Inqilab Logo

মঙ্গলবার ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক নীতি-কৌশলের পুনর্মূল্যায়ন প্রয়োজন

উপ-সম্পাদকীয়

| প্রকাশের সময় : ২২ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মেহেদী হাসান পলাশ : গত ডিসেম্বর ও চলতি জানুয়ারি মাসে দেশের বেশ কয়েকটি জাতীয় দৈনিক পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে ধারাবাহিক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। এ সকল পত্রিকার রিপোর্টার ও সিনিয়র সাংবাদিকগণের সাম্প্রতিক পার্বত্য চট্টগ্রাম সফরের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে লেখা এসব সরেজমিন প্রতিবেদনে পার্বত্য চট্টগ্রামের উদ্বেগজনক পরিস্থিতির চিত্র ফুটে উঠেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কিত খবরের নিয়মিত পাঠক হিসাবে বলতে পারি, বাংলাদেশের বেশিরভাগ জাতীয় দৈনিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে লেখালেখির একটি কমন ট্রেন্ড রয়েছে। এই ট্রেন্ডের টার্গেট থাকে পুনর্বাসিত বাঙালি ও সেনাবাহিনী। পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল অশান্তি ও অস্থিরতার জন্য এদেরকে দায়ী করা হয় এবং আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর সশস্ত্র শাখার সন্ত্রাসী তৎপরতাকে সযত্মে আড়াল করা হয়। কিন্তু এবারের প্রতিবেদনগুলোতে সেই ট্রেন্ড ছিল না। রিপোর্টারগণ সরেজমিন পরিদর্শন করে খোলা চোখে যা দেখেছেন তাই লিখেছেন। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রকৃত এবং লুকানো বাস্তবতা উঠে এসেছে এই রিপোর্টগুলোতে। এতে সারাদেশের মানুষের মনে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রকৃত চিত্রের উপর কিছুটা হলেও ধারণা তৈরি হয়েছে। এর ইতিবাচক ফলও পাওয়া গেছে।
গত ৯ জানুয়ারি সোমবার জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির ২১তম বৈঠক থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সব ধরনের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর তৎপরতা বাড়াতে সুপারিশ করা। একই সাথে সকল রাজনৈতিক শক্তিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে কমিটির পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়। প্রকৃতপক্ষে এটি ইতিবাচক রিপোর্টের সুফল।
স্বাধীন বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রামের কালপঞ্জীকে আমরা মোটামুটি তিনটি ভাগে ভাগ করতে পারি। সত্তরের দশকে জেএসএস ও শান্তিবাহিনীর প্রতিষ্ঠা, আশির দশকে বাঙালি পুনর্বাসন এবং ১৯৯৭ সালে শান্তিচুক্তি।  ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত শান্তিচুক্তি পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। শুধু রাজনীতি নয়; নিরাপত্তা, উন্নয়নসহ জনজীবনের সকল ক্ষেত্রেই এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রেক্ষাপটে এই চুক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক ও দিকবদল। শান্তিচুক্তির পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রামে সক্রিয় সন্ত্রাসী ও নিরাপত্তা বাহিনী পরস্পর মুখোমুখি ও শত্রুতাপূর্ণ অবস্থানে ছিল। শান্তিবাহিনী যেখানে পেরেছে নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যদের উপর অতর্কিত বা পরিকল্পিত হামলা পরিচালনা করেছে। নিরাপত্তা বাহিনীগুলোও হামলা চালিয়ে রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত শান্তিবাহিনীর আস্তানা গুঁড়িয়ে দিয়েছে। তাদের আটক করেছে। শান্তিচুক্তির