হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
মোবায়েদুর রহমান : গত রবিবারের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত দুটি খবরের প্রতি আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। একটি হল, বিএনপি নেতা প্রাক্তন মন্ত্রী মেজর হাফিজ উদ্দিনের মন্তব্য। তিনি বলেছেন, ‘১৯৯৬ সালের পানি বণ্টন চুক্তি জাতীয় স্বার্থবিরোধী’। অপরটি হল, বিএনপির অপর একজন নেতা ও প্রাক্তন মন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদের একটি মন্তব্য। তিনি বলেছেন, সাজা হলেও খালেদা জিয়া প্রার্থী হতে পারবেন। তিনি বলেন, ওটা সাজানো মিথ্যা মামলা। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগের কোনো সত্যতা মেলেনি। তারপরও সাজা হলেও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। শুধু প্রার্থীই নয়; নির্বাচন সময়ে দলের ও জোটের নেতৃত্বও দিতে পারবেন’। দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আইন অনুযায়ীই বেগম জিয়া নির্বাচনে প্রার্থী হবেন।
তিনি আরও বলেন, আজকে একটা ধারণা পরিষ্কার করে বলে দেই। বেগম খালেদা জিয়ার সাজা হলে উনি আর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন নাÑ এটা সঠিক নয়। এ ধরনের প্রচারণা অমূলক। বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মনোবল দুর্বল করতে সুকৌশলে এ অপপ্রচার চালাচ্ছে ক্ষমতাসীনরা। আমি পরিষ্কার করে বলছি, মিথ্যা মামলায় খালেদা জিয়ার যদি সাজাও হয় তাহলে তার জনপ্রিয়তা আরও অনেক বেড়ে যাবে যা ভোটে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। যারা বাংলাদেশের রাজনীতি বোঝেন, রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত, তারা কেউ আমার এই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করবেন না। তিনি বলেন, ধরে নিলাম, মিথ্যা মামলায় খালেদা জিয়ার সাজা হয়ে গেলো। ভালো কথা। সাজা হয়েছে, নিয়ম অনুযায়ী আমরা আপিল ফাইল করবো। আপিল হলো বিচারের ধারাবাহিকতা। তখন আমরা উচ্চ আদালত থেকে তার জন্য জামিন নেব। বেগম খালেদা জিয়ার সাজা হলেও নির্বাচনে তিনি সরাসরি অংশগ্রহণে তথা প্রার্থী হতে পারবেন। শুধু প্রতিদ্বন্দ্বিতাই নয়, বরং তিনি দল এবং জোটের নেতৃত্বও দিতে পারবেন। উনি যদি সাজাপ্রাপ্ত হয়ে যান তাহলে তিনি আগামী ৩ বছর বা ৭ বছর জেলখানায় থাকবেন, এটা হয় না। বাস্তবতা এটা নয়। দেশের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী আপিল ফাইল করার পরপরই আমরা জামিনের জন্য দরখাস্ত করবো। আমাদের দেশের আইন অনুযায়ী সাধারণত ৩ বছর সাজা হলে এমনিতেই জামিন হয়। আর ৭ বছর সাজা হলে অল্প কিছুদিনের ব্যবধানে জামিন নিশ্চিত হবে। খালেদা জিয়া জেলখানা থেকে আবার মুক্ত হয়ে ফিরে আসবেন। এটাই হলো বাস্তবতা। কিন্তু এটা নিয়ে নানা ধরনের জল্পনা-কল্পনা কথাবার্তা হচ্ছে। এগুলো অমূলক।
গঙ্গার পানি চুক্তি সম্পর্কে মেজর হাফিজ উদ্দিন বলেন, ১৯৯৬ সালে ভারতের সাথে আওয়ামী লীগ সরকারের করা পানি বণ্টন চুক্তি জাতীয় স্বার্থবিরোধী। তিনি বলেন, এ চুক্তির কোনো গ্যারান্টি ক্লজ এবং কোনো আরবিট্রারি ক্লজ নেই।
মেজর (অব.) হাফিজ বলেন, আন্তঃনদী পানি বণ্টনের ক্ষেত্রে একটি সফল পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, যার ফলে ৬০ শতাংশ পানি প্রবাহ নিশ্চিত হয়েছিল। তিনি রাজনীতিবিদদের দোষারোপ করে বলেন, তারা এ বিষয়ে কোন জ্ঞান ছাড়াই কথা বলেন যা কোন প্রভাব তৈরি করতে পারে না। বাংলাদেশের পানি বণ্টন সংক্রান্ত অবস্থান দেশের ক্ষমতার পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়। কিন্তু ভারতে এ ধরনের পরিবর্তন দেখা যায় না। তিনি আরো বলেন, সবাইকে এ বিষয়ে একত্রিত হয়ে আন্দোলনের মাধ্যমে আমাদের নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করা উচিত এবং প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের পূর্বে সকল শ্রেণীর মানুষের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি স্বারকলিপি তার হাতে তুলে দেয়া উচিত যা পানি ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বাংলাদেশের পানি সমস্যা সমাধানের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে সহায়তা করবে।
