দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
এখানে দুনিয়ার কল্যাণ বলতে দুনিয়ার সামগ্রিক কল্যাণকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ এর মাধ্যমে দুনিয়ার জীবন সর্বাঙ্গীন সুন্দর হবে। সমাজব্যবস্থা নিস্কলুষ ও নিখুঁত হবে স্থায়ী ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। রাসূলুল্লাহর (স.) উদ্দেশ্য ছিল সমাজের কর্তৃত্ব গ্রহণ করে সেখানে ন্যায়-নীতি ও ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা। এ কারণে কুরাইশদের সাথে দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যাওয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি আবার আহ্বান করেন এভাবে যে, একটি মাত্র কথা যদি তোমরা আমাদের দাও, তবে তা দ্বারা তোমরা সমগ্র আরব জাতির ওপর আধিপত্য লাভ করবে এবং যত অনারব আছে তারা তোমাদের বশ্যতা স্বীকার করবে। মাক্কী জীবনে রাসূলুল্লাহ স. ও তাঁর সাহবীরা যখন প্রচ- বিবোধিতা ও নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছিলেন, তখন সাহাবীরা একবার রাসূলুল্লাহর (স.) কাছে তাঁদের নির্যাতনের কথা বলে এ অবস্থা পরিবর্তনের জন্য দু’আ চাইলেন। তখন তিনি সাহাবীদের সুসংবাদ শুনিয়ে বললেন, আল্লাহর কসম, আল্লাহ এ দীনকে একদিন অবশ্যই পূর্ণতা দান করবেন। (ফলে সর্বত্রই নিরাপদ ও শান্তিময় অবস্থা বিরাজ করবে)। এমনকি তখনকার দিনে একজন উষ্ট্রারোহী একাকী সান’আ থেকে হাযরামাউত পর্যন্ত নিরাপদে সফর করবে, অথচ আল্লাহ ছাড়া আর কারো ভয়ে সে ভীত থাকবে না, এমনকি তার মেসপালের ব্যাপারে নেকড়ে বাঘের আশঙ্কাও তার থাকবে না। কিন্তু তোমরা (ঐ সময়ের অপেক্ষা না করে) তাড়াহুড়া করছো। এখানে রাসূলুল্লাহ (স.) এমন এক সমাজ প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত দিলেন, যেটা সম্পূর্ণ ন্যায়ভিত্তিক ও শান্তিময়। যেখানে কোন চুরি-ডাকাতি, খুন-রাহাজানি ও লুণ্ঠন থাকবে না। কেউ অন্যের জান-মাল, ইজ্জত, সম্ভ্রম অন্যায়ভাবে স্পর্শ করার সাহস করবে না। বাস্তবিকই রাসূল স. এ রকম এক শান্তিময় সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
মাক্কী জীবনে রাসূলুল্লাহ (স.) যেমন মনে-প্রাণে কামনা করতেন সকল অন্যায়-অবিচারহীন একটি শান্তিময় সমাজ বির্নিমাণের, তেমনি মদীনায় গিয়ে তাঁর প্রধান লক্ষ্যই ছিল সমস্ত অন্যায়-অবিচার দূর করে সাম্যের ভিত্তিতে এক শান্তিময় সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। প্রকৃত অর্থেই মদীনায় রাসূল (স.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সমাজ ব্যবস্থায় ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজের বাস্তব চিত্র পাওয়া যায়। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সমাজ ব্যবস্থায় মানুষ তার সমস্ত সামাজিক সম্পর্কসহ এমনভাবে সংশোধিত হয়েছিল, যার ফলে সমাজের সকল স্তরে শান্তি-শৃঙ্খলা বিরাজমান ছিল। সেখানে কেউ অন্যায়ভাবে অন্যের হক নষ্ট করতো না। প্রত্যেকে নিজ নিজ অধিকার ভোগ করতো। কারো প্রতি সামান্যতম জুলুম করা হতো না। বিশেষ করে ওহুদ যুদ্ধের পর নাযিলকৃত সূরা আন-নিসা এবং আল-মা’ইদাতে বর্ণিত ইসলামের পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনের