Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

যমুনা এখনই মরুপথে

হারিয়ে যাচ্ছে জীব-বৈচিত্র্য, কৃষিতে মহাবিপর্যয়ের শঙ্কা

| প্রকাশের সময় : ১৩ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

সিরাজগঞ্জ থেকে সৈয়দ শামীম শিরাজী : ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে/ বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে’ যমুনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট নদী নয়। যমুনা দেশের সর্ববৃহৎ নদীগুলোর অন্যতম। যমুনার পানির তোড়ে হাজার হাজার বাড়িঘর বিলীন হয়েছে। পানির স্তর নীচে নামতে নামতে সেই প্রমত্তা যমুনার এখন কার্যত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট নদীতে পরিণত হয়েছে। পায়ে হেঁটেই এখন নদী পার হওয়া যায়। পানির অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে জীব-বৈচিত্র্য। শত শত বছর ধরে যারা যমুনার পাড়ে বসবাস করছেন, নদীর ভাঙ্গাগড়ার সঙ্গে যাদের নিয়তি তারা শঙ্কা প্রকাশ করছেন, পানির অভাবে এভাবে নদীর পেটে চরসৃষ্টি অব্যবহৃত থাকলে কয়েক বছর পর যমুনা বিধৌত বিশাল এলাকা মরুভূমিতে পরিণত হবে। কৃষিতে নেমে আসবে মহাবিপর্যয়।
চৈত্র আসার এখনো দুই মাস বাকী। পানির অভাবে দেশের অন্যতম প্রধান নদী যমুনা এখনই মরুপথে। পানি প্রবাহের স্তর নীচে নেমে যাওয়ায় জেগে উঠেছে অসংখ্য বালুচর। হুমকির সম্মুখীন হয়েছে জীব-বৈচিত্র্য। নদীর দু’ধারে মাইলের পর মাইল ধূধূ চর আর চর। কোথাও কোথাও নদীর পেটের ভিতরেই জেগে উঠেছে বিশালাকৃতির চর। পৌষের শেষ দিকে যেখানে প্রমত্ত নদীর পানিতে উথাল-পাতাল অবস্থা থাকার কথা; সেখানে পানির স্তর নীচে নেমে যাওয়ায় মানুষজন হেঁটে নদী পার হচ্ছে। নদীকে কেন্দ্র করে যাদের জীবিকা নির্বাহ হয় তাদের কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ। অনেকেই বাপ-দাদার পেশা বদল করে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। যারা সেচ কাজে যমুনার পানি ব্যবহার করেন তারাও পড়ে গেছে মহাবিপাকে। উজানের নদী থেকে ভারত অবৈধভাবে পানি তুলে নেয়ায় পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় ১৯৯৮ সাল থেকেই যমুনা নদীতে ব্যাপক চর সৃষ্টি শুরু হয়। সময়ের ধারাবাহিকতায় সেই চরের সংখ্যা প্রতিবছর বাড়ছে। স্থানীয়দের মতে, এক সময় যমুনা নদীর নীল পানির স্রোত আর প্রবল ঢেউ দেখে মানুষ ভয় পেত। ২০ বছর আগেও পৌষ মাসে গভীর পানি থাকতো নদীতে। চৈত্র-বৈশাখে তখন বালির চর দেখা যেত বটে; তবে তার মধ্য দিয়েই থাকতো নদীর পানির স্রোতধারা। এখন ভরা বর্ষায়ও সে পানি দেখা যায় না। কেউ কেউ বলছেন, যমুনায় প্রতিবছর যে ভাবে চর উঠছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে একদিন করালগ্রাসী ‘যমুনা নদী’ হবে রূপকথার গল্পের মতো।