ড. এস আই খান তার প্রবন্ধে বলেন, ভারতের উচিত তার আধিপত্যবাদী মনোভাব থেকে বেরিয়ে এসে বাংলাদেশের পানি সমস্যা সমাধানে আগ্রহী হওয়া। তিনি এ ব্যাপারে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
॥ দুই ॥
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে গঙ্গা নদীর পানি ভাগাভাগির বিষয়ে যে চুক্তি হয়েছিল তার ২০ বছর পূর্ণ হলো ১২ ডিসেম্বর, সোমবার। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবেগৌড়া ত্রিশ বছর মেয়াদি এই চুক্তি সই করেন। ভারত পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের কারণে ভাটিরদেশ বাংলাদেশ প্রয়োজনীয় পানি না পাওয়ায় যে সংকট তৈরি হচ্ছিল তা থেকে মুক্তির জন্যই এই চুক্তিটি হয়েছিল। কথা ছিল দুই দেশ ন্যায্যভাবে পানি ভাগ করে নেবে।
কিন্তু প্রায়ই এই অভিযোগ করা হয় যে চুক্তি অনুযায়ী পানি পায়নি বাংলাদেশ। কুড়ি বছর পরে এসে এই চুক্তির বিষয়ে পদ্মা নদী এলাকার মানুষেরা কী বলছেন? আর পানির ভাগ পাওয়ার যে কথা ছিল তা কতটা মিলছে? রাজশাহীর কাজলাঘাট এলাকায় এক সময় অনেক জেলে পরিবার বাস করতো। নদীর মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করাই ছিল তাদের পেশা। কিন্তু এখন নদীতে মাছ ধরা ছেড়ে অনেকেই বেছে নিচ্ছেন অন্য পেশা।
এমনই একজন মোঃ মহসিন মিয়া। বাবা-দাদার পেশা ছিল মাছ ধরা। শুরুতেই মাছই ধরতেন। তবে এখন চা-পান-বিড়ি-চিপস ইত্যাদি নিয়ে দোকানদারি করছেন। কাজলা ঘাটে ঢোকার মুখেই তার দোকানে কথা হচ্ছিল মহসিন মিয়ার সাথে। তিনি বলেন, ‘বাপ-দাদা মাছ ধরতো। আমিও ১৫ বছর মাছ ধইরছি। কিন্তু নদীটা শুকায়ে গেল। মাছ আর হয় না। বাধ্য হইয়া যে কোনো কর্ম করতে লাগলাম। বাধ্য হইয়া দোকান দিলাম। ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে দিল আর নদীটা শুকাতে লাগলো।’
রাজশাহী, পাবনা কিংবা ঈশ্বরদীতে পঞ্চাশোর্ধ জেলেদের অনেকের সাথেই কথা হয়। তারা জানান, গত ২০/২৫ বছর ধরে নদীর পানি কমতে থাকায় তারা পিতৃ পুরুষের পেশা মৎস্য শিকার ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। নদী বিষয়ে কথা শুরু করতেই স্মতিচারণ শুরু করে দেন এক সময় নদীকে কেন্দ্র করে জীবিকা চালানো মানুষেরা।
আগে জেলে পেশায় ছিলেন এমন একজন বলেন, ‘আগে তিন মাইল দূর থেকে ডাক শোনা যেত নদীর। ছাকনা দিয়ে ইলিশ ধরা হতো। অনেক সময় উপরেও উঠে যেত।’
আরেকজন বলেন, ‘আগে নদীতে বিভিন্ন ধরনের মাছ পাওয়া যেত। সব ধরনের মাছই ছিল। রাজশাহী থেকে নবাবগঞ্জ, খোলাবুনা, বাবলাবুনা, ক্যাডেট কলেজ এইসব এলাকায় মাছ ধরতাম।’ নদীর পানি অনেক নেমে যাওয়ায় হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে চলছে ফুলকপির চাষবাস।
রাজশাহী শহরের গায়ের সাথে জড়িয়ে আছে পদ্মা। কিন্তু নদীর তীর ধরে চলতে থাকলে চোখে পড়ে বিশাল এলাকাজুড়ে চর। ‘টি বাঁধ’ নামে পরিচিত একটি শহর রক্ষা বাঁধ থেকে ট্রলারে করে চরে পৌঁছে দেখা যায় বহু লোক সেখানে বৈকালিক ভ্রমণে এসেছেন। নদী গবেষক এবং লেখক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, ‘এই চুক্তির ফলে বাংলাদেশের উপকার যা হয়েছে, ক্ষতি হয়েছে তার চেয়ে বেশি। যাদের পেশা ছিল নদীকেন্দ্রিক তারা গ্রাম থেকে উচ্ছেদ হয়েছেন, ইকো সিস্টেম নষ্ট হয়ে গেছে। অনেকে দেশ ছেড়ে গেছে।’
