হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
আবদুল আউয়াল ঠাকুর : বছর ঘুরে আবার এসেছে মহান ভাষার মাস। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিন বাংলা একাডেমিতে অমর একুশে গ্রন্থমেলার উদ্বোধন করেছেন। এবার তার নিজেরও একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিপথে যাওয়া ছেলেমেয়েরা সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার মধ্যদিয়ে সুপথে ফিরে আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেছেন, আমাদের ছেলেমেয়েরা যখন বিপথে (সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ-মাদকাসক্ত) চলে যাচ্ছে তখন তাদের এই ভুল পথ থেকে বিরত রাখা যায় কেবল সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে। লেখাপড়া, সংস্কৃতি চর্চা যত বেশি হবে ততই তারা ভালো পথে আসবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন। বর্তমান সময়ে দেশের ভবিষ্যৎ তরুণদের নিয়ে উদ্বিগ্নতার কোনো শেষ নেই। তাদের একটি বড় অংশই এখন বখে গেছে। সাধারণত তরুণ-কিশোররা যা নিয়ে মেতে থাকে অর্থাৎ যে দুরন্তপনায় তাদের মানায় এখনকার এই শ্রেণি সে স্তর পেরিয়ে এমন সব অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়েছে, যা তাদের জন্য বেমানান। সভ্যতার জন্য হুমকিস্বরূপ। সমাজ-রাষ্ট্র নিয়ে প্রতিদিন নানা মহামূল্যবান নসিয়ত শোনা গেলেও বাস্তবতা হচ্ছে অন্য রকম। আদৌ সমাজে কোনো শৃঙ্খলা নিয়মনীতি রয়েছে কিনা অথবা এসবের কোনো তোয়াক্কা কেউ করছে কিনা সে প্রশ্নই এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। সমাজের ভবিষ্যৎ বলে পরিচিত তরুণ সমাজের মধ্যে অবক্ষয় কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে তার নজির প্রায় প্রতিদিনই পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ হচ্ছে। কিছু দিন আগে খোদ রাজধানীতে ইভটিজিংয়ের প্রতিবাদ করায় দুই বোন বখাটের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল। অবস্থা এতটাই গুরুতর ছিল যে, তাদের হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে। এর আগে উত্তরায় গ্যাংস্টার নামে তরুণদের সংগঠনের সদস্যদের হাতে অন্য এক তরুণকে নিহত হতে হয়েছে। এর আগে ফরিদপুরে মোটরসাইকেলের টাকা দিতে না পারায় পিতাকে হত্যা করা হয়েছে। এদিকে বলা হচ্ছে, কিশোর-তরুণদের খুন-ধর্ষণের মতো ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়ানোর প্রবণতা বাড়ছে। দেশের দুই কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী সেখানে থাকা কিশোরদের ২০ শতাংশ খুনের মামলায় আর ২৪ শতাংশ নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার আসামি। নারী ও শিশু নির্যাতন মামলাগুলোর বেশির ভাগই ধর্ষণের অভিযোগে করা। কিশোর অপরাধে জড়িয়ে পড়ার ওপর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এসব কিশোরের মধ্যে দরিদ্র পরিবারের সন্তান যেমনি আছে তেমনি রয়েছে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানও। গবেষণায় দেখা গেছে, ১৪ থেকে ১৬ বছর বয়সীরা অপরাধে বেশি জড়াচ্ছে। অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন, আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন, আকাশ সংস্কৃতি ও ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা তথ্য-প্রযুক্তি কিশোরদের অপরাধ প্রবণতা বাড়ার অন্যতম কারণ। মনোচিকিৎসক অধ্যাপক তাজুল ইসলাম মনে করেন, কিশোররা ইন্টারনেটে সংযোগসহ মুঠোফোন ব্যবহার করছে। তারা যা দেখছে বাস্তবে