পর সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের একটি অংশ অস্ত্র জমা দিয়ে সাধারণ ক্ষমার আওতায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। শুধু ফিরে আসাই নয়, শান্তিচুক্তির পুনর্বাসনের আওতায় জেএসএস ও শান্তিবাহিনীর সন্ত্রাসীরা অতিদ্রুতই মন্ত্রী-এমপিসহ বিভিন্ন পদমর্যাদায় সরকারি পদে আসীন হয়। ফলে কিছুদিন আগেও যে সন্ত্রাসী হিসাবে রাষ্ট্রের ও সেই সুবাদে নিরাপত্তা বাহিনীর শত্রু ছিল, চুক্তির বছরখানেকের মধ্যেই তারা একই অফিসের বস বা সহকর্মীদের পরিণত হয়। অনেকেই আবার রাষ্ট্র প্রদত্ত বিভিন্ন সুবিধার আওতায় ব্যবসা বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ভাবে বেসরকারি পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হয়।
তবে একথা সকলেই জানেন যে, পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের একটি বড় অংশ শান্তিচুক্তির বিরোধিতা করে অস্ত্র সমর্পণ না করে রাষ্ট্রবিরোধী সশস্ত্র তৎপরতায় লিপ্ত থাকে। শান্তিচুক্তির দুই দশক পরেও এই তৎপরতা স্তিমিত না হয়ে ক্রমাগত বেপরোয়া ও নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। এদের নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশে নিরাপত্তা বাহিনীগুলো নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বিগত ২ বছরে নিরাপত্তা বাহিনীর প্রশংসনীয় অর্জন রয়েছে। বিশেষ করে সাজেক, বাঘাইছড়ি, দিঘীনালা, মহালছড়ি, রাঙামাটি ও রুমাতে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন পরিচালনা করে নিরাপত্তা বাহিনী ব্যাপক সাফল্য লাভ করেছে। অন্যদিকে আলীকদমে আলোচনার মাধ্যমে অর্ধশতাধিক সন্ত্রাসী শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিপুল পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্র সমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে। এগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। সে কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের সন্ত্রাস মোকাবেলায় নিরাপত্তা বাহিনীর সশস্ত্র অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ নিয়ে অতীতে বিস্তারিত লিখেছি বহুবার।
কিন্তু শান্তিচুক্তির পর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসে শান্তিবাহিনী ও জেএসএসের যেসকল নেতাকর্মী পূর্বের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যেই কাজ করে যাচ্ছে তাদের মোকাবেলার বিষয়টি আজ অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা, বর্তমান প্রেক্ষাপট গভীরভাবে বিবেচনা করে দেখলে এটা সহজেই প্রতিভাত হয়ে যে, শান্তিবাহিনী সশস্ত্র লড়াই করে যা অর্জন করতে পারেনি, শান্তিবাহিনীর সাবেক ও গুপ্ত সদস্যরা নিরস্ত্র লড়াই চালিয়ে তার চেয়ে ঢের বেশী অর্জন করেছে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, সশস্ত্র লড়াইয়ের ঝুঁকি ও কষ্টকর জীবন পার্বত্য চট্টগ্রামের অভিজাত, শিক্ষিত ও নিরীহ উপজাতীয় সমাজে যতটা থাবা বিস্তার করতে পেরেছিল, নিরস্ত্র লড়াই তার থাবা সহজেই অনেক গভীরে বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে। এর ফলে অফিস-আদালত, হাটে-মাঠে, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, শিল্প বাণিজ্য, মিডিয়া প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে শান্তিবাহিনীর নিরস্ত্র অনুসারীরা জালের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। প্রত্যেকটি অবস্থানে থেকে এই নিরস্ত্র অনুসারীরা