Inqilab Logo

শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

ক্ষতিকর আহরণ উপকরণ দেশের মৎস্য সম্পদের জন্য হুমকি

| প্রকাশের সময় : ১৯ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

নাছিম উল আলম : দেশের উপকূলীয় পাঁচটি জেলার নদ-নদীসহ উন্মূক্ত জলাশয়ে ক্ষতিকর জাল এবং মাছ বিনাশী বিভিন্ন সরঞ্জাম অপসারণের কর্মসূচি শেষ হয়েছে সম্প্রতি। ইলিশসহ মৎস্য সম্পদ রক্ষায় ক্ষতিকর জাল অপসারণে ১৫ দিনের এ বিশেষ কর্মসূচি বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয় থেকে পাঁচজন যুগ্ম সচিবকে ১ থেকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সরেজমিনে বরিশাল, নোয়াখালী, ভোলা, পটুয়াখালী ও বরগুনাতে বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করা হয়। এসব যুগ্ম সচিবগণ  জেলাগুলোর মৎস্য সম্পদ সমৃদ্ধ নদ-নদী থেকে ক্ষতিকর জাল অপসারণে বিশেষ অভিযান পরিচালনা ও তত্ত্বাবধান করেন। সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনসহ পুলিশ ও কোস্ট গার্ড এ অভিযানে সহায়তা করে। মুক্ত জলাশয়ের মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান এখন সারা বিশ্বে চতুর্থ। এক্ষেত্রে চীন, ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার পরেই বাংলাদেশের অবস্থান বলে মৎস্য অধিদফতর সূত্রে বলা হয়েছে।
মৎস্য অধিদফতরের দায়িত্বশীল সূত্রের মতে ১৫ দিনের এ বিশেষ অভিযানে প্রায় ৩২ লাখ মিটার কারেন্ট জাল আটক ও বাজেয়াপ্ত করে পুড়িয়ে ফেলা হয়। এসময় ৫ শতাধিক অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে প্রায় সাড়ে ৭শ’ বেহুন্দি জালসহ অন্যান্য আরো প্রায় হাজারখানেক ক্ষতিকর জাল আটক ও বাজেয়াপ্ত করা হয়। অভিযান চলাকালে প্রায় ১০ টনের  মতো জাটকা ও ২ টন অন্যান্য মাছও আটক করা হয়। গত ১ নভেম্বর থেকে আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত সারা দেশে জাটকা নিধনে সরকারি নিষেধাজ্ঞা বলবত রয়েছে।
এরই মাঝে মৎস সম্পদ সম্প্রসারণে ক্ষতিকর বেহুন্দী জাল, বেড় জাল ও কারেন্ট জালের মতো ক্ষতিকর জালসমূহ অপসারণে এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়। দেশে কারেন্ট জাল উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহারে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা জারির পরেও তা এখনো পরিপূর্ণভাবে কার্যকর করা সম্ভব হয়নি কতিপয় অতি লোভী ব্যবসায়ীর কারণে।  এখনো অবৈধ ও দেশের মৎস্য সম্পদের জন্য ক্ষতিকর এ জাল বিপণন ও ব্যবহার কিছুটা হলেও অব্যাহত রয়েছে। এ প্রেক্ষিতেই মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে মৎস্য অধিদফতর ১৫ দিনের এক বিশেষ অভিযান পরিচালনা করল। অভিযানকালে প্রায় ৫০ জেলে ও মৎস্যজীবীকে বিভিন্ন মেয়াদে জেল ছাড়াও আরো বিপুল সংখ্যকের কাছ থেকে পাঁচ লক্ষাধিক টাকা জরিমানা ও আদায় করা হয়।
দক্ষিণাঞ্চলসহ উপকূলীয় এলাকায় নানা ক্ষতিকর মৎস্য আহরণÑ উপকরণ দেশের মৎস্য সম্পদের জন্য ক্রমাগত হুমকির সৃষ্টি করলেও তা বন্ধে এতদিন তেমন কোনো বাস্তব উদ্যোগ ছিল না। এমনকি এসব ক্ষতিকর মৎস্য আহরণÑ উপকরণের উৎপাদন ও বিপণন বন্ধেও কোনো কঠোর পদক্ষেপ ছিল না। দীর্ঘ দেড় যুগ পরে দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে কারেন্ট জাল উৎপাদন ও বিপণন নিষিদ্ধ ঘোষিত হবার পরেও কতিপয় ব্যবসায়ী গোপনে তা বাজারজাত করছিল। তবে গত ১ জানুয়ারি থেকে ১৫ দিনের অভিযানে এর বিরুদ্ধে একটি কঠোর বার্তা দিয়েছে সরকার। পাশপাশি ক্ষতিকর এসব মৎস্য আহরণ উপকরণ বন্ধে জেলে ও মৎস্যজীবীদের উদ্বুদ্ধকরণের বিষয়টিও জোরদার করার তাগিদ দিয়েছেন ওয়াকিবহাল মহল।
