হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
জামালউদ্দিন বারী : মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রচারণার শুরু থেকে যে অনভিপ্রেত রাজনৈতিক বিতর্কের সূত্রপাত করেছিলেন বিজয়ী হয়ে হোয়াইট হাউসের দায়িত্ব গ্রহণের পরও তা শুধু অব্যাহত নয়Ñ তার মাত্রা, বিতর্ক ও জনবিক্ষোভও যেন বেড়ে চলেছে। দীর্ঘদিনের আলোচনা ও সমঝোতার মধ্য দিয়ে অর্জিত ট্রান্সপ্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) চুক্তি প্রথম দিনেই বাতিল করে দিয়ে তিনি তার অন্যতম নির্বাচনী অঙ্গীকার পালন করেছেন। তবে মুসলিমদের জন্য আমেরিকার দরজা বন্ধ করে দেয়ার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনেক বেশি সমালোচিত হওয়ার পর এক সময় তিনি নিজেই সে অবস্থান থেকে সরে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। এ কথাও সত্য যে, রাজপথের একজন রাজনীতিবিদ যত কথাই বলুন ক্ষমতাসীন একজন প্রেসিডেন্টের পক্ষে দেশি-বিদেশি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক বাস্তবতায় সেসব মাঠের কথার বাস্তবায়ন অনেক কঠিন। এমনকি নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পরও কোনো কোনো বিষয়ে ট্রাম্প ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেছেন বলে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছিল। ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির অন্যতম বিষয় ছিল মধ্যপ্রাচ্য থেকে মার্কিন হস্তক্ষেপ কমিয়ে আনা এবং সৈন্য প্রত্যাহার করা। এর মধ্য দিয়ে কার্যত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য, কর্মসংস্থান এবং অর্থনৈতিক অবস্থাকে সুসংহত করাই ছিল তার মূল প্রতিশ্রুতি। তবে ‘মর্নিং শো’জ দ্য ডে’, দায়িত্ব গ্রহণের দুই সপ্তাহের মধ্যেই মার্কিন জনগণ এবং বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছে অনেকটা স্পষ্ট হয়ে গেছে কেমন হতে পারে ট্রাম্পের আগামী ৪ বছরের শাসন। ট্রাম্পের শাসন সম্পর্কে নির্বাচনের আগে যেসব আশঙ্কার কথা বলা হচ্ছিল, সেখানে সংশয়ের পাশাপাশি কিছু প্রত্যাশারও স্থান ছিল। এখন সে কিঞ্চিৎ প্রত্যাশার আলোটুকু অন্ধকারে নিবু নিবু হতে শুরু করেছে। একই সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাবৎ বিশ্বের সাধারণ মানুষও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনী বৈধতার মধ্য দিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অপশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ও প্রতিবাদী হতে শুরু করেছে। দায়িত্ব গ্রহণের ১০ দিনের মাথায় অবশেষে ট্রাম্প ৭টি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রের নাগরিকদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞার বিলে সই করেছেন। এসব দেশের কোনোটিই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমকক্ষ, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রতিপক্ষ বা বৈরী শক্তি নয়। অতীতে কখনই, এমনকি নাইন-ইলেভেন পরবর্তী সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের সময় এসব দেশের সাধারণ নাগরিকরা ঢালাওভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিষেধাজ্ঞার শিকার হয়নি। ইরানের সাথে এক ধরনের রাজনৈতিক-কূটনৈতিক তিক্ততা থাকলেও বাকি ৬টি দেশই মার্কিনিদের নগ্ন হস্তক্ষেপের শিকার হয়ে রাষ্ট্র হিসেবে অকার্যকর ও অস্থিতিশীল হয়েছে। গৃহযুদ্ধ, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক যুদ্ধের শিকার হওয়া মানুষের একটি অংশ শরণার্থী হিসেবে ইউরোপের দেশগুলোতে পাড়ি জমিয়েছে। আর আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গঠনে মূল ভূমিকা রেখেছে ইমিগ্রান্টরা ধর্ম-বর্ণের নিরিখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা বাতিল বা ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ মার্কিন গণতন্ত্র ও সংবিধানের মৌলিক নীতিমালার পরিপন্থী। মুসলমানদের জন্য ভিসা লাভের সুযোগ রহিত করে ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান লঙ্ঘনের মধ্য দিয়েই বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ও বিস্তৃত ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে পরোক্ষভাবে একটি যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। তবে মার্কিন জনগণ, আদালত এবং নিরাপত্তা বিভাগ ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি। হিলারির কাছে পপুলার ভোটে বিপুল ব্যবধানে হেরে যাওয়া ডোনাল্ড ট্রাম্প ইলেক্টোরাল ভোটের মারপ্যাঁচে প্রেসিডেন্ট হলেও রাজনৈতিক ও নৈতিক অবস্থানগত দিক থেকে অত্যন্ত দুর্বল। শুরু থেকেই বির্তকিত ও বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত নিয়ে ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বকে ঝুকির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে পেশাদার রাজনীতিকদের অবস্থান এখনো সুদৃঢ়। সেখানকার কংগ্রেস ও সিনেটে শতকরা ৩৮ ভাগ ব্যবসায়ী হলেও বাকি বেশির ভাগই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। সুদীর্ঘদিন পর সম্ভবত ডোনাল্ড ট্রাম্পই প্রথম একজন অরাজনৈতিক ব্যবসায়ী হয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হলেন। ট্রাম্পের নির্বাচনী মাঠে পদার্পণের শুরু থেকে যেসব বিতর্ক এবং আশঙ্কার কথা উচ্চারিত হয়েছিল দায়িত্ব গ্রহণের দুই সপ্তাহ পার হওয়ার আগেই দেখা যাচ্ছে বাস্তবে তার রূপ আশঙ্কার চেয়েও বেশি কদাকার ও অনিষ্ঠকর। সেই সাথে এও দেখা গেল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার পথিকৃৎ ও ইউনিপোলার বিশ্বের মূল পরাশক্তি রাষ্ট্রটির নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট কীভাবে দায়িত্ব পালনের শুরুতেই কতটা অজনপ্রিয় ও গণবিক্ষোভের সম্মুখীন হয়। সাতটি মুসলমান দেশের নাগরিকদের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার বিলে ডোনাল্ট ট্রাম্প সই করার পর থেকে ওয়াশিংটনে হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভে রাজপথে নেমে এসেছে। অর্থাৎ ইলেক্টোরাল ভোটে নির্বাচিত ঘোষিত হওয়ার পর থেকে শপথ গ্রহণের দিন পর্যন্ত যেসব লাখো জনতা ট্রাম্পকে নিজেদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে মানতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছিল, তড়িঘড়ি মুসলিম নিষেধাজ্ঞার বিলে সই করে সেসব বিক্ষুব্ধ জনতার হাতে ট্রাম্প নিজেই একটি মোক্ষম অস্ত্র তুলে দিয়েছেন। ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্ত একই সাথে মার্কিন সংবিধান বিরোধী, মার্কিন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিরোধী, অনৈতিক, অযৌক্তিক এবং বাস্তবতা বিবর্জিত। ফলে বিরোধীরা খুব সহজেই ফেডারেল আদালতের শরণাপন্ন হয়ে প্রতিকার পেয়েছেন। মার্কিন ফেডারেল আদালত ৭ মুসলিম প্রধান দেশের নাগরিকদের ওপর ট্রাম্পের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার নির্বাহী আদেশ স্থগিত করেছেন। পাশাপাশি মার্কিন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্সের পক্ষ থেকেও ট্রাম্পের এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এরপরও ট্রাম্পের মধ্যে কোনো চৈতন্যদোয় ঘটেনি, নিজের নির্বাহী আদেশ বহাল রাখতে মার্কিন সরকার তথা ট্রাম্পের পক্ষ থেকে যে আপিল করা হয়েছিল তাও খারিজ করে দিয়েছেন আদালত। এর মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে শুরুতেই সবচেয়ে বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ততধিক বিতর্কিত ও গুরুত্বপূর্ণ একটি নির্বাহী আদেশ চরমভাবে হোঁচট খেয়ে কার্যত পরিত্যাজ্য হলো। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে মার্কিন সংবিধান, মানবাধিকার, জনমত, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা এবং বিশ্বজনমতেরই যেন বিজয় ঘোষিত হয়েছে। গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, সেক্যুলারিজম ও মাল্টিকালচারালিজমের ভিত্তিতে মার্কিন ফাউন্ডিং ফাদারদের নীতি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বিচ্যুত করার ভিত্তিহীন পদক্ষেপ গ্রহণের মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট হিসেবে শুরুতেই ডোনাল্ড ট্রাম্প তার অযোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন। সম্মিলিত কণ্ঠে সোচ্চার প্রতিবাদী ভূমিকা নিয়ে মার্কিন জনগণই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে একটি বড় ধরনের নৈতিক ও সাংবিধানিক বিপর্যয় ও হিউমিলিয়েশন থেকে রক্ষা করেছেন। ট্রাম্পের অভিবাসন নীতির বিরুদ্ধে শুধু রাজপথে প্রতিবাদ বিক্ষোভেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে প্রায় অর্ধশত মামলা দায়ের হয়েছে মার্কিন আদালতে। ট্রাম্পবিরোধী বিক্ষোভের ঢেউ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টিকের সীমা পেরিয়ে ইউরোপ-মধ্যপ্রাচ্যসহ বাকি দুনিয়াকেও আলোড়িত করছে। জার্মানির প্রভাবশালী সাপ্তাহিক সংবাদ সাময়িকী ‘দার স্পিজেল’ তাদের চলতি সংখ্যার প্রচ্ছদে একটি কার্টুন চিত্র ছেপেছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি ছুরি দিয়ে স্টাচু অব লিবার্টির মুন্ডু কেটে একহাতে তুলে ধরেছেন কাটা গলা থেকে রক্ত ঝরছে, অন্য হাতে রক্তাক্ত সঙ্গিন উঁচিয়ে ধরে আছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন অনলাইন মিডিয়ায় প্রকাশিত ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞা বিরোধী ব্যাপক লেখালেখি চলছে। অনুসন্ধানী ইতিহাস গবেষক এরিখ জুয়েসের একটি নিবন্ধের শিরোনামÑ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচিত স্টাচু অব লিবার্টি ফ্রান্সে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া (ইউএস শুড শিপ স্টাচু অব লিবার্টি ব্যাক টু ফ্রান্স)। আমেরিকান সিভিল ওয়ারের পর ঊনবিংশ শতকের শেষদিকে ফ্রান্স মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এই স্টাচু উপহার হিসেবে আমেরিকায় পাঠিয়েছিল। লিবার্টি দ্বীপ নামে পরিচিত নিউইয়র্কের ম্যানহাটান আইল্যান্ডে স্থাপিত এই স্টাচু গ্রিক দেবিমূর্তির আদলে ঢিলেঢালা কাপড়ে আবৃত এক নারী যার এক হাতে উঁচু করে ধরা একটি মশাল, বাম হাতে বুকের পাশে চেপে রাখা একটি ট্যাবলেট বা আইনের বই। ট্রাম্পের বৈষম্য ও বর্ণবাদী রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলোর বাস্তবায়নের শুরু থেকে এই স্টাচু অব লিবার্টির প্রতীক যেন অপমানিত, ¤্রয়িমাণ ও লজ্জাবনত হয়ে পড়েছে।
মার্কিন অর্থনীতির দুর্দশার জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যায় হস্তক্ষেপ ও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়াকে দায়ী করে নির্বাচনী প্রচারণার সময় তিনি এ থেকে সরে আসার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। এমনকি আইএস এবং সিরীয় গৃহযুদ্ধের বাস্তবতা থেকে বেরিয়ে এসে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের সাথে আলোচনা ও সমঝোতার সম্ভাবনাকেও নাকচ করেননি। তবে নির্বাচিত হওয়ার পর বোঝা যাচ্ছে ট্রাম্প আসলে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি চান না, তিনি অনেক আগে পেন্টাগনের গৃহীত ওয়ার প্লানকে নতুনভাবে বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছেন। সেটি হলো ইরানের সাথে সংঘাতে জড়ানো। মূলত ইরাক ও আফগানিস্তান দখল এবং সিরিয়ায় রিজিম