হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
জামালউদ্দিন বারী : ডেমোক্রেট দলীয় বারাক ওবামা দুবারে আট বছর প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর মার্কিন জনগণ পরিবর্তনের পক্ষে রায় দেবে এটা স্বাভাবিক ধারণা হলেও ডোনাল্ড ট্রাম্পের বর্ণবাদী প্রচারণা ও চরমপন্থি রাষ্ট্রচিন্তার কারণে তার জয়লাভের সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ বলে প্রতীয়মান হয়েছিল। সেই সাথে ২০০৮ সালে মার্কিন ইতিহাসের প্রথম আফ্রো-আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে বারাক ওবামা নির্বাচিত হওয়ার পর এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আরেকটি ইতিহাস রচিত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। তা হচ্ছে মার্কিন গণতন্ত্রের আড়াইশ বছরের ইতিহাসে প্রথম কোনো নারীর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা। বিশ লক্ষাধিক ভোট বেশি পাওয়ার পরও হিলারি ক্লিনটনের প্রেসিডেন্ট হতে না পারার রাজনৈতিক বাস্তবতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী ব্যবস্থার দুর্বলতাকেও এবার বিশ্বের সামনে স্পষ্ট করে দিয়েছে। এ বিষয়ে সারা বিশ্বে বিস্তর লেখালেখি-আলোচনা হয়েছে এবং হচ্ছে। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের শত শত শহরে নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে ট্রাম্পবিরোধী বিক্ষোভের উত্তাল জনসমুদ্র ছিল ইতিহাসে নজিরবিহীন। রাজনীতির সাথে সংশ্রব না থাকলেও একজন ব্যবসায়ী ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প অপরিচিত ছিলেন না। তার প্রেসিডেন্সি সম্পর্কে সেখানকার রাজনীতিসচেতন জনগণের মধ্যে অশুভ আশঙ্কা তৈরি হওয়ার কারণে নির্বাচনী ক্যাম্পেইন চলার সময় থেকে নির্বাচিত হওয়া, শপথ গ্রহণের দিন এবং তারপরও অব্যাহতভাবে ট্রাম্পবিরোধী বিক্ষুব্ধ জন¯্রােত দেখা গেছে। ট্রাম্পের বোধ-বুদ্ধি ও বর্ণবাদী রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে সর্বশ্রেণীর মানুষের এমনিতেই একটি পূর্ব ধারণা তৈরি হয়েছিল, তীব্র বর্ণবাদী ও মুসলিমবিদ্বেষী নির্বাচনী মেনিফেস্টো সেই ধারণাকে আরো পরিস্কার করেছে। পক্ষান্তরে ট্রাম্প পপুলার ভোট কম পেলেও নির্বাচনের ফলাফলে বোঝা গেল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় অর্ধেক মানুষ এখনো তাদের ফাউন্ডিং ফাদারদের গণতান্ত্রিক চেতনাকে ধারণ করতে পারেনি। তাদের মধ্যে বর্ণবাদী চিন্তা-চেতনা এখনো ফ্যাসিবাদী জাতীয়তাবাদের কাছাকাছি স্তরেই রয়ে গেছে। ট্রাম্পের দায়িত্ব গ্রহণের পর গত এক মাসের ঘটনা প্রবাহে এটাও প্রমাণিত হয়েছে, যে গণতান্ত্রিক চেতনা এবং বহুত্ববাদী রাজনৈতির-সাংস্কৃতি সমর্থক জনশক্তি তিলে তিলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বের প্রধান রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত করেছিল তারা এখন আর বর্ণান্ধ একদেশদর্শী রাজনীতিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বেসর্বা হয়ে উঠতে দেবে না। এটা ইতিমধ্যে অনেকটা স্পষ্ট হয়ে গেছে। একদিকে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যিনি কিনা ইতিহাস-ঐতিহ্যকে পাশ কাটিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আবারো গ্রেট বানাতে চান! পুঁজির বিশ্বায়ন এবং মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রবক্তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির মূলধারাকে ডিঙিয়ে প্রতিবেশী মেক্সিকো, কৌশলগত