তা ঘটিয়ে বসছে। এ ঘটনা সম্পর্কে বিশিষ্টজনরা মনে করছেন, সামাজিক অবক্ষয়, অস্থিরতা ও পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় না থাকাতেই এ ধরনের ঘটনা বাড়ছে। তিনি মনে করেন, বর্তমানে কিশোরদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন নেই বললেই চলে। কিশোরদের এ ধরনের অপরাধে জড়ানো অশনিসংকেত বলেও তিনি মনে করেন। সব মিলে পরিস্থিতি এই যে, সমাজের অভিভাবক ও পিতামাতার এক ধরনের অবহেলা, দায়িত্বহীনতা সমাজকে যে কুরে কুরে খাচ্ছে তারই নতিজা হচ্ছে তরুণদের অবক্ষয়। বিষয়টি নতুন নয় এবং হঠাৎই ঘটেনি। একটু একটু করে আস্কারা পেয়ে এখন কিশোর তরুনরা উচ্ছন্নে যাবার চরম অবস্থায় এসে পৌঁছেছে।
প্রধানমন্ত্রী সে শ্রেণিকে সঠিক পথে পরিচালিত হওয়ার অনুকূলে কাজ করতে বলেছেন। সেই গুরুত্বপূর্ণ আহ্বানটিকে বাস্তবায়ন করতে গেলে সঙ্গতভাবেই এ প্রশ্ন উঠবে, কেন এই শ্রেণি এখন এ পথে আর এ জন্য কারাই বা দায়ী। অপরাধের দায় প্রত্যেকের নিজস্ব হলেও সামগ্রিকভাবে সমাজের অভিভাবক, রাজনীতিক এবং দায়িত্বশীলরা এর দায় থেকে মুক্ত থাকতে পারেন না। কারণ, এই সমাজ এরকম ছিল না। স্নেহ ভালোবাসা পারিবারিক বন্ধন সবই ছিল। তাহলে এই থাকা না থাকার মধ্যবর্তী অবস্থাটা খুঁজে বের করা দরকার। এটাও বলার অপেক্ষা রাখে না, সমাজে এখন কোন উৎকৃষ্ট উদাহরণ নেই। নেই ভালো কোনো শিক্ষক। অন্যদিকে শিক্ষা নৈতিকতা বর্জিত হওয়ার খেসারতই এখন দিচ্ছে সমাজ। ভ্রষ্ট তরুণদের সংক্রমণ থেকে সমাজের কোনো অভিভাবকই হয়তো মুক্ত নন। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আক্রান্ত। কার্যত সুপরিকল্পিত উপায়ে নতুন বংশধরদের নির্মূল করে দেয়া হচ্ছে, যা জাতির ভবিষ্যৎ প্রশ্নে অত্যন্ত উদ্বেগজনক। তরুণদের ধংস করে দেয়া হচ্ছে কি উপকরণে সেটিও আমাদের ভাবতে হবে। অতি অল্প দামে আমাদের তরুণদের অতল গহ্বরে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। আধিপত্য বাদীদের চক্রান্তে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের তরুণ সমাজ। আমরা মুখে তাদের উদ্ধারের কথা বললেও কার্যত আমাদের সকল প্রক্রিয়া-প্রবণতাই তাদের ধ্বংসের অনুবর্তী। এখন তরুণদের যে অবস্থা তাতে তাদের বাঁচানোই দায় হয়ে পড়েছে। বোধকরি মহান একুশের আলোচনা এবং তা থেকে প্রকৃত শিক্ষা নেয়া গেলে অবশ্যই তা তরুণদের উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হতে পারে। কারণ এই তরুণরাই সেদিন জীবনের মায়া ত্যাগ করে নিজের ভাষার সম্মান রক্ষার্থে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
আবদুল মতিন, প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম, অলি আহাদ, গোলম মাহবুব, অধ্যাপক আবদুল গফুর, গাজীউল হাসান, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীদের নাম যখন উচ্চারিত হয় তখন তাদের কোনো পরিচয়-পরিচিতির প্রয়োজন হয় না। যে কেউ একবাক্যে স্বীকার করবেন, ভাষা আন্দোলনের মহান কর্ণধারদের কথাই বলা হচ্ছে। তেমনিভাবে যখন শহীদ রফিক, শফিক, বরকতদের আলোচনা হয় তখনও বলে দেয়ার প্রয়োজন নেই এরা কোথায় কখন কী কারণে শহীদ হয়েছেন। একবাক্যে সকলে মিলে বলে উঠবেন মহান ভাষা শহীদদের কথাই বলা হচ্ছে। তেমনিভাবে তমুদ্দুন মজলিসের কথা উঠলেই আমরা স্মরণ করি মহান ভাষা আন্দোলনের স্থপতি সংগঠন হিসেবে। এর মূল কারণ ভাষার লড়াই ছিল এ দেশের মানুষের অস্তিত্বের লড়াইয়ের অংশ। প্রত্যেকের মন ছুঁয়ে গিয়েছিল। আজো আমরা প্রতিবছর ভাষা আন্দোলনের সেই রক্তঝরা দিনটিকে স্মরণ করি বিন¤্রচিত্তে, পরম শ্রদ্ধায় ও