হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
কামরুল হাসান দর্পণ : দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) কর্মীনির্ভর নয়, সমর্থকনির্ভর দল। এমন একটি তকমা বেশ ভালোভাবেই দলটির গায়ে লেগে আছে। এই তকমা আক্ষরিক অর্থেই সত্য। ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদকও কিছু দিন আগে তা স্বীকার করেছেন। বলেছেন, সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হলেও বিএনপির ভালো জনসমর্থন রয়েছে। বিভিন্ন নির্বাচনে ভোটের শতকরা হারেও দলটির ভালো সমর্থনের প্রমাণ পাওয়া যায়। শতকরা হারের ওঠা-নামার মধ্যেও দেখা যায় এই হার প্রায় ৩০-৩৫ শতাংশ বা তার বেশি। এত জনসমর্থন নিয়েও দলটি এখন অগোছালো হয়ে পড়েছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। দলটির রাজনৈতিক কার্যক্রম সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছানির্ভর হয়ে পড়েছে। বৃহৎ একটি রাজনৈতিক দলের জন্য তা কোনোভাবেই সম্মানের নয়। রাজনৈতিক কর্মসূচি কেন পালন করতে পারছে না, এমন প্রশ্ন এলেই দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়, সরকার নিপীড়ন-নির্যাতন করে। রাস্তায় নামলেই গুলি করে। তাদের এ কথা যেমন সত্য, তেমনি এটাও সত্য দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের মধ্যে তাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে আন্দোলন-সংগ্রাম করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট অনীহা রয়েছে। এর কারণ হতে পারে, দলটির নীতিনির্ধারক ও শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ মনে করেছিলেন, বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক ধারা তাতে একবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে, পরেরবার তারা অবধারিতভাবে ক্ষমতায় আসবেন। এমপি-মন্ত্রী হবেন। এ জন্য তাদের মাঠে-ময়দানে খুব একটা নামতে হয় না। তবে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এবং ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বিনা ভোটে করে ফেলার পর প্রচলিত ধারাটি পুরোপুরিই বদলে গেছে। বদলে দেয়া হয়েছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকাতে দলটি আন্দোলন করেছে ঠিকই, তবে মাঠে দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে সাধারণ নেতা-কর্মীদের দেখা যায়নি। এর কারণ হতে পারে, তাদের প্রচলিত ধারণা। বিএনপিকে ক্ষমতায় আসতে খুব বেশি আন্দোলন করতে হয় না, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে সমর্থকরাই ভোট দিয়ে ক্ষমতায় নিয়ে আসে। এ ধারা যে এককালে ছিল, এখন নেইÑ এ বোধ দলটির নেতাদের মধ্যে জন্মায়নি বলেই আন্দোলনে তাদের রাজপথে দেখা যায়নি। এখন দলটির সমর্থকদের মধ্যে এমন কথাও উঠছে, সরকার পেটাবে, হামলা-মামলা করবেÑ এ ভয়েই দলটির নেতারা মাঠে নামেন না। তারা এ কথাও বলছে, মাঠে নামলেই না পেটানোর সুযোগ থাকে। সরকারকে তো নেতারা পেটানোর সুযোগই দিচ্ছে না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরোধী দলের নেতারা আন্দোলন করতে গিয়ে লাঠিপেটা, টিয়ার শেল খাননিÑ এমন নজির কখনই ছিল না। এদেশে বিরোধী দলের