Inqilab Logo

মঙ্গলবার ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ঘরে ঘরে মাদকের ভয়াল থাবা

প্রকাশের সময় : ১৭ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৩৫ পিএম, ১৬ জানুয়ারি, ২০১৭

নূরুল ইসলাম : সারাদেশের মতো নিয়ন্ত্রণহীন মাদকাসক্তির বিস্তৃতি রাজধানীবাসীকেও গ্রাস করেছে। অভিজাত এলাকা হয়ে পাড়া- মহল্লা ছাপিয়ে মাদকের ভয়াল থাবা এখন ঘরে ঘরে। ভয়াল মাদকাসক্তি তারুণ্য, মেধা, বিবেক, লেখাপড়া, মনুষ্যত্ব- সবকিছু ধ্বংস করে দিচ্ছে। বিনষ্ট করে দিচ্ছে স্নেহ-মায়া, ভালোবাসা, পারিবারিক বন্ধন। মাদকাসক্ত সন্তানের হাতে বাবা-মা, ঘনিষ্ঠ স্বজন নির্মম হত্যাকা-ের শিকার হচ্ছেন। নেশাখোর পিতা মাদক সংগ্রহে ব্যর্থ হওয়ার ক্রোধে নিজ সন্তানকে খুন করছে। নেশার টাকা না পেয়ে স্ত্রীকে আগুনে পুড়িয়ে মারা, মাকে জবাই করা, আদরের সন্তানকে বিক্রি করে দেয়ার মতো অমানবিক ঘটনাও ঘটছে। কয়েক বছর আগে রাজধানীতেই মাদকসেবী মেয়ের হাতে পুলিশ অফিসার বাবা ও মা খুনের ঘটনা নিয়ে সারাদেশে তোলপাড় হয়। একদিন আগে গত রোববার সমাজে মাদকের ভয়াবহতা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি ও যুবসমাজ মাদকে নিমজ্জিত হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সরকারি প্রতিশ্রুতি সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। কমিটির বৈঠকে ভয়াবহ এই ব্যাধি থেকে সমাজকে রক্ষায় র‌্যাব, পুলিশ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও বিজিবিসহ সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানকে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে। পুলিশের একাধিক প্রতিবেদনেও মাদকের জের হিসেবে অপরাধ বৃদ্ধির ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। মাদকাসক্তির কারণেই চাঁদাবাজি, ছিনতাই-রাহাজানি, ডাকাতি ও খুন-খারাবির ঘটনা বেশি ঘটছে বলেও একাধিক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ভুক্তভোগীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সারাদেশের মতো রাজধানীতে এখন মাদকের ছড়াছড়ি। এমন কোনো এলাকা নেই যেখানে মাদক বেচাকেনা হয় না। উঠতি বয়সীদের পাশাপাশি স্কুল পড়ুয়ারাও এখন ইয়াবা, হেরোইন, ফেনসিডিলে আসক্ত হয়ে পড়েছে। এখন টিফিনের টাকা একত্র করে সহপাঠীরা মিলেমিশে হেরোইন-ইয়াবা সেবন করলেও টাকা না পেলেই তারা শুঁকছে জুতায় লাগানোর পেস্টিং গাম। রাজধানীতে হাত বাড়ালেই পাওয়া যাচ্ছে  গাঁজা, ইয়াবা, ইনজেকশন, হেরোইন, চোলাই মদসহ বিভিন্ন মাদক। এসব না পেলেও পাড়া-মহল্লার দোকানে অনায়াসে পাওয়া যায় উত্তেজক নেশাজাতীয় এনার্জি ড্রিংকস। বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেছে, নেশার সর্বগ্রাসী থাবা সবচেয়ে বেশি ছড়িয়ে পড়ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্যাম্পাস থেকে শুরু করে মাধ্যমিক স্কুলের গ-ি পর্যায়েও মাদকের ভয়াল বিস্তার হয়েছে। সহজলভ্যতা, বেকারত্ব বৃদ্ধি, কালো টাকার আধিক্য, পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণ ইত্যাদি কারণে মাদকাসক্তের মিছিল দিন দিন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর গত কয়েক মাসে কয়েক হাজার পিস ইয়াবাসহ বিক্রেতাদের আটক করেছে। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে র‌্যাব-পুলিশ সদস্যরা অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা উদ্ধার ও পাইকারি বিক্রেতা পর্যায়ের মাদক সরবরাহকারীদের আটক করে থাকে। টেকনাফ-কক্সবাজার, চট্টগ্রাম এলাকায় অভিযানে নামলেই মিলছে লাখ লাখ পিস ইয়াবা। তারপরও ইয়াবার নেশাকে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের এক কর্মকর্তা জানান, ইয়াবা বাণিজ্যের সঙ্গে প্রভাবশালী লোকজন জড়িত। কেউ বেশি সংখ্যক ইয়াবা নিয়ে আটক হলেই ভিআইপি শ্রেণির প্রভাবশালীরা তাদের ছাড়িয়ে নিতে তদবির করে থাকে। রাজনৈতিক নেতারাই নিয়ন্ত্রণ করছে মাদক বাণিজ্য। কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে মহানগর, জেলা, উপজেলা, ওয়ার্ড এমনকি ইউনিট পর্যায়ের অনেক নেতা-কর্মী-সমর্থক সরাসরি মাদক কেনাবেচা করছে। ইউনিয়ন পর্যায়ের কাউন্সিলর থেকে শুরু করে ইউপি চেয়ারম্যান, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান, কতিপয় জাতীয় সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধেও মাদক কেনাবেচাসহ সরবরাহ কাজে জড়িত থাকার সুস্পষ্ট অভিযোগ রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর