Inqilab Logo

শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

ট্রাম্প যুগে চ্যালেঞ্জের মুখে বিশ্বায়ন

উপ-সম্পাদকীয়

| প্রকাশের সময় : ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মেহেদী হাসান পলাশ : খুব সংক্ষেপে বললে বলা যায়, অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিশ্বব্যাপী বিস্তৃতিকে বিশ্বায়ন বা গ্লোবালাইজেশন বলা হয়। তবে আজকের দিনে অর্থনীতি ছাড়াও রাজনীতি, সমাজব্যবস্থা, কৃষ্টি, গবেষণা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, যোগাযোগ, কৃষি, পরিবেশ, সংস্কৃতি, বিনোদন, শিক্ষা প্রভৃতি প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের বিপুল প্রভাব লক্ষণীয়। বিশ্বায়ন একদিনে আবিষ্কৃত কোনো তত্ত্ব নয়। মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের মধ্যেই বিশ্বায়নের বীজ লুক্কায়িত ছিল অথবা মানব সভ্যতার বিকাশের পাশাপাশি চলেছে বিশ্বায়ন। তবে আধুনিক বিশ্বে বিশ্বায়ন বলতে যা বুঝি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তার রূপ স্পষ্ট হয়েছে ও ক্রমবিকাশ ত্বরান্বিত হয়েছে। বিশেষ করে তথ্য, যোগাযোগ ও যোগাযোগ  প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে বিশ্বায়ন ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি ঘটেছে। আইএমএফ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, ডব্লিউটিওর মতো সংস্থাগুলো বিশ্বায়ন ব্যবস্থাকে এগিয়ে নিয়েছে। একই সাথে নাফটা, সাফটা, বিমসটেক, আশিয়ান প্রভৃতি আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক জোট বিশ্বায়ন ধারণারই সৃষ্টি। বিশ্বায়ন নিয়ে যে সমালোচনা নেই তা কিন্তু নয়। বিশ্বায়নের এই জয়জয়কার অবস্থার মধ্যেই দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের অর্ধেক সম্পদ মাত্র ১০ জন ধনী ব্যক্তির দখলে। অনেক বিশেষজ্ঞই বিশ্বায়ন ব্যবস্থার সমালোচনা করেছেন। বিশ্বায়ন ব্যবস্থার প্রসারে পাশ্চাত্যের দেশগুলো বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী ভূমিকা রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন এককেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা সৃষ্টিতে বিশ্বায়নের জোরালো ভূমিকা রয়েছে। বিশ্বায়নের সৃষ্টি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও প্যাক্টগুলো যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারে প্রভূত ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু নতুন নির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্টের রক্ষণশীল নীতি ও উগ্র জাতীয়তবাদের মুখে আজ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বিশ্বায়ন নীতি- ব্যবস্থা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে মার্কিন সরকারসমূহ রাষ্ট্র পরিচালনায় এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে যে নীতির ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখেছে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড জে ট্রাম্প দায়িত্ব নেয়ার পর সেই ধারাবাহিকতা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছেন। নির্বাচনী প্রচারণায় ট্রাম্প প্রবলভাবে মার্কিন স্বার্থকে গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করেছিলেন ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি। এই নীতির মূল লক্ষ্য, দেশে এবং বিদেশে সর্বক্ষেত্রে মার্কিন নীতি ও স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া। ট্রাম্পে যুগের আগেও মার্কিনীরা নিজ দেশের স্বার্থকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে এসেছে। কিন্তু বিশ্ব মোড়লীপনা করতে গিয়ে তাকে বিভিন্ন স্থানে অন্যদেরকেও একমডেট করতে হয়েছে, সুযোগ দিতে হয়েছে। কিন্তু ট্রাম্প চাইছেন এই ব্যবস্থাও ভেঙে দিতে। কতটুকু সক্ষম হবেন তা নিশ্চিত করে বলা এখনই সম্ভব নয়। ট্রাম্প এগিয়ে চলছেন তার নীতিতে।