ভালোবাসায়। দেশের অলিগলি প্রান্তে সর্বত্রই পালিত হয় দিবসটি। কোনো সরকারি ফরমানের কারণে নয় বরং নিজের মায়ের ভাষার প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবেই। এই যে ভালোবাসা, গভীর শ্রদ্ধাবোধ এর মূলে রয়েছে প্রগাঢ় দেশপ্রেম। আজকের বাস্তবতাতে যদি ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে মৌলিক কিছু বিষয় উঠতে পারে। সে বিবেচনায় দেখার রয়েছে, যে চেতনা নিয়ে ভাষার আন্দোলন হয়েছিল সেই চেতনা এবং যে রাজনৈতিক আবহ গড়ে তোলার একান্ত অনুভব-অনুভূতি নিয়ে দেশের তরুণ ছাত্রসমাজ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তার প্রতি কি যথাযথ সম্মান আমরা করছি ? সংস্কৃতি রক্ষার লড়াই এখন গুরুতর হয়ে উঠেছে। দেশ বিজাতীয় সংস্কৃতির গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে যাচ্ছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যেন বিজাতীয়রাই ঠিক করে দিচ্ছে আমাদের পোশাক-আশাক। এমনকি সাংস্কৃতিক চিন্তা-চেতনার বিষয়াবলিও। আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে এবং আগ্রাসনে গোটা জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। সুস্থ সংস্কৃতি চর্চায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বিনোদনের জায়গা দখল করে নিচ্ছে অপসংস্কৃতি। বিদেশি এবং বিজাতীয় সংস্কৃতি। এখন দেশে ভারতীয় চ্যানেলগুলো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এসব চ্যানেলে বাংলাদেশকে উপস্থাপন করা হয় ওপার বাংলা হিসেবে। আমরা এর কোনো প্রতিবাদ করছি না। ব্যাপারটি যদি এমনই হবে তা হলে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রয়োজন কি ছিল? আমাদের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টরা এটি কোনো বিবেচনাতেই নিচ্ছে না। এই না নেয়ার মধ্যেই মূলত রয়েছে জাতীয় চিন্তা-চেতনার বিষয়টি। রাজনীতি কার্যত রুদ্ধ হয়ে পড়েছে এক ধরনের খামখেয়ালিপনায়। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, আজকের দিনের দিকে যদি তাকানো যায় তাহলে ভাষা আন্দোলনের নিবেদিত প্রাণদের দেখা যাবে একেকজন একেক দলে রয়েছেন অথচ ভাষার প্রশ্নে সেদিন তারা ঐক্যবদ্ধ ছিলেন। এই একবৃন্তে শত ফুল ফোটার মতো বাস্তবতা আজও সুস্থ সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক মেধা-মননের চর্চায় অতীব জরুরি।
একুশ ফেব্রুয়ারি আমাদের চেতনায় এমনভাবে মিশে আছে যে, আলাদা করে জানান দেয়ার প্রয়োজন নেই। বছরের দিনপঞ্জিতে যে কয়টা দিন কোনো ঘোষণার অপেক্ষা না করেই জাতীয় চেতনায় জাগরিত হয়ে উঠে মহান ভাষা দিবস তার একটি। রক্তের শিরায় শিরায় চেতনার গভীরতম প্রদেশে এই দিনটির অবস্থান বিধায় একে উপড়ে ফেলার কোনো সুযোগ নেই। বাংলা আমাদের ভাষা হওয়া সত্ত্বেও একুশ ফেব্রুয়ারিকে বাংলায় পরিণত করার মধ্যদিয়ে সম্ভবত একুশের সংস্কৃতির সাথে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির কিছুটা সমন্বয় করা হয়েছে। হয়তো এ বিবেচনায় বলা যায়, পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং আমাদের ভাষা আন্দোলন আন্তঃযোগ সূত্রে গ্রোথিত। গণতান্ত্রিক অধিকার বঞ্চনার প্রতিবাদের দাবি আর ভাষার দাবি সূত্রবদ্ধ। বাস্তব হচ্ছে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য রক্ত দেয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। অন্যদিকে ভাষার লড়াই এখন যতটা রাজপথে তার চেয়ে বোধ, বিশ্বাসের লড়াইয়ে অনেক বেশি চলমান। ভাষা দিবসের ভাষা নিয়ে কথা বলতে গেলে