বিভিন্ন নিয়ম-নীতি, বিধি-বিধান রাসূলুল্লাহ (স.) তাঁর প্রতিষ্ঠিত সমাজে পরিপূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (স.) শক্র-মিত্র, সমর্থক বা বিরোধী, মুসলিম বা অমুসলিম সবার সাথে ন্যায় ও ইনসাফপূর্ণ আচরণ করতেন। নিজের নিকট আত্মীয় হলেও কোন রকম পক্ষপাতমূলক বিচার করতেন না। একবার মাখযুম গোত্রের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের জনৈকা মহিলা চুরি করলো। উসামাহ রা. তার উপর আল্লাহর বিধান কার্যকর না করার সুপারিশ করলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে বলেন, তুমি কি আল্লাহর নির্ধারিত শাস্তি মওকুফের সুপারিশ করছো? এরপর তিনি দাঁড়ালেন এবং লোকদের উদ্দেশ্য বললেন “হে মানুষেরা তোমাদের পূর্ববর্তীরা এজন্য ধ্বংস হয়ে গেছে যে, যখন তাদের মধ্যে মর্যাদাশীল কেউ চুটি করতো তখন তারা তাকে ছেড়ে দিতো। আর যখন দুর্বল কেউ চুরি করতো তার উপর শাস্তি প্রয়োগ করতো। রাসূলুল্লাহ (স.) তার প্রতিষ্ঠিত সমাজে সকলের জীবন, সম্পদ ও সম্মানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। অপরের ধন সম্পদ জবর দখল, আত্মসাৎ ও লুণ্ঠন করাকে তীব্র ভাষায় ভর্ৎসনা করেন। এটাকে অবৈধ বলে ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, যে অন্যায়ভাবে অপরের জমির এক বিঘত পরিমাণ অংশও জবর দখল করবে, তার গলায় সপ্ত যমীনের হার ঝুলিয়ে দেয়া হবে। তিনি কঠোর ভাষায় বলেন, প্রত্যেক মুসলিমের জন্য অপর মুসলমানের রক্ত, ধন-সম্পদ ও মান-সম্মানের উপর অন্যায় হস্তক্ষেপ হারাম। মানুষের ব্যক্তিগত স্বাভাবিক স্বাধীনতা ছাড়া পূর্ণাঙ্গ সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। এ কারণে রাসূলুল্লাহ (স.) মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রতি খেয়াল রাখতেন। তবে এ স্বাধীনতা অবশ্যই লাগামহীন স্বাধীনতা নয়, যার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি শুধু ভোগ বিলাস ও নিজ স্বার্থ সংরক্ষণে সর্বদা ব্যস্ত থাকে। বরং এটি একটি সীমারেখা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সমাজের প্রত্যেক শ্রেণি-পেশার মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক ও দায়িত্ব ও দায়িত্ববোধ ছাড়া শুধু ব্যক্তি স্বাধীনতা ও সমতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ সামাজিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনয়ন করা সম্ভব না। এ জন্য রাসূলুল্লাহ (স.) সবাইকে দায়িত্বশীল হবার তাকীদ দিয়েছেন। তিনি বলেন-তোমরা প্রত্যেকে দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেককে তার দায়িত্বের ব্যাপারে জবাবদিহি করতে হবে। তিনি সামাজিক জীবনের পারস্পরিক দায়িত্বশীলতার নীতিমালাকে স্পষ্ট করেছেন।