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে প্রকাশ তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় দেশের অন্যান্য নদীর মতো যমুনার পানির স্তর নীচে নেমে গেছে। নদীমাতৃক এই দেশে যমুনার উৎপত্তি দেশেই। ভারতের আসাম থেকে ব্রহ্মপুত্র নদ বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীতে। ওই নদী যমুনা নাম ধারণ করে আরিচার কাছে পদ্মা নদীতে মিশেছে। বাংলাদেশে এর দৈর্ঘ্য প্রায় ২শ’ কিলোমিটার। এ নদীর শাখা ও উপনদীর দৈর্ঘ্য প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার। পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, করতোয়া, আত্রাই, বারনই, শিব, ছোট যমুনা, তিস্তা, ধরলা, তুলসিগঙ্গা, বাঙ্গালীনগর, যমুনেশ্বরীর উৎস ওই ব্রহ্মপুত্রই। এক দশকে নদীর নাব্যতা কমে যাওয়া এবং ধূধূ বালুচর সৃষ্টি হওয়ায় সরাসরিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত উত্তরাঞ্চলের কুড়িগ্রাম জেলার কুড়িগ্রাম, নাগেশ্বরী, উলিপুর, চিলমারী, রৌমারী, রাজিবপুর, গাইবান্ধা জেলার গাইবান্ধা, সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি, দেওয়ানগঞ্জ, সাঘাটা, ইসলামপুর, বগুড়ার সোনাতলা, মাদারগঞ্জ, সারিয়াকান্দি, ধুনট, সিরাজগঞ্জের কাজীপুর, সিরাজগঞ্জ, কামারখন্দ, ভুয়াপুর, কালীহাতি, বেলকুচি, শাহজাদপুর, নাগরপুর, দৌলতপুরসহ নওগাঁ, রংপুর, জয়পুরহাট জেলার প্রায় ২৭টি উপজেলা।
বঙ্গবন্ধু সেতুর উভয় দিকে ৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে জেগে উঠেছে বালুচর। এ বালুচরে অস্থায়ীভাবে ঘরবাড়ি তৈরি করে বসবাস করছে মানুষ। রাক্ষসী যমুনা এখন যেন মারা নদী। এ জেলা উত্তরের বেড়াঘোলা থেকে দক্ষিণের কাউনিয়া পর্যন্ত দীর্ঘ ১৫০ কি: মি: নদীতে কচ্ছপের পীঠের মত ছোট বড় অসংখ্য চর জেগে উঠেছে। প্রায় ৫ লক্ষাধিক চরবাসী নানাবিধ সমস্যায় পড়ে কষ্টে জীবন যাপন করছে।
জানা গেছে, শুষ্ক মৌসুমের শুরু থেকেই বৃহত্তর যমুনা নদীসহ বিভিন্ন প্রায় ১২টি শাখা নদীর পানি  হ্রাস পেয়ে চর জেগেছে উঠেছে। বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর পূর্ব ও পশ্চিম পাশে খালের মত কিছু পানি থাকলেও মাঝখানে উভয় পাশে বিশাল বিশাল চর জেগে উঠেছে। দৃশ্যত এ সেতুর নিচে দিয়ে এখন যেন হেঁটেই পাড় হওয়া যায়। তবু বঙ্গবন্ধু সেতুই কেবল নয় সিরাজগঞ্জের কাছে যমুনা নদীর বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছোট বড় চর ও ডুবো চর জেগে উঠেছে। ভারী ড্রাপটের যানবাহন তো দূরের কথা যাত্রী বোঝাই শ্যালো নৌকা চলাচলে বিঘœ সৃষ্টি হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ রুটের খেয়া পারাপারও বন্ধ রয়েছে। লঞ্চ, কার্গো ভারী নৌযানের কথা তাই বলাই বাহুল্য। যমুনা নদী তীরবর্তী এলাকার ফসলী জমি পানির অভাবে বিবর্ণ রূপ ধারণ করেছে। সেচ দেবার মতো পানি না পেয়ে চাষীরা পড়েছে বিপাকে। এ চরাঞ্চলের চরবাসীরা পড়েছে মহা বিপাকে। তাদের নৌ পথ বন্ধ হয়ে পাড়ায় চলাচল ও পণ্য পরিবহন করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। নৌকার বদলে এখন ঘোড়ার গাড়ী ও গরুর গাড়ী ভরসা। এত