Inqilab Logo

বুধবার ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১, ০৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উত্তরায় লেকের জমিতে অবৈধ বহুতল ভবন

রাজউকের রহস্যজনক ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন

| প্রকাশের সময় : ১৪ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

স্টাফ রিপোর্টার : রাজধানীর উত্তরাতে লেকের জমি দখল করে নির্মাণ করা হচ্ছে বহুতল ভবন। এ ব্যাপারে এলাকাবাসীর অভিযোগও আমলে নিচ্ছে না রাজউকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। লেক পাড়ের বৃক্ষ নিধন করে প্রভাবশালীরা স্টিলের বহুতল ভবন নির্মাণ করায় রাজউকের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এলাকাবাসী। তারা বলছেন, উত্তরায় এখন দখলের মহোৎসব চলছে। খেলার মাঠ, লেক, জলাশয়, প্রধান সড়ক, ফুটপাত, ছোট-বড় রাস্তা, অলিগলি কোথাও ফাঁকা নেই। সরকারি খালি জায়গা দেখলেই জবরদখল করে গড়ে তোলা হচ্ছে বিভন্ন ধরনের মার্কেট ও দোকানপাট। সরকারদলীয় বড় বড় নেতাদের নামে চলছে এসব অবৈধ দখল। অবৈধ দখলদাররা কখনো মন্ত্রী-এমপির নামে, কখনো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নামে, কিংবা সরকারদলীয় প্রভাবশালী নেতাদের নাম
ভাঙিয়ে রাজধানীর উত্তরাতে হাজার কোটি টাকার জমি দখল করেছে গত পাঁচ বছরে। স্বয়ং রাজউকের কর্মকর্তারাই এ দখল প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত রয়েছে বলে ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। রাজউকের কাছে স্থানীয় লোকজন লিখিতভাবে অভিযোগ করার পরও দখলমুক্ত হচ্ছে না। ফলে গত পাঁচ বছরের মধ্যে একবারও রাজউক এসব দখলকৃত জমি উদ্ধারে তৎপর হয়নি। সফি নামের এক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী আওয়ামী লীগের নেতাদের সহযোগিতায় ১১ নম্বর সেক্টরের আবাসিক এলাকায় রাজউকের জমি জবরদখল করে গড়ে তুলেছেন বিশাল কাঁচাবাজার। ওই কাঁচাবাজার থেকে প্রায় ১০ কোটি টাকা দুই বছর আগেই হাতিয়ে নিয়েছে বলে দোকানদাররা জানিয়েছেন। তারা বলছেন, জমজম টাওয়ারের মালিক সফিকুল ওই মার্কেট থেকে প্রতিমাসে প্রায় এক কোটি টাকা চাঁদা হাতিয়ে নিচ্ছেন।  এ ছাড়া উত্তরায় এখনো লেকও বেদখল হয়ে যাচ্ছে।
এলাকাবাসী জানান, ওয়ার্ড কাউন্সিলর আফসার উদ্দিন আহমদ উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টরে লেক দখল করে স্টিলের বহুতল ভবন নির্মাণ করছেন। কয়েক বছর আগে লেক পাড়ে মাটি ভরাট করে সেখানে বৃক্ষ রোপণ করা হয়। রাজউক লেক পাড়ে বনায়ন করার পর সেখানে বসানো হয় ফার্নিচারের অবৈধ মার্কেট। ফার্নিচার মার্কেটের পাশাপাশি  কিছুদিন আগে ওই স্থানে বহুতল ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেন কাউন্সিলর আফসার উদ্দিন। স্থানীয়দের অভিযোগ, রাজউকের সহযোগিতা নিয়েই অবৈধ দখলদাররা উত্তরা লেকের ভেতর বহুতল ভবন নির্মাণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এলাকার সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির জন্য লেক পাড়ে বৃক্ষ রোপণ করা হলেও বৃক্ষ নিধন করে এখন সেখানে নির্মাণ করা হচ্ছে বহুতল মার্কেট। আর এসব কিছুই হচ্ছে রাজউকের সহযোগিতায়। অভিযোগ রয়েছে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে রাজউকের নির্বাহী প্রকৌশলী মহিউদ্দীন এ অবৈধ মার্কেট স্থাপনে সহযোগিতা করছেন। এলাকাবাসী এ ব্যাপারে অভিযোগ করলেও বিষয়টি তিনি আমলে নেননি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর উত্তরাসহ নগরীর বিভিন্ন এলাকায় রাজউকের ১৫শ’ বিঘা জমি দীর্ঘদিন ধরে বেদখল রয়েছে। রাজউক অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান শুরু করলেও   রহস্যজনক কারণে তা এখন বন্ধ রয়েছে। বেদখলকৃত জমি উদ্ধারে কোনো মাথা ব্যথা নেই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। বরং দখলদারদের সাথে তাদের যোগসাজশ রয়েছে। সম্প্রতি রাজউকের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশেই উত্তরায় কয়েক শ’ কোটি টাকার জমি দখল করে নিয়েছে প্রভাবশালীরা। অভিযোগকারীরা বলছেন, উত্তরায় রাজউকের জমি দখলের মহোৎসব চলছে। এসব জমিতে অস্থায়ী দোকানপাঠ, কাঁচাবাজার এবং বিভিন্ন মার্কেট তৈরি করে বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছে ভাড়া দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। উত্তরা সোনারগাঁও জনপদ রোডর উভয়পাশে ১৩, ১২, ১১ ও ১০ নম্বর সেক্টরে প্রায় হাজার কোটি টাকার রাজউকের জমি দখল করেছে প্রভাবশালী মহল। এ ছাড়া ওই রোডের ফুটপাতগুলোও অস্থায়ী ব্যবসায়ীদের দখলে। ফলে এলাকাবাসীর চলাচল করতে নানা সমস্যা ও দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। আর এ দখল চলছে রাজউকের কর্মকর্তাদের সহযোগিতায়।
উত্তরা পশ্চিম থানা আওয়ামী লীগের একজন নেতা জানান, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী, রাজউকের চেয়ারম্যান ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নাম ভাঙিয়ে নব্য আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের কিছু হাইব্রিড নেতা এ দখল প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত রয়েছে। এদের কারণে দলের সম্মান মারাত্মকভাবে ক্ষুণœ হচ্ছে। তিনি জানান, বিএনপির কয়েক নেতার সাথেও এদের যোগসাজশ রয়েছে। তিনি বলেন, ব্যবসায়ী শফিক ও তার কয়েকজন সহযোগী উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরে রাজউকের জমি দখল করে কাঁচাবাজার তৈরি করেছে। এর সাথে রাজউকের অসাধু কিছু কর্মকর্তাও জড়িত। ওই কাঁচাবাজারের প্রতিটি দোকান থেকে চার লাখ টাকা করে অগ্রীম প্রায় ১০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এ চক্র। আবাসিক এলাকার ভেতর অবৈধভাবে কাঁচাবাজার তৈরি করায় এলাকার পরিবেশও নষ্ট হচ্ছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে শফিকুল ইসলাম বলেন, আমি এসবের সাথে জড়িত নই। উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরে আমার কোনো কাঁচাবাজার নেই এবং ওই বাজারের সাথে আমি কোনোভাবেই জড়িত না। দুই লাখ টাকার রিসিট দিয়ে প্রতিটি দোকান থেকে কয়েক কোটি টাকা