মৎস্য অধিদফতরের এক প্রকাশনায় কারেন্ট জাল, বেহুন্দি জাল, মশারি জাল, চরঘেরা জাল ও পাঙ্গাস চাঁই-এর মতো ক্ষতিকর মৎস্য আহরণ উপকরণের নানা খারাপ দিক তুলে ধরা হয়েছে। ইলিশ প্রজননকে নির্বিঘœ করতে প্রায় ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার উপকূলীয় প্রজনন এলাকাসহ দক্ষিণাঞ্চলের কয়েকটি অভয়াশ্রমে অগ্রহায়নের বড় পূর্ণিমার সময় এবার ২২ দিন আহরণ নিষিদ্ধ রাখা হয়।  কিন্তু তার মধ্যেও কিছু জেলে কারেন্ট জালসহ বিভিন্ন ক্ষতিকর মৎস্য আহরণ উপকরণের ব্যবহার করতে দেখা গেছে। প্রজননের মূল সময়টিতে ইলিশ আহরণের প্রবণতা আগের তুলনায় যথেষ্ট হ্রাস পেলেও সারা বছর জুড়ে ক্ষতিকর মৎস্য আহরণ উপকরণের ব্যবহার অব্যাহত থাকার মধ্যে এ বিশেষ অভিযান যথেষ্ট ইতিবাচক ফল দেবে বলে আশাবাদী মৎস্য অধিদফতরের দায়িত্বশীল মহল।
এসব ক্ষতিকর মৎস্য আহরণ-উপকরণ বা ফিশিং গীয়ার আমাদের নদ-নদীসহ উন্মুক্ত জলাশয়ের জীব-বৈচিত্র্যের ওপরও ক্রমাগত বিরূপ প্রভাব ফেলছে। ক্ষতিকর উপকরণসমূহ আমাদের চিরাচরিত মৎস্য প্রজাতি, ইলিশ পোনা-জাটকা, চেউয়া, চাপিলা, বেলে, সিলন, বাটা, চিংড়ি, গাউরা, পোয়া, ফাইসা, রিটা, বাচা, পাংগাশসহ দেশের একক বৃহৎ মৎস্য প্রজাতি ইলিশের জন্যও ক্রমাগত বিপর্যয় ডেকে আনছে।
এতদিন চাঁদপুরের মোহনপুর, এখলাসপুর, আমিরাবাদ, আনন্দবাজার, পুরান বাজার, নীল কমল, চর ভৈরবী, হাইমচর, ভোলার মনপুরা, কালীগঞ্জ, চর ধলুয়া, লক্ষ্মীপুরের চর আলেকজান্ডার, রামগতি এবং নোয়াখালীর হাতিয়া ছাড়াও পদ্মা ও মেঘনার বিভিন্ন অবস্থানে নানা ধরনের ক্ষতিকর জাল ও মৎস্য আহরণ উপকরণসমূহের ব্যাপক ব্যবহার অব্যাহত ছিল। এ অভিযানের পরে পরিস্থিতি কি হয় তা নিয়মিত মনিটরিংসহ মাঝে-মধ্যেই এ ধরনের অভিযান পরিচালনার তাগিদ দিয়েছেন মৎস্য বিজ্ঞানীগণ।
মৎস্য অধিদফতর ও মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট-এর উচ্চ পর্যায়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ও গবেষকদের মতে, আমাদের অভ্যন্তরীণ নদ-নদীসমূহে মৎস্য আহরণে ব্যবহৃত উপকরণের ৫০ ভাগই এখনো নদ-নদীর জীব-বৈচিত্র্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। এসব মৎস উপকরণাদি বা ফিশিং গিয়ারসমূহের মধ্যে বেহুন্দি জাল, কাঁথা বেড় জাল, চর ঘেরা জাল, ভেশাল জাল,  কারেন্ট জাল ও পাঙ্গাশ চাই সর্বাধিক ক্ষতিকর। এসব জাল ও উপকরণ বিভিন্ন মাছের বংশ বিস্তার ব্যাহত করাসহ অনেক মাছকে নির্বংশ করছে বলেও আতংকিত মৎস্য বিজ্ঞানীগণ।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, দেশে স্বাদু পানির ২৬৫ প্রজাতির মাছের মধ্য ৫৪টি বিপন্নের পথে। এর মধ্যে ৩২টি প্রজাতিই ছোট মাছ হিসেবে বিবেচিত মৎস্য বিজ্ঞানীদের কাছে। বিপন্ন ছোট মাছসমূহের মধ্যে ৫টি চরমভাবেই বিপন্ন। এছাড়াও ১৮টি বিপন্ন ও ৯ প্রজাতির ছোট মাছ সংকটাপন্ন বলে মৎস্য অধিদফতরের এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে। ‘দি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব কনজার্ভেশন অব নেচার-আইইউসিএন’ ২০০৩ সালে পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেশের অভ্যন্তরীণ জলাশয়ের ৫৪ প্রজাতির মাছকে ‘বিলুপ্তপ্রায়’ বলে ঘোষণা করে।
২০১৪-১৫ অর্থ-বছরে দেশে মোট মাছের উৎপাদন ছিল পায় ৩৭ লাখ টন। যার মধ্যে অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে উৎপাদনই ছিল ৩০.৮৫ লাখ টন এবং মুক্ত জলাশয়ে উৎপাদন ছিল ১০.২৪ লাখ টনের  মতো। ২০১৩-১৪ সালে দেশে মোট মাছের উৎপাদন ছিল ৩৩৫.৪৮ লাখ টন। আর এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে উৎপাদন ছিল ২৯.৫২ লাখ টন। এর মধ্যে নদী ও মোহনায় থেকে উৎপাদন ছিল ১.৬৭ লাখ টন।
এ বিপুল মৎস্য সম্পদের জন্য হুমকি সৃষ্টিকারী নানা ধরনের ক্ষতিকর মৎস্য আহরণ-উপকরণ বা ফিশিং গিয়ারের অনেক বিলম্বে হলেও সম্মিলিত অভিযান পরিচালিত হয়েছে। যা দেশের মৎস্য সম্পদের জন্য যথেষ্ট ইতিবাচক ফল দেবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীগণ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