Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

একুশের বইমেলা এবং সৃজনশীল পুস্তক প্রকাশনা শিল্পের সঙ্কট

উপ-সম্পদকীয়

| প্রকাশের সময় : ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মেহেদী হাসান পলাশ : একুশের বইমেলা, দাপ্তরিক নামে অমর একুশের গ্রন্থ মেলা। বইমেলা মানে বইয়ের মেলা, প্রকাশকের মেলা, পাঠকের মেলা, দর্শকের মেলা, ক্রেতার মেলা। একুশের বইমেলা বাঙালির প্রাণের মেলা, জ্ঞানের মেলা, মেধা ও মননের মেলা। কয়েক বছর আগেও জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের উদ্যোগে ডিসেম্বর মাসে একটি বইমেলা অনুষ্ঠিত হতো। অজ্ঞাত কারণে তা বন্ধ হয়ে গেছে। সেকারণে লেখক, প্রকাশক ও পাঠক সারা বছর এই একটি মাসের জন্য, এই মেলার জন্য অপেক্ষা করে থাকে। প্রতি বছরের মতো এ বছরও পহেলা ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শুরু হয়েছে অমর একুশের গ্রন্থ মেলা। শুরুতে বইমেলা বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণেই অনুষ্ঠিত হতো। ধীরে ধীরে এর পরিসর বাড়তে শুরু করলে দোয়েল চত্বর থেকে টিএসসি পর্যন্ত মূল রাস্তার দুই পাশে বইমেলা প্রসারিত হয়। পাঠক, দর্শক ও চলাচলের সুবিধার্থে রাস্তা মুক্ত করার উদ্যোগ নেয়া হলে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে সঙ্কুলান না হওয়ায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সরিয়ে নেয়া হয়। গত ৪/৫ বছর ধরে বইমেলা দুইভাগে বিভক্ত হয়ে বাঙলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বসছে। গত দুই বছরের মতো এবারও বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে মূলত সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, এনজিও, মিডিয়া ও শাসক দলের বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নামে স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আর মূল ধারার প্রকাশক বা বাংলাদেশ সৃজনশীল পুস্তক প্রকাশকদের স্টলগুলো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্থান পেয়েছে। সে হিসাবে মূল বইমেলা বসছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই।
একুশের বইমেলা যদিও জাতীয় বইমেলা কিন্তু নানা বিচারে এটি যেকোনো আন্তর্জাতিক বইমেলার সাথে পাল্লা দেবার সমকক্ষতা রাখে। বইমেলা নানা নামে সারা বিশ্বেই হয়ে থাকে। এর রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। জ্ঞানের বাহন হিসেবে বই বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন মাধ্যম। জ্ঞানের প্রসারে বইয়ের প্রয়োজনীয়তা প্রাচীনকাল থেকেই অনুভূত ছিল। তবে মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের আগে বইয়ের বিস্তার তেমনভাবে ঘটেনি। হাতে লেখা বইয়ের প্রচার কষ্টসাধ্য ছিল। পঞ্চদশ শতকে জার্মানির গুটেনবার্গ মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কার করলে বইয়ের জগতে বিপ্লব সাধিত হয়। গুটেনবার্গ নিজের আবিষ্কৃত ছাপাখানায় ছাপা বই বিক্রির জন্য ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরে নিয়ে আসতেন। তার দেখাদেখি স্থানীয় অন্যান্য বই বিক্রেতাও তাদের প্রকাশিত বই নিয়ে সেখানে বসতে শুরু করেন। সে সকল বই কিনতে বিভিন্ন শহর