Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ০২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৭ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

টাকা দিয়ে যন্ত্রণা কেনার নাম হানিফ ফ্লাইওভার

বসবাসের অযোগ্য ঢাকা-৬

| প্রকাশের সময় : ১৩ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

নূরুল ইসলাম : মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার। রাজধানীর দক্ষিণ প্রবেশ মুখে নিরবচ্ছিন্ন গতিতে পারাপারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছিল। ২০১৩ সালে চালু হওয়ার পর থেকে যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান এলাকার যানজট থেকে অনেকটাই স্বস্তি দিয়েছে এই ফ্লাইওভার। এখন আর সেই অবস্থা নেই। এখন নকশা বহির্ভূতভাবে ফ্লাইওভারের উপরেই তৈরী করা হয়েছে বাসস্ট্যান্ড। লাগানো হয়েছে সাতটি সিঁড়ি। যেগুলো দিয়ে যাত্রীরা ফ্লাইওভারের উপরে উঠে হাঁটাচলা করে, বাস ও টেম্পুতে ওঠে। এতে করে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে। বাড়ছে যানজটের ভোগান্তিও। ভুক্তভোগিদের মতে, হানিফ ফ্লাইওভার মানে টাকা দিয়ে যন্ত্রণা কেনার মতো। গত বছরের মার্চ মাসের দিকে একইভাবে ফ্লাইওভারের উপরে বাসস্ট্যান্ড তৈরী করার চেষ্টা করা হয়। সে সময় বিভিন্ন মিডিয়ায় এ নিয়ে সংবাদ প্রচার হওয়ার পর তা বন্ধ করে দেয়া হয়। মাস খানেক ধরে আবার তা চালু হয়েছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষক ও দুর্ঘটনা বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল হক বলেন, হানিফ ফ্লাইওভারের উপরে বাস দাঁড়ানোর ব্যবস্থা করা মানেই পথচারীদের উপরে ওঠার সুযোগ করে দেয়া। এজন্য সিঁড়িও লাগানো হয়েছে। এটা খুবই বিপজ্জনক। নিরাপত্তাকে কমপ্রোমাইজ করে এখানে বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এটা একেবারেই ঠিক হয়নি। গত বছর যখন ফ্লাইওভারের সিঁড়ি লাগানো হয় তখন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন বলেছিলেন, এ বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না।
সরেজমিনে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে গিয়ে দেখা গেছে, বেশ কিছুদিন ধরেই ফ্লাইওভারের উপরে স্থায়ী বাসস্ট্যান্ড তৈরী করা হয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ধরে গুলিস্তানের দিকে আসার সময় প্রথমে সবগুলো গাড়ি দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছে ফ্লাইওভারের মুখে। সেখানে লোকাল বাসগুলো ফ্লাইওভার পারাপারের জন্য যাত্রী তোলে। বাসগুলো এলোমেলোভাবে দাঁড়িয়ে যাত্রী তোলে বলে ফ্লাইওভারের গাড়িগুলো নির্বিঘেœ চলতে পারে না। সকালে এখানে ভয়াবহ যানজটের সৃষ্টি হয়। জানতে চাইলে মতিঝিলের ব্যাংক কর্মকর্তা বদরুল আলম বলেন, আমরা সময় বাঁচানোর জন্য টাকার বিনিময়ে ফ্লাইওভার ব্যবহার করি। কিন্তু ফ্লাইওভারে উঠতে গিয়েই ৫-১০ মিনিট দাঁড়াতে হয়। এরপর যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তার উপরে যাত্রীদের ভিড়ে প্রায় সব গাড়িকেই থামতে হয়। সেখানেও বাস ও টেম্পু দাঁড়িয়ে যাত্রী তোলে। এভাবে সায়েদাবাদ ও টিকাটুলীতেও বাস দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানামা করে। তিনি বলেন, ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে অনায়াসে ৫/৭ মিনিটে মতিঝিল যাওয়া যায়। সেখানে ৩০ মিনিটের বেশি সময় লাগে। তাহলে আমরা কেন ৬০ টাকা করে দিবো? এখন এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে, টাকা দিয়ে আমরা যন্ত্রণা কিনছি। গুলিস্তানের ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন, গুলিস্তান থেকে ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে যেসব বাস চলে সেগুলোকে ডাইরেক্ট বলে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হয়। অথচ ফ্লাইওভারের উপরে বাসগুলো কমপক্ষে চার বার থামে। ওই ব্যবসায়ী বলেন, সামান্য এই পথের ভাড়া নেয়া হচ্ছে ১৫ টাকা। অথচ এটা দেখার কেউ নেই। ফ্লাইওভারে চলাচলকারী বাসের চালক ও হেলপারের সাথে কথা বলে জানা গেছে, একেকটা বাস ফ্লাইওভারে যাতায়াত করলে কমপক্ষে ১১০০ টাকা থাকে। এভাবে সারাদিনে কমপক্ষে ১৫ বার ট্রিপ মারতে পারলেই ১৬/১৭ হাজার টাকা ইনকাম। এই টাকা থেকে গুলিস্তানের ট্রাফিক পুলিশকে দিতে হয়। টাকা না দিলে তারা ফ্লাইওভারে বাস উঠতে দেয় না। অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত বছর হানিফ ফ্লাইওভারে একটি সিঁড়ি লাগানোর পর স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলররা এর বিরোধিতা করেন। সূত্র জানায়, গত বছরের ২০ জুন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়ে ৪৮ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবুল কালাম অনু, ৪৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর বাদল