বাণিজ্যিক অংশীদার চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি তেলের মূল জোগানদার মধ্যপ্রাচ্যকে সাইডলাইনে রেখে ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ শ্লোগান তুলেছেন। একশ্রেণীর মার্কিনি তার এই পপুলিস্ট স্ট্যান্টবাজির টোপ গিলেছেন, আর বেশির ভাগ মার্কিনি এবং বাকি দুনিয়া ট্রাম্পের শাসনকালে বিশ্বে ভয়াবহ রাজনৈতিক বিপর্যয় সৃষ্টির আশঙ্কা করছেন। সেসব মানুষের অশুভ আশঙ্কা যে অমূলক নয় ডোনাল্ড ট্রাম্প তার প্রমাণ দিতে শুরু করেছেন। মার্কিন সংবিধান সমুন্নত রাখার শপথ গ্রহণের এক মাসের মধ্যেই সংবিধান লঙ্ঘন করে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টিকারী মুসলিম ব্যান বিল পাস করেছেন, সাংবিধানিক নিরাপত্তার সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ায় যা ইতিমধ্যে বিভিন্ন আদালতের দ্বারা বারিত হয়ে গেছে। সাতটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের অভিবাসীদের জন্য ভিসা রুদ্ধ এবং ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ-বিক্ষোভের ঢেউ স্তিমিত হতে না হতেই ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বাধীনতা তথা আরব-ইসরাইল সমস্যার দুইরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান থেকে সরে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে বিশ্বশান্তির সম্ভাবনার মূলে সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত আঘাত হেনেছেন ট্রাম্প।
ফিলিস্তিন সংকট প্রশ্নে গত ৬০ বছর ধরে মার্কিন প্রেসিডেন্টদের নীতি প্রায় অভিন্ন হলেও প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা শেষদিকে এসে সে রীতির কিছুটা ব্যত্যয় সৃষ্টিকারী ভ‚মিকা নিয়েছিলেন। এতে ইহুদি রাষ্ট্রের মোড়লরা বেশ নাখোশ হয়েছিল। মার্কিন কংগ্রেসের স্পিকারের আমন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে বক্তৃতা করার বিরল সুযোগ গ্রহণ করে নেতানিয়াহু ২০১৫ সালে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার জন্য এক ধরনের রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ ছুড়েছিলেন। হোয়াইট হাউসকে পাশ কাটিয়ে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীর কংগ্রেসে প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে বিষোদগারমূলক বক্তৃতাকে ‘ওবামার মুখে নেতানিয়াহুর থুথু’ বলে উল্লেখ করেছিল কোনো কোনো পশ্চিমা গণমাধ্যম। এরপর বিশ্ব রাজনীতিতে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে অনেকগুলো ইতিবাচক ঘটনা ঘটেছে। পূর্ব জেরুজালেমের ওপর ইসরাইলিদের নিয়ন্ত্রণ নিরঙ্কুশ করার উদ্যোগের প্রেক্ষাপটে ইউনেস্কো রায় দিয়েছে পূর্ব জেরুজালেম ও আল আকসা মুসজিদের ওপর ইহুদিদের কোনো ঐতিহাসিক ও আইনগত অধিকার নেই। তার আগে জাতিসংঘে আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনের পতাকা উত্তোলন হয়েছে। সেই সাথে বিশ্বের অন্তত ৮০ ভাগ জনগনের একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে সমর্থন হিসেবে দেড় শতাধিক রাষ্ট্র স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়েছে। সম্প্রতি রোমের ভাটিকান সিটিতেও ফিলিস্তিনের দূতাবাস খোলার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছেন স্বয়ং পোপ ফ্রান্সিস। এহেন বাস্তবতায় একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের বাস্তবতা যখন অপ্রতিরোধ্য, তখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিশ্ব