থেকে ক্রেতারাও আসতে শুরু করে। আর এভাবেই বিশ্বে বইমেলার প্রচলন হয়। এভাবেই বিশ্বের প্রাচীন বইমেলা শুরু হয় জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরে। রেনেসাঁ ও শিল্প বিপবের হাত ধরে জার্মানির দেখাদেখি ইউরোপের অন্যান্য শহরেও বইমেলার প্রচলন হয়। ১৮০২ সালে ম্যাথু কেরির উদ্যোগে প্রথম বইমেলা বসে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে। ১৮৭৫ সালে প্রায় ১০০ জন প্রকাশক মিলে নিউইয়র্কের ক্লিনটন শহরে আয়োজন করে বৃহৎ এক বইমেলার।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৯ সালে জার্মানির পুস্তক প্রকাশক সমিতি ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরে আনুষ্ঠানিক বইমেলার প্রচলন করে। এ মেলা এখন বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন বইমেলা। বিশ্বে শতাধিক দেশ থেকে ২০ হাজারেরও বেশি প্রতিষ্ঠান এ মেলায় অংশ নিয়ে থাকে। ফ্রাঙ্কফুর্টের পর লন্ডন বুক ফেয়ার বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয়। এই মেলাটি মূলত প্রকাশকদের মেলা, পাঠকরা এখানে ততোটা গুরুত্ব পায় না। প্রকাশিতব্য বইয়ের প্রচারের জন্য, অন্য প্রকাশক থেকে বইয়ের স্বত্ব অথবা বইয়ের অনুবাদ স্বত্ব কেনাবেচার জন্য প্রকাশকরা এ মেলায় অংশ নেয়। ১৯৬৯ সালে আরব বিশ্বের সবচাইতে বড় মেলা অনুষ্ঠিত হয় মিশরের রাজধানী কারয়োতে। কাতারের দোহা ও ইরানের রাজধানী তেহরানেও বড়সড় বইমেলা হয়। ১৯৭৭ সালে শুরু হওয়া মস্কো ইন্টারন্যাশনাল বুক ফেয়ার বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বইমেলা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এশিয়ান দেশগুলোর মধ্যে বৃহত্তম বইমেলা কোলকাতা বইমেলা শুরু হয় ১৯৭৬ সালে। অনেকের মতে, এটি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম বইমেলা। ২০১৩ সালে কলকাতা বইমেলায় বাংলদেশ ছিল থিম কান্ট্রি। বাংলাদেশে বইমেলার ইতিহাস কোলকাতার থেকে প্রাচীন।
পাকিস্তান আমলে বাংলাভাষা ও সাহিত্যের প্রসারে ১৯৫৫ সালে বাংলা একাডেমির প্রতিষ্ঠা হয়। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান তার এক লেখায় বলেছেন, বইমেলার চিন্তাটি এ দেশে প্রথমে মাথায় আসে প্রয়াত কথাসাহিত্যিক জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সাবেক পরিচালক সরদার জয়েনউদদীনের। তিনি বাংলা একাডেমিতেও একসময় চাকরি করেছেন। বাংলা একাডেমি থেকে ষাটের দশকের প্রথম দিকে তিনি গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক পদে নিয়োগ পান। তিনি যখন বাংলা একাডেমিতে ছিলেন, তখন বাংলা একাডেমি প্রচুর বিদেশি বই সংগ্রহ করত। এর মধ্যে একটি বই ছিল
Wonderful World of Books. . এই বইটি পড়তে গিয়ে তিনি হঠাৎ দুটি শব্দ দেখে পুলকিত বোধ করেন। শব্দ দুটি হলো : ‘ Book ’ এবং ‘ Fair’. কত কিছুর মেলা হয়। কিন্তু বইয়েরও যে মেলা হতে পারে এবং বইয়ের প্রচার-প্রসারের কাজে এই বইমেলা কতটা প্রয়োজনীয়, সেটি তিনি এই বই পড়েই বুঝতে পারেন। বইটি পড়ার কিছু পরেই তিনি ইউনেসকোর শিশু-কিশোর গ্রন্থমালা উন্নয়নের একটি প্রকল্পে কাজ করছিলেন। কাজটি শেষ হওয়ার পর তিনি ভাবছিলেন বিষয়গুলো নিয়ে একটি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করবেন। তখন তার মাথায় আসে, আরে প্রদর্শনী কেন? এগুলো নিয়ে তো একটি শিশু গ্রন্থমেলাই করা যায়। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। তিনি একটি শিশু গ্রন্থমেলার ব্যবস্থাই করে ফেললেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরির (বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি) নিচতলায়। যত দূর জানা যায়, এটাই ছিল বাংলাদেশের প্রথম বইমেলা। এটি অনুষ্ঠিত হয় ১৯৬৫ সালে।
শিশু গ্রন্থমেলা করে সরদার জয়েনউদদীন পুরোপুরি তৃপ্ত হতে পারেননি। আরও বড় আয়োজনে গ্রন্থমেলা করার তিনি সুযোগ খুঁজতে থাকেন। সুযোগটি পেয়েও যান। ১৯৭০ সালে নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সহযোগিতায় নারায়ণগঞ্জে একটি গ্রন্থমেলার আয়োজন করা হয়। এই মেলায় আলোচনা সভারও ব্যবস্থা ছিল। সে সব আলোচনায় অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তৎকালীন প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ আব্দুল হাই, শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ও সরদার ফজলুল করিম। এই মেলায় সরদার জয়েনউদদীন একটি মজার কান্ড করেছিলেন। মেলায় যে রকম বইয়ের পসরা সাজিয়ে বসেছিলেন, উৎসুক দর্শকরাও এসেছিলেন প্রচুর, বইয়ের বেচাকেনাও মন্দ ছিল না কিন্তু তাদের জন্য ছিল একটি রঙ্গ-তামাশাময় ইঙ্গিতধর্মী বিষয়ও। মেলার ভেতরে একটি গরু বেঁধে রেখে তার গায়ে লিখে রাখা হয়েছিল ‘আমি বই পড়ি না’। সরদার জয়েনউদদীন সাহেবের এই উদ্ভাবনা দর্শকদের ভালোভাবেই গ্রন্থমনস্ক করে তুলেছিল বলে অনুমান করি। এখানেই সরদার জয়েনউদদীন থেমে থাকেননি। ১৯৭২ সালে তিনি যখন গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক, তখন ইউনেসকো ওই বছরকে ‘আন্তর্জাতিক গ্রন্থবর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করে। গ্রন্থমেলায় আগ্রহী সরদার সাহেব এই আন্তর্জাতিক গ্রন্থবর্ষ উপলক্ষে ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে একটি আন্তর্জাতিক গ্রন্থমেলার আয়োজন করেন। সেই থেকেই বাংলা একাডেমিতে বইমেলার সূচনা।
১৯৭২ সালে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলা একাডেমির একুশের অনুষ্ঠানে কোনো বইমেলা হয়নি। তবে বাংলা একাডেমির দেয়ালের বাইরে স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্সের রুহুল আমিন নিজামী তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রগতি প্রকাশনীর কিছু বইয়ের পসরা সাজিয়ে বসেন। তার দেখাদেখি মুক্তধারা প্রকাশনীর চিত্তরঞ্জন সাহা এবং বর্ণমিছিলের তাজুল ইসলামও ওভাবেই তাদের বই নিয়ে বসে যান। ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমির উদ্যোগে একটি বিশাল জাতীয় সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই সম্মেলনের উদ্বোধন করেন। সে উপলক্ষে নিজামী, চিত্তবাবু এবং বর্ণমিছিলসহ সাত-আটজন প্রকাশক একাডেমির ভেতরে পূর্ব দিকের দেয়ালঘেঁষে বই সাজিয়ে বসে যান। সে বছরই প্রথম বাংলা একাডেমির বইয়েরও বিক্রয়কেন্দ্রের বাইরে একটি স্টলে বিক্রির ব্যবস্থা করা হয়। এভাবেই বিচ্ছিন্ন বই বিক্রির উদ্যোগের ফলে ধীরে ধীরে বাংলা একাডেমিতে একটি বইমেলা আয়োজনের জন্য গ্রন্থমনস্ক মানুষের চাপ বাড়তে থাকে। (শামসুজ্জামান খান, প্রথম আলো, ৩১ জানুয়ারি, ২০১৪)। এ বিচারে দেখা যায়, বাংলাদেশে বইমেলার প্রাণপুরুষ কথা সাহিত্যিক সরদার জয়েনউদদীন। ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমান প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক থাকাকালে এ বইমেলা সরকারি স্বীকৃতি লাভ করে। তার আগ্রহে ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক ড. আশরাফ সিদ্দিকী এই বইমেলার সাথে বাংলা একাডেমিকে সম্পৃক্ত করলে বইমেলা শক্ত ভিত্তি লাভ করে। ১৯৭৯ সালে এ বইমেলার সাথে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি যুক্ত হলে মেলার ব্যাপকতা বহুল বৃদ্ধি পায়। ওই সময় ৭ থেকে ২৮ ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত বইমেলা অনুষ্ঠিত হতো। ১৯৮১ সালে বইমেলার মেয়াদ ২১ দিনের পরিবর্তে ১৪ দিন করা হয়। এরপর প্রকাশকদের দাবির মুখে ১৯৮২ সালে মেলার মেয়াদ আবার ২১ দিনে বৃদ্ধি করা হয়। মেলার উদ্যোক্তা থাকে বাংলা একাডেমি। সহযোগিতায় জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র এবং বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি। ১৯৮৩ সালে কাজী মনজুরে মওলা বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে বাংলা একাডেমিতে প্রথম অমর একুশে গ্রন্থমেলার আয়োজন করেন। মূলত ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রæয়ারি বাংলা ভাষার জন্য আত্মোৎসর্গের করুণ স্মৃতিকে অম্লান করে রাখতেই এই মেলার নামকরণ হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ যা নিয়মিতভাবে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
এবার সরেজমিন বইমেলা পরিদর্শনে গিয়ে দেখা গেল, দোয়েল চত্বর থেকে টিএসসি পর্যন্ত রাস্তা মুক্ত থাকায় পাঠক ও দর্শনার্থীরা সহজেই মেলায় প্রবেশ করতে পারছে। তাছাড়া বিস্তৃত এলাকায় মেলা হওয়ায় দর্শক ও ক্রেতারা ভিড় ও ঠেলাঠেলি এড়িয়ে সহজেই মেলায় ঘোরাঘুরি করতে পারছে। তবে এতে বয়স্ক পাঠক ও দর্শকদের কিছুটা কষ্ট হচ্ছে। অন্যদিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মেলা চত্বরে ইট বিছিয়ে দেয়ায় ধুলার উপদ্রব থেকে রক্ষা পেয়েছে মেলা প্রাঙ্গণ। নিরাপত্তা ব্যবস্থাও সন্তোষজনক বলেই অনেকের অভিমত। এবারের বইমেলায় ৬৬৭টি ইউনিটে ও ১৫টি প্যাভেলিয়নে মোট ৪১১টি প্রতিষ্ঠান স্টল দিয়েছে। প্রকাশকদের অভিযোগ একই প্রকাশকের বেনামি একাধিক স্টল, প্রকৃত সৃজনশীল প্রকাশক নয় এমন প্রতিষ্ঠানকে ও প্রকাশনা শিল্পের বাইরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে বিপুল পরিমাণ স্টল দেয়ায় স্টল সংখ্যা বেড়ে গেছে। তাদের মতে, বাংলাদেশে প্রকৃত প্রকাশকের সংখ্যা আড়াইশতের বেশী হবে না এবং এই প্রকৃত প্রকাশকদের নিয়ে যদি বাংলা একাডেমির মধ্যেই স্টল মেলা সীমাবদ্ধ করা হয় তাহলে বইমেলা অনেক বেশী সার্থক হতো।