ক্ষমতা গ্রহণের তিন দিনের মাথায় ট্রাম্প নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় ১২ দেশের অংশীদারিত্ব চুক্তি ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নেন। ট্রাম্পের মতে, টিপিপি চুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের ‘কর্মসংস্থান হত্যাকারী’ এবং ‘স্বার্থের ধর্ষণকারী’। নির্বাচনী প্রচারণার সময় দেওয়া ট্রাম্পের প্রতিশ্রুতিগুলোর মধ্যে টিপিপি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেওয়া ছিল অন্যতম। এ ছাড়া তিনি উত্তর আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (নাফটা) থেকেও যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের সদ্য সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রশাসনের সময় ২০১৫ সালে ১২টি দেশের মধ্যে টিপিপি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। স্বাক্ষর করা দেশগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ব্রুনেই, কানাডা, চিলি, জাপান, মালয়েশিয়া, মেক্সিকো, নিউজিল্যান্ড, পেরু, সিঙ্গাপুর ও ভিয়েতনাম। বিশ্ব অর্থনীতির ৪০ শতাংশ এই দেশগুলোর দখলে। তবে ওই চুক্তি এখনো কার্যকর হয়নি। মার্কিন কংগ্রেসও চুক্তি অনুসমর্থন করেনি। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নিজেকে প্রত্যাহার করে নেওয়ায় চুক্তিটি অনেকাংশেই অকার্যকর হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এদিকে টিপিপি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরিয়ে নেয়ার ঘটনায় এই ভিয়েতনাম, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলো চায়নার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। সুযোগ চায়নাও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোতে তার প্রভাব বিস্তারে এগিয়ে এসেছে। ফলে ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্তটি যুক্তরাষ্ট্রের অনুকুলে যাবে কিনা তা নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।
ট্রাম্পের নির্বাচনীর প্রচারণার একটি বড় অংশ ছিল অভিবাসী বিরোধী অবস্থান। অভিবাসীর দেশ যুক্তরাষ্ট্রে তার এ অবস্থান অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। কিন্তু তিনি ঝুঁকিটা নিয়েছিলেন এবং জয়লাভ করেছেন তাতে। নির্বাচনে জয়লাভ করার পর এখন ট্রাম্প চাইছেন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী স্রোত বন্ধ করতে। সেজন্য তিনি  দীর্ঘ দিনের বন্ধু ও প্রতিবেশী রাষ্ট্র মেক্সিকোর সাথে দেয়াল তুলে দিতে। দুই দেশের মধ্যে সীমান্তের দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৯০০ মাইল, তা নির্মাণে খরচ ১ হাজার ৫০০ কোটি ডলার পেরিয়ে যাবে। ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, এই পুরো অর্থ আসবে মেক্সিকো থেকে। কিন্তু মেক্সিকো জানিয়ে দিয়েছে, এর জন্য এক পয়সাও দেবে না। সে কথা শুনে ট্রাম্প নতুন প্রস্তাব করেছেন, মেক্সিকো থেকে রপ্তানি করা প্রতিটি পণ্যের ওপর ২০ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক ধার্য করা হবে। এ কথার অর্থ, দেশের সাধারণ মানুষকেই সেই টাকা জোগাতে বাধ্য করা হবে। রক্ষণশীল রিপাবলিকান নেতৃত্ব এতে আপত্তি তুলেছে। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত ম্যাক্সিকান অভিবাসীদের পাঠানো অর্থের ওপর কর আরোপের মাধ্যমে তাঁর দেয়ালের জন্য অর্থ সংগ্রহের ইঙ্গিতও দিয়েছেন ট্রাম্প। এতে অভিবাসীদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে দীর্ঘদিনের বন্ধু রাষ্ট্র মেক্সিকোতে প্রবল সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। ট্রাম্প মেক্সিকোকে কড়া ভাষায় সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্রমুখী অভিবাসীদের স্রোত থামাতে মেক্সিকান সেনাবাহিনী নিয়োগের আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, তারা অসমর্থ হলে তিনি মার্কিন সেনাবাহিনী পাঠাবেন। তার এ বক্তব্য নিয়ে দেশেই প্রবল সমালোচনা হয়েছে। ডেমোক্রেটিক সিনেটর বেন কারডিন বলেছেন, সাত দিনও হয়নি, আর এরই মধ্যে ট্রাম্প আমাদের সবচেয়ে নির্ভরশীল মিত্রের সঙ্গে বিরোধ পাকিয়ে বসেছেন। ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় ভাষ্যকার জেনিফার রুবেন লিখেছেন, ‘ট্রাম্প তাঁর অভ্যাস না বদলালে খুব বেশি মিত্র আর আমাদের পাশে থাকবে না।’
একই বিষয়ে কথা বলায় ট্রাম্প মুখের উপর টেলিফোন কেটে দিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম টার্নবুলের। ট্রাম্পের পূর্বসূরি ওবামা প্রশাসনের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার শরণার্থী পুনর্বাসন চুক্তি হয়। ওই চুক্তি অনুযায়ী অস্ট্রেলিয়ায় আশ্রয় চাওয়া এক হাজার ২৫০ জন শরণার্থীকে যুক্তরাষ্ট্রে পুনর্বাসন করার কথা। অস্ট্রেলিয়া দীর্ঘদিন ধরেই শরণার্থীদের গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে। দেশটি শরণার্থীদের প্রশান্ত মহাসাগরীয় নাউরু ও পাপুয়া নিউগিনিতে শরণার্থী শিবিরগুলোতে আটকে রেখেছে। এসব শরণার্থীর বেশিরভাগই ইরান, ইরাক ও আফগানিস্তানের। দুই নেতার টেলিফোন কথোপকথনে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী টার্নবুল শরণার্থী পুনর্বাসন চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে স্পষ্ট ধারণা পেতে চান। গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেছেন, শরণার্থীদের গ্রহণ করার মানে হলো যুক্তরাষ্ট্র ‘বোস্টনের পরবর্তী হামলাকারীকে’ গ্রহণ করা। যদিও বোস্টনের হামলাকারীরা ছিল রাশিয়ার ককেশাস অঞ্চলের। জ্যেষ্ঠ মার্কিন কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাম্প ও টার্নবুলের মধ্যে এক ঘণ্টা ব্যাপী ওই ফোনালাপ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ট্রাম্প ২৫ মিনিট পরই ফোন কেটে দেন। ধারণা করা হচ্ছে, শরণার্থী নিয়ে কথা বলায় ট্রাম্প এ ব্যবহার করেছেন অস্ট্রেলিয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ট্রাম্পের অভিবাসী নীতির মূল লক্ষ্য মুসলিম শরণার্থী। তিনি যে কোনো মূল্যে যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিম শরণার্থী প্রবেশ বন্ধে বদ্ধপরিকর। গত ২৭ জানুয়ারি হলোকস্ট স্মরণ দিবসে ট্রাম্প অভিবাসন প্রশ্নে দুটি নির্বাহী আদেশ দিয়েছেন। প্রথমটিতে সিরিয়া থেকে উদ্বাস্তু গ্রহণের ব্যাপারে পরবর্তী সিদ্ধান্ত না নেওয়া পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। অন্য সব দেশের উদ্বাস্তুদের ক্ষেত্রে এই নিষেধাজ্ঞা চালু থাকবে পরবর্তী ১২০ দিনের জন্য। দ্বিতীয় নির্দেশে সাতটি আরব দেশ থেকে মুসলিমদের ভিসা দেওয়ার ব্যাপারে অত্যন্ত কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। দেশগুলো হলো : ইরাক, ইরান, সিরিয়া, ইয়েমেন, সুদান, লিবিয়া ও সোমালিয়া। যেসব দেশের সঙ্গে ট্রাম্পের ব্যবসায়িক সম্পর্ক আছে; যেমন সৌদি আরব, মিসর, জর্ডান; তাদের ক্ষেত্রে অবশ্য এই কড়াকড়ি আরোপ হবে না। এর আগেই এক নির্দেশে ট্রাম্প অবৈধ অভিবাসীদের বহিষ্কারের লক্ষ্যে অতিরিক্ত কর্মী নিয়োগের নির্দেশ দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের যেসব শহর অবৈধ অভিবাসীদের গ্রেপ্তারে সহযোগিতা করবে না, তাদের বাধ্য করতে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী নিয়োগ করা হবে। নিউইয়র্ক, লস অ্যাঞ্জেলেসসহ অনেক শহরের মেয়ররা জানিয়েছেন,  ট্রাম্পের নির্দেশ সত্ত্বেও তাঁরা ফেডারেল সরকারের সঙ্গে এ ব্যাপারে কোনো সহযোগিতা করবেন না। সত্যি সত্যি যদি অবৈধ অভিবাসী ঘেরাও করার লক্ষ্যে ট্রাম্প ফেডারেল বাহিনী পাঠান, তাহলে ফেডারেল সরকারের সঙ্গে অঙ্গরাজ্য পর্যায়ে বড় ধরনের বিরোধের