সঙ্গতই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির কথা উঠে আসবে। ব্যাপারটা হয়তো কারো কাছে অস্পষ্ট এবং কারো কাছে স্পষ্ট। যেভাবেই বলা যাক না কেন, আমাদের ভাষা, আমাদের সংস্কৃতি এবং এর অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই ঐতিহাসিককাল থেকেই ভিন্ন বাস্তবতায় বিবেচিত হয়ে আসছে। সে কারণেই প্রতিবারই ভাষা দিবস নতুন দাবি নিয়ে আমাদের সামনে উপস্থিত হয়। যেভাবে বা যে দাবি নিয়েই একুশ আমাদের কাছে আসুক না কেন, কেবলমাত্র আনুষ্ঠানিকতার বিবেচনায় একুশ পালন যে সঙ্গত নয় তার উল্লেখ না করাই যুক্তিসঙ্গত।
যেহেতু ভাষার ইজ্জত, সম্মান এবং মর্যাদা রক্ষার প্রয়োজনে আমাদের পূর্বসূরিরা নিজেদের সর্বোত্তম ভালোবাসার ধন জীবনকে উৎসর্গ করেছেন সে কারণেই আমাদের ভাষার অন্তর্নিহিত শক্তি অনস্বীকার্য। কেবলমাত্র মনের ভাব প্রকাশের যে বৈয়াকরণিক নীতি তার বাইরেও আমাদের ভাষা ভিন্ন কিছু। ভাষার দাবিতে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই কোনো ব্যাকরণে লিপিবদ্ধ নেই। তবু তা হয়েছে। এই বিধিভঙ্গের মধ্যদিয়ে জাতীয় যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল তার ইতিবাচক প্রভাবই আজকের বাস্তবতা। যে ভাষায় আমরা কথা বলি, যে ভাষায় আমরা নিজেদের জাহির করি তা টিকে আছে আমাদের মতোই নিরন্তর সংগ্রাম করে। প্রাকৃতজনের এই ভাষা হয়তো হারিয়ে যেত যদি না রাজনৈতিক বিজ্ঞজনদের হাতের ছোঁয়া পড়ত। সে বিবেচনায় ভাষা এবং রাজনীতির মধ্যে সেতুবন্ধন রয়েছে। বৃহত্তর অর্থে এটি হচ্ছে গণতান্ত্রিক। সুতরাং ভাষা সংস্কৃতি এবং গণতন্ত্রকে আমাদের দেশে আলাদা করে ভাবার সুযোগ খুব কম। গণতন্ত্রের অর্থ যদি বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হয় তাহলে অবশ্যই সেখানে মত প্রকাশের বিষয়টি সর্বাগ্রে বিবেচিত হবে। মত প্রকাশকে গণতান্ত্রিকতার প্রথম শর্ত মনে করা হয়। ভাষা হচ্ছে, মত বিনিময়ের মাধ্যম। পৃথিবীতে প্রতিটি প্রাণীরই ভাষা রয়েছে। পাখি মনের আনন্দে গান গায়। প্রাণীকূল তাদের ভাষায় কথা বলে। মানুষই একমাত্র সৃষ্টি যে তার মতের সাথে সুবিবেচিত সিদ্ধান্ত দেয়। কারণ, মানুষের চিন্তা করার ক্ষমতা রয়েছে। সে ভালো-মন্দ বিবেচনা করে। মতবিনিয়ের ব্যাপারটি এখানেই গুরুত্বপূর্ণ। এখানেই বহুমতের গুরুত্ব। বহুমতের মর্মার্থ হচ্ছে একদিকে বহু রাজনীতিকদের অস্তিত্ব এবং তাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী হওয়া, অন্যদিকে ভিন্নমতের প্রকাশকে শ্রদ্ধার সাথে দেখা। এটাই যে একুশের নিবেদিতপ্রাণ কর্মীদের মানসিকতা ছিল সেটি প্রমাণ করে তাদের রাজনৈতিক সহনশীলতা। ভাষা মতিন এবং গাজীউল হক কোনো বিবেচনাতেই এক রাজনৈতিক চিন্তার ছিলেন না। অথচ ভাষার প্রশ্নে তাদের ঐকমত্য ছিল। বিতর্ক ছিল তবে এটি প্রাধান্য পায়নি। অথচ আজকের বাস্তবতা হচ্ছে, মহান একুশকে আমরা সবাই গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি অথচ রাজনৈতিকভাবে বিরোধী মতকে দলন করাই যেন সরকারি দৃষ্টিভঙ্গি। এমনকি যে গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষা ছিল একুশের প্রাণ সেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রাণ গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথা শুনলেও সরকারের শীর্ষস্থানীয়দের মাথা গরম হয়ে যায়। তাহলে একুশের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের অর্থ কি দাঁড়াবে? কেবলই আনুষ্ঠানিকতা নয় কি? এটা কাম্য নয়, কাম্য হতে পারে না। এটাও হয়তো বলা সঙ্গত যে, আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া যখনই ব্যাহত হয়েছে, ভাষার চলার পথও আক্রান্ত হয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সকলেই একমত যে, গণতন্ত্রের সংকটকাল চলছে। কিন্তু কেন? এর দায় থেকে ক্ষমতাসীনদের মুক্তি থাকায় কোনো পথ খোলা নেই।