ঈশ্বরদী রেলস্টেশনের সাথে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে দেখা গেল অনেকটা এলাকাজুড়ে নদীর বুকে আখ, গাজর আর ফুলকপির চাষ হচ্ছে। পাবনার রূপপুর গ্রামের মজিবুর রহমান জানান, ‘নদীর পানি কমে যাওয়ায় বছরের প্রায় দুই মাস বাদ দিয়ে বাকিটা সময় অনেকেই নানা ধরনের সবজির চাষাবাদ করেন।’
॥ তিন ॥
গঙ্গা নদী যেটি বাংলাদেশে পদ্মা নামেই সুপরিচিত, সেই নদীর পানি বাংলাদেশ ও ভারত প্রতিবেশী দুটো দেশই যেন ভাগ করে নিতে পারে সেজন্যই ঠিক কুড়ি বছর আগে দুই দেশের সরকার পানি ভাগাভাগির চুক্তিটি করেছিল। কারণ কলকাতা বন্দরের নাব্যতা রক্ষার কথা বলে ভারত পশ্চিমবঙ্গের ফারাক্কায় গঙ্গার ওপর বাঁধ দেয়, যা চালু করা হয় ১৯৭৫ সালে। এর ফলে শুকনো মৌসুমে বাংলাদেশের ভেতরে পদ্মায় পানি কমে আসে, আবার বর্ষা মৌসুমে দেখা যায় উল্টো চিত্র । ভারত বাঁধ খুলে দেওয়ায় সৃষ্টি হয় বন্যা। রূপপুর গ্রামের মজিবুর রহমান একসময় ফেরিঘাটে কাজ করতেন। নদীতে পানি কমে যাওয়ায় এখন তিনি সেখানে চাষাবাদ করছেন।
গঙ্গা চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল শুষ্ক মৌসুমে প্রতি বছর ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ১০ দিনের চক্র করে দুই দেশ পানি ন্যায্যভাবে ভাগ করে নেবে। কিন্তু চুক্তির কুড়ি বছর পরে এসেও পানি নিয়ে কেন এই হাহাকার? অবস্থা সেই কবিতার মত, ‘পার হয়ে যায় গরু পার হয় গাড়ি’।
পানির অভাবে সেচ কাজ চালাতে না পেরে বিপন্ন হয়ে পড়েছেন পদ্মা তীরের বহু এলাকার মানুষ। তাদের সহয়তা দেয়ার জন্য একসময় চালু করো হয় গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রকল্প।
সেই প্রকল্পের একজন কর্মকর্তা ওবায়দুল্লাহ সিদ্দিকী বলেন, প্রকল্পটি বেশ গতি নিয়ে শুরু হলেও পানির অভাবে তাও মুখ থুবড়ে পড়ে। তিনি বলেন, ‘চুক্তি অনুযায়ী পানি পায়নি বাংলাদেশ। চুক্তি করার কারণে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বিষয়টি তুলে ধরতে পারছে না বাংলাদেশ। এক সময় পদ্মার নদীপথে অসংখ্য ছোটবড় জাহাজ এবং মাছধরার নৌকা দিনরাত চলতো। কিন্তু এখন শুষ্ক মৌসুমে প্রায় সাড়ে তিনশ কিলোমিটারের বেশি নৌপথ বন্ধ রাখতে হয়।
এক সময় পদ্মা নাম পেয়েছিল কীর্তিনাশা। সাহিত্যে উঠে এসেছে এই নদীটির নাম। নদীর ঠিক মাঝখানে চর জেগে ওঠায় এখন কোথাও কোথাও তার এমন বিশীর্ন চেহারা। রাজশাহী ছাড়াও কুষ্টিয়া, পাবনা, ঈশ্বরদী, রাজবাড়ী, ফরিদপুরসহ বিভিন্ন দিকে বিভিন্ন নামে প্রবাহিত হয়েছে পদ্মা নদীর শাখা-প্রশাখা ও উপনদী। কুষ্টিয়ায় গড়াই নদীতে দেখা দিচ্ছে লবণাক্ততা।
॥ চার ॥
ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদের মন্তব্য সম্পর্কে বলার কিছু নাই। তিনি যেটা বলেছেন সেটি হলো আইনের কথা। এখনও এই দুটি মামলার রায় হয়নি। ওই দিকে ইলেকশনের রয়েছে আর ২৩ মাস। বেগম জিয়ার মামলার রায় হতে যদি আরও ৩ মাস লাগে তাহলে নির্বাচনের জন্য হাতে থাকবে আর ২০ মাস। যদি তার দ- হয় তাহলে আপিল করা হবে হাইকোর্টে। তারপর সেখান থেকে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে। সেই মামলা শেষ হতে লাগবে ৩-৪ বছর। ততদিনে ইলেকশন শেষ হয়ে যাবে। যত দিন আপিল চলবে তত দিন নিম্ন আদালতের রায় কার্যকর হবে না। সুতারং নির্বাচনে দাঁড়াতে এবং দল পরিচালনা করতে বেগম জিয়ার আইনগতভাবে কোন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এখন তার দন্ড হচ্ছে কি না এবং তার পরে কি হতে যাচ্ছে সেটা নিয়ে এই মুহূর্তে জল্পনা-কল্পনার কোন অবকাশ নাই।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।