বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
প্রফেসর ড. মখদুম মাশরাফী : ব্যাপ্ত সমাজের সংক্ষিপ্ত কর্তৃপক্ষ না হলে সামাজিক পরিচালনা অসম্ভব, এ রকম একটি ধারণা রক্ষণশীলভাবে সমাজে বিরাজিত আছে। কিন্তু এটি যে শাশ্বত সত্য নয়, এটি আজও বিবেচিত বা বিশ্লেষিত নয়। এভাবেই ভেবে নেয়া হয়েছে যে, সমাজ নানা অর্থে বিশাল তাই তার পরিচালনার জন্য প্রতিনিধি ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু প্রতিনিধিত্ব যে আরো কিছু অনুষঙ্গকে অবধারিতভাবে ধারণ করে সেটি নিয়ে ভাবনার কোনো ব্যবহার হয়নি। সমাজের প্রতিনিধিত্বের সাথে সব সময় এক ধরনের অটোনোমি অবধারিত হয়। সূচনা থেকেই তা হয় এবং উত্তরোত্তর তার ব্যাপ্তি সম্প্রসার লাভ করে। উত্তরোত্তর ওই কর্তৃপক্ষের
মধ্যে আধিপত্যের বোধ জাগ্রত হতে শুরু করে এবং সময়ের দাক্ষিণ্যে তা বি¯ৃÍততর ও গভীরতর হতে থাকে। আরো যা ভয়াবহ তা হচ্ছে কর্তৃপক্ষীয়তার সাথে ক্ষমতায়নের একটি যোগসূত্র তৈরি হয়। ওই ক্ষমতায়নও বিস্তৃততর হতে থাকে। এক সময় তা একক ও অপ্রতিরোধ্য হওয়ার উপক্রমে পৌঁছায় এবং এক সময় তা ওই পর্বকেও অতিক্রম করে। তখন তা হয়ে ওঠে সমাজ বিচ্ছিন্ন। এমন কি সমাজ বিপরীত। সমাজের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের মেরুকরণ একটি ভয়াবহ মাত্রা। তা যেমন স্বাধীনতা বিপরীত, তেমনি জীবন বিপরীত।
কর্তৃপক্ষের কর্তৃপক্ষীয়তা তথা ক্ষমতায়ন ততবেশি হবে বা হতে থাকবে যত বেশি অনালোকিত থাকবে সমাজ। কারণ, ততবেশি নির্ভরশীল থাকবে, সে ক্ষেত্রে সমাজ। নির্ভরশীলতার বিপরীতে ক্ষমতায়ন একটি শাশ্বত প্রক্রিয়া। নির্ভরশীলতা আসে উপলব্ধি সামর্থ্যরে ঘাটতির কারণে। তাই কর্তৃপক্ষ ও সমাজের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করে। এই দূরত্ব কৃত্রিমভাবে বাড়ানো ও কমানো যায়। তবে সাধারণত কোনো কর্তৃপক্ষ এ দূরত্ব কমানোর চেষ্টা করে না। বরং সর্বোতভাবে চেষ্টা করে এ দূরত্ব বাড়াতে। কর্তৃপক্ষের ক্ষমতায়নপ্রক্রিয়াকে আরো গতিশীল, তীব্র ও স্থায়ী করার জন্য এ চেষ্টা করা হয়। সাধারণত ক্ষমতাবান কখনো ক্ষমতাহীন হতে চায় না বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া। আর ওই বিশেষ ক্ষেত্র হচ্ছেÑনেতৃত্বের ভিশন। কিন্তু ভিশন একটি অসাধারণ মাত্রা। কোনো অসাধারণ মাত্রার অপেক্ষায় থাকা যৌক্তিক নয়। প্রায়োগিক বাস্তবের স্বাভাবিক গতিশীলতার কারণেই তা সম্ভব নয়। তাই সাধারণভাবে এবং সে কারণে সর্বোতভাবে কর্তৃপক্ষ ও সমাজের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি অবারিত ও অনবরত থাকে। এর জন্যে কর্তৃপক্ষ নানা কৌশল অবলম্বন করে যার মধ্যে রয়েছে ধারণা রাজনীতির চর্চা। ধারণা রাজনীতি সমাজের আবেগকে ব্যবহার করে উপলব্ধির বিপরীতে উত্তেজনা সৃষ্টি করে। সব পরিপ্রেক্ষিতেই এই কৌশল অবলম্বনের সুযোগ থাকে। এটি এই জন্য যে, মানুষ যেমন যুক্তি ধারণ করে, তেমনি প্রাণ ধারণ করে। আর জীবন যাত্রার ক্ষেত্রে আবেগের একটি জায়গা সব সময়ই থাকে। সমাজ যত বেশি অনালোকিত থাকে, তত বেশি অশীলিত আবেগের অবসর থাকে। আর ঠিক ততবেশি তীব্রতার সাথে ঐ আবেগ উপলব্ধির বিপরীতে ব্যবহারযোগ্য থাকে। একেকটি সন্ধিক্ষণে ওই আবেগ এতো উত্তঙ্গু হয় যে সেটিকে অন্ধ সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়। এটি একটি নেতি বৈপ্লবিক প্রক্রিয়াÑযেন হ্যামিলনের বাঁশি।
