Inqilab Logo

শুক্রবার, ০৫ জুলাই ২০২৪, ২১ আষাঢ় ১৪৩১, ২৮ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

শত শত ট্রাক্টরে গোমতীর দুই পাড়ের মাটি যাচ্ছে প্লট ভরাট আর ইটভাটায়

| প্রকাশের সময় : ৩১ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

সাদিক মামুন, কুমিল্লা থেকে  : কুমিল্লার গোমতী নদীর দুই পাড়ের মাটি কেটে সাবাড় করে দিচ্ছে সিন্ডিকেটের লোকজন। শীত মৌসুম এলেই সিন্ডিকেটের লোকজন গরম হয়ে ওঠে। স্থানীয়দের কাছে সিন্ডিকেটধারীরা নিজেদের আওয়ামী লীগের লোকজন বলে পরিচয় দিয়ে থাকে। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাটিকাটা সিন্ডিকেটধারীরা যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে সেই সরকারের দলীয় পরিচয় বহন করে।
গোমতীপাড়ের বাসিন্দাদের মতে ওরা এখন ‘শুষ্ক মৌসুমের আওয়ামী লীগ’। দিনের আলোতে ওরা মাটিকাটা কাজ খুব একটা তদারকি করতে আসেননা। কারণ দিনের বেলায় কখনো কখনো ম্যাজিস্ট্রেটের অভিযান হয়ে থাকে গোমতী পাড়ে। তাই ওরা সন্ধ্যার পর থেকেই আটঘাট বেঁধে মাটিকাটার সার্বিক দিক তদারকি করে। আর দিনের বেলায় সিন্ডিকেটের বেতনভুক্ত কিছু লোক রয়েছে যারা মাটিকাটা দেখভাল করে।
দিনে-রাতে শত শত ট্রাক্টরযোগে গোমতীপাড়ের মাটি যাচ্ছে ইটভাটা আর প্লটভরাটের কাজে। কুমিল্লা সদর থেকে মুরাদনগর পর্যন্ত গোমতী নদীর প্রায় ৫০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে গত দুই মাস ধরে চলছে ওই কথিত সিন্ডিকেটের মাটিকাটা বাণিজ্য। এক এক করে ট্্রাক্টর নামছে গোমতী নদীর পাড়ে। কোদাল আর ভেলচায় কেটে ট্রাক্টরে তোলা হচ্ছে মাটি। নদীর পাড় থেকে মূল রাস্তায় উঠা-নামার জন্য বিকল্প পথও তৈরি করা হয়েছে বাঁধ কেটে। গতকাল কুমিল্লা সদরের চাঁনপুর ব্রিজের খানিকটা উত্তর-পশ্চিমে ছত্রখীল পুলিশ ফাঁড়ির সামনে দিয়ে মাটিভর্তি এসব ট্রাক্টর একের পর এক রাস্তায় উঠে গন্তব্যে চলে যেতে দেখা যায়। প্রতিদিনই গোমতী পাড়ের মাটিভর্তি ট্রাক এ রাস্তায় চলাচল করছে। চোখে দেখলেও অবৈধভাবে মাটি কাটার এ কাজটি বন্ধ বা ট্রাক্টর আটকের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারছে না ফাঁড়ি পুলিশ। কারণ গোমতীপাড়ের বাসিন্দাদের ভাষায় মাটি ভরাট ট্রাক্টর নিয়ন্ত্রণকারীরা এখন ‘শীতকালীন মাটিকাটা আওয়ামী লীগ’। হয়তো পুলিশও এমনটি ভেবে কিছু করতে পারছে না। নয়তো তারাও মাটিকাটা সিন্ডিকেটের সঙ্গে ‘অলিখিত চুক্তিতে’ আবদ্ধ হয়ে গেছেন। তবে এবারের মৌসুমে কুমিল্লা পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা গোমতীপাড়ে খুব একটা পা রাখেননি। আর মাটি কাটা বন্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানও আগের মতো জোরালো হয়নি। ফলে সিন্ডিকেট বেশ খোঁজ মেজাজেই চালাচ্ছে তাদের মাটি চুরির বাণিজ্য।  