প্রকাশ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসন এবং গোপনে স্বাধীনতার জন্য বা স্বাধীন জুম্মল্যান্ড প্রতিষ্ঠার জন্য অভিন্ন লক্ষ্যে ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। তাই আজকের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সামনে, বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর সামনে, বাংলাদেশের ইন্টিলিজেন্স এজেন্সিগুলোর সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই নিরস্ত্র ও গুপ্ত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মোকাবেলার উপায় বের করা।
আমরা জানি, রাষ্ট্রগঠনের মৌলিক উপাদান হচ্ছে জাতীয়তা বা জাতীয়তাবোধের চেতনা। এই জাতীয়তাবোধের চেতনা থেকেই দেশপ্রেমের জন্ম হয়। এই জাতীয়তাবোধের চেতনা বা দেশপ্রেমের কারণেই ১৯৪৭ সালে এই ভূখ-ের নাগরিকেরা ভারতে যোগ না দিয়ে পাকিস্তান নামে, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশ নামে স্বাধীন হয়েছে। ইতিহাস খুললে দেখতে পাই, পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় সামন্ত সমাজের বড় অংশটিই ১৯৪৭ সালে এবং ১৯৭১ সালে এই জাতীয় চেতনার বিরোধিতা করে এ ভূখ-ে ভারত, মিয়ানমার ও পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করেছিল বা সমর্থন দিয়েছিল। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ৪৬ বছর পেরিয়ে গেলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের বাসিন্দাদের একটি অংশ এখনো এই জাতীয় চেতনার বিরোধিতা করে চলেছে। তার প্রমাণ ১৯৪৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের মাটি থেকে ভারতীয় পতাকা নামানোর দিনকে উপজাতীয় এ সকল জনগোষ্ঠীর একাংশ কর্তৃক ‘পাকিস্তান আগ্রাসন দিবস’ পালন করা, পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় আঞ্চলিক সংগঠনের নেতাদের স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস পালন না করা প্রভৃতি। শুধু জাতীয় চেতনার সাথে অঙ্গীভূত না হওয়াই নয়, বরং পার্বত্য চট্টগ্রামে এই জাতীয় চেতনার বিরুদ্ধে চরম বিদ্বেষমূলক, প্রতিহিংসামূলক ও ঘৃণাত্মক প্রচারণা চলানো হচ্ছে প্রবলভাবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন আঞ্চলিক সংগঠনের নেতারা ও তাদের অনুসারীগণ ক্রমাগত বিভিন্নভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ঘৃণাত্মক, বিদ্বেষমূলক ও প্রতিহিংসাপরায়ণ প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের এ অপপ্রচারণায় সরলপ্রাণ, সাধারণ ও নিরীহ পাহাড়ি তরুণরা বিভ্রান্ত হচ্ছে। এতে তাদের মনেও জন্ম নিচ্ছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতি  ঘৃণা, বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসা। বাংলাদেশ রাষ্ট্র উপজাতীয়দের শিক্ষা ও কর্মসংস্থান দিয়েছে বিশেষ কোটা, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের জন্যও দিয়েছে নানা প্রকার আর্থিক বিশেষ সুবিধা। এই কোটা ও আর্থিক সুবিধার আওতায় বড় হয়ে একটি পাহাড়ি তরুণের যেখানে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও অপার দেশপ্রেম প্রদর্শন করার কথা, বাস্তবে হচ্ছে তার উল্টো। পাহাড়ি সংগঠনগুলোর হেইট ক্যাম্পেইনের শিকার হয়ে আজ পাহাড়ের ঘরে ঘরে তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতি বিদ্বেষী তরুণ প্রজন্ম যাদের আনুগত্য বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতি নয়, বরং জুম্মল্যান্ড নামক কল্পিত রাষ্ট্রের প্রতি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে পলাতক (পরে ভারতে আটক) ক্যাপ্টেন উদ্ভাস চাকমা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। উদ্ভাস চাকমা ইনফেন্ট্রি অফিসার হিসাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে গৌরবোজ্জ্বল ক্যারিয়ার ও ভবিষ্যৎ গড়ার সুযোগ পেয়েছিল। পরে আর্টিলারি ও কমান্ডো অফিসারের কোর্সও করার সুযোগ পায় সে। এমন উন্নত ভবিষ্যতের হাতছানিও তাকে আটকে রাখতে পারেনি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে কল্পিত জুম্মরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী জুম্ম লিবারেশনর আর্মির প্রশিক্ষক হিসাবে যোগ দেয়ার জন্য ভারতে গমন করে। উদ্ভাস চাকমা শুধু একজন নয়, রাষ্টের বিভিন্ন সেক্টরে এমন অনেক উদ্ভাস চাকমা আছে যারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে কল্পিত জুম্ম রাষ্ট্রের জন্য কাজ করে যাচ্ছে, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিষোদগার ও অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের অপপ্রচারের প্রধান টার্গেট বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও পুনর্বাসিত বাঙালি। কারণও স্পষ্ট। কল্পিত জুম্ম রাষ্ট্রের পক্ষে এ দুটিই প্রধান বাধা। পাহাড়ি সন্ত্রাসী ও তাদের সমর্থকরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দীর্ঘদিন ধরে এ দুটির বিরুদ্ধে ধারাবাহিক অপপ্রচার চালিয়ে আসছে।
এদের জন্য মঞ্চ, মিডিয়া, বই, জার্নাল, গবেষণা, বুদ্ধিবৃত্তিক সমর্থন, আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষকতা সবই রয়েছে। জাতীয় গণমাধ্যম, বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিকদের একটি বড় অংশ সজ্ঞানে অথবা বিভ্রান্তির শিকার হয়ে এই রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতায় সমর্থন জুগিয়ে আসছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের কথা অনেকেই জানেন। কাজেই জুম্মরাষ্ট্রের সমর্থকদের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থনের কারণও স্পষ্ট। বাংলাদেশের তথাকথিত নাগরিক সমাজের সমর্থনের কারণও একই। দেখা যায়, নাগরিক সমাজের নেতাকর্মী কোনো না কোনোভাবে পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের প্রতি সহানুভূতিশীল বিভিন্ন দেশ ও সেসব দেশের এনজিও এবং দাতা সংস্থার সাথে কোনো না কোনোভাবে সম্পৃক্ত বা উপকারভোগী। পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের প্রতি সহানুভূতিশীল রাজনীতিবিদদের জন্যও এ কথা সত্য। তবে এদের বেশিরভাগই আবার বামধারার রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। পাহাড়ি আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর সাথে বাম ধারার রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর নানা কারণে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। সামগ্রিক এই সমর্থন, পৃষ্ঠপোষকতা, অপপ্রচারের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে জাতীয় পর্যায়ে জনসচেতনতা গড়ে উঠতে পারেনি। সে কারণে রামপাল নিয়ে জাতীয়ভাবে যে আন্দোলন দেখেছি, পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন সংশোধনী-২০১৬ এর বিরুদ্ধে তার ছিটেফোঁটাও পরিলক্ষিত হয়নি। অথচ গুরুত্ব বিচার করলে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন বাংলাদেশের এক-দশমাংশ  ভূখ- পার্বত্য চট্টগ্রামের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলেছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এর