হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
আফতাব চৌধুরী : বই পড়া যে শিক্ষিত মানুষের একটা বৈশিষ্ট্য সে বিষয়ে দেশে-বিদেশে কারোরই দ্বিমত থাকার কথা নয়। একালে অনেক বড় লোকের বাড়িতে তাকে সুন্দর করে বই সাজিয়ে রাখাকে অনেকে কটাক্ষ করেন কিন্তু বাড়িতে বই রাখা যদি ফ্যাশন হয় তবে সেই ফ্যাশনকেও আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে মেনে নেব। আজকের পৃথিবীতে এ কথা সবাই জেনে গেছে, যে জাতি যত বেশি বই পড়ে সে জাতি তত বেশি শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান হয়। এ কথা তো জানা যে, সাহিত্যচর্চা এক নির্মল আনন্দ। ব্যাপক অর্থে বলা যায়, সাহিত্যচর্চা না করলে মানুষ আনন্দ থেকে বঞ্চিত থাকে। তার ভিতরকার সুকুমার বৃত্তিগুলো বিকশিত হতে পারে না। মানবিকতার প্রতি টান রুদ্ধ হয়ে যায়।
বই পড়ার জন্য পৃথিবীর সব দেশেই লাইব্রেরি গড়ে ওঠে। পাড়ায় পাড়ায় যেমন লাইব্রেরি থাকে তেমনি বৃটিশ মিউজিয়াম বা আমাদের ন্যাশনাল লাইব্রেরি, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ গ্রন্থাগার কিংবা এশিয়াটিক সোসাইটির লাইব্রেরির মতো বৃহৎ লাইব্রেরি এবং গবেষণাগার সরকারি-বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় গড়ে ওঠা আধুনিক সভ্য সমাজে একটা বিশাল দপ্তর হয়ে উঠেছে। ব্যক্তিগতভাবে বই কিনে নিজের মতো লাইব্রেরি গড়ে তোলা অনেকেরই শখ। অধ্যাপক আবুল ফজল এই লাইব্রেরিকেই ‘মনের হাসপাতাল’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি আরো বলেছেন, এর স্থান স্কুলের অনেক উপরে। এ কথা সহজে জানা, পাস হওয়া মানে শিক্ষিত হওয়া নয়। সুশিক্ষিত মানেই স্বশিক্ষিত। মনকে সতেজ রাখে সাহিত্য পাঠ, স্বাভাবিকভাবেই নতুন প্রজন্মকে গ্রন্থাগারমুখী করে তোলা দেশের সুস্থ নাগরিকদের সামাজিক কর্তব্য। আমরা একালে বড়রা এ কাজটা সঠিকভাবে করতে পারি না বলেই আমাদের বংশধররা ক্রমান্বয়ে গ্রন্থবিমুখ হয়ে পড়েছে। অনেকে বলবেন, এ জন্য টেলিভিশনের একটা নিরর্থক ভূমিকা আছে। কথাটা পুরো সত্য নয়। কোনো শিশুকে শৈশব থেকে গ্রন্থমুখী করে তুললে কোনো ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাধ্য নেই যে তাকে গ্রন্থবিমুখ করে তোলে। ইউরোপে দেখেছি দুই-তিন বছর বয়সের শিশু নার্সারি স্কুলে যায়। সেখানে খেলার ছলে বর্ণ পরিচয় ও শব্দ ভান্ডার বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তাদের হাতে তুলে দেয়া হয় রং আর তুলি। ইচ্ছা মতো তারা রং আর তুলি নিয়ে চুবিয়ে চুবিয়ে তার কল্পনার বর্ণময় রূপগুলো কাগজে তুলে ধরতে থাকে। সপ্তাহে দুই দিন তাদের একটা করে বই বাড়িতে আনতে দেওয়া হয়। এভাবে বুক সেলফ থেকে বই নিতে নিতে এমন একটা অভ্যাস তৈরি হয় যে, আগে নেওয়া কোনো বই শিশু কখনো বাড়ি নিয়ে যায় না। যে শিশুর বর্ণ পরিচয় হয়নি সে বই বাড়িতে নিয়ে গিয়ে কী করবে, এ কথা মনে হওয়া স্বাভাবিক কিন্তু ভাবলেই বোঝা যাবে সপ্তাহে দুবার করে বাড়িতে বই নিয়ে যাওয়া একটা অভ্যাস তৈরি করে দেয়। শিশু বাড়িতে ছবি দেওয়া গল্পের বইগুলো বাবা-মাকে দিয়ে পড়িয়ে গল্পরস আস্বাদ করে থাকে। পড়তে শিখলে আগ্রহে নিজেই বই পড়তে থাকে। এই পঠন অভ্যাস দ্বারাই একটা জাতি তৈরি হয় ধীরে ধীরে।