সম্প্রদায়ের ৬ দশকের প্রয়াস-প্রচেষ্টাকে বিপরীত খাতে প্রবাহিত করতে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের লক্ষ্য থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়ার আভাস দিয়েছেন। ইসরাইলের জায়নবাদী নেতারা দীর্ঘদিন ধরে ট্রাম্পের মতো একজন মুসলিমবিদ্বেষী মার্কিন প্রেসিডেন্টের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প-নেতানিয়াহু যৌথ সংবাদ সম্মেলনে সেই জায়নবাদীদের জন্য সেই মাহেন্দ্রক্ষণটি যেন ধরা দেয়। অবশ্য ইসরাইল-আমেরিকা সম্পর্ক মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বে ইসরাইল নামক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার পর থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্টরা ইসরাইলকে যুক্তরাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য বন্ধু, এ সম্পর্ক চিরপ্রত্যাশিত, শর্তহীন ও অভঙ্গুর (আনব্রেকেবল) ইত্যাদি বলে অভিহিত করেছেন বার বার। ট্রাম্পের সাথে নেতানিয়াহুর প্রথম সাক্ষাৎ ও যৌথ সংবাদ সম্মেলনে সেই পুরনো বন্ধুত্বের গৎবাঁধা কথাগুলোর পুনরাবৃত্তি শোনা গেলে আগের চেয়ে অনেক বেশি দৃঢ় ও স্বতঃস্ফ‚র্ততায়। সেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্প যেন নেতানিয়াহুকে খুশি করতে বেশি ব্যাস্ত। তিনি তা-ই বলেছেন, যা নেতানিয়াহু এবং জায়নবাদী ইসরাইলিরা শুনতে চায়। সেখানে মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় পঁচিশটি দেশের প্রায় অর্ধশত কোটি মানুষকেই শুধু নয়, বিশ্বের দেড়শ কোটি মুসলমান এবং অবশিষ্ট দুনিয়ার শান্তিকামী মানুষকেই যেন কটাক্ষ করা হয়েছে। যৌথ ঘোষণায় নেতানিয়াহু এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প একই সুরে বলেছেন, তারা দুই বন্ধু একটি কমন শত্রুর সাথে লড়াই করছেন, যাদের কোনো মানবিক মূল্যবোধ নেই। তবে সারা বিশ্ব এখন জানে, কারা দশকের পর দশক ধরে কোটি কোটি মানুষের বেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকারকে পদদলিত করে বার বার শান্তিকামী মানুষের ওপর বর্বর সামরিক আগ্রাসন চালাচ্ছে। অন্যের ভ‚মি দখল করে অবৈধ রাষ্ট্র গঠন করে বিশ্বশান্তির ওপর বিষফোঁড়া হয়ে বার বার মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করছে। এখন একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনে বিশ্বের শত শত কোটি মানুষের প্রয়াস ও প্রত্যাশাকে অস্ত্রের বলে দমন করে ইহুদিদের গ্রেটার ইসরাইলের স্বপ্ন বাস্তবায়নের দায়িত্ব গ্রহণ করতে চাইছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
বংশানুক্রমিকভাবে হাজার বছর ধরে বসবাসরত ফিলিস্তিনি আরবদের হত্যা করে, উচ্ছেদ করে, বুলডোজার দিয়ে সবকিছু মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে লাখ লাখ ফিলিস্তিনিকে উদ্বাস্তু করে অস্ত্রের বলে যে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে আরবদের তা মেনে না নেয়া কি স্বাভাবিক নয়? তিন হাজার বছর আগে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের বসবাস ছিল। রোমান ও খ্রিস্টানদের সাথে দ্ব›েদ্ব তারা ফিলিস্তিন ছেড়ে ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ইসলামের আবির্ভাবের সময় বহু ইহুদি ইসলাম গ্রহণের পরও সামান্য কয়েক শতাংশ খ্রিস্টান ও ইহুদি জনগোষ্ঠী আরবদের সাথে মিলেমিশে বসবাস করত। ফিলিস্তিনি কবি-সাহিত্যিকদের রচনায় সে সময়ের নস্টালজিক স্মৃতিগুলো ফুটে উঠেছে। আন্তর্জাতিকভাবে প্রখ্যাত-পুরস্কৃত ফিলিস্তিনি