জন্য কে দায়ী? দায়ী রাষ্ট্র, দায়ী সরকারসমূহ, দায়ী দেশপ্রেমিক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনগুলো। কেননা তারা কখনই পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে জাতীয় দৃষ্টিতে দেখেনি, জাতীয়ভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের গুরুত্ব, সমস্যা ও সম্ভাবনাকে তুলে ধরেনি। পার্বত্য চট্টগ্রামের আন্তর্জাতিক গুরুত্ব এবং এ অঞ্চলকে ঘিরে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের বিষয়ে দেশবাসীকে সচেতন করেনি। সে কারণে সরকারের সাথে সাথে পার্বত্য নীতি পরিবর্তিত হয়েছে, এমনকি অফিসার পরিবর্তনের সাথে সাথেও এ নীতি পরিবর্তিত হতে দেখা যায়। অথচ প্রতিপক্ষ কিন্তু অর্ধ শতাব্দী ধরে একই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে এবং আজ তার সুফল পেতে শুরু করেছে।
একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। সকল ইতিহাস ও যুক্তি উপেক্ষা করে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে ও নাগরিক সমাজে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় জনগোষ্ঠীকে ‘আদিবাসী’ বলা হয়। এ নিয়ে কথা বলতে গেলে বলা হয়, ‘উপজাতি’ বললে তারা যদি অপমানিত বোধ করে এবং ‘আদিবাসী’ বললে তারা যদি সম্মানিত বোধ করে তাহলে সমস্যা কোথায়? কেউ কেউ এ নসিহতও করেন যে, বড় জাতি বাঙালিদের এতটুকু উদারতা দেখানো উচিত। অদ্ভুত এক সরল চিন্তা। কিন্তু ‘আদিবাসী’ উপমার আড়ালে যে ভয়াবহ রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের আন্তর্জাতিক ব্লু প্রিন্ট লুকায়িত রয়েছে, দেশের বেশিরভাগ মানুষই সে বিষয়ে অজ্ঞাত। কারণ রাষ্ট্র তাদের সচেতন করেনি। রাষ্ট্র মিডিয়াকে দূষেছে, অথচ মিডিয়াকেও ডেকে, বুঝিয়ে বলা হয়নি, কেন ‘আদিবাসী’ থিওরিটি বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর এবং কতটা ক্ষতিকর। আমাদের পাঠ্যপুস্তকে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে শুধু পড়ানো হয়, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জীবন ও সংস্কৃতি। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে বছরের পর বছর একই সিলেবাস পড়তে পড়তে শিক্ষার্থীদের ধারণা জন্মে পার্বত্য চট্টগ্রাম যেন শুধু পাহাড়িদের আবাসস্থল। ফলে বড় হয়ে তাদের ধারণা জন্মে বাঙালিদের ও সেনাবাহিনীকে সেখানে পাঠানো ভুল সিদ্ধান্ত। আমাদের সিলেবাসে ’৭১ সালের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনী ও সংগ্রামের কাহিনী পড়ানো হয় অথচ স্বাধীনতার পর দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় পার্বত্য চট্টগ্রামে শত শত সেনাসদস্য অকাতরে প্রাণ দিয়েছে তাদের জীবনী পড়ানো হয় না। ফলে শহীদ লে. মুশফিক, ক্যাপ্টেন জসিমউদ্দীন, মেজর মহসিন রেজাদের আত্মত্যাগ আড়ালেই রয়ে গেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে ’৭১ শহীদদের স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে জেলায় জেলায়। অথচ স্বাধীনতার পর দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যারা শহীদ হয়েছেন তাদের নাম কোথাও প্রদর্শিত হয়নি। ফলে পর্যটকরা পার্বত্য চট্টগ্রামের সৌন্দর্য দেখে বিমোহিত হয়ে ফিরে আসেন, কিন্তু এই পার্বত্য চট্টগ্রামকে পর্যটনবান্ধব করে আজকের অবস্থায় আনতে যারা অকাতরে প্রাণ দিয়েছেন তাদের কথা কেউ জানে না। হলিউড বলিউডে রাষ্ট্রবিরোধীদের সাথে নিরাপত্তা বাহিনীর বিভিন্ন লড়াইয়ের বিভিন্ন কাহিনী নিয়ে সিনেমা, নাটক তৈরি