শীতের মৌসুম এলেই গোমতী নদীর কুমিল্লা সদরের পূর্বদিকের উত্তরাংশের গোলাবাড়ি এবং দক্ষিণাংশের কটকবাজার এলাকা থেকে শুরু করে বুড়িচং হয়ে প্রায় ৫০ কিলোমিটার বিস্তীর্ণ মুরাদনগর পর্যন্ত দুই পাড়ের মাটি কাটা বাণিজ্য শুরু হয়। গত দুইদিন গোমতী নদীর পাড় ঘুরে দেখা গেছে, কুমিল্লা সদরের গোমতী নদীর উত্তরপাড়ের পাঁচথুবীর গোলাবাড়ি এলাকা হয়ে শাহপুর, সূবর্ণপুর, শালধর, গোমতী বেইলি ব্রিজের নিচের অংশে, ছত্রখীল পুলিশ ফাঁড়ির সামনের অংশে, শীমপুর সড়ক, বানাসুয়া থেকে বুড়িচং উপজেলার গোবিন্দপুর ব্রিজ হয়ে কুমিল্লা সদরের দক্ষিণপাড়ের দুর্গাপুর, আড়াইওড়া, আমতলী, পালপাড়া, বদরপুর, কাপ্তানবাজার, চাঁনপুর, টিক্কারচর, বাঁজগড্ডা, জগন্নাথপুর কটকবাজার এলাকায় নদীরপাড়ের মাটি কেটে নিয়ে শত শত ট্রাক্টর বাঁধ কেটে তৈরি পথে রাস্তায় উঠে নির্দিষ্ট গন্তব্যে যাচ্ছে। আবার খালি ট্রাক্টর এসে জড়ো হচ্ছে নদীর পাড়ে। গোমতীর মাটি কেটে নদীর পাড়, বাঁধ, ফসলী জমি ও গাছপালার কী সর্বনাশ করছে চোখে না দেখলে বুঝা যাবে না। কোন কোন এলাকায় দেখা গেছে নদীর পাড়ের কাছাকাছি জায়গায় তাল, নারকেল, খেজুর, আমগাছ, বাঁশঝাড় স্থানে শ্রমিকরা কোদাল বসিয়ে সেখানকার মাটি এতো গভীরভাবে সাবাড় করেছে দেখলে মনে হবে ওইসব গাছপালা খ- খ- টিলার উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। গোমতী নদীর পাড় অনেকটা উঁচু। অনেকেই এসব উঁচু ভূমির কোনো কোনো অংশে চাষাবাদ করে থাকেন। কিন্তু পাড়ের মাটি কেটে নেয়ায় এসব জায়গায় সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় গর্ত। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গোমতী বাঁধে সিটি কর্পোরেশনের এমজিএস প্রজেক্টের আওতায় আমতলী থেকে টিক্কাচর পর্যন্ত বাইপাস সড়ক নির্মাণ কাজ চলমান থাকায় নদীর দক্ষিণাংশে পাড়ের মাটি কাটা দিনের বেলায় বন্ধ থাকে। তবে সন্ধ্যারাতে শুরু হয় শতশত ট্রাক্টরের মাটি নেয়ার পালা। নদীর উত্তরাংশেও রাতের বেলায় পাড়ে জমে ওঠে ট্রাক্টরের মেলা।    
গোমতী নদীর কুমিল্লা সদরের দুর্গাপুর, পাঁচথুবি ও আমড়াতলি ইউনিয়নের ওইসব এলাকার বাইরে মুরাদনগর উপজেলায় কোম্পানীগঞ্জ, বাখরাবাদ, দনিরামপুর, জাহাপুর, দেবিদ্বার উপজেলা অংশে জাফরগঞ্জ, বড় আলমপুর, বিনাইপাড়, বালিবাড়ি, ভিংলাবাড়ি এবং বুড়িচং উপজেলার কংশনগর, গোবিন্দপুর, রামপুরেও চলছে নদীর পাড়ের মাটি কাটার মহোৎসব। গোমতী পাড়ের মাটি বহনকারি ট্রাক্টর চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এসব মাটির ৭০ ভাগ ইটভাটায় যায়। আর বাকি অংশ আবাসিক-বাণিজ্যিক ভবন ও প্লট ভরাটের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। ট্রাক্টরের বহন খরচসহ মাটির দামের বিষয়টি সিন্ডিকেটের দুইটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করে।
পরিবেশবিদদের মতে, বছরের শুষ্ক মৌসুমের প্রায় ৪ মাস গোমতী পাড়ের যে পরিমাণ মাটি কাটা হয় বৃষ্টির মৌসুমে পলি জমে তা সিকিভাগও পূরণ হয় না। এভাবে ধীরে ধীরে একসময় নদীর প্রশস্ততা বেড়ে বাঁধ হুমকির মুখে পড়বে। পরিবেশ হারাবে তার ভারসাম্য। কেবল তাই নয়, আমতলী থেকে টিক্কাচর পর্যন্ত যে বাইপাস সড়ক নির্মাণ হচ্ছে এটিও ভবিষ্যতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