ধারণা রাজনীতির রূপকের উৎস হয় কখনো আঞ্চলিকতা, কখনো বর্ণ, কখনো ধর্ম, কখনো কুসংস্কার, কখনো কোনো বিশেষ অধিকার ইত্যাদি। ক্ষেত্রবিশেষে এগুলো প্রাসঙ্গিকতার যোগ্য হয় এবং সেভাবেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ধারণা রাজনীতি কখনো কখনো প্রায়োগিক বাস্তবের বাধ্যতার কারণেও ব্যবহৃত হতে পারে। যেমন আমেরিকার গৃহ যুদ্ধের সময় দাস প্রথা দূর করার জন্য রূপক হিসেবে মানবাধিকারের প্রশ্নটিকে সাধারণ্যে উপস্থিত করা হয়েছিল যাতে করে এটি একটি রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে প্রতীয়মান হয় ও সে কারণে রাজনৈতিক সমর্থনযোগ্যতা পায়। অথচ দাস প্রথা দূর করার বিষয়টি ছিল সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক। পুঁজিবাদ উৎপাদনহীনতার কালে দাসের ব্যয় বহন যুক্তিযুক্ত মনে করতে পারছিল না। তাই দাসদের স্বাধীনতার নামে তাদের প্রতি দায় এড়ানোর আগ্রহে তারা এই রূপকের ব্যবহার করেছে। দাসেরা স্বাধীন হলে তাদের টিকে থাকার দায় তাদের ওপরে বর্তায়, পুঁজিবাদী মালিকের ওপরে নয়। একইভাবে গান্ধীর ‘রামরাজ্য’ প্রতিষ্ঠার বিষয়টিও বিবেচ্য। এটি আপাত চোখে নৈতিকতার বিষয়টিকে পুরোভাগে আনলেও এর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য সূক্ষ্ম ইতিবাচকতার সাথে ধর্মের সংহতি উপাদানকে রাজনৈতিক সংহতি উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা। এই ধারাবাহিকতায় আর একটি উদাহরণ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হবে তা হচ্ছে জনএফ কেনেডির সোভিয়েত ইউনিয়নকে চাঁদের স্বপ্ন দেখানো। ১৯৬১ সালে যখন জনএফ কেনেডি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট তখন তিনি জাতির কাছে চাঁদে অভিযানের প্রস্তাব রাখেন। এই ধারণার উদ্দেশ্য ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অস্ত্রপ্রতিযোগিতার জন্য অর্থায়ন ও বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্য অর্থায়নের ধারাকে মহাশূন্য অভিযানের দিকে নিয়ে যাওয়া যাতে সোভিয়েত ইউনিয়ন আমেরিকার তুলনায় পিছিয়ে পড়ে। অর্থাৎ পুঁজিবাদের সঙ্গে সমাজতন্ত্রের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে। সেই ধারণা ফলও দিয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন মহাশূন্য গবেষণার কারণে রাজনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়ে। যদিও সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৬৩ সালে ইউরি গ্যাগারিনকে মহাশূন্যে পাঠিয়ে মহাকাশ গবেষণায় গৌরবজনক উদাহরণ সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু সব চেয়ে বড় কথা কেনেডির ধারণা রাজনীতি অদ্ভুত সফলতা পেয়েছিল। পক্ষান্তরে নেতিবাচক ধারণা রাজনীতির উদাহরণ হচ্ছে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের ‘তারকা যুদ্ধে’র ধারণা। এটি ছিল অত্যন্ত বিপর্যয়কর। এর ফল হতে পারত আর একটি বিশ্ব যুদ্ধ। এতে তীব্র অস্ত্র প্রতিযোগিতা সম্ভব্য হতো, যার ফল যুদ্ধে এসে পৌঁছাতো। কিন্তু পৃথিবীর সৌভাগ্য ছিল এ সময় গর্বাচেভ ভেতর থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভাঙছিলেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে অস্ত্রপ্রতিযোগিতায় যাওয়া সম্ভব হয়নি। যাই হোক ইতিবাচক ধারণা রাজনীতি নির্ভর করে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ভিশনের ওপর। আগেই বলেছি, ভিশনারি নেতৃত্ব একদিকে যেমন প্রতিভার বিষয়, তেমনি দুর্লভতার বিষয়। এ রকম নেতৃত্বকালে ভদ্রে আসে। নিত্যই আসে না। সুতরাং এই ব্যতিক্রমের অপেক্ষায় কোনো পদ্ধতি অপেক্ষমান থাকে না। কোনো পদ্ধতি আবিষ্কার ও সৃষ্টির জন্য সাধারণ মাত্রাই বিবেচ্য, ব্যতিক্রম নয়।
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কর্তৃপক্ষ ধারণা রাজনীতির জন্য রূপক অন্বেষণ করে সনাতন উৎস থেকে। যেমন- ভাষা, ধর্ম বা কোনো ধরনের বিশ্বাস অথবা কুসংস্কার থেকে। এসব রূপক সমাজের অনানুষ্ঠানিক শক্তিকে তীব্রভাবে উল্লম্ফিত করার সম্ভাব্যতা বহন করে এবং সংস্কৃতি নেতিমুখী হয়। সংস্কৃতিতে এক ধরনের অধঃপাত অবধারিত হয়। এতে করে সমাজের আলোকায়ন প্রক্রিয়া শুধু বিঘœীত হয় তাই নয়, বরং অর্জিত আলোকায়নে ঘাটতি নিশ্চিত হয়। এ রকম ক্ষেত্রে সব চেয়ে যা ক্ষতিগ্রস্ত হয় তা যুক্তির শুদ্ধতা ও স্বাভাবিকতা; যা শিক্ষা, বিজ্ঞান, প্র্রাতিষ্ঠানিক নীতিমালা, সাংবিধানিকতা ও ন্যায় বিচারের জন্য অনস্বীকার্যভাবে অত্যাবশ্যক। এক কথায় তা প্রকাশ্য অথবা নেপথ্য বা সুপ্ত নৈরাজ্যের দ্বারা সমাজকে আক্রান্ত করে রাখে। এতে করে ঐসব সমাজে কর্তৃপক্ষীয়তা যেমন বাড়ে, তেমনি কমে সামাজিক আলোকায়ন। এর ফল হয় বহুমুখী সাংঘর্ষিকতা যা সমাজ ও রাজনীতিতে বিস্তৃত হয়ে থাকে।
রাষ্ট্র ও সমাজের স্বাধীনতার জন্য সামাজিক আলোকায়নের কোনো বিকল্প নেই। সামাজিক আলোকায়নের পূর্বশর্ত হচ্ছে ধারণা রাজনীতি থেকে সরে আসা অথবা তার গুণগত মানকে সৃজনশীলভাবে বাড়ানো। (উদাহরণ স্বরূপ জনএফ কেনেডির চাঁদ দেখানোর মতো) এক্ষেত্রে এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ উপায় হচ্ছে প্রায়োগিক বাস্তব ঘনিষ্ঠ ও প্রাসঙ্গিক কর্মসূচিভিত্তিক রাজনীতি, যা সমাজ ও জীবনের জন্য বিশ্লেষণযোগ্য স্বপ্নের ও উদ্দীপনার সঞ্চার করতে পারে, যা অদৃশ্য বায়বীয়তায় হারিয়ে যায় না। তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যুক্তি ও বিশ্লেষণকে শানিত করার অবসর তৈরি করা। বিশ্লেষণ ক্ষমতাই হচ্ছে রাষ্ট্র সমাজের স্বাধীনতার পূর্বশর্ত। এখন পর্যন্ত সভ্যতার সবচেয়ে বড় সামাজিক ও রাজনৈতিক অর্জন হচ্ছে সিভিক কালচার, যা উন্নত বিশ্ব অর্জনও করেছে। বর্তমানের মানদ-ে যাকে গণতান্ত্রিক সফলতা বলা যায়, যা পাশ্চাত্যে বিরাজিত তা ওই সিভিক কালচারের কারণেই। তবে এ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার চূড়ান্ত ও যথাযথ গণতান্ত্রিক অর্জন পাশ্চাত্যও এখনো নিজেদের জন্য নিশ্চিত করতে পারেনি। ওদের গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেও এখনো যথেষ্ট ফাঁক-ফোকর আছে। সুতরাং আমাদের গণতান্ত্রিক অনুশীলনের জায়গায় অনুকরণের কোনো অবকাশ নেই। আমাদের গণতন্ত্র আমাদেরই বিশ্লেষণ ও তাত্ত্বিক কাঠামো দিয়ে অর্জন করতে হবে। তাই রাজনৈতিক কৌশল যাতে নিছক তাৎক্ষণিকতা দুষ্ট ও যথেচ্ছাচার না হতে পারে সে ব্যাপারে গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের সচেতন চোখকে জাগ্রত রাখতে হবে।
য় লেখক : প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।