এছাড়াও বইমেলায় শিশু সাহিত্য কর্নার নামে যে চত্বর করা হয়েছে সেখানে কোনো খ্যাতিমান প্রতিষ্ঠান রাখা হয়নি। বেশিরভাগই বেনামি প্রতিষ্ঠান সেখানে স্টল নিয়েছে। সেসকল স্টলে শিশু সাহিত্যের নামে যা প্রদর্শন করা হচ্ছে তা কতোটুকু শিশুর পাঠযোগ্য সে নিয়ে প্রবল প্রশ্ন রয়েছে। পাইরেট ও পুরাতন বই নতুন কার্টুন, অলঙ্করণ ও বিন্যাসে আকর্ষণীয় মোড়কে বই প্রদর্শন করা হচ্ছে। দেশী শিশু সাহিত্যিকদের বই সেখানে খুব একটা দেখা যায় না। বিদেশী নানা কার্টুন ও কমিকসের বইয়ের প্রাধান্য প্রবলভাবে লক্ষ্যণীয়। বাংলাদেশে বছরে গড়ে সাড়ে চার হাজার থেকে ৫ হাজার সৃজনশীল বই প্রকাশিত হয়। এরমধ্যে চার সহস্রাধিক বই শুধু বইমেলাতেই প্রকাশিত হয়। চলতি বইমেলায় শুক্রবার পর্যন্ত দুই সহস্রাধিক বই প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশকদের মতে, বাংলাদেশে সৃজনশীল পুস্তকের বাজার ৫০ কোটির বেশী নয়। বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ দাবী করেছিল গত বছর বইমেলায় ৪০ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছিল। হুমায়ূন আহমেদ মারা যাওয়ার পর বাংলাদেশে সৃজনশীল প্রকাশনা শিল্পে যে ক্ষতি হয়েছে তা অপুরণীয়। প্রকাশকদের মতে, তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার মানুষের পাঠাভ্যাসের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। ফেসবুকসহ সোস্যাল মিডিয়া, ভারতীয় টিভি সিরিয়াল মানুষের পাঠের সময় দখল করে নিয়েছে। ফলে খুব দ্রুত বাংলাদেশে বই পাঠকের সংখ্যা কমছে। এমনকি ই-বুক থাকলেও পাঠক সেদিকে খুব একটা যায় না। বাংলাদেশী পাঠকদের বেশিরভাগ সময় দখল করে নিচ্ছে ফেসবুক ও ভারতীয় টিভি সিরিয়াল। এ কারণে বই ব্যবসা আর তেমন লাভজনক নয়। তাদের মতে, বই ব্যবসা ভাল না হওয়ার আরো একটি কারণ হলো, ভাল লেখক ও ভাল পান্ডুলিপির অভাব। ভাল বই ঠিকই পাঠকরা গ্রহণ করছে। কিন্তু সেই ভাল বই বছরে হাতে গোনা কয়েকটি বেরুচ্ছে। অন্যদিকে পাঠকদের অভিযোগ, ভাল পান্ডুলিপি না হওয়ার কারণে প্রকাশকরা কোনো রয়ালিটি না দেয়া। একজন লেখক অনেক কষ্ট করে বই প্রকাশ করে, কিন্তু নামকরা লেখক না হলে প্রকাশকরা তা ছাপতে চান না। ফলে লেখককেই টাকা বিনিয়োগ করে মার্কেটিংয়ের জন্য কোনো প্রকাশনীর নাম দিয়ে বই প্রকাশ করতে হয়। প্রকাশনা ব্যবসা এখন বিনা পুঁজির ব্যবসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। লেখকের টাকায় বই ছাপিয়ে প্রকাশনীর মালিক হন প্রকাশকেরা। সেই বই বিক্রিরও কোনো হিসাব প্রকাশকরা লেখককে দেন না, রয়ালিটি তো দূরের কথা। কিন্তু প্রকাশকরা এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, বই বিক্রি হলে তার রয়ালিটি অবশ্যই দেয়া হয়। ভাল বই বা নামকরা লেখকের বইয়ের রয়ালিটি আমরা এডভান্স দিয়ে থাকি। সমস্যা হলো, বাংলাদেশ সবাই লেখক হতে চায়, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আমলা সকলেই বই প্রকাশ করে লেখক হতে চায়। তাদের বই বিক্রি হয় না বলেই প্রকাশকরা সে বই প্রকাশে আগ্রহী হয় না। সেক্ষেত্রে লেখকরা টাকা দিয়ে অখ্যাত প্রকাশনী থেকে বই প্রকাশ করে। একই বক্তব্য মানহীন পুস্তকের ক্ষেত্রেও। এসব কারণে বাংলাদেশে সৃজনশীল পুস্তক প্রকাশনা শিল্প এখন চরমভাবে হুমকির সম্মুখীন।