সূত্রপাত হতে পারে। ট্রাম্পের এই নির্দেশ যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাইরেও বিভিন্ন দেশে প্রবল সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। এমনকি নিজ দলের অনেক রিপাবলিক্যানও ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তে খুশী হতে পারেননি। তার এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন পূর্বসূরী প্রেসিডেন্ট ওবামা এবং প্রতিদ্বন্দ্বী ও পরাজিত প্রেসিডেন্ট প্রার্থি হিলারী ক্লিনটন। টুইটে তিনি লিখেছেন, আমাদের মূল্যবোধ এবং সংবিধানের পক্ষে আজ রাতে যারা বিক্ষোভে সমবেত হয়েছেন আমি তাদের পক্ষে আছি। হিলারি আরও লেখেন, এটা আমাদের সত্যিকারের পরিচয় নয়। ডেমোক্রেটিক পার্টির সিনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেন ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের কড়া সমালোচনা করে বলেছেন, এতে আমেরিকান মূল্যবোধের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। সিনেটর কমলা হ্যারিস বলেছেন, এই আদেশ আসলে মুসলিমদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা। ট্রাম্পের এই নির্দেশের সমর্থকরা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে জঙ্গি তৎপরতা রোধ করতেই ট্রাম্পের এই কঠোর অবস্থান। অন্যদিকে বিরোধিতাকারীরা বলেছেন, এর ফলে বরং জঙ্গি তৎপরতা আরো বাড়বে। যাইহোক, ট্রম্পের এই নির্দেশের ফলে জার্মনি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের মতো মিত্র দেশেও ট্রাম্পের সমালোচনা হচ্ছে। যুক্তরাজ্যে ট্রাম্পের আসন্ন সফর বাতিলের দাবী উঠেছে। এরপক্ষে ১০ লক্ষাধিক লোক আবেদনে স্বাক্ষর করেছেন। ফলে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে। প্রথম দিকে এড়িয়ে যেতে চাইলেও পরবর্তীতে জনগণের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে থেরেসা মে বলতে বাধ্য হয়েছেন, আমেরিকার এই নীতি ভুল বলে মনে করে ব্রিটিশ সরকার। আমরা এই পথে হাঁটব না। ৬ বছর ধরে স্বরাষ্ট্র সচিব থাকার সময়ও কখনও এই নীতি অনুসরণ করিনি। আমরা মনে করি আমেরিকার এই সিদ্ধান্ত ভুল। এতে শুধু বিভেদ বাড়বে। এদিকে ট্রাম্পের এই ঘোষণার পর যুক্তরাষ্ট্রে ও যুক্তরাষ্ট্রের বাইরেও ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ বেড়েছে আরো। যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে মসজিদে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। কানাডা নামাজরত মুসল্লিদের উপর গুলি বর্ষণে ৬ জন নিহত ও ৮ জন আহত হয়েছেন। ট্রাম্পের ইসলামবিরোধী নীতির পরোক্ষ প্রভাবে এ ঘটনা ঘটেছে বলে মনে করছে অভিজ্ঞমহল। অবশেষে যুক্তরাষ্ট্রের একটি আদালত ট্রাম্পের অভিবাসী সংক্রান্ত আদেশ স্থগিত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের একমাত্র লক্ষ্য হতে যাচ্ছে ইসলাম। ইসলামী চরমপন্থাকে টার্গেট করে সরকারি নীতি গ্রহণ করছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সব ধরনের সহিংস মতাদর্শ মোকাবিলায় মার্কিন সরকারের প্রচলিত একটি কর্মসূচিকে বদলে এখন কেবল ইসলামের বিরুদ্ধেই ফোকাস করা হচ্ছে। ট্রাম্প প্রশাসনের এ পরিকল্পনার বিষয়ে জ্ঞাত পাঁচজন কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে এ তথ্য জানিয়েছেন। সহিংস চরমপন্থা মোকাবেলায় মার্কিন সরকারের কর্মসূচির নাম ‘কাউন্টারিং ভায়োলেন্ট এক্সট্রিমিজম’ (সিভিই)। এই কর্মসূচির নাম পরিবর্তন করে ‘কাউন্টারিং ইসলামিক এক্সট্রিমিজম’ (ইসলামী চরমপন্থা মোকাবেলা) অথবা ‘কাউন্টারিং রেডিক্যাল ইসলামিক এক্সট্রিমিজম’ রাখা হবে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রে বোমা ও বন্দুক হামলায় জড়িত শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে এ কর্মসূচি আর ব্যবহার করা যাবে না বলে জানিয়েছে রয়টার্স। এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নির্বাচনী প্রচারণাকালে ট্রাম্প যে মনোভাব ব্যক্ত করেছিলেন তার প্রতিফলন ঘটল। এতে বোঝা যাচ্ছে, ট্রাম্পের মূল টার্গেট হচ্ছে ইসলাম। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের অনুসৃত নীতিরও পরিবর্তন আনতে যাচ্ছেন ট্রাম্প। এতে করে ইরান, ইরাক, সিরিয়া, তুরস্ক, ইয়েমেন, লিবিয়া, মিশরের মতো দেশগুলোর সাথে রাশিয়ার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হবার সুযোগ সৃষ্টি হবে। এসব দেশে আগের চেয়ে অনেক বেশি চাইনিজ অর্থনৈতিক আধিপত্য বৃদ্ধি পাবে যা দীর্ঘ মেয়াদে মার্কিন স্বার্থের অনুকূল নাও হতে পারে।
অন্যদিকে রাশিয়ার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের পররাষ্ট্র নীতিতে পরিবর্তন সময়ের ব্যাপার মাত্র। ইউক্রেনে হামলার পর রাশিয়ার উপর যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার দিকে ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন ট্রাম্প। তিনি মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্ব পরিচালনায় রাশিয়ার সাথে সমঝোতা করেই চলতে চাইছেন। বিশ্বের দুই প্রবল পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া যদি নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও শত্রুতা ভুলে একসাথে চলতে চায় শান্তিকামী মানুষের তাতে খুশী হওয়ার কথা। বাস্তবে এর আড়ালে রয়েছে অন্য খেলা। যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরেই রাশিয়াকে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ও শত্রু গণ্য করে আসছে। কিন্তু ট্রাম্প সেই নীতির পরিবর্তন করে ইসলামকেই প্রধান টার্গেট করতে চাইছে এবং ইসলাম দমনে রাশিয়াকে পাশে পেতে চাইছে। একইসাথে চায়নার বিরোধী তৎপরতায় রাশিয়াকে নিষ্ক্রিয় রাখতে চাইছে। কিন্তু রাজনীতি ঝানু খেলোয়াড় মি. পুতিন ট্রাম্পের সেই বাড়ানো হাত কতোটা আন্তরিকতার সাথে ধরবেন তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
খবরে প্রকাশ গর্ভপাত, সমকামী বিবাহ ও লিভ টুগেদার বন্ধ করে ধর্মীয় বিবাহের উপর জোর দিতে নির্বাহী আদেশ দিতে চলেছেন ট্রাম্প। মূলত তিনি ধর্মীয় রক্ষণশীলদের কাছে টানতে চাইছেন এর মাধ্যমে। শুধু তাই নয়, গির্জাগুলোর রাজনৈতিক অধিকার ফিরিয়ে দেয়ারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৫৪ সালের একটি আইনে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গির্জাসহ অন্যান্য করমুক্ত প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এটি জনসন সংশোধনী নামে পরিচিতি। কিন্তু ওয়াশিংটন ডিসিতে দেশটির বার্ষিক জাতীয় প্রার্থনায় অংশ নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প ধর্মীয় নেতাদের উদ্দেশে বলেন, ধর্মীয় স্বাধীনতা একটি পবিত্র অধিকার। কিন্তু এটি আমাদের চারপাশে হুমকি হয়ে আছে। এ কারণে আমি ‘জনসন সংশোধনী’ পুরোপুরি বাতিল করতে চাই। যাতে করে সবাই কোনো ভীতি ছাড়া স্বাধীনভাবে কথা বলার সুযোগ পায়।
এককথায় শপথ নেয়ার ১৫ দিনের প্রতিটি দিনেই এমন কোনো কোনো সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন ট্রাম্প যাকে এক কথায় লঙ্কাকা- বলা যায়। এ নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে দেশটির অভ্যন্তরে ও গণমাধ্যমে। গণমাধ্যমগুলোর উপর বেজায় নাখোশ তিনি। একহাত নিয়েছেন গণমাধ্যমকেও। লক্ষ্য করলে স্পষ্ট প্রতীয়মান হবে, ট্রাম্পের সকল কর্মকান্ডের মূলে রয়েছে মার্কিনী রক্ষণশীল চিন্তা, উগ্র জাতীয়তাবাদ ও খ্রিস্টবাদ। এইসব চেতনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তিনি এমন সব কর্মকা- করছেন বা করার ঘোষণা দিচ্ছেন যা নিয়ে সংশয় ও শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে। বিগত এক শতাব্দী ধরে বিশ্বে যে উদার নৈতিকতা, মুক্ত চিন্তা, বিশ্বায়ন ও মুক্তবাজার ব্যবস্থায় পরিচালিত হয়ে আসছিল, ট্রাম্পের অনুসৃত নীতি তাতে ছেদ টানবে। এতে বিশ্ব এক নতুন মেরুকরণ ও নতুন ব্যবস্থার মাধ্যমে পরিচালিত হবার পথ সৃষ্টি হবে। সেটা ভাল হবে না মন্দ হবে তা এখনই বলার সময় আসেনি। তবে অবসরপ্রাপ্ত মার্কিন সেনা কর্মকর্তা জেনারেল ডেভিড পেট্রাউস ট্রাম্পের বিশ্বনীতির সমালোচনা করে ১ ফেব্রুয়ারি মার্কিন সংসদ কংগ্রেসকে এ হুঁশিয়ারি দিয়ে  বলেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়কালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি করা বিশ্বব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে। তিনি কংগ্রেসের সশস্ত্র সেবা কমিটিকে বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়কালে গড়ে ওঠা বিশ্বব্যবস্থা ইতিমধ্যেই নানা দিক থেকে অভূতপূর্ব হুমকির সম্মুখীন হতে শুরু করেছে। আর আমেরিকানদের উচিত নয় চলমান আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলাকে যেমন আছে তেমন ভাবেই অব্যাহত রাখা। এই শৃঙ্খলা নিজে নিজে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আমরা এই ব্যবস্থাকে সৃষ্টি করেছি। ফলে এটি নিজে নিজেই টিকে থাকতেও সক্ষম নয়। আমরাই এতদিন একে টিকিয়ে রেখেছি। আর আমরা যদি এখন তা করা বন্ধ করে দিই তাহলে এই ব্যবস্থা বিশৃঙ্খলায় নিপতিত এবং পরিণতিতে ভেঙে পড়বে। অবসরপ্রাপ্ত এই মার্কিন জেনারেল ইরাক যুদ্ধে মার্কিন বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এরপর তিনি সিআইএ এর প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ট্রাম্প প্রশাসন যে একলা চলো এবং সংরক্ষণবাদী নীতি অবলম্বন করছে এর বিরুদ্ধেও তিনি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। এর পরিবর্তে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়কাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র দুনিয়াব্যাপী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে মিশন চালিয়ে আসছে তা অব্যাহত রাখার পরামর্শ দেন তিনি। পেট্রাউস বলেন, বিশ্ব শান্তি বজায় রাখার জন্য আমরা বৈশ্বিক মিত্রতার একটি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্ঠায় নেতৃত্ব দিয়েছি। এ ছাড়া মার্কিন সামরিক ক্ষমতার বলয়ে নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং ইউরোপ ও এশিয়ায় মার্কিন ঘাঁটি স্থাপিত হয়েছে। বিশ্ব সমৃদ্ধির জন্য আমরা একটি উদার, মুক্ত এবং নিয়মভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছি। আর আমাদের নিজেদেরকে সুরক্ষিত করার জন্যই আমরা এমন একটি পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করেছিলাম যার লক্ষ্য ছিল বিশ্বব্যাপী স্বাধীনতা এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় উৎসাহ-উদ্দীপনা যোগানো এবং সহযোগিতা করা। পেট্রাউসের এই বক্তব্য ট্রাম্প ও যুক্তরাষ্ট্রের আইনপ্রণেতা, নীতি নির্ধারক ও প্রশাসনের উপর কতোটুকু প্রভাব ফেলে তা দেখতে বিশ্ববাসীকে আরো কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে।
email: [email protected]



 

Show all comments
  • সনিয়া ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:৪২ পিএম says : 0
    দেখা যাক শেষ পর্যন্ত ট্রাম্প কী করতে পারে?
    Total Reply(0) Reply
  • হাসিব ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:৪৭ পিএম says : 0
    আমেরিকার জন্য ট্রাম্প ভালো খারাপ যা ই হোক না কেন, মুসলমানদের জন্য সে কখনওই ভালো কিছু করবে না।
    Total Reply(0) Reply
  • Fahim ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:৫৪ পিএম says : 0
    maje maje abar tini U turn nen.
    Total Reply(0) Reply
  • Md. Ismail hossain ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ৩:০৩ পিএম says : 0
    ট্রাম্প মুসলমানদের জন্য সে কখনওই ভালো কিছু করবে না
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