নেয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, আমি কোনো টাকা নেইনি। ব্যবসায়ী শফিক বলেন, আমার মার্কেটের নাম জমজম টাওয়ার। আমি কেন অবধৈ দখলে সাথে জড়িত হবো। এদিকে ১১ নম্বর সেক্টরের কাঁচাবাজারের একাধিক ব্যবসায়ী জানান, প্রতিটি দোকান থেকে দুই লাখ টাকা করে অগ্রীম নিয়েছেন শফিক সাহেব। এ টাকা বাবদ ব্যবসায়ীদের রশিদও দেয়া হযেছে। যা প্রতিটি দোকানদারের কাছে সংরক্ষিত রয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, উত্তরা সোনারগাঁও জনপদ রোডের উভয় পাশে রাজউকের জমি দখল করে পাঁচ-সাতটি মার্কেট তৈরি করার সময় এলাকাবাসীর অভিযোগের ভিত্তিতে প্রথমে বাধা দিলেও পরে রহস্যজনক কারণে রাজউক কর্মকর্তারা দেখেও না দেখার ভান করেন। অভিযোগ রয়েছে, প্রায় দুই কোটি টাকার বিনিময়ে রাজউকের কর্মকর্তার চুপ হয়ে গেছেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে উত্তরা জোনের নির্বাহী প্রকৌশলী মহিউদ্দিন বলেন, রাজনৈতিক প্রভাব কাটিয়ে উত্তরায় কিছু আওয়ামী লীগ নেতা অবৈধভাবে রাজউকের জমিতে অস্থায়ী মার্কেট তৈরি করেছেন। এ ব্যপারে আমরা খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছি। তিনি বলেন, লেকের জমি দখল করে কে বা কারা বহুতল ভবন নির্মাণ করছে, তা আমার জানা নেই।
নির্বাহী প্রকৌশলী মহিউদ্দিন আরো বলেন, উত্তরা এলাকায় রাজউকের যেসব জমি বেদখল হয়েছে তা উদ্ধারের জন্য অভিযান চালানো হবে। এত দিনে কেন ওই জমি উদ্ধারের উদ্যোগ নেয়া হয়নি, জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান।
অন্য দিকে স্থানীয় লোকজন বলছেন, ১১ নম্বর কাঁচাবাজার ও ১৩ নম্বর সেক্টরের সোনারগাঁও জনপদ সড়কের পাশের অবৈধ মার্কেট থেকে প্রতিমাসে তিন লাখ টাকা দেয় হয় প্রকৌশলী মহিউদ্দিনকে। এ ছাড়া রাজউক অফিসের নামে সাইদুল, রুহুলসহ আরো কয়েকজন ওই কাঁচাবাজার থেকে মাসে চার লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। সম্প্রতি মেলার নামে আরো নতুন করে প্রায় তিন বিঘা জমি বেদল হয়েছে। ওই এলাকায় ১৩ নম্বর সেক্টরে রাজউকের প্রায় ২০০ কাঠা জমি অবৈধ দখলদারেরা দখল করে নিয়েছে। এলাকাবাসী বারবার অভিযোগ করার পরও রাজউক তা আমলে নেয়নি।
অভিযোগ রয়েছে, উত্তরায় দখলবাজরা ভূমি জালিয়াতচক্র ভুয়া দলিলপত্র বানিয়ে আদালতে উপস্থাপন করে আইনি জটিলতা ও প্রতিন্ধকতা সৃষ্টি করে রাজউকের জমি হাতিয়ে নিচ্ছে। এ চক্রটি উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের সোনারগাঁ জনপথ রোডের দক্ষিণ পাশে জমি দখল করে কয়েকটি মার্কেট তৈরি করছে। রাজউকের অঞ্চল-১ এর কর্মকর্তা মহিউদ্দিন, ইঞ্জিনিয়ার এনামুল কাদির, উপ-সহকারী খান মোহাম্মদ ফারুক, রাজউকের ফিল্ড সুপারভাইজার সাইদুল ও রুহুলের সাথে অবৈধ দখলদারদের যোগসাজশ রয়েছে। তাদের মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে ম্যানেজ করা হয়েছে বলে এলাকায় প্রচুর অভিযোগ রয়েছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, রাজধানীর উত্তরা সোনারগাঁও জনপথ সড়কসহ পুরো এলাকাজুড়েই এখন চলছে অবৈধ দখলের মহোৎসব। এলাকাবাসীর অভিযোগ, উত্তরা পশ্চিম থানার