চেঞ্জের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল ইরানকে টার্গেট করেই। মিথ্যা অভিযোগে ইরাকে মার্কিন সামরিক আগ্রাসন এবং দশ বছরের বেশি সময় ধরে সেখানে দখলদারিত্ব কায়েম করেও সেখানে মার্কিনিরা সামরিক বা রাজনৈতিক বিজয় অর্জন করতে পারেনি। মূলত ইরাকি গেরিলা বাহিনীর সাথে আপস ও সমঝোতা করেই তাদেরকে সেখান থেকে পশ্চাৎপসারণ করতে হয়েছে। আর সিরিয়ায় ইরান এবং রাশিয়া সমর্থিত সরকারি বাহিনীর কাছে পশ্চিমা মদদপুষ্ট বিদ্রোহী, আল-নুসরা ও দায়েশ ইতোমধ্যেই পরাস্ত হয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে। এমন পরাস্ত-পলায়নপর অবস্থায়ও অপেক্ষাকৃত অনেক বৃহৎ ও সুসংহত শক্তি ইরানের সাথে যুদ্ধে জড়ানোর হুমকি দিতে শুরু করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। তবে আশির দশকের শুরু থেকে পরমাণু সমঝোতা চুক্তি পর্যন্ত গত সাড়ে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরেই ইরানিরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি অব্যাহত সামরিক হুমকির মধ্যেই রয়েছে। ইসরাইল ও জায়নবাদী চক্রের বিরোধিতা ও ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে ইরানের সাথে ৬ জাতির পরমাণু সমঝোতা চুক্তির মধ্য দিয়ে উত্তেজনা নিরসনের উদ্যোগ প্রেসিডেন্ট ওবামার একটি কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবেই বিবেচিত হয়েছে। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার দ্বিতীয় সপ্তায়ই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সাথে পরমাণু সমঝোতা চুক্তি লঙ্ঘন করতে শুরু করেছে। ২০১৫ সালের একটি জাতিসংঘ রেজুলেশন অনুসারে ইরানকে পরমাণু অস্ত্রবহনে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালানো থেকে বিরত থাকতে বলা হলেও কনভেনশনাল মিসাইল টেস্ট থেকে বারিত করা হয়নি। সম্প্রতি ইরান তার স্থল ও সমুদ্রসীমায় একাধিক সামরিক মহড়া ও মিসাইল পরীক্ষা চালিয়েছে। ইসরাইল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের কাছ থেকে অব্যাহত সামরিক হুমকির মধ্যে থাকা ইরান নিজের নিরাপত্তা ও সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগকে এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক হুমকি বলে ঘোষণা করছে হোয়াইট হাউস। এ সপ্তায় নবনিযুক্ত মার্কিন নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইকেল টমাস ফ্লিন হোয়াইট হাউসে এক সংবাদ সম্মেলনে ইরানের ব্যালাস্টিক মিসাইল কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ততার দায়ে ২৫ ব্যক্তি ও সংস্থার ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পাশাপাশি লোহিত সাগরে হুথি বিদ্রোহীদের হাতে একটি সউদি রণতরী আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাকে আমলে নিয়ে একটি কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছে। মাইকেল ফ্লিনের বক্তব্যের ভাষা ও মুখোভঙ্গি বিশ্লেষণ করে পশ্চিমা রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শীঘ্রই ইরানের সাথে নতুন সংঘাতে জড়াচ্ছে বলে মনে করছেন। নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক প্যাট বুকানেন প্রশ্ন রেখেছেন, যেখানে সউদি আরব প্রতিদিনই হুথি দমনের নামে ইয়েমেনে বোমা ফেলে তছনছ করে দিচ্ছে, তখন কথিত সউদি রণতরী হুথিদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা কীভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে আঘাতের বিষয় হয়। সেখানে সউদি রণতরী আদৌ হুথি বা ইরানিদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে কিনা তার কোনো প্রমাণও হাজির করতে পারেনি হোয়াইট হাউস। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ শুরু করতে কোনো প্রমাণ লাগে না। ১৮৯৮ সালে স্পেনিশ-আমেরিকান যুদ্ধ শুরুর আগে হাভানা উপকূলে একটি মার্কিন জাহাজে বিস্ফোরণের অভিযোগ তোলা হয়েছিল, ১৯৬৪ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধের আগে দক্ষিণ ভিয়েতনামি বাহিনীর হাতে ‘গাল্ফ অব টনকিং ইন্সিডেন্ট’ খ্যাত দুটি মার্কিন ডেস্ট্রয়ার আক্রান্ত হওয়ার অভিযোগ তোলা হয়েছিল। ইরাকে আগ্রাসনের অজুহাত যে মিথ্যা ও বানোয়াট ছিল তা এখন পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্য থেকেই বেরিয়ে আসছে।