আমাদের শৈশব-কৈশোর বয়সে বই পড়া নিয়ে আমরা যেসব কান্ড করতাম সে কথা জানলে একালের অভিভাবকরা আর্তনাদ করবেন। আমরা জ্যামিতির বইর নিচে ‘বিদুষীভার্ষা’ লুকিয়ে চিৎকার করে জ্যামিতি মুখস্থ করার ছলে উপন্যাসটি শেষ করার চেষ্টা করতাম। কারণ পরের দিন সকালে সে বই ফেরত দিতে হবে। আমাদের কলেজ জীবনে প্রথম ক্লাসেই আমাদের জিজ্ঞেস করা হতো- আমরা কী বই পড়েছি। কেউ বলত রাজসিংহ, কেউ গোরা, কোনো কোনো ছেলে যখন বলে উঠত সে উদ্ধারণপুরের ঘাট বা নজরুলের বিষের বাঁশী-পড়েছে তখন খুশিতে উদ্বেল হয়ে উঠতেন অধ্যাপক। আমরা এখন যখন ছেলেমেয়েদের অনার্স ক্লাসে কী বই পড়ছে জিজ্ঞেস করি তখন প্রায় সবাই ফ্যালফ্যাল করে নির্বাক তাকিয়ে থাকে। জানা যায়, সময় নষ্ট হবে ভেবে জীবনে একটা গল্পের বইও পড়েনি। এই দোষটা ছাত্রছাত্রীদের শুধু নয়, শিক্ষকদের এবং কিছুটা বাবা-মায়ের। আমরা তাদের শৈশব থেকে বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করে দেইনি।
আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা উল্টোভাবে চলে। ইংরেজ এ অঞ্চল ছেড়ে চলে গেছে পঁয়ষট্টি বছর হলো কিন্তু ক্রমান্বয়ে ইংরেজিয়ানা আমাদের চেপে ধরেছে। এখন তো ইংরেজি না শিখলে উচ্চ সমাজে মেলামেশা করা যায় না। ঔপনিবেশিক শিক্ষার একেবারে খারাপ একটা অবস্থার মধ্য দিয়ে আমাদের জাতি চলছে এখনও। এর মধ্যেই কী বিপুল উদ্দীপনায় গ্রামে, গঞ্জে, শহরে প্রচুর বইমেলা হচ্ছে। শহরে আন্তর্জাতিক বইমেলায় ছোটখাটো স্টলে যে পাঠকরা আসেন তারা সাহিত্যে নিবেদিত পাঠক দূর গ্রাম-গঞ্জ থেকে আসেন। তারা কিন্তু পাশের ছোটো বড় ইংরেজি বইয়ের স্টলগুলোতে ভিড় করে। আমাদের বাঙালি ঘরের ছেলেমেয়ে অথচ ভাষা হিসেবে বরণ করে নিয়েছে ইংরেজিকে। দেশের উজ্জ্বল ছেলেমেয়েরা যদি এভাবে বাংলা সাহিত্যের বাইরে চলে যায় তাহলে একটা জাতির সাহিত্য বেড়ে ওঠা ভবিষ্যতে খুবই কষ্টকর হবে তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। শিশুদের বই কেনার একটা ধুম চলে এসব মেলায় কিন্তু পিতা-মাতারা কিনেন নানা কমিক্স আর ছবিতে গল্প জাতীয় কাহিনীর চিত্রিত বই। শিশুর কল্পনা শক্তি বাড়ে রূপকথা, অ্যাডভেঞ্চার ভ্রমণ জাতীয় বইতে। আমাদের কর্তব্য হচ্ছে এ জাতীয় বইতে তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে তাদের আগ্রহ তৈরি করে তোলা। তার ফল হবে এই যে, ধীরে ধীরে তারা সাহিত্য পাঠ করে এমন এক আনন্দের সংকেত পেয়ে যাবে যে কখনই আর বই না পড়ে থাকতে পারবে না।