ওসির সহযোগিতায় সম্প্রতি ১৩, ১২  এবং ১১ নম্বর সেক্টরের সকল ফুটপাতে দোকানপাট বসানো হয়েছে। এ ছাড়া ওই এলাকার ময়লার মোড়ে রাজউকের প্রায় ১৫০ কাঠা জমি জবরদখর করে ফার্নিচারের মার্কেট করেছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা। থানা পুলিশ এদের সহযোগিতা করছেন বলে যুবলীগের স্থানীয় একাধিক নেতা অভিযোগ করেছেন। অভিযোগকারী এক যুবলীগ নেতা জানান, উত্তরা পশ্চিম থানার ওসির সহযোগিতার কারণেই অবৈধ দখল মুক্ত হচ্ছে না রাস্তাঘাট ও ফুটপাত। ওসি প্রতি মাসে তার লোকজন দিয়ে এসব অবৈধ দোকান পাট থেকে অর্ধ কোটি টাকা চাঁদা আদায় করেন।
উত্তরা পশ্চিম থানা আওয়ামী লীগের একজন নেতা জানান, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী, রাজউকের চেয়ারম্যান ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নাম ভাঙিয়ে নব্য আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের কিছু হাইব্রিড নেতা এ দখল প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত রয়েছে। এদের কারণে দলের সম্মান মারাত্মকভাবে ক্ষুণœ হচ্ছে। তিনি জানান, বিএনপির কয়েক নেতার সাথেও এদের যোগসাজশ রয়েছে। তিনি বলেন, ব্যবসায়ী শফিক ও তার কয়েকজন সহযোগী উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরে রাজউকের জমি দখল করে কাঁচাবাজার তৈরি করেছে। এর সাথে রাজউকের অসাধু কিছু কর্মকর্তাও জড়িত। ওই কাঁচাবাজারের প্রতিটি দোকান থেকে চার লাখ টাকা করে অগ্রীম প্রায় ১০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এ চক্র। আবাসিক এলাকার ভেতর অবৈধভাবে কাঁচাবাজার তৈরি করায় এলাকার পরিবেশও নষ্ট হচ্ছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে শফিকুল ইসলাম বলেন, আমি এসবের সাথে জড়িত নই। উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরে আমার কোনো কাঁচাবাজার নেই এবং ওই বাজারের সাথে আমি কোনোভাবেই জড়িত না। দুই লাখ টাকার রিসিট দিয়ে প্রতিটি দোকান থেকে কয়েক কোটি টাকা নেয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, আমি কোন টাকা নেইনি। ব্যবসায়ী শফিক বলেন, আমার মার্কেটের নাম জমজম টাওয়ার। আমি কেন অবধৈ দখলে সাথে জড়িত হব। স্থানীয়রা জানান, শফিকুলের শ্যালক জনি ওই বাজার এখন নিয়ন্ত্রণ করছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে, উত্তরা থানা আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলেন, সফিকের কোনো দল নেই। সে একজন স্বর্ণ  চোরাকারবারি। কিছুদিন আগেও তাকে ডিবি পুলিশ গ্রেফতার করেছিল। সে মূলত একজন সুবিধাবাদী লোক। চারদলীয় জোট যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন সে ছিল উত্তরা থানা বিএনপির কোষাধ্যক্ষ। এখন আবার আওয়ামী লীগ। তারা বিরুদ্ধে প্রচুর অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও স্থানীয় আওয়ামী লীগ তাকে দল থেকে বহিষ্কার করেনি, বরং আরো জামাই আদরে রেখেছে কতিপয় নেতা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রাজউক

৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