কথিত হুথিদের হাতে সউদি রণতরী আক্রান্ত হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় ইরানের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা গ্রহণের হুঁশিয়ারি দেয়ার পর ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী হোয়াইট হাউসের ডিফেন্স অ্যাডভাইজার মাইক ফ্লিনকে ধন্যবাদ জানিয়েছে বলে জানা যায়। আইসিএইচ ব্লগে জাইদ জিলানি এবং এলেক্স ইমন্সর লেখা এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, মার্কিনিরা সাধারণত এভাবেই যুদ্ধ শুরু করে থাকে। তবে শুধু ইরান নয়, ভিসা ও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার নামে মূলত মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ঘোষিত প্রথম যুদ্ধে তার নৈতিক, রাজনৈতিক ও আইনগত পরাজয় ইতোমধ্যেই ঘটে গেছে। ট্রাম্পের অভিবাসন বিরোধী অধ্যাদেশ জারির পর হাজার হাজার মার্কিন নাগরিক তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিবাদ-বিক্ষোভে রাস্তায় নেমে আসে। সেখানে প্রভাবশালী মার্কিন ডেমোক্রেটরাও ট্রাম্পের অভিভাসন বিরোধী বিক্ষোভে যোগ দেয়। তবে ম্যাসাচুসেটস থেকে নির্বাচিত সিনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেন সিনেটে দেয়া বক্তৃতায় রিপাবলিকান দলীয় সিনেটরদের কঠিন প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেছেন। তিনি তাদের নীরবতাকে অমানবিক ও মেরুদ-হীনতা বলে আখ্যায়িত করেন। এক ঘণ্টারও বেশি দীর্ঘ বক্তৃতায় ওয়ারেন ট্রাম্পের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার শিকার নিরপরাধ মানুষের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ ও মানবিক বিপর্যয়ের একের পর এক কেস স্টাডি তুলে ধরেন। যেখানে দেখা যায়, এক ইরানি পিতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাসপাতালে চিকিৎসারত তার ক্যান্সার আক্রান্ত কন্যাকে দেখতে আসতে না পারার হৃদয়বিদারক ঘটনা, নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়া দেশগুলো থেকে এমআইটিসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও গবেষকদের ভিসা বাতিল হওয়ার কারণে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি অনেকের শিক্ষাজীবন ও পারিবারিক জীবনে বিপর্যয় নেমে আসার উদাহরণগুলো প্রত্যেক শ্রোতা-দর্শকের হৃদয়কে স্পর্শ করেছে। ট্রাম্পের মার্কিন স্বার্থবিরোধী অভিবাসন নীতির বিরুদ্ধে সেখানকার বিভিন্ন গণমাধ্যম কীভাবে সোচ্চার হয়েছে তারও কিছু উদাহরণ তুলে ধরেছেন সিনেটর ওয়ারেন। তিরিশ জানুয়ারিতে ট্রাম্পের এই নিষেধাজ্ঞাকে ভ্রাতৃপ্রতিম মুসলমানদের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাসঘাতকতা বলে অভিহিত করে এই আদেশকে ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলার আহ্বান ছিল এলিজাবেথ ওয়ারেনের পুরো বক্তৃতা জুড়ে। আমরা দেখছি ট্রাম্পের মুসলিম নিষেধাজ্ঞা অধ্যাদেশ ইতোমধ্যেই ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলা হয়েছে। জায়নবাদী ইসরাইলের ক্রীড়নক ট্রাম্পের নতুন রণপ্রস্তুতি থামিয়ে দিতে মার্কিন আদালত, লিবারেল জনগণ, গণমাধ্যম ও বিশ্বসম্প্রদায় কি অনুরূপ সোচ্চার ভূমিকা অব্যাহত রাখতে পারবে?
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।