প্রয়োজনের তাগিদে ইংরেজি ভাষা শেখা দোষের কিছু নয় কিন্তু ইংরেজি শেখার অর্থ নিজের মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করা বা বর্জন করা নয়। নিজের ভাষার প্রতি যার ভালোবাসা নেই তাকে কখনই ভালো নাগরিক বলা যায় না। ভাষার প্রতি ভালোবাসা থেকে জন্ম নেয় নিজের মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা। আজ আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা বিদেশে পড়তে গিয়ে, চাকরি করতে গিয়ে আর দেশে ফিরতে চায় না সে তো শুধু অর্থের লোভ নয়, দেশের প্রতি ভালোবাসার কোনো টান থাকে না বলেই এমনটা হতে পারে। আশ্চর্য এই যে, দেশে বাবা-মা পড়ে রয়েছে সেই মাতৃভূমির প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা এই ভালো ছেলেমেয়েরা কখনই অনুভব করে না। সাহিত্য যে ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি করে তা থেকে বঞ্চিত হওয়ার ফলেই এমনতর ঘটনা আজ ঘরে ঘরে ঘটে যাচ্ছে। বই পড়াকে যদি শখ হিসেবেও দেখা হয় তবে বলতে হবে, সেটা মনুষ্য জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ শখ। বই পড়ে ইহলৌকিক নানা জাতীয় লাভের আশা করা দুরাশা। এমনকি বই পড়লেই মানুষ নীতিবাদী হয়ে একটা সমাজকে রক্ষা করবে এমনও নয়। কিন্তু বইপড়া থেকে যে সংস্কৃতি তৈরি হয় সেটা মানুষকে রুচিবান করে তোলে। এই রুচিশীলতা মানব জীবনের অন্যতম কৃত্য। এই রুচির অভাবের জন্যই আমরা এত অসহিষ্ণু হয়ে পথে-ঘাটে, পার্লামেন্টে যে কান্ড করি তা শুধু হাস্যকরই নয়, রুচিহীন বলেই তা একটা জাতির জীবনে গভীর সংকট সৃষ্টি করে। বই পড়ায় অভ্যস্ত হলে একজন মানুষ যে আনন্দের আস্বাদ পাবে তা তার মনকে শুধু সজীব করে রাখবে, তা নয় ভালোবাসতে শেখাবে প্রকৃতিকে, মানুষকে, তার নিজের কল্পনা শক্তি ক্রমাগত বাড়তে থাকবে। ফলত জগৎকে নিয়ে, জীবনকে নিয়ে নতুন সৃষ্টিময় জগৎ তৈরি করতে উৎসাহিত হবে সেই পাঠক। এভাবে একটা জাতির জীবনে বইপড়া সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে উঠলে সেই জাতি শুধু সহনশীল রুচিশীল হয়ে উঠবে তা-ই নয়, পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তুলতে যথাসাধ্য চেষ্টা করবে।
বইপড়া জ্ঞানচর্চার সহায়ক, বিশ্বজগতের নানা আবিষ্কার, মানুষের উদ্ভব ও ক্রমবিবর্তনের রোমাঞ্চকর কাহিনী যে কোনো পাঠককে মানব প্রজাতি সম্পর্কে আগ্রহী করে তার সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক স্থাপনে তাকে তুলবে রুচিশীল এক বিশিষ্ট নাগরিক রূপে। এভাবে বইপড়া শুধু একজন পাঠককে জ্ঞানী বা প্রাজ্ঞ করে তুলবে না, তার সাহিত্য পাঠের আনন্দ এমন এক জগতের সঙ্গে পরিচিত করবে, যে জগৎটি সারা বিশ্বের রুচিশীল মানুষের ভালোবাসায় পরিপূর্ণ। একজন রুচিশীল নাগরিক হিসেবে আমাদের সামাজিক দায়িত্ব নতুন প্রজন্মের মধ্যে বইপড়ার আকর্ষণ তৈরির সমস্ত সুযোগ সৃষ্টি করে রাখা। এটা শুধু মুখের ভাষাতে হবে না, নিজেদের তা করে দেখাতে হবে। আর তখনই আমরা আমাদেরকে একটা সুস্থ সবল জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে পারব।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।