ব্যক্তি ও তার সত্তা, ব্যক্তি ও সমাজ, ব্যক্তি ও পরিবার, এক জাতির সাথে অন্য জাতির প্রত্যেক জাতির ভবিষ্যৎ বংশধর সবার মাঝে তিনি এক মজবুত পাস্পরিক সম্পর্ক স্থাপনের দৃষ্টান্ত রেখেছেন। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন-তোমরা নিজেদের হাতকে ধ্বংসের দিকে নিক্ষেপ করো না। রাসূলুল্লাহ স. তাঁর সমাজে দেখিয়েছেন যে, প্রত্যেক ব্যক্তিকে সমাজের স্বার্থ ও কল্যাণের জন্য পাহারাদার হতে হবে। স্বাধীনতার অজুহাতে সমাজের কোথাও ক্ষতিকর কোন কিছু করার অধিকার কারো নেই। বরং সকলের দায়িত্ব পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নজর রাখা। এ সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল (স.) একটি চমৎকার উপমা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন-আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখা যারা মেনে চলে, আর যারা তা অতিক্রম করে তাদের উদাহরণ হলো- যেমন কিছু লোক একটি জাহাজে আরোহণ করলো। তাদের কিছু লোক জাহাজের উপর তলাতে থাকতে এবং কিছু নীচের তলাতে থাকার জন্য স্থান বেছে নিল। যারা নীচের তলায় অবস্থান করছে তাদের পানি পার করার জন্য উপর তলার লোকদের নিকট যেতে হয়। সুতরাং নিচের তলার লোকেরা বলল-আমরা যদি পানির জন্য নিচে ছিদ্র করে নিতাম এবং উপরের তলার লোকদের কষ্ট না দিতাম তাহলে কতইনা ভালো হত। অতএব, লোকের যদি নিচের তলার লোকদের ইচ্ছা পূরণ করার সুযোগ দেয় তাহলে তারা সকলেই ধ্বংস হয়ে যাবে। আর যদি তাদের এ কাজ থেকে বিরত রাখে তাহলে তারা নিজেরা মুক্তি পাবে এবং সাথে সবাই ধ্বংস থেকে মুক্তি পাবে। আলোচ্য হাদীসে ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিন্তা-চেতনার যে ধ্বংসাত্মক পরিণতি তার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
বরং এখান থেকে অনুধাবন করা যায়, ব্যক্তি ও সমাজ পরস্পরের সাথে সম্পৃক্ত। এখানে সবাইকে অপরের কল্যাণের বিষয় ভাবতে হবে। আর তা না হলে সমগ্র সমাজ অশান্তি ও বিশঙ্খলার মধ্যে নিপতিত হবে। কিন্তু আজকের বিশ্ব-ব্যবস্থা রাসূলের (স.) এ শিক্ষা থেকে বহু দূরে অবস্থান করছে। নিজের, নিজের পরিবারের, নিজের জাতির বা নিজের দেশের সামান্য স্বার্থের জন্য অন্যের, অন্যের পরিবারের, অন্য জাতির বা অন্য দেশের মারাত্মক ক্ষতি সাধন করেছে। এমনকি বাড়ির পর বাড়ি, শহরের পর শহর দেশের পর দেশ ধ্বংস করা হচ্ছে। ধ্বংস হচ্ছে জান-মাল ও ফসলাদি। একদিকে অত্যাচারী এভাবে অন্যের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে, অন্যদিকে বিশ্ব-বিবেকও সবকিছু নীরবে সহ্য করছে। নিজেদের স্বার্থ ছাড়া কেউ কোথাও কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না। আর সে জন্যই সারা বিশ্ব আজ অশান্তির দাবানলে জ্বলছে। অথচ আল্লাহর রাসূল স. বলেন-তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি কোন খারাপ কাজ দেখবে, সে সেটা হাত দিয়ে তা প্রতিহত করবে। এতে যদি সে সক্ষম না হয় তবে সে মুখ দিয়ে প্রতিবাদ করবে। পরস্পর পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও প্রেম-প্রীতির বেলায় মুসলিম জাতি একটি দেহের ন্যায়। দেহের একটি অঙ্গ যদি আক্রান্ত হয় তবে তার জন্য সমস্ত শরীর জ্বর ও নিদ্রাহীনতায় ব্যথিত হয়ে পড়ে। রাসূলুল্লাহ স. -এর সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল পরামর্শের ভিত্তিতে সমাজ পরিচালনা করা। আল-কুরআনের নির্দেশনা “কোন কাজ করার ক্ষেত্রে তাদের সাথে পরামর্শ করে নিন “তাদের কাজকর্ম পরামর্শের ভিত্তিতে হয়” কে তিনি পরিপূর্ণরূপে অনুসরণ করতেন। (চলবে)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।