কবি মাহমুদ দারবিশ ১৯৪২ সালে ফিলিস্তিনের আক্রে অঞ্চলের বিরওয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। দারবিশের ৬ বছর বয়সে সংঘবদ্ধ ইহুদি সন্ত্রাসী বাহিনীর আক্রমণে প্রাণ বাঁচাতে ১৯৪৮ সালে তার পরিবারকে বাড়ি ছেড়ে লেবাননে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। এরপর শিক্ষা ও সাংবাদিকতার কাজে ইউরোপ ও আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন। ২০০৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের হিউস্টনে মৃত্যুবরণ করার আগ পর্যন্ত সেখানেই বসবাস করছিলেন। দারবিশের সারা জীবনের লেখালেখি ও সাহিত্যচর্চার প্রতিপাদ্য ছিল মাত্র ৬ বছরের ফিলিস্তিনের স্মৃতি এবং তার জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার। গত হাজার বছরের ফিলিস্তিনি-আরব ইতিহাসে ইহুদিদের সাথে মুসলমানদের যুদ্ধের কোনো ঘটনা নেই বললেই চলে। প্রায় ২০০ বছরব্যাপী ক্রুসেডের ইতিহাস মুসলমানদের সাথে খ্রিস্টানদের যুদ্ধের কাহিনী। ত্রয়োদশ শতকে মুসলমানদের হাতে জেরুজালেমের পতনের পর ৭০০ বছর ধরে খ্রিস্টান এবং আরবরা পাশাপাশি শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করেছিল। ফিলিস্তিনে বৃটিশ ম্যান্ডেট প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ১৯২২ এবং ১৯৩১ সালের আদম শুমারিতে দেখা যায়, মাহমুদ দারবিশের জন্মস্থান আল-বিরওয়া গ্রামের মোট লোকসংখ্যা ১৯২২ সালে ছিল ৮০৭ জন, এর মধ্যে ৭৩৫ জন মুসলমান এবং ৭২ জন খ্রিস্টান। প্রায় এক দশক পর ১৯৩১ সালে গ্রামের জনসংখ্যা হয় ৯৯৬ জন, এর মধ্যে ৮৮৪ জন মুসলমান এবং ৯২ জন খ্রিস্টান। প্রায় এক হাজার মুসলমান ও খ্রিস্টান ২২৪টি বাড়িতে বসবাস করত। আদম শুমারি রিপোর্টে খ্রিস্টান জনসংখ্যার মধ্যে বেশির ভাগ অর্থডক্স এবং সামান্য কিছু সংখ্যক অ্যাঙলিকান খ্রিস্টানের কথা উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রথম মহাযুদ্ধের সময়ের এক জরিপে পুরো ফিলিস্তিন ভূ-খন্ডের ডেমোগ্রাফিক চিত্রটি ছিল ৬,৫৭,০০০ মুসলমান, ৮১ হাজার খ্রিস্টান এবং ৫৯ হাজার ইহুদি। অর্থাৎ বালফোর ডিক্লারেশনের সময় ফিলিস্তিনে ইহুদিরা ছিল থার্ড মাইনরিটি, তাদের শতকরা হার ছিল প্রায় ৮ ভাগ। ইসরাইল প্রতিষ্ঠার সময় এই আটভাগের সাথে রাশিয়া, জার্মানি থেকে বিতাড়িত ইহুদিদের ফিলিস্তিনে জড়ো করার পরও আরব জনসংখ্যার অর্ধেকও হয়নি। ইঙ্গ-মার্কিন অর্থ, অস্ত্র ও ট্রেনিং নিয়ে সশস্ত্র বহিরাগত ইহুদিরা ফিলিস্তিনের শতকরা ৭৭ ভাগ ভ‚মি দখল করে নেয়। অবশিষ্ট ২৩ ভাগ ফিলিস্তিনি ভ‚মির ওপর সর্বদা ইসরাইলিদের শ্যেনদৃষ্টি বিদ্যমান। তারা গাজার ওপর দশক ধরে অবরোধ আরোপ করে রেখেছে। জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক কনভেনশন অমান্য করে তারা পশ্চিম তীরের দখলিকৃত এলাকায় হাজার হাজার নতুন ইহুদি বসতি গড়ে তুলেছে এবং আরো হাজার হাজার বাড়ি নির্মাণের পরিকল্পনা করছে। ফিলিস্তিনিরা পাথর ছুড়ে এসব অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে আইডিএফ (ইসরাইলি ডিফেন্স ফোর্স) তাদের গুলি করে হত্যা করছে। নামে ডিফেন্স ফোর্স হলেও এরাই বিশ্বের সবচেয়ে বড় আগ্রাসী-মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী বাহিনী। পাথর ও গুলতি ছেড়ে হামাস-হিজবুল্লাহর মতো প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে ওঠার পর এসব সংগঠনকে ইসরাইল ও পশ্চিমারা সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যা দিচ্ছে। দশকের পর দশক ধরে অবরুদ্ধ থাকা, ইসরাইলি