ব্রিটিশ আমলে এ অঞ্চলের মানুষের অধিকার আদায়ের রাজনৈতিক লড়াইয়ের কথা যখন স্মরণ করা হয় তখন সঙ্গতভাবেই আমাদের সামনে ফুটে ওঠে মওলানা আকরম খাঁ ও দৈনিক আজাদের কথা। কালের অমোঘ নির্দেশে মওলানা আকরম খাঁ বিদায় নিয়েছেন। সত্যিকারের উত্তরাধিকারী নির্বাচিত না হওয়ায় প্রবীণ বাংলা দৈনিক আজাদের প্রকাশনাও বন্ধ হয়ে গেছে। আমাদের জাতীয় জীবনের একটি অধ্যায়ই মূলত এখন আলোচনার বাইরে চলে গেছে। পাকিস্তান আমলে আমাদের গণতান্ত্রিক লড়াই অধিকারের কথা যখন উচ্চারিত হয় তখন মরহুম আবুল কালাম শামসুদ্দিন, মরহুম তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, আব্দুস সালাম, জহুর হোসেন চৌধুরী প্রমুখের নাম শ্রদ্ধার সাথে উঠে আসে। এ কথা বর্তমান প্রেক্ষাপটে বলা বোধহয় অমূলক নয় যে, সবকিছু সত্ত্বেও সে সময়ে যতটুক সহনশীলতা ছিল এখন বোধহয় ততটুকুও নেই। সে সময়কার পত্রপত্রিকা উল্টালেও দেখা যায়, নানাভাবে, নানা কৌশলে জনগণের পাশে তারা দাঁড়িয়েছেন। এমনকি সরকারের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বোধগম্য করে ঠিক বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন। কি সংবাদ পরিবেশন, কি সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয় সব ক্ষেত্রেই এমনকি আন্তর্জাতিক সংবাদ পরিবেশনের জন্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে মৌলিক চিন্তার স্বাক্ষর রেখেছেন। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে এবং গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের অনুকূলে জনমত গঠনের বিবেচনায় তাদের উদ্ভাবনী শক্তির কোনো তুলনা বোধহয় এখনও করা সম্ভব নয়। এখনও অনেকের মুখেই মরহুম আবুল কালাম শামসুদ্দিনের ’৫২-র ভাষা শহীদদের পক্ষে লেখা সম্পাদকীয়, মরহুম তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার মুসাফিরের কলাম আলোচনায় উঠে আসে। অনেকেই প্রাজ্ঞ কলামিস্টদের লেখা এবং সম্পাদকীয় পড়ে নিজেদের করণীয় নির্ধারণ করতেন। শাসকরাও প্রকৃত বিবেচনায় ওই সকল কলামকে সমীহ করতেন। সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায়, সংবাদপত্র যেহেতু পরিশীলিত গণতান্ত্রিক চেতনা সমৃদ্ধ এবং সংবাদপত্রে যারা দায়িত্ব পালন করেন তারাও যেহেতু সচেতন রাজনীতিক বোধসম্পন্ন সে কারণেই হয়তো সে সময় গণতান্ত্রিক চেতনাবোধসম্পন্ন জনগণ এসব কলাম পড়ে নিজেদের উদ্দীপ্ত করতেন, চেতনায় সমৃদ্ধ হতেন।
সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চা না থাকার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সমাজের সর্বত্র। সমাজদেহকে এটা কুরে কুরে খেতে শুরু করেছে। একুশের চেতনা এই বাস্তবতার সম্পূর্ণ বিপরীত। মানুষের সাম্য ও ন্যায্যতার ঘোরতর সমর্থক হচ্ছে একুশ। মানুষে মানুষে কৃত্রিম ব্যবধান রেখে একটি সভ্য-সহমর্মী সমাজ গঠন সম্ভব নয়। রাজনৈতিক সহনশীলতা না থাকলে পরিবারেও এটা প্রায় অসম্ভব। আমাদের সমাজদেহে বিরূপ রাজনীতির যে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে তা থেকে মুক্তি পেতেই একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক ধারা প্রবর্তন জরুরি। এ কথা যদি সংশ্লিষ্টরা অনুভব করেন, তাহলেই সেটি হবে একুশের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।