সৃজনশীল পুস্তক প্রকাশনা শিল্পের সঙ্কটের একটি বড় কারণ কাগজ, ছাপা ও বাঁধাইয়ের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বর্তমানে বইয়ের দামও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বইয়ের পাঠক সংখ্যা কমছে। বর্তমানে প্রতি ফর্মা বইয়ের দাম ২৫-৩০ টাকা রাখা হচ্ছে। ফলে ১০০ পৃষ্ঠার একটি বইয়ের দাম দাঁড়াচ্ছে ১৫০ টাকা। এ দামে পাঠক বই কিনছে কম। ফলে প্রকাশকরা ব্যয় তুলতে পারছেন না। আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, পাবলিক লাইব্রেরী, গ্রন্থকেন্দ্র প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ বই ক্রয় করতো। প্রকাশকেরা এই প্রকল্পগুলোতে বই বিক্রয় করে লাভের মুখ দেখতো। কিন্তু বর্তমানে অফিসিয়ালি শিক্ষা মন্ত্রণালয় কোনো বই ক্রয় করছে না। (রাজনৈতিক বিবেচনায় কিছু বই মন্ত্রণালয় থেকে ডিসির মাধ্যমে চিঠি দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্রয় করতে বাধ্য করা হচ্ছে।) অন্যদিকে পাবলিক লাইব্রেরী ও গ্রন্থকেন্দ্র সামান্য পরিমাণে বই ক্রয় করলেও তাতে রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পাচ্ছে। সরকারী রাজনৈতিক দর্শনমূলক, মন্ত্রী, এমপি, সরকারী নেতা, কর্মী, সমর্থক ও আমলাদের লেখা মানহীন বই সেখানে ক্রয়ে প্রাধান্য পাচ্ছে। ফলে প্রকাশকরা বই প্রকাশের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। বাংলাদেশের সৃজনশীল পুস্তক প্রকাশনা শিল্পকে এগিয়ে নিতে হলে এসব বাধা ও ক্ষুদ্রতাকে অতিক্রম করতে হবে বলে দাবী প্রকাশকদের। বই জাতির মেধা ও মননের প্রতীক। উন্নত জাতি গড়তে সৃজনশীল পুস্তক প্রকাশনা শিল্পের বিদ্যমান বাধাগুলো দূর করতে সরকার উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করবে এটাই সকলের প্রত্যাশা। অন্যদিকে, প্রকাশকরা সৎ পেশাদারি মনোভাব দেখিয়ে পাঠকদের ঠকানোর মনোবৃত্তি পরিত্যাগ করবেন এও একান্তভাবে কাম্য।
email: [email protected]



 

Show all comments
  • শরীফ ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ২:২৭ পিএম says : 0
    ইতিহাসভিত্তিক এই লেখাটি খুব ভালো লেগেছে। অনেকদিন পরে হলেও বইমেলার ইতিহাস জানলাম.....
    Total Reply(0) Reply
  • সালমান ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ২:২৯ পিএম says : 0
    লেখকরা প্রকাশকের দোষ দিচ্ছে আর প্রকাশকরা লেখকের দোষ দিচ্ছে । আসলে দোষ উভয়ের।
    Total Reply(1) Reply
    • Harun ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ২:৩২ পিএম says : 4
      akdom khati kotha. tai dui group er uchit sommilito chesta kora
  • সাব্বির ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ২:৩৪ পিএম says : 0
    বইমেলার সমস্যা নিয়ে অত্যান্ত একটি যৌক্তিক ও বাস্তবধর্মী লেখা। লেখককে অসংখ্য ধন্যবাদ।
    Total Reply(0) Reply
  • মনিরুল ইসলাম ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ২:৩৫ পিএম says : 0
    বিষয়টি নিয়ে সকলের ভাবা উচিত।
    Total Reply(0) Reply
  • হারুন আর রশিদ ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ২:৩৬ পিএম says : 0
    এভাবে চলতে থাকলে এই খাতের ভবিষ্যত অন্ধকার।
    Total Reply(0) Reply
  • সাইদুর রহমান ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ৩:২১ পিএম says : 0
    সৃজনশীল পুস্তক প্রকাশনা শিল্পের সঙ্কট সমাধানে সরকারেরও এগিয়ে আসতে হবে।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