বাহিনীর টার্গেটেড কিলিংয়ের শিকার হামাসের কাছে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী আইডিএফ ইতিমধ্যে একাধিকবার পরাজিত হয়েছে। ইসরাইলের যুদ্ধবাজ প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এবার ডোনাল্ড ট্রাম্পের সহায়তায় ফিলিস্তিনি আরবদের প্রতিরোধ সংগ্রাম চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামতে চাইছে। পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে সাতষট্টি সালের আগের সীমারেখা অনুসারে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বপ্ন বাস্তবায়ন ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ যোদ্ধাদের মূূল লক্ষ্য। অন্যদিকে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করাই ট্রাম্প-বিবি’র মূল লক্ষ্য।
মধ্যপ্রাচ্যে ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রের নিয়ামক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকে দাবিয়ে রাখা। ছয় দশক ধরে ফিলিস্তিনি জনগণকে দাবিয়ে রাখার নীলনকশার সাম্রাজ্যবাদী অপরাজনীতি চলছে। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার প্রতি বিশ্বের সব মুসলমানের আবেগ ও সংবেদনশীলতা রয়েছে, এ কারণে মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম দেশগুলোতে নানা রকম অস্থিরতা, বিভাজন ও সংঘাতপূর্ণ অবস্থা সৃষ্টি করে দেশগুলোকে নানাভাবে দুর্বল ও অস্থিতিশীল করে রাখা হচ্ছে। এ লক্ষ্য অর্জনে পশ্চিমা মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের যুদ্ধবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পাশাপাশি তারা একটি সম্মিলিত প্রপাগান্ডা ও ইসলামোফোবিয়া ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তুলেছে। তবে পশ্চিমা পাওয়ার এলিটদের এই রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দূরভিসন্ধি ইতিমধ্যে বিশ্বের কাছে অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে গেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প ইসরাইলের টিকে থাকার সংগ্রাম এবং কথিত জেনোসাইড ও অত্যাচার থেকে ইহুদি জনগোষ্ঠীর টিকে থাকার যে লড়াইয়ের কথা বলা হয়েছে, সেখানে মুসলমানের কোনো হাত নেই। তবে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের পথ রুদ্ধ হয়ে গেলে ফিলিস্তিনিরা তাদের হারানো ভ‚মি পুনরুদ্ধারে সম্ভাব্য সব ধরনের শক্তি ও তৎপরতা শুরু করবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ইঙ্গ-মার্কিনিরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের নাৎসি বাহিনীর হাতে নির্যাতিত, ইউরোপ থেকে বিতাড়িত ইহুদিদের ফিলিস্তিনিদের ভ‚মিতে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে পুনর্বাসিত করে আরব-ইসরাইল সংকট সৃষ্টি করলেও এর সমাধানের কোনো উদ্যোগই তারা গ্রহণ করেনি। গত দুই দশকে ইঙ্গ-মার্কিনিদের একের পর এক মিথ্যা অপপ্রচার এবং তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, রিজাইম চেঞ্জের গৃহযুদ্ধ ইত্যাদি কারণে কয়েক কোটি মুসলমান উদ্বাস্তু হয়েছে। কয়েক মিলিয়ন মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে। এই সংখ্যা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে নির্যাতিত ও নিহত ইহুদির সংখ্যার চেয়ে ১০ গুণ বেশি। ফিলিস্তিন সমস্যার স্থায়ী সমাধানের উদ্যোগে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের সম্ভাবনা যদি ট্রাম্প-বিবি’রা ভন্ডুল করে দেন, তাহলে একমাত্র বিকল্প থাকে