রাজনীতি করতে হলে, এ সংস্কৃতিÑ সেটা ভালো কিংবা মন্দ হোক তা মেনেই করতে হয়। আমাদের নামতে দিচ্ছে না বলে ঘরে বসে থাকলে বা অন্দরমহলে বসে দুয়েকটি প্রেস কনফারেন্স করে সরকারবিরোধী বক্তব্য দিলেই সরকার তা আমলে নেবে বা তার টনক নড়বে, এখন আর এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। ক্ষমতাসীন দলও বুঝিয়ে দিচ্ছে, তোমাদের আন্দোলন করার ক্ষমতা নেই। করলেও তা কীভাবে মোকাবেলা করতে হবে, তা জানা আছে। এর ফলে ক্ষমতাসীন দলও তাকে নিয়ে হেলাফেলা করার এন্তার সুযোগ পেয়ে গেছে। এমনকি এ জন্য টিপ্পনি কাটা হচ্ছে। গত কয়েক দিনে ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক এ কথা পর্যন্ত বলেছেন, বিএনপির নেতারা রাস্তায় নামেন না, তারা ঘরে বসে হিন্দি সিরিয়াল দেখেন। বিএনপির যারা সমর্থক তারাও ভাবতে পারেন, নিশ্চয়ই ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদকের কাছে এসব তথ্য রয়েছে। তা না হলে, এমন কথা বলবেন কেন? বিএনপি নেতাদের নিষ্ক্রিয়তা দেখে ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদকের কথার সাথে যদি সমর্থকদের ভাবনা মিলে যায়, তবে তাদের চরম হতাশ হওয়া ছাড়া কোনো গতি থাকে না। বিএনপির শীর্ষ নেতৃবৃন্দ হয়তো মনে করতে পারেন, সরকার আন্দোলন করতে তাদের উসকানি দিচ্ছে। আন্দোলনে নামলেই বেধড়ক নিপীড়ন-নির্যাতন করবে। হামলা-মামলার জালে আরও বেশি করে ফেলবে। প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে বিএনপি কী করবে? তার কর্মসূচি কি? এভাবেই কি শুয়ে-বসে সময় পার করে দেবে? দলটির বর্তমান ভাবগতি দেখে তাই মনে হচ্ছে। নেতারা অন্দরমহলে বসে দুয়েকটি সরকারবিরোধী কথা বলেই দায়িত্ব শেষ করছেন। এতে কি কোনো ফায়দা হচ্ছে? আমরা যদি লক্ষ্য করি তা হলে দেখব, বিগত কয়েক বছরে বিএনপি ঘরে বসে সরকারবিরোধী যত কথা বলেছে, তা সরকার আমলে নিয়েছেÑ এমন একটি নজিরও নেই। তাহলে এ দলটির কার্যকারিতা কি?
দুই.
এ কথা অনস্বীকার্য, বিএনপি এমন এক সরকারের কবলে পড়েছে, যেখানে সরকারবিরোধী যে কোনো কার্যক্রম খুবই কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। সভা-সমাবেশের অনুমতি চাইলেও দেয়া হয় না। সরকারের দৃষ্টিতে বিএনপি একটি মারদাঙ্গা দল। তাকে কর্মসূচি পালন করতে দিলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হবে। কাজেই তাকে ঘর থেকে বের হতে দেয়া যাবে না। ব্যারিকেড দিয়ে রাখতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপি যদি মারদাঙ্গা দলই হতো, তবে কি তাকে এভাবে শান্ত-শিষ্ট করে রাখা যেত? কোনো না কোনোভাবে সে তার প্রকাশ ঘটাতই। বিষয়টি আসলে তা নয়। সরকার ঠিকই জানে, বিএনপিকে যদি সভা-সমাবেশ করতে দেয়া হয়, তবে সেখানে যে মানুষের সমাবেশ ঘটবে, তাই সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়ে উঠবে। সরকারের ভয় ওখানেই। কারণ সরকার জানে, বিএনপির ব্যাপক জনসমর্থন রয়েছে। এই সমর্থকদের যদি বিএনপির সমাবেশে আসতে দেয়া হয়, তাহলে সরকারের অনেক কর্মকা-েরই বিরুদ্ধাচরণ হয়ে যাবে। সরকার তা করতে দেবে কেন? তার চেয়ে সন্ত্রাসী কর্মকা-ের দল আখ্যা দিয়ে তাকে ঘরে আটকে রাখাই ভালো। বিএনপিকে হাঁটতে দিলে, তার বড় ধরনের