পরিবহন খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্য দিকে শুষ্ক আবহাওয়া ও পানি কমে যাওয়ায় শাক-সবজীর চাষাবাদও ব্যাহত হচ্ছে। প্রকৃতির বিরূপ প্রতিক্রিয়া তারা নানা রূপ সমস্যায় পড়েছেন। চরাঞ্চলে গবাদী পশু খাদ্য-ঘাস-লতাপাতা না পাওয়ায় গবাদী পশু পালন করা দায়সাধ্য হয়ে পড়েছে। দুর্গম চরাঞ্চলের যাতায়াত ব্যবস্থা না থাকায় প্রসূতি মায়েদের ও অসুস্থ বৃদ্ধা ও অন্যান্য রোগীদের  নিয়ে দ্রুত চিকিৎসা দিতে না পারায় মহাবিপাকে পড়েছে তারা।
এদিকে এই ইরি-বোরো মৌসুম শুরুর আগেই পানির স্তর অবিশ্বাস্য ভাবে নীচে নেমে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছে প্রান্তিক চাষীরা। তাদের শঙ্কা পানি প্রবাহ বৃদ্ধি না পেলে এবারের ইরি-বেরো মৌসুমে জমিতে সেচ দেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। এখনই পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় ইদারা কুয়া ও টিউবওয়েলে স্বাভাবিক পানি পাওয়া যাচ্ছে না। বরিশস্যে সেচ প্রদান বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। সিরাজগঞ্জ শস্য ভা-ার নামে খ্যাত বৃহত্তর চলনবিল অঞ্চলের বিস্তৃত এলাকা জুড়ে পানি স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় গভীর খাদ করে শ্যালো মেশিন নিচে নামিয়ে পানি তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করা হচ্ছে। ভরা মৌসুমে কি হবে সে চিন্তায় কৃষকুল অস্থিরতায় দিন কাটাচ্ছে।
এদিকে সিরাজগঞ্জ শস্যভা-ার নামে পরিচিত তাড়াশ উপজেলার দেওড়া গ্রামের প্রান্তিক চাষী নজরুল জানান, ভরা ইরি-বোরো মওসুমে জমিতে সেচ দেওয়া কষ্ট সাধ্য হয়ে পড়বে। এছাড়া নদী পথে নৌযান চলাচল বিঘœ ঘটায় যমুনা সার কারখানা থেকে সার পরিবহন করাও সমস্যা দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে সিরাজগঞ্জে একমাত্র নৌবন্দর বাঘাবাড়ী ঘাটে সার বোঝাই জাহাজও কার্গো কুলে ভিড়তে পায়ছে না। ফলে উত্তরবঙ্গে সার পরিবহনেও সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। তাই ইরি-বোরো মৌসুমে কিভাবে চাষাবাদ সম্ভব হবে সে চিন্তায় কৃষকদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। প্রান্তিক কৃষকরা জানান, যমুনায় যেভাবে পানির স্তর নীচে নেমে যাচ্ছে এবং একের পর এক চর জাগছে তাতে ভবিষ্যতে যমুনার বিস্তীর্ণ এলাকা মরুভূমিতে পরিণত হবে। তাদের দাবি নদীকে বাঁচাতে সরকারি পদক্ষেপ জরুরী।



 

Show all comments
  • selina ১৩ জানুয়ারি, ২০১৭, ১০:৩৯ এএম says : 0
    out of 54 river already 30 river totally no water discharge as per information on news media from source and rest 20 river within short interval, then so adverse situation cumming . no natural water flow in river virtually no Bangladesh .
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: যমুনা

৯ মে, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