Inqilab Logo

সোমবার ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চট্টগ্রামে উন্নয়ন নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া

টানা দুই মেয়াদে সরকারের আট বছর

| প্রকাশের সময় : ১৩ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

রফিকুল ইসলাম সেলিম : চট্টগ্রামের উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেয়ার পরও আওয়ামী লীগ সরকারের দুই দফায় আট বছরে অনেক মেগা প্রকল্প আলোর মুখ দেখেনি। বৃহত্তর চট্টগ্রামের উন্নয়নে কিছু ক্ষেত্রে সরকার সফল হয়েছে। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে চট্টগ্রামের সঙ্গে করা হয়েছে বিমাতাসুলভ আচরণ।
আট বছরেও চট্টগ্রামে গ্যাস সঙ্কটের অবসান হয়নি। অপার সম্ভাবনার পরও দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে প্রধান বাধা হয়ে আছে গ্যাস সঙ্কট। দেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য হ্যান্ডলিং বাড়লে সক্ষমতা বাড়েনি।
বিগত ৮ বছর চট্টগ্রামের উন্নয়নে একাধিক মেগা প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। তবে দেরিতে হলেও বেশ কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ায় মানুষ খুশি। কয়েকটি বড় প্রকল্পের কাজ শুরু হলেও বেশ কয়েকটির কাজ এখনও শুরু হয়নি। আবার মহেষখালীর সোনাদিয়া দ্বীপে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্পটি একেবারেই চাপা পড়ে গেছে। ভূ-রাজনৈতিক কারণে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্র বন্দরের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা।  
আট বছরে বড় প্রকল্পের মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনের কাজ শেষ হয়েছে। উৎপাদনে গেছে চট্টগ্রাম ওয়াসার কর্ণফুলী পানি শোধনাগার প্রকল্প। এতে করে পানি সঙ্কটের কিছুটা হলেও অবসান হয়েছে। বিদ্যুৎ খাতেও যথেষ্ট উন্নয়ন হয়েছে। এখন আর লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণা নেই।
তবে কক্সবাজারমুখি রেল লাইন, সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, মহেষখালীতে কয়লা বিদ্যুৎ ও এলএনজি প্রকল্পে উল্লেখযোগ্য কোন অগ্রগতি হয়নি। কর্ণফুলী টানেলের ভূমি অধিগ্রহণ চলছে। আনোয়ারায় চীনা ইপিজেড ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং মিরসরাইয়ে আরও একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজও চলছে ধীর লয়ে। কক্সবাজার থেকে মিরসরাই পর্যন্ত উপকূলীয় বেড়িবাঁধ হয়ে মহাসড়ক নির্মাণ প্রকল্প এখনও পরিকল্পনায় সীমিত রয়েছে।
এই সরকারের চলতি মেয়াদে শুরু হয় নগরীর সবচেয়ে বড় ফ্লাইওভার মুরাদপুর থেকে লালখান বাজার পর্যন্ত প্রায় ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ আক্তারুজ্জামান ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজ। ইতোমধ্যে প্রকল্পের ৮৫ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে বলে জানান প্রকল্প পরিচালক সিডিএ’র প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান। মার্চ নাগাদ মূল ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজ শেষ করা যাবে বলে জানান তিনি।
সরকারের এই মেয়াদে শুরু হওয়া আউটার রিং রোড প্রকল্পেও তেমন গতি নেই। গত বছরের ২৯ জানুয়ারি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এখনও এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়নি। চীনা প্রেসিডেন্টকে সাথে নিয়ে গত বছরের ১৪ অক্টোবর কর্ণফুলি টানেলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে প্রধানমন্ত্রী। চট্টগ্রামবাসীর স্বপ্নের এ টানেলের নির্মাণ কাজ চলতি মাসে শুরু হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট। সরকারের ওই সময়ে চট্টগ্রামের উন্নয়নে অনেক প্রকল্প নেওয়া হলেও বেশিরভাগ প্রকল্প বাস্তবায়ন হতে পুরো মেয়াদ পার হয়ে যায়।