বিপদ দেখা দেবে। নিশ্চিন্তে চলতে পারবে না। সরকার ভালো করেই জানে, এরশাদবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে বিএনপি নেত্রীর হাঁটার কারণেই অতি সামান্য শক্তি নিয়েও বৃহৎ হয়ে উঠেছিল। এমনকি ক্ষমতায় গিয়েছিল। দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানও গ্রাম-গঞ্জের পথেঘাটে হেঁটে হেঁটে অতি সাধারণ মানুষের সাথে হাত মিলিয়ে, কথা বলে দলটিকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে গিয়েছিলেন। অর্থাৎ রাজনীতিতে রাজপথে হাঁটার বিকল্প নেই এবং এটাই হচ্ছে দল শক্তিশালী করার একমাত্র উপায়। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগও সুদীর্ঘকাল ধরে রাজপথে হেঁটে হেঁটেই শক্তিশালী ও সুসংগঠিত হয়েছে। তবে হাঁটলেই হবে না। কখন হাঁটতে হবে, কীভাবে হাঁটতে হবে, তার সঠিক সময় নির্ধারণ করা অত্যন্ত জরুরি। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে না হাঁটলে হোঁচট খেতেই হবে। সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের নয় ফোঁড়ের মতো। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এ সময়টা বেশ ভালোভাবেই ধরেছে। বিএনপি বলতে পারে, সময়ের কারণে প্যাঁচে পড়লে, অতি আপন মানুষও দুই কথা বলতে ছাড়ে না। তাকে এটাই বুঝতে হবে, রাজনীতির পথটি কুসুমাস্তীর্ণ নয়। কণ্টকযুক্ত এ পথে হেঁটেই মসৃণ করে মনজিলে মকসুদে পৌঁছতে হয়। চলতি পথে অনেকেই অনেক কথা বলবে। সবার কথা শুনতে হবে এবং পরিস্থিতি বুঝে নিজস্ব বোধ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সরকার যে দলটির কথা এখন আমলে নিচ্ছে না, এর কারণ সে ভালো করেই জানে, বিএনপির এখন তেমন কিছুই করার নেই। সরকারের গায়ে আঁচড় কাটার মতো কোনো কর্মসূচি দেয়ার ক্ষমতা নেই। দলটির নেতারা ঘরে বসে হিন্দি সিরিয়াল দেখে সময় কাটান। ক্ষমতাসীন দলের কথানুযায়ী এভাবে যদি একটি দলের নেতারা সময় কাটান, তবে বুঝতে হবে দলটির অবস্থা খুবই করুণ। বাস্তবেও দলটির সমর্থকদের মধ্যে যদি এ বিশ্বাস জন্মাতে থাকে, তবে তাদের খুব একটা দোষ দেয়া যাবে না। সমর্থকরা তো দেখছেই, দলটি রাজপথে নেই। রাজপথে না থেকে, ঘরে বসে থেকেও জেল-জুলুম থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। যদি রক্ষা না পাওয়াই যায়, তবে ঘরে বসে থেকে লাভ কি? জনমুখী কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামাই তো শ্রেয়। সেখান থেকে জেলে যাওয়ার বিষয়টি অনেক সম্মানের। সমর্থকসহ সচেতন মহলেও এ বিশ্বাস জন্মাবে যে জনগণের ন্যায্য দাবি নিয়ে আন্দোলন করতে গিয়ে জুলুমের শিকার হয়েছে। জেল-জুলুমের ভয় করলে কি আর রাজনীতি হয়? আর তিন তিনবার ক্ষমতায় থাকা এবং বিরোধী দলে থাকা একটি রাজনৈতিক দলের কি এই অভিজ্ঞতা নেই যে, বিরূপ পরিস্থিতিতে কী ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে আন্দোলন করতে হয়? বিএনপির মতো একটি দলের কি রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত ও কৌশল নেয়ার ক্ষমতা নেই? যে বিপুল সমর্থক তার দিকে চেয়ে আছে, তাদের হতাশা দূর করার কোনো দায়িত্ব কি দলটির নেই? দলটি কি হিন্দি সিরিয়াল দেখার দলের অপবাদ নিয়েই নিশ্চুপ বসে থাকবে?
তিন.
