Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভেজালের কারণে দামুড়হুদার খেজুরের গুড় হারাচ্ছে ঐতিহ্য

মূল্য ভালো থাকায় গাছিদের মুখে ফুটছে হাসি

| প্রকাশের সময় : ২৭ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

নুরুল আলম বাকু, দামুড়হুদা (চুয়াডাঙ্গা) থেকে : চুয়াডাঙ্গা জেলার দামুড়হুদা উপজেলাসহ পুরো এলাকায় বইছে হিমেল হাওয়া। গত এক মাসে জেলায় বেশ কয়েকদিন রেকর্ড করা হয়েছে দেশের সর্বনি¤œ তাপমাত্রা। দিনের বেলায় মিষ্টি রোদের উপস্থিতি থাকলেও রাতে পড়ছে তীব্র শীত। শীত মৌসুমের শুরু থেকেই দামুড়হুদার গাছিরা খেজুর রস সংগ্রহ করে গুড় তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। এবার খেজুগুড় তৈরির জন্য অনুকুল আবহাওয়া ও গুড়ের বাজারদর ভাল থাকায় গাছিদের মুখে ফুটে উঠেছে রসালো হাসি। বাড়ি বাড়ি চলছে খেজুর গুড়ের তৈরি আবহমান গ্রামবাংলার ঐতিহ্য পিঠা-পুলির উৎসব। প্রতি বছরই শীতের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এ উপজেলার গ্রামাঞ্চলে সকাল হলেই খেজুর রস, পিঠা ও নলেন গুড়ের মৌ মৌ গন্ধে ভরে ওঠে পুরো এলাকা। শীতের সকালে খেজুরের ঠা-া রস পান করা যে কতটা তৃপ্তিকর তা বলে বোঝানো যায় না। আর খেজুর রসের পিঠা পায়েস যে কেমন মজাদার তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রতি বছরের মতো এবারও শীতের শুরুতেই গ্রামাঞ্চলে খেজুর রসের ক্ষীর, পিঠা, পায়েস, তৈরির ধুম পড়ে গেছে। প্রতিদিনই কোন না কোন বাড়িতে চলছে খেজুরের রস ও গুড়ের তৈরি নানারকম খাবারের আয়োজন। শীতের সকালে বাড়ির উঠানে বসে পিঠে মিষ্টি রোদ লাগিয়ে খেজুরের গরম গরম ঝোলা গুড় দিয়ে রুটি খাওয়ার মজাই আলাদা। একবার খেলে তার স্বাদ মুখে লেগে থাকে অনেকদিন পর্যন্ত। খেজুর গুড় দিয়ে তৈরি হয় সুস্বাদু পাটালি। নুতন ধানের মুড়ি আর পাটালি খুবই মুখোরোচক খাবার। খেজুরের নলেন গুড় ছাড়া শীতকালিন পিঠা-পায়েস এর উৎসবের কথা ভাবাই যায় না। আগেকার দিনে শীত মৌসুমে উপজেলার গ্রামাঞ্চলের মানুষের সকালের নাস্তা হতো নতুন ধানের চিড়া, ঘরে পাতা দই আর খেজুরগুড় দিয়ে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় নানারকম খাবারের ভিড়ে সেসব আজ শুধুই স্মৃতি। সূত্রে জানা গেছে, এক সময় দামুড়হুদা উপজেলাসহ জেলার আলমডাঙ্গা ও জীবননগর উপজেলার সব অঞ্চলই খেজুর গুড়ের জন্য বিখ্যাত ছিল। দেশের বিভিন্ন জেলায় এই খেজুর গুড়ের ব্যাপক চাহিদা ছিল। এ এলাকার বিভিন্ন হাটবাজার থেকে বিভিন্ন যানবাহনযোগে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ খেজুর গুড় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চালান হতো। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পুর্বে জীবননগর বাজারের খেজুর গুড় চালান হতো ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার বিভিন্ন অঞ্চল, কলকাতাসহ বিভিন্ন শহরে। ওই সময় ভারতের রানাঘাট ও মাজদিয়া হাটের ব্যাপারীরা এসে দামুড়হুদা সদর, কার্পাসডাঙ্গা, জীবননগরসহ পার্শ¦বর্তী এলাকা থেকে গুড় কিনে গরু ও ঘোড়ার গাড়িতে বোঝাই করে নিয়ে যেত তাদের নিজ এলাকায়। উপজেলার জয়রামপুর গ্রামের গাছি রহমত আলি বলেন, আমি প্রায় ২০-২৫ বছর যাবৎ খেজুর রস সংগ্রহ ও খেজুর গুড় তৈরি করে আসছি। আগে এ কাজে ভালই লাভ হতো। গুড় তৈরির কাজ করে এখন আর আগের মতো লাভ হয় না। কারণ, আগে এলাকার সব মাঠে ও গ্রামের আনাচে কানাচে খেজুর গাছ ছিল। একসাথে অনেক গাছ কাটা যেত। এখন এলাকায় খেজুর গাছ অনেক কমে গেছে। অন্যান্য কাজের ফাঁকে একাজ করতে হয়। প্রতি বছর ভাটায় ইট ও টালি পোড়াতে বিপুলসংখ্যক খেজুর গাছ কেটে সাবাড় করা হচ্ছে। যে হারে বড় বড় খেজুর গাছ কাটা পড়ছে তাতে কয়েক বছর পরে আর রসের জন্য বড় গাছ পাওয়া যাবে না। ছোট গাছে রস তেমন একটা হয় না। রসের স্বাদও নেই। আর ছোট গাছ থেকে রস পাড়তে সুবিধা হয় তাই এসব গাছে চোরের উপদ্রব বেশি। বর্তমানে যে হারে গাছ কাটা হচ্ছে সেই তুলনায় লাগানো হচ্ছে না। গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায় গুড়ের উৎপাদনও কমে গেছে। বর্তমানে উপজেলার বিভিন্ন হাট-বাজারে প্রতি কেজি চিনির দাম ৬০টাকা থেকে ৬৫ টাকা। আর প্রতি কেজি খেজুর গুড় বিক্রি হচ্ছে ৮৫ টাকা থেকে ৯০ টাকায়। বাজারে চিনির চেয়ে খেজুর গুড়ের দাম বেশি হওয়ায় এক শ্রেণির মুনাফলোভী অসাধু গাছিরা খেজুর গুড় তৈরির সময় তাতে চিনি মিশিয়ে ভেজাল গুড় ও পাটালি তৈরি বাজারে বিক্রি করছে। এসব চিনি ভেজাল দেওয়া গুড় ও পাটালিতে আসল স্বাদ থাকছে না। ফলে ভেজাল গুড় কিনে ক্রেতারা প্রতারিত ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সেইসাথে মানুষও ভুলতে বসেছে আসল খেজুর গুড়ের স্বাদ। ভেজাল খেজুর গুড় তৈরি করে হাতেগোনা কিছু অসাধু গাছি লাভবান হলেও ভেজালের কারণে এলাকার খেজুর গুড় ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। আর অভিজ্ঞ লোক ছাড়া ভেজাল ও আসল খেজুর গুড় সহজে চেনারও উপায় নেই। তাই ভেজালের কারনে মানুষ খেজুর গুড় খাওয়ার প্রতি আগ্রহ হারচ্ছে। কয়েক বছর যাবৎ গুড়ে ভেজাল দেওয়া ও সেইসাথে আসল গুড়ের উৎপাদন কমে যাওয়ায় গ্রামীণ অর্থনীতিতে পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। তাই ভেজাল গুড় উৎপাদনের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন ভোক্তাসাধারণ। তবে এত প্রতিকূলতার মাঝেও এখনও অনেক পুরতন গাছিরা অন্যান্য কাজের সাথে ভাল খেজুর গুড় তৈরি করে এর ঐতিহ্য ধরে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। খেজুর গাছ আমাদের রস ও গুড় দেওয়া ছাড়াও ছায়াদান, জ্বালানি সরবরাহসহ প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে নানাভাবে উপকার করে থাকে। তাই এ গাছ থেকে সুমিষ্ট রস গুড় পেতে, আমাদের জীবনের প্রয়োজনে পরিবেশ বাঁচাতে ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করতে আমাদের উচিত নির্বিচারে খেজুর গাছ কাটা বন্ধ করা ও সেইসাথে আরও বেশি বেশি করে খেজুর গাছ রোপণ করা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