হাজার কবির উঠে আসার বার্তা দিচ্ছে? বাস্তবতা হচ্ছে, গত ৬ দশকে কালোত্তীর্ণ ও সমাজকে প্রভাবিত করার মতো কবি-সাহিত্যিকের সংখ্যা ৬ জনের বেশি নয়। সাহিত্যের অন্যান্য শাখারও অবস্থা তথৈবচ। শত শত লেখক-কবি সাহিত্যিক, গবেষক গন্ডিবদ্ধ চিন্তাকেই তাদের সৃষ্টির প্রেরণা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তারা কল্পজগতে পাখা মেলে বাস্তব জগতের মানুষের চিন্তাকে কল্পজগতেই ঠেলে দিতে চাইছেন। এভাবে চিন্তা ও বুদ্ধি গন্ডিবদ্ধ হয়ে পড়তে বাধ্য। প্রায় দুইশ বছরের ঔপনিবেশিক আমলে ভাটি বাংলার মুসলমান সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশটি বিংশ শতকের শুরুতে মাথাতুলে দাঁড়াতে সচেষ্ট হয়েছিল। ইংরেজ শাসকরা আমাদের পূর্বপুরুষদের দুরবস্থা ঘোচাতে এবং বাণিজ্যের কাঁচামাল ও নতুন বাজার সৃষ্টিকল্পে শতবছরের অবহেলিত ঢাকাকেন্দ্রিক পূর্ব বাংলাকে প্রশাসনিকভাবে আলাদা প্রদেশ হিসেবে গড়ে তোলার যে উদ্যোগ নিয়েছিল কলকাতাকেন্দ্রিক বাবু বুদ্ধিজীবী ও সুবিধাভোগী পেশাজীবীরা তার নাম দিয়েছিল বঙ্গভঙ্গ। অনগ্রসর মুসলমানদের সামাজিক-রাজনৈতিক উন্নয়নের প্রত্যাশা জাগানিয়া ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ বা প্রশাসনিক রোডম্যাপ ভন্ডুল করতে তারা নানা ধরনের আবেগি শ্লোগান ও রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করে ইংরেজদের মনে ভয় ধরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের ক্ষেপিয়ে বা বিরাগভাজন হয়ে ভারত শাসন করা যাবে না, এই উপলব্ধি থেকেই ব্রিটিশ রানী ভারত সফরে এসে ১৯১১ সালে দিল্লি দরবারে ‘বঙ্গভঙ্গ রদ’ ঘোষণা করেন। এভাবেই বাঙালি মুসলমানের একটি স্বপ্ন ও সম্ভাবনার অপমৃত্যু ঘটে। তবে বঙ্গভঙ্গের ৬০ বছর পর ১৯৭১ সালে বাঙালি মুসলমানের হাজার বছরের রাজনৈতিক স্বপ্নসাধের সফল বাস্তবায়ন ঘটে ৯ মাসের একটি রক্তাক্ত যুদ্ধে লাখো প্রাণের বিনিময়ে। আমরা বলে থাকি, একাত্তরের স্বাধীনতা বীজ বপিত হয়েছিল বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনে। আরেকটু পিছিয়ে আমরা কি বলতে পারি না আমাদের স্বাধীনতার বীজ বপিত হয়েছিল ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গর সিদ্ধান্তের মধ্যদিয়ে? অথবা ইতিহাসের আরেকটু পিছন ফিরে তাকিয়ে আমরা কি বলতে পারি, যেহেতু ১৮৫৭ সালের সালের ব্রিটিশবিরোধী মহাবিদ্রোহের মূল কেন্দ্র ছিল এই ভাটি বাংলায়, এ অপরাধে শত শত বিদ্রোহী বীরযোদ্ধাকে এই ঢাকা শহরেই গাছে ঝুলিয়ে হত্যা করেছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা। অতএব এই বাংলার স্বাধীনতার বীজ ১৮৫৭ সালেই এদেশের সিপাহি জনতার চেতনায় বপিত হয়েছিল? ইতিহাসের কোনো ঘটনাই বিচ্ছিন্ন নয়, কিছু ঘটনা বৃহত্তর শক্তির প্রভাব বা চাপিয়ে দেয়া হলেও মূলত সব ঘটনাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জাতিমানসের পরিগঠন ও আশা-আকাক্সক্ষার একটি ঐতিহাসিক পরম্পরা বিদ্যমান। এখনকার পাঠ্যপুস্তকের নব্য ইতিহাসবিদদের জাতির রাজনৈতিক ইতিহাসকে বায়ান্নো থেকে একাত্তরে সীমাবদ্ধ রাখতেই যেন সচেষ্ট দেখা যাচ্ছে।
বঙ্গভঙ্গ রদের কারণে পূর্ববাংলার মুসলমানের মধ্যে যে স্বপ্নভঙ্গ ঘটেছিল তা কিছুটা পুষিয়ে দিতেই ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিল ইংরেজ সরকার। এ ক্ষেত্রে ঢাকার নবাব পরিবার এবং নবগঠিত মুসলিম লীগ নেতাদের ঐকান্তিক আগ্রহ ও বড় ধরনের অর্থনৈতিক সমর্থন ছিল। তবে কলকাতার বাবু বুদ্ধিজীবীরা এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধেও সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ গড়ে তুলেছিল। প্রতিক্রিয়াশীল হিন্দুরা খোদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও এই প্রতিবাদী কাফেলায় সামিল করতে সক্ষম হয়েছিল। তবে বাংলাদেশের মুসলিম নেতৃবৃন্দের পাশাপাশি ইংরেজ শিক্ষাবিদ ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিরাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বাংলার মুসলমানদের নবজাগরণ ও এগিয়ে যাওয়ার পাদপীঠ হয়ে ওঠার ভবিষ্যদ্বানী করেছিলেন। তাদের সেই প্রত্যাশা ও ভবিষ্যদ্বানী মিথ্যা হয়নি। তবে আজকের বাস্তবতা বলে দিচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জনে মাঝপথে পথ হারিয়েছে। একটি জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও বিশ্বসভায় ভাস্বর হয়ে ওঠার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও দার্শনিক রূপরেখা যেভাবে এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল তা সম্ভব হয়নি। প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার অনেক কিছুই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে ন্যস্ত হওয়া, দ্বিজাতিতত্তে¡র ভিত্তিতে বাংলাদেশ পাকিস্তান রাষ্ট্রের অংশ হওয়ার পর পাকিস্তানি শাসকদের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ অঞ্চলের মুসলমানদের জন্য একটি অভীষ্ট সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংস্কারের পথরেখা বিনির্মাণের সুপরিকল্পিত উদ্যোগ দেখা যায়নি। রাষ্ট্রশক্তির বাইরে তথাকথিত প্রগতিশীল এবং ধর্মীয় রক্ষণশীল অভিধায় অভিষিক্ত শ্রেণির দ্বান্দিক বিভাজনও এ দেশের মানুষের আকাক্সক্ষা ও চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য বিধানে ব্যর্থ হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার যাত্রা শুরুর পর পর ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক আবুল হুসেন, কাজী আনোয়ারুল কাদির, কাজী আব্দুল ওদুদ, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল ফজল, আব্দুল কাদির প্রমুখের নেতৃত্বে ও অংশগ্রহণে মুসলিম সাহিত্য সমাজ নামে যে সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়াস শুরু হয়েছিল তা ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলন নামেও পরিচিতি পেয়েছিল। তবে বৃহত্তর সমাজ মানসকে রাতারাতি পাল্টে ফেলার বিপরীতমুখী প্রগতিশীল থিওরি আরোপ করতে গিয়ে তারা পরিবর্তনকামী সাধারণ মানুষের কাছেও গ্রহণযোগ্যতা লাভ করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের কেউ কেউ প্রগতিশীলতার নামে ইসলাম বিমুখতা ও নাস্তিকতার অপবাদ লাভ করেছিলেন। বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক আবুল হুসেন মাত্র এক দশকের মাথায় ১৯৩৮ সালে রক্ষণশীল সমাজের বাধার মুখে চাকরি ছেড়ে ঢাকা ত্যাগ করতে বাধ্য হন। একদিকে শেকড় বিচ্ছিন্ন প্রগতিশীলতা অন্যদিকে ক্ষীণদৃষ্টিসম্পন্ন রক্ষণশীলতার দ্ব›দ্ব এখনো আমাদের সমাজে যথাশক্তিতে অবস্থান করছে। এই দু’য়ের বিপরীতে সমাজে যে মডারেট বা মধ্যপন্থি শক্তি রয়েছে ভোটের রাজনীতি বা আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে রাষ্ট্রশক্তির কাছে সুবিধাজনক বিবেচিত না হওয়ায় তাদের আকাক্সক্ষার উপযোগী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের রাজনৈতিক কর্মসূচি কখনোই গ্রহণ করা হয়নি। একদিকে ধর্মান্ধ শ্রেণি যারা ইসলাম ধর্মকে খন্ডিত এবং বিকৃতভাবে উপস্থাপনে অভ্যস্ত, অন্যদিকে ধর্মবিমুখ বা ইসলাম বিদ্বেষী তথাকথিত প্রগতিশীল সমাজ, এই দুই শ্রেণির দ্ব›দ্ব রাষ্ট্রশক্তিকে নিজেদের সুবিধার্থে ব্যবহার করে আসছে। একদিকে একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে ফুল দেয়া যখন শ্রেফ রাজনৈতিক কর্মসূচিতে পরিণত
হয়েছে, তখন এই ফেব্রুয়ারিতেই পহেলা ফাল্গুন এবং ভেলেন্টাইন ডে পালনের পোশাকি আড়ম্বর ক্রমবিস্তৃত হওয়ার পেছনেও আছে কর্পোরেট মুনাফাবাজি এক সাংস্কৃতিক দুরভিসন্ধি। এমনকি পহেলা বৈশাখের সাথে জড়িয়ে থাকা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের সাংবাৎসরিক হালখাতা উৎসব এখন মঙ্গল শোভাযাত্রায় পরিগ্রহ করেছে। রক্ষণশীল মুসলমানরা যখন অভিযোগ করেন, বাঙালি মুসলমানের স্বাধীন রাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ভুলিয়ে তার বিশ্বাসকে দুর্বল করা এবং চির ধরিয়ে দেয়াই এসব সাংস্কৃতিক তৎপরতার মূল লক্ষ্য। তখন সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এই মতকেই সমর্থন করে এসব তৎপরতার বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ও অবস্থান গ্রহণ করেন। এভাবেই আমাদের স্বাধীনতার শুরু থেকে অদ্যাবধি জাতিসত্তার বুদ্ধিবৃত্তি, মননশীলতা ও জনমানস স্পষ্টত বিভাজিত। যতই দিন যাচ্ছে এই বিভাজন যেমন বাড়িয়ে তোলা হয়েছে।