বিএনপির বর্তমান পরিস্থিতি দেখে যে কারো মনে হতে পারে, দেশে-বিদেশে দলটির কোনো ধরনের কার্যক্রম নেই। এ বিষয়টি সরকারও বেশ ভালোভাবে জানে। বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে, দলটিতে এখন এমন নেতা দেখা যায় না যাকে বা যাদের দেখে মনে হতে পারে, তিনি বা তারা জনগণকে প্রভাবিত বা আলোড়িত করতে পারেন। এটা একটি বৃহৎ দলের জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। অথচ ক্ষমতাসীন দলের দিকে তাকালে দেখা যায়, তাদের একাধিক প্রভাব বিস্তারকারী নেতা রয়েছেন। যাদের কথা শুনলে মনে হতে পারে, একজন নেতা কথা বলছেন। তাদের একেকটি কথা বোমার মতো ফোটে। প্রতিপক্ষকে এফোড়-ওফোড় করে দেয়। বিএনপিতে এখন এ ধরনের কোনো নেতা দেখা যায় না। সব যেন হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো মিলিয়ে গেছে। এ কথা কে না জানে, জনগণ নেতার কথা দ্বারা আলোড়িত হয়। তাদের ভেতর নেতার কথা সঞ্চারিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। বিএনপিতে এখন আলোড়ন সৃষ্টিকারী নেতা কোথায়? বিএনপির নাখোশ নেতারা হয়তো বলতে পারেন, কথা বললেই আমাদের জেলে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। সরকার কথা বলার অধিকারটুকুও কেড়ে নিয়েছে। প্রশ্ন আসতে পারে, জেলের ভয়ে যদি চুপ থাকতে হয়, তাহলে রাজনীতি করার দরকার কি? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তো অসংখ্যবার জেলে নেয়া হয়েছে, তার জন্য ফাঁসির মঞ্চও তৈরি করা হয়েছিল। তারপরও তো তিনি দমে যাননি। মাথা নোয়াননি। বীরদর্পে কথা বলে গেছেন। উদাহরণটি টানতে হলো এ কারণে যে, রাজনীতি করতে হলে এমন অকুতোভয় হতে হয়। হিম্মতওয়ালা হতে হয়। বিরোধী দলে থাকলে ‘ফুলবাবু’ হয়ে থাকার সুযোগ থাকে না। রাজপথে হাঁটতে হাঁটতে জুতার তলা ক্ষয় করতে হয় এবং স্লোগান দিতে দিতে গলা ভাঙতে হয়। বিএনপির বর্তমান রাজনৈতিক কর্মসূচির দিকে তাকালে, তার সমর্থকদের মনে হতে পারে দলটি ‘রণেভঙ্গ’ দিয়েছে। প্রেস কনফারেন্স ও আলোচনা অনুষ্ঠানের মধ্যে তার কর্মসূচি সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এসব অনুষ্ঠানে নেতারা সরকারের সাথে সংলাপ বা আলোচনার কথা বারবার বলছেন। ক্ষমতাসীন দলের নেতারাও কথার জবাব দিয়ে বলছেন, বিএনপির সাথে সংলাপ বা আলোচনার কোনো সুযোগ নেই। অর্থাৎ ক্ষমতাসীন দল বিএনপির আহ্বানকে পাত্তাই দিচ্ছে না। এমনকি কথাবার্তা ও আচার-আচরণে বুঝিয়ে দিচ্ছে বিএনপি কোনো দলই নয়। আবার রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনেও বিএনপিকে কীভাবে বাইরে রাখা যায়, এমন পরিকল্পনাও করছে। অবশ্য আগামী নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ করা ছাড়া গতি নেই। কারণ পরপর দুটি জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে, নির্বাচন কমিশনে তার রেজিস্ট্রেশন বাতিল হয়ে যাবে। এ বিষয়টি ক্ষমতাসীন দলও ভালো করে জানে। ফলে ক্ষমতাসীন দলের তো চেষ্টা থাকবেই বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখতে। আর বিএনপি যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেও তবে কীভাবে তাকে সাইজ করে রাখা যাবে, সে পরিকল্পনাও ক্ষমতাসীন দল নেবে, এটাই স্বাভাবিক। এখন বিএনপি আগামী নির্বাচন কীভাবে করতে হবে, তার কথা বলে বেড়াচ্ছে। নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার গঠনের কথা বলছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দল বলছে, তার অধীনেই আগামী নির্বাচন হবে। বিএনপির দাবি মোতাবেক নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের কথা সরকার ভুলেও উচ্চারণ করছে না। প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপি কীভাবে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের দাবি আদায় করবে? এ জন্য যে আন্দোলন করতে হবে, তার ধরন কী হবে? আন্দোলনে জনগণকে কীভাবে সম্পৃক্ত করবে? জনসম্পৃক্ত করার মতো কোনো কর্মসূচি কী বিএনপি পালন করছে? এই যে জিনিসপত্রের দামের ঊর্ধ্বগতি, গ্যাসের অভাবে মানুষের জীবনযাত্রার দুঃসহ পরিস্থিতি, কলকারখানা চালু করা যাচ্ছে না, মানুষের জীবনের টানাপড়েন, অর্থনৈতিক দুরবস্থা, দুর্নীতির ব্যাপকতাসহ অজ¯্র সমস্যা রয়েছেÑএ ব্যাপারে তো দলটির কোনো কর্মসূচি দিতে দেখা যায় না। বিএনপির মতো ক্ষমতা প্রত্যাশী একটি দল যদি সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখের বিষয়গুলো নিয়ে জনগণের কাছে না যায়, তবে জনসম্পৃক্ততা কীভাবে বাড়বে? এটা তো জানা কথা, বিএনপির যেটুকু জনসমর্থন রয়েছে, তা থাকবে। এর বাইরেও যে আরও বিরাট একটি জনগোষ্ঠী রয়েছে, তাদের কাছে পৌঁছার মতো কী কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে? বিশেষ করে বিরাট তরুণ প্রজন্মের কাছে দলটির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরতে কি কোনো উদ্যোগ নিয়েছে? এক দশকের বেশি সময় ধরে বাইরে থাকা দলের সমর্থন ধরে রাখা এবং বৃদ্ধিতে কি কর্মসূচি নিয়েছে? বাস্তবতা হচ্ছে, এসবের কিছুই দলটির কার্যক্রমে দৃশ্যমান নয়। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দল মানুষের সামনে রঙিন স্বপ্ন ক্রমাগত তুলে ধরে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। সত্য-অসত্যের বিষয়টি বাদ দিয়েও বলা যায়, দলটি জনগণের কানে তাদের কথা পৌঁছাতে পারছে। কথায় আছে, একটি মিথ্যা দশবার, বারবার বললে তা মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে। বিএনপি তো তার ন্যায্য দাবিগুলোই জনগণের সামনে উপস্থাপন করতে পারছে না বা উপস্থাপন করার চেষ্টাও তার মধ্যে দেখা যায় না। বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ রয়েছে, দলটির নেতৃত্বে যেসব নেতা রয়েছেন, তারা নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। সরকারের সাথে গোপন আঁতাত ও মিল দিয়ে বিভিন্ন মামলা-মোকদ্দমা থেকে বাঁচার কাজে তৎপর এবং দলে বড় পদ-পদবি পাওয়ার কাজে ব্যস্ত। এমন নেতাদের দিয়ে কি আর আন্দোলন-সংগ্রাম করা যায়?
চার.