হয় কিন্তু বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরাপত্তা বাহিনীর সংগ্রাম নিয়ে কোনো ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরি হয়নি। বলিউডে কারগিল নিয়ে অনেক সিনেমা হয়েছে, সীমান্তে ফেলানীকে হত্যা করে ঝুলিয়ে রেখে সিনেমা বানিয়েছে বজরঙ্গি ভাইজান। ওরা নিরাপত্তা বাহিনীর ত্যাগকে জাতীয়ভাবে গৌরবের উপাদান হিসাবে তুলে ধরছে কিন্তু বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম। বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের সম্ভাবনা, ভৌগোলিক গুরুত্বের বিষয়টি পড়ানো হয় না। পড়ানো হয় না পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি ও নিরাপত্তা বাহিনীর অবস্থানের গুরুত্ব। ফলে আমরা চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, বৈসাবি, কোমর তাঁত, দোচুয়ানী, বাঁশ নৃত্য, বোতল নৃত্য প্রভৃতি উপজাতীয় সম্প্রদায়ের নাম, খাদ্য, পোশাক ও সংস্কৃতির বাইরে আর কিছুই জানতে পারছি না।
দেখা যায়, আন্তর্জাতিক কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিদর্শন করতে এলে তাকে যে সকল প্রতিষ্ঠান থেকে তথ্য দেয়া হয় তা একটি পক্ষের প্রতি পক্ষপাতদুষ্টু। এমনকি তিনি/তারা যাদের সাথে কথা বলেন, সেই নাগরিক সমাজের ব্যক্তিবর্গও বিশেষ পক্ষের প্রতি সহানুভূতিশীল। ফলে ঐ প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি ফিরে গিয়ে যখন রিপোর্ট করেন তাও একদেশদর্শী হয়। এতে করে রাষ্ট্রের ভাবমর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয়। রাষ্ট্র তখন ওই ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে পক্ষপাতদুষ্ট বলে অভিযোগ করে। কিন্তু বাস্তবতা কী? রাষ্ট্র কি তার কাছে নিরপেক্ষ তথ্য গবেষণা পৌঁছে দিয়েছে? নাকি রাষ্ট্রের এ ধরনের কোন ইন্সট্রুমেন্ট বা থিংক ট্যাংক আছে? বিষয়গুলো ভেবে দেখার দাবি রাখে।
তাই আজ সময় এসেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে জাতীয় সচেতনতা সৃষ্টির উপায় বের করা। একই সাথে এ অঞ্চল নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে যে বিভ্রান্তিকর, হিংসাত্মক, বিদ্বেষপ্রসূত ও ঘৃণাব্যঞ্জক প্রচারণা চালানো হচ্ছে তা মোকাবেলা করা। এই কাজটি খুব সহজ নয়। কেননা শান্তিচুক্তির আগে শান্তিবাহিনীর সদস্যরা যখন অস্ত্র নিয়ে জঙ্গলে অবস্থান করছিলো তখন হয়তো তাদের অস্ত্র নিয়ে মোকাবেলা করা যেত। কিন্তু শান্তিবাহিনীর যে সাবেক সদস্য বা তাদের অনুসারী অফিসে, আদালতে, মিডিয়াতে, মঞ্চে, ময়দানে, এনজিওতে, আন্তর্জাতিক ফোরামে বসে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত তাকে তো অস্ত্র দিয়ে মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। তাকে মোকাবেলার জন্য তার ক্ষেত্রেই উপায় ও ইন্সট্রুমেন্ট তৈরি করতে হবে। ফেসবুকসহ সামাজিক গণমাধ্যমে পোস্ট দিয়ে যে ব্যক্তিটি সরকার ও দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করছে তাকে আইসিটি অ্যাক্ট দিয়ে মোকাবেলা করে চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন সম্ভব নয়, মিথুন চাকমা তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। সামাজিক গণমাধ্যমের অপপ্রচার যেমন সামাজিক গণমাধ্যমেই কাউন্টার করে জবাব দিতে হবে। তেমনি মিডিয়া, বই, পুস্তক, গবেষণা, সেমিনারের জবাব আইন ও শাসন দিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। এগুলোর জবাবও মিডিয়া, বই, পুস্তক, জার্নাল, গবেষণা, তথ্য, উপাত্ত ও সেমিনার করেই দিতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের এমন পরিস্থিতি মোকাবেলায় আজ নিরাপত্তা টহলের চেয়েও অপপ্রচারের মোকাবেলা (কাউন্টার ক্যাম্পেইনিং) অধিক গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ ফেসবুকের বিরুদ্ধে ফেসবুক, কলমের বিরুদ্ধে কলম, তথ্যের বিরুদ্ধে তথ্য, মিডিয়ার বিরুদ্ধে মিডিয়া, মঞ্চের বিরুদ্ধে মঞ্চ সৃষ্টি করতে হবে। আগামী দিনের তরুণ ও যুবকেরা যেনো সন্ত্রাসবাদী, রাষ্ট্রবিরোধী ও তাদের অনুসারীদের খপ্পরে পড়ে রাষ্ট্রবিদ্বেষী না হয়ে পড়ে তা দেখার দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে। তাদের প্রবলভাবে জাতীয়তাবোধে উজ্জীবিত করতে, দেশপ্রেমে অনুপ্রাণিত করতে প্রয়োজনীয় উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি প্রণয়ন করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারের উন্নয়ন ও ইতিবাচক পদক্ষেপগুলোর প্রতি পার্বত্যবাসীকে সচেতন ও আন্তরিক করতে পদক্ষেপ নিতে হবে। একই সাথে ১৬ কোটি মানুষকে দেশের এই এক দশমাংশ ভূখ-ের প্রতি ভালোবাসা, আগ্রহ, অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। এ কাজে কোনো গাফলতি, ধীরগতি কেবল জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও অখ-তাকেই হুমকির মুখেই ফেলবে।
email: [email protected]



 

Show all comments
  • তৌহিদ ২২ জানুয়ারি, ২০১৭, ১০:৫৮ এএম says : 0
    আমি আপনার কথার সাথে সম্পূর্ণ একমত।
    Total Reply(0) Reply
  • Abdul Ahad ২২ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:১৮ পিএম says : 0
    পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারের উন্নয়ন ও ইতিবাচক পদক্ষেপগুলোর প্রতি পার্বত্যবাসীকে সচেতন ও আন্তরিক করতে পদক্ষেপ নিতে হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • জুয়েল ২২ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:১৯ পিএম says : 0
    আশা করি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়গুলো ভেবে দেখবেন।
    Total Reply(0) Reply
  • Laboni ২২ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:২০ পিএম says : 0
    Many many thanks to the writer & The Daily Inqilab for this news.
    Total Reply(0) Reply
  • Kamal ২২ জানুয়ারি, ২০১৭, ৪:৩১ পিএম says : 0
    apnara aro basi basi ai dhoroner report korun. tahle jodi prosason kono valo babostha ney
    Total Reply(0) Reply
  • মাহমুদ ২২ জানুয়ারি, ২০১৭, ৪:৩২ পিএম says : 0
    একজন পার্বত্যবাসী হিসেবে যারা সমতলে মানুষ হয়েও এই অঞ্চল নিয়ে কাজ করেন, তাদের জন্য অনেক দোয়া করছি।
    Total Reply(0) Reply
  • হারুন ২২ জানুয়ারি, ২০১৭, ৪:৩৫ পিএম says : 0
    ওখানকার আসল পরিস্থিতি দেশ বিদেশের কাছে তুলে ধরতে হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • বেলাল ২২ জানুয়ারি, ২০১৭, ৪:৩৬ পিএম says : 0
    দেশ প্রেম থেকে দেশের অখন্ডতার স্বার্থে সরকারি ও বেসরকারিভাবে এই কাজগুলো করা দরকার।
    Total Reply(0) Reply
  • আফরোজা ২২ জানুয়ারি, ২০১৭, ৪:৩৮ পিএম says : 0
    ওই অঞ্চলের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে প্রশাসনকে আরো কঠোর হতে হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • Fahad ২২ জানুয়ারি, ২০১৭, ৪:৩৯ পিএম says : 0
    ১৬ কোটি মানুষকে দেশের এই এক দশমাংশ ভূখ-ের প্রতি ভালোবাসা, আগ্রহ, অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