যদিও রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিভাবে দেশ এগিয়ে চলেছে বলে দাবি করা হচ্ছে, বাস্তবতা হচ্ছে দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। এখনো লাখ লাখ শিশু ন্যূনতম শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। সুষ্ঠু, অবাধ নির্বাচনের মধ্যদিয়ে জনগণকে নিজেদের শাসক নির্বাচিত করার সুযোগ গণতন্ত্রের মূল শর্ত। রাজনৈতিক স্বাধীনতার প্রশ্নে জনগণ তথা ব্যক্তির সামষ্টিক স্বাধিকারের দাবির মূল ভিত্তি এটি। আমরা যদি রাষ্ট্রব্যবস্থায় আমাদের গণতন্ত্র ও নির্বাচনের আধুনিক ইতিহাস পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখব ১৯২০ সালের ব্রিটিশ-ভারতের ইম্পেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের নিম্নকক্ষ এবং প্রাদেশিক কাউন্সিল নির্বাচনই হচ্ছে সত্যিকার অর্থে জনগণের অংশগ্রহণে প্রথম সাধারণ নির্বাচন। দিল্লিভিত্তিক লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের নিম্ন কক্ষের আসন সংখ্যা ১০৪, উচ্চকক্ষের স্টেট কাউন্সিল আসন ৩৪ এবং বেঙ্গল প্রাদেশিক পরিষদের ৬৩৭টি আসনের মধ্যে বেশিরভাগ আসে সরাসরি প্রতিদ্ব›িদ্বতার সুযোগ রাখা হলেও বিশেষভাবে সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা থাকায় নির্বাচনে হিন্দু, মুসলমান, শিখ এবং ইউরোপীয়দের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান নিশ্চিত হয়েছিল। উল্লেখ্য, মহাত্মা গান্ধী নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দেয়া সত্তে¡ও বাংলা-ভারতের ইতিহাসের প্রথম সাধারণ নির্বাচনটি বেশ স্বাধীন ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। মহাত্মা গান্ধীর নির্বাচন বর্জনের কারণে মাত্র ৬টি আসনে কোনো প্রার্থী ছিল না। এরপর গত প্রায় এক শতাব্দীতে বাংলাদেশে আরো ২০টি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এরমধ্যে সর্বশেষ নির্বাচন হিসেবে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটিকে গণতন্ত্রের মানদন্ডে সব দিক থেকেই নিকৃষ্ট নির্বাচন হিসেবে বিচার করা যেতে পারে। অর্থাৎ আমরা বিদেশি ঔপনিবেশিক শক্তির কাছ থেকে স্বরাজ আদায় এড়াতে এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের কাছ থেকে আলাদা রাষ্ট্র গঠনে নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে সক্ষম হলেও শত বছর পেরিয়ে এসেও আমরা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে জনগণের জন্য নিরাপদ ও নিশ্চিত করতে পারিনি। গত সাড়ে ৬ দশক ধরে আমরা ফেব্রুয়ারি মাসে শোকের আবহে যে ভাষা শহীদদের স্মরণ করছি তাদের সংখ্যা ছিল ৫-৬ জন। আর স্বাধীন বাংলাদেশে ২০০৯ সালে এই ফেব্রুয়ারির ২৫ তারিখে ঢাকার পিলখানায় জাতির ৫৭ জন শ্রেষ্ঠ সন্তানকে নির্মমভাবে হত্যার ঘৃণ্য ইতিহাস রচিত হয়। আমাদের রাজনীতি ও নির্বাচনী সংস্কৃতি, আমাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা এবং সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য এগিয়ে যাওয়ার বদলে ক্রমাগত যেন এভাবেই পিছিয়ে পড়ছে। আমাদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা, ভাষার মাস, স্বাধীনতার মাস, বিজয়ের মাসকেন্দ্রিক সম্মিলিত ভাবাবেগ এখন যেন কর্পোরেট মুনাফাবাজি ও অপরাজনৈতিক প্রপাগান্ডার দখলে চলে গেছে। শত বছরের রক্তাক্ত সংগ্রাম ও লাখো শহীদের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে হীন রাজনৈতিক মতাদর্শিক ভেদাভেদ ভুলে এসব অপদখল থেকে রাষ্ট্র ও সমাজের মননশীলতার মহামূল্যবান স্বত্ব ও সম্পদগুলো রক্ষার সম্মিলিত রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক উদ্যোগ প্রয়োজন। [email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।