একরাষ্ট্রের সমাধান। যেহেতু পশ্চিমাদের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধে ইউরোপের দেশগুলোতে এবং আমেরিকায় লাখ লাখ মুসলমান শরণার্থী ভিড় জমিয়েছে। দেশগুলো তাদের আশ্রয় দিতে চাইছে না, নতুন নতুন নিষেধাজ্ঞা ও আইনগত জটিলতা সৃষ্টি করছে। যেহেতু ষাট বছরেও ইসরাইলিরা তার আরব প্রতিবেশীদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশ বা আস্থা অর্জন করতে পারেনি। উপরন্তু তারা বার বার যুদ্ধাপরাধ ও ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে। যেহেতু বিশ্বের সর্বাধুনিক সেনাবাহিনী এবং পারমাণবিক সমরাস্ত্রের মজুদ গড়ে তোলার পরও ইসরাইলিরা কখনো নিজেদের নিরাপদ বোধ করতে পারছে না। এমনকি হেজবুল্লাহ হামাসের মতো আঞ্চলিক মিলিশিয়া বাহিনীর সাথে শক্তিশালী ইসরাইলি বাহিনী স্থলযুদ্ধে হেরে গেছে। অন্যদিকে দেড় দশক ধরে যুদ্ধ করেও মধ্যপ্রাচ্যে সন্ত্রাস নির্মূল করে সামরিক বা রাজনৈতিক বিজয় লাভে পশ্চিমা দেশগুলো ব্যর্থ হয়েছে। পক্ষান্তরে পশ্চিমাদের সব ষড়যন্ত্র ও নিয়ন্ত্রণ অগ্রাহ্য করেই রাশিয়া, চীন, ইরান অব্যাহতভাবে মধ্যপ্রাচ্যের মূল নিয়ন্ত্রকের ভ‚মিকায় চলে আসছে। এসব বিবেচনাকে সামনে রেখে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে চলমান যুদ্ধে কয়েক কোটি উদ্বাস্তু আরব মুসলমানের পুনর্বাসনের জন্য ১৯৪৮ সালে আরব মুসলমানদের বিতাড়িত করে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার অনুরূপ বহিরাগত ইহুদিদের বিতাড়িত করে সেখানে আবার বৃহত্তর ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন করা হয়? যদি দুই রাষ্ট্রের সমাধান সম্ভব না হয়, তবে এটিই কি আরব, মধ্যপ্রাচ্য ও ফিলিস্তিনের জন্য একমাত্র বিকল্প নয়? মধ্যপ্রাচ্য এবং পশ্চিমা দুনিয়ায় সৃষ্ট সহিংসতা, নাশকতা এবং আইএসের মতো সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই, পুঁজিবাদ এবং সামাজিক বিচারহীনতাই এই সন্ত্রাসের মূল উৎস- এমন মন্তব্য করেছেন ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের পোপ। অন্যদিকে মিউনিখের নিরাপত্তা সম্মেলনে জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মারকেলও বলেছেন, ইসলাম সন্ত্রাসবাদের উৎস নয়, তিনি আইএসের মতো সন্ত্রাসবাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় জাতিসংঘ এবং ন্যাটোর মতো সংস্থার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরার পাশাপাশি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান দেশগুলোকে সহযোগিতা করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। মারকেল বুঝতে পেরেছেন, প্রপাগান্ডা ও যুদ্ধের বিভীষিকা ছড়িয়ে মুসলমানদের অগ্রযাত্রা রুদ্ধ করা সম্ভব নয়। ট্রাম্প-নেতানিয়াহুর মধ্যে এই উপলব্ধি জাগ্রত না হলে চ‚ড়ান্ত যুদ্ধে পশ্চিমা পুঁজিবাদ এবং জায়নবাদী রাষ্ট্রের পতনের মধ্য দিয়েই রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদের চিরঅবসান হতে পারে। পোপের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে আবারো বলতে হয়, বিশ্বে খ্রিস্টান সন্ত্রাসবাদ নেই, ইহুদি সন্ত্রাসবাদ নেই এবং মুসলমান সন্ত্রাসবাদও নেই। পুঁজিবাদী বৈষম্য এবং তাদের অন্যায় যুদ্ধ ও সামাজিক-রাজনৈতিক বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকেই এই অশান্তি ও নিরাপত্তাহীনতার সৃষ্টি। শান্তি ও সহাবস্থানের পথ ওখান থেকেই শুরু করতে হবে।
bari [email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।