সরদার, ৫০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর দেলোয়ার হোসেন দেলু এবং ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে সিটি করপোরেশন অঞ্চল-৫ এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা বিজয় কৃষ্ণের সভাপতিত্বে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে কাউন্সিলররা মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের ওপর ও নিচের রাস্তা যানবাহন চলাচলে নির্বিঘœ রাখা এবং ট্রাফিক বিভাগের অনুমতি না থাকায় সিঁড়ি নির্মাণ কাজের অনুমতি না দিতে সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত না মেনেই ফ্লাইওভার নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ওরিয়ন গ্রুপ ফ্লাইওভারে সিঁড়ি লাগানোর কাজ শুরু করে। এভাবে একে একে ৭টি সিঁড়ি  তৈরী করা হয়।  এর মধ্যে যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তায় দুটি, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের ভিতরে একটি,  সায়েদাবাদ জনপথ মোড়ে একটি, ডেমরার রাস্তায় একটি সিঁড়ি  রয়েছে। এসব সিঁড়ি দিয়ে শত শত যাত্রী ফ্লাইওভারের উপরে ওঠে। তারা বাসে ওঠার জন্য হাঁটাহাঁটি করে। এতে করে ফ্লাইওভারে চলাচলরত যানবাহনের গতি কমানো ছাড়া দুর্ঘটনা এড়ানোর আর কোনা পথ থাকে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানুষের ভিড়ে গাড়িগুলো থামতে বাধ্য হয়।
যাত্রাবাড়ী এলাকায় সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামার জন্য যাত্রীদের দৃষ্টি আকর্ষণে সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে। সাইনবোর্ডে গুলিস্তান, পলাশীগামী বাসে উঠতে দক্ষিণের সিঁড়ি ব্যবহার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এখানকার সাইনবোর্ড দুটিতে লেখা রয়েছে, ‘গুলিস্তান যাওয়ার জন্য সিঁড়ি ব্যবহার করুন’, ‘পলাশী যাওয়ার জন্য সিঁড়ি ব্যবহার করুন’। সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের ভিতরে সিঁড়িটি ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। সিঁড়ির কাছে থেকেই তিশা পরিবহনের বাস ছাড়ে। কোম্পানীগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জসহ কয়েকটি জেলার যাত্রীদের এই সিঁড়ি ব্যবহার করে বাসে ওঠানামা করে। সরেজমিনে দেখা গেছে, ফ্লাইওভারের ওপরে ৫টি স্থানে বাস-বে তৈরি করা হয়েছে। ফ্লাইওভারে ওঠানামার র‌্যাম্পগুলোর সংযোগস্থলে অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে এই সিঁড়ি দিয়েই নিয়মিত যাত্রীরা ওঠানামা করছেন। বাস ছাড়াও হিউম্যান হলারে যাত্রীরা ওঠানামা করছেন ওই স্টপেজগুলোতে। রাস্তার দুই পাশেই এভাবে যাত্রী ওঠানামা করে। এতে গুলিস্তান বা পলাশীগামী যাত্রীরা একদিক দিয়ে বাসে উঠছে, ফেরত আসা যাত্রীরা অপরদিকে নামছেন। এছাড়া ঝুঁকি নিয়ে দৌড়ে ফ্লাইওভারের ওপর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে যাচ্ছে যাত্রীরা। এ জন্য ডিভাইডারের মাঝে সামান্য ফাঁকা জায়গাও রাখা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দুই লেনের ফ্লাইওভারের ওপরে বাস স্টপেজ করা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ।  যখনই একটি গাড়ি যাত্রী তোলার জন্য থেমে থাকবে তখন চলমান গাড়ির জন্য এটি বাধা সৃষ্টি করবে। দুর্ঘটনা ঘটবে। ফ্লাইওভারের ওপরও যানজটের সৃষ্টি হবে। হচ্ছেও তাই। হানিফ ফ্লাইওভারে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে। তাতে প্রাণহানিসহ বহু মানুষ আহত হচ্ছে। গত শুক্রবারেও বাস থেকে নেমে এক বৃদ্ধ যাত্রী রাস্তা পারাপার হতে গিয়ে এক মোটরসাইকেলের ধাক্কায় গুরুতর আহত হন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, ফ্লাইওভার তৈরীর উদ্দেশ্যই হলো যানবাহনকে দ্রুতগতির সাথে পারাপার করা। এজন্য ফ্লাইওভারের উপরে গণপরিবহন চলাচল করতে পারে না। গণপরিবহনের যাত্রীরা থাকবে ফ্লাইওভারের নিচে। কিন্তু আমাদের দেশে এটা মানা হচ্ছে না। গণপরিবহন ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে চলাচলের কারণে ঝুঁকির বিষয়টা থেকেই যাচ্ছে। এতে করে ফ্লাইওভারের উপরে দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে। প্রাণহানি ঘটতেই থাকবে। যার দায়-দায়িত্ব সরকারের উপর বর্তাবে।



 

Show all comments
  • Mohammed Saleh Bablu ১৩ জানুয়ারি, ২০১৭, ১১:৩১ এএম says : 0
    নোংরামি শুধু বাংলাদেশ ই , পৃথিবীর ইতিহাসে কোথাও এই রকম ব্যবস্হা নাই , অন্তত কর্মের জন্য পৃথিবীর পাঁচ টি দেশে ঘুরে আমি কোথাও এই রকম দেখিনি ???
    Total Reply(0) Reply
  • Nannu chowhan ১৭ জানুয়ারি, ২০১৭, ৯:১১ এএম says : 0
    Thats right,anywhere in the world there is no where like"you can stop over,in the fly over".This is very dangerous.....
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: টাকা

২০ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