পাড়া-মহল্লায় দিন দিন মাদকাসক্তের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। প্রভাবশালীরা মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে বলে অনেক ভুক্তভোগীই এ বিষয়ে প্রতিকারও চাইতে পারেন না। কদমতলী থানার মুরাদপুর এলাকার এক চাকরিজীবী জানান, তার ছেলে এইচএসসি পাস করার পর মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। এলাকার সহকর্মীরাই ছেলেকে মাদকাসক্ত বানিয়েছে বলে ওই অবিভাবকের অভিযোগ। তিনি বলেন, আমার বাড়ির আশপাশেই ইয়াবা বিক্রি হয়। যারা বিক্রি করে তাদের বহু অনুরোধ করেছি এ এলাকায় এসব বিক্রি না করার জন্য। কিন্তু তারা শোনেনি। এরপর একদিন যখন রেগে গেলাম তখন প্রভাবশালীদের কাছ থেকে প্রচ্ছন্ন হুমকি পেলাম। তারা জানিয়ে দিলো এসব নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করা যাবে না। ওই অবিভাবক বলেন, পরে জানতে পেরেছি এই এলাকায় ইয়াবা ব্যবসার নিয়ন্ত্রক স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের আত্মীয়। সে জন্যই এ বিষয়ে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস করে না। যাত্রাবাড়ী এলাকার এক বাড়িওয়ালা আক্ষেপ করে বলেন, আমার ছেলে গাঁজা সেবন করে একথা শোনার পর আমি বিস্মিত। কারণ আমি নিজে কোনোদিন একটা সিগারেটে টান দেইনি। কিন্তু বাস্তবতা হলো আসলেই সে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে। আমি চিকিৎসা করাচ্ছি। কিন্তু কতদিন তাকে মাদকমুক্ত রাখতে পারব জানি না। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ঘরের চার দিকে যেভাবে প্রকাশ্যে ইয়াবা ও গাঁজা বিক্রি হচ্ছে তাতে নেশাগ্রস্ত ছেলেকে ঠেকানো খুবই কষ্টকর। শুধু কদমতদলী, যাত্রাবাড়ী নয়, রাজধানীর প্রতিটি এলাকার চিত্র একইরকম। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ব্যবসায়ী অভিভাবক বলেন, তার বুয়েটে পড়–য়া ছেলে নেশাসক্ত হয়ে পড়েছে। কিভাবে হয়েছে তা তিনি জানেন না। জানতে পেরেছেন বুয়েট থেকে তাকে ডাকার পর। সেখানে গিয়ে শিক্ষকদের কাছে থেকে জানতে পেরেছেন তার ছেলে এক বছরে মাত্র কয়েকটি ক্লাসে উপস্থিত ছিল। পরীক্ষা দেয়নি একটাও। এ কারণে তার প্রমোশনও হয়নি। ওই অভিভাবক হতাশা প্রকাশ করে বলেন, বিষয়টা এতটাই স্পর্শকাতর যে, কাউকে বলতেও পারছি না। আবার নিজেও সহ্য করতে পারছি না। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আমার ঘর-সংসার সব তছনছ করে দিয়েছে আমার এই ছেলে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মাদকই এখন আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শেষ করে ফেলছে। তাদের ধ্বংসের পাশাপাশি সমাজকেও কলুষিত করছে। মরণনেশা ইয়াবা এখন সারাদেশের আনাচে- কানাচে পাওয়া যায় বলে অনেকেই এতে আসক্ত হয়ে পড়ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. আমানউল্লাহ বলেন, মাদকের বিশাল নেটওয়ার্ক সারাদেশেই ছড়িয়ে পড়ায় নেশাসক্তদের সাথে ব্যবসায়ীও বেড়েছে। সহজলভ্য হওয়ায় কিশোর, তরুণ-তরুণী, যুবক সবাই মাদক কিনতে পারছে। তিনি বলেন, মাদকের বিস্তার রোধ করার জন্য রাষ্ট্রকে প্রথমে আন্তরিক হতে হবে। এরপর সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। মাদক বিস্তারের জন্য টিভি-মিডিয়াকে অনেকাংশে দায়ী করে তিনি বলেন, মাদক নিয়ে অনুষ্ঠান, খবর প্রচার আমাদের মিডিয়াগুলোর কাছে অনেকটা ফ্যাশনের মতো  হয়ে গেছে। এগুলো বন্ধ হওয়া দরকার। এজন্য টেলিভিশনের অনুষ্ঠান প্রচারের ক্ষেত্রে ফিল্টারিং থাকা দরকার।



 

Show all comments
  • Nannu chowhan ১৭ জানুয়ারি, ২০১৭, ৭:৪৭ এএম says : 0
    What is doing auntie narcotics dpt.Also why home minister can't take action those powerful leaders& rich people?why this administration wants to see our future generation will be brainless addict?
    Total Reply(0) Reply
  • মোশাররফ হোসাইন খাঁন ১৭ জানুয়ারি, ২০১৭, ১১:২২ পিএম says : 0
    আমাদের উচিং সামাজিক সচেতনতা এবং মনস্তান্তিক মূল্যবোধকে সজাগ রাখা এবং আইনের সঠিক ব্যবহার তাহলে সমাজে মাদক কেন কোন অসামাজিক কায' কম হবেনা
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ময়লা

১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
২৬ নভেম্বর, ২০২১
৯ নভেম্বর, ২০২১
১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১
১১ জানুয়ারি, ২০২১

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