আমাদের দেশে ক্ষমতাসীন দল বরাবরই বিরোধী দলকে নির্মূলে কম-বেশি নীপিড়ন-নির্যাতন করে থাকে। বিরোধী দলও সরকারের সেসব অত্যাচার সয়ে যৌক্তিক আন্দোলনের মাধ্যমে মোকাবেলা করেছে এবং ক্ষমতায়ও গেছে। এখন রাজনীতির এ ধারা বদলে গেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিরোধী দল নির্মূলে এখন কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হচ্ছে। বিরোধী দলের আন্দোলনে সরকারেরই এজেন্টরা অনেক ক্ষেত্রে নৃশংস ঘটনা ঘটিয়ে তা চাপিয়ে দেয়। যাকে বলে উদোর পি-ি বুদোর ঘাড়ে। এতে বিরোধী দলের যৌক্তিক আন্দোলন যেমন সহিংস করে তোলা হয়, তেমনি সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে দমন নীতিও অবলম্বন করা যায়। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট যৌক্তিক দাবি নিয়ে যে আন্দোলন করেছিল, তা এভাবেই সরকার মোকাবেলা করেছে বলে এখন অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। ফলে বিএনপি ও তার জোট সাধারণ মানুষের কাছে চরম ইমেজ সংকটে পড়েছে। এটা হতে পেরেছে এ কারণে যে, তখন আন্দোলনের ডাক দিয়ে বিএনপি ও তার জোটের কোনো নেতাই মাঠে নামেননি। হয় ঘরে বসেছিলেন, না হয় গ্রেফতার এড়াতে পালিয়ে ছিলেন। এতে মাঠ খালি পড়ে থাকে। আর খালি মাঠে তৃতীয় পক্ষ অঘটন ঘটিয়ে তার দায় আন্দোলনের ডাক দেয়া দল ও জোটের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। এতে তাদেরও বলার কিছু থাকেনি। এ কাজ আমরা করিনি বলে যে বলবে, তার কোনো ভিত্তিও দিতে পারেনি। কারণ আন্দোলনের ডাক তারাই দিয়েছে এবং এ আন্দোলনে সহিংস ঘটনা ঘটেছে। স্বাভাবিকভাবে এর দায় তাদেরই নিতে হবে। এটা বিরোধী দলের জন্য খুবই ট্র্যাজিক ঘটনা। আন্দোলনে সফল হতে তো পারলই না, উল্টো সন্ত্রাসী আখ্যা পেয়ে দমননীতির শিকার হতে হলো। এটা হতে পেরেছে নেতাদের রাজপথে না থাকার কারণে। পলায়নপর মনোবৃত্তির কারণে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, তারা রাজপথে না থেকে এবং পালিয়ে থেকেও মামলা-মোকদ্দমা থেকে রেহাই পাননি। তাহলে কী লাভ হলো! লাভের সবটুকুই ক্ষমতাসীন দল নিয়ে নিয়েছে। সবচেয়ে বড় লাভ হয়েছে, সন্ত্রাসী কর্মকা-ের অভিযোগে এখন বিএনপি ও তার জোটকে মাঠে নামতে না দেয়া। জনগণের কাছে পৌঁছতে না দেয়া। সরকারের কাছে তো উছিলা রয়েছে, তাদের নামতে দিলে সন্ত্রাসী কর্মকা- ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। এ এক বড় অপবাদ! এ থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে বিএনপি ও তার জোট যে ভিন্ন কৌশল নিয়েছে, তার কোনো আলামতও দেখা যাচ্ছে না। সরকার যে তাদের জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার কৌশল নিয়ে সফল হচ্ছে, তা মোকাবেলা করতে পারছে না। বিএনপির মতো বৃহৎ একটি রাজনৈতিক দলের কাছে এমন জটিল পরিস্থিতি মোকাবেলার কৌশল থাকবে না, তা তার সমর্থকদের কাছেও বিস্ময়কর ঠেকছে। তাদের কাছে এটাও মনে হচ্ছে, বিএনপির নেতারা এখন গা বাঁচিয়ে চলার কৌশল নিয়ে চলছেন। এমন রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে বাংলাদেশে কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় গেছে, তার নজির আজও স্থাপিত হয়নি। আর এখন রাজনৈতিক ধারার পুরো খোলনলচে বদলে যাওয়ার সময় এ আশা করা দুরাশা ছাড়া কিছুই নয়। বিএনপির উচিত হবে, কীভাবে জনগণের কাছে পৌঁছানো যায়, এমন কর্মসূচি ও পন্থা অবলম্বন করা। সরকার বা প্রশাসন তার কর্মসূচি পালন করার অনুমতি দেয় না বলে ঘরে চুপ করে বসে থাকলে হবে না। জনসম্পৃক্ত দাবি নিয়ে আন্দোলন ও প্রতিবাদ করার অনুমতি বারবার চাইতে হবে। কতবার দেবে না? বারবার অনুমতি না দেয়াটাও তো সরকারের জন্য বিব্রতকর। এ কৌশল বিএনপি নেবে না কেন? নিলে তো ঘরে বসে হিন্দি সিরিয়াল দেখার যে অপবাদ দলটির নেতাদের দেয়া হয়েছে, তা কিছুটা হলেও ঘুচবে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।