এরপর বিগত ১৪ সালের ৫ জানুয়ারি এক তরফা নির্বাচনে ফের ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এক টানা দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের তিন বছর পর হয়েছে। আর তাই সরকারের আট বছরের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়েও আলোচনা চলছে। বিশেষ করে উন্নয়ন নিয়ে এখানকার সাধারণ মানুষের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আগামী দুই বছর বর্তমান সরকারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুই বছর পর সরকারকে অবতীর্ণ হতে হবে নির্বাচনী অগ্নিপরীক্ষায়। আর এই সময়ের মধ্যে সরকারকে তার নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণ করতে হবে।
এর আগের মেয়াদের আগে সরকার গঠনের পর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার কাজ শুরু করে সরকার। দফা দফায় মেয়াদ ও খরচ বাড়িয়ে নির্ধারিত সময়ের কয়েক বছর ওই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়। ওই মেয়াদে গৃহিত প্রকল্প বাস্তবায়ন হয় চলতি মেয়াদে। এরপরও দেশের লাইফ লাইন খ্যাত মহাসড়ক চার লেনে উন্নতি হওয়ায় মানুষ খুশি। মহাসড়কে এখন আর আগের মতো যানজট নেই। দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরমুখি আমদানি-রফতানি পণ্যবাহী যানবাহন চলাচলের ক্ষেত্রেও গতি এসেছে। ব্যতিক্রম কিছু না হলে এখন মাত্র ৫ ঘণ্টায় ঢাকা-চট্টগ্রাম যাতায়াত করা যাচ্ছে।
বিগত ২০১১ সালে চট্টগ্রামের দোহাজারি থেকে রামুর ঘুমধুম পর্যন্ত রেল লাইন প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। এখনও পুরোদমে ওই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়নি। নানা পরিবর্তনের পর এই প্রকল্পের রেলপথ ও অবকাঠামো নির্মাণকাজের দর ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) প্রকল্প নির্মাণকাজের অর্থের জোগান দেবে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আন্তর্জাতিক দরপত্র দেয়া হয়েছে, খুব শিগগির রেল লাইন নির্মাণ কাজ শুরু হবে। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের জন্য পাকিস্তান আমলে ১৯৫৮ সালে জরিপ চালানো হয়েছিল। আর চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত রেলপথটি নির্মিত হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে।
এদিকে ভূ-রাজনৈতিক কারণে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্র বন্দরের ভবিষ্যত নিয়ে আশার আলো দেখছেন না অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মইনুল ইসলাম। সম্প্রতি অর্থনীতি সমিতি চট্টগ্রাম চ্যাপ্টার আয়োজিত ‘রিজিওনাল কানেকটিভিটি: দ্য কারেন্ট চ্যালেঞ্জ ফর ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট’ প্রবন্ধে এ কথা বলেন তিনি।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ও ইউজিসি অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্র বন্দর অদূর ভবিষ্যতে হবে না। এটা ভূ-রাজনৈতিক কারণে। ভারত চীনকে বঙ্গোপসাগরে আসতে দিতে চায় না। এতে ভারতের ভেটো (আপত্তি) রয়েছে।
‘ভূ-রাজনৈতিক’ কারণে দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার-ঘুনধুম রেললাইন প্রকল্পের কাজও ‘সহজে’ হবে না বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, দুই-তিন বছর আগেও মিয়ানমার চীনকে বন্ধু মনে করত। এখন মিয়ানমার আমেরিকাকে বন্ধু মনে করে। তাই তারা চীনকে দূরে সরিয়েছে। মাঝখান থেকে আমরা আটকা পড়েছি।
টেকনাফ থেকে চট্টগ্রাম হয়ে খুলনা পর্যন্ত বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকাকে ‘সোনার খনি’ হিসেবে অভিহিত করে তিনি বলেন, এখানে অনেক বন্দর হতে পারে। আরও একাধিক বন্দর হোক। এখানে শুধু ভারতকে সুবিধা দেয়া নয় এর মাধ্যমে আমরা পুরো অঞ্চলে উইন-উইন সিচুয়েশনে যেতে পারি। ভারত কালাদান রিভার প্রজেক্ট নামে একটি প্রকল্প করছে জানিয়ে ড. মইনুল বলেন, আগামী এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে এর কাজ শেষ হবে। এটি হলে ভারতের সেভেন সিস্টার মিয়ানমারের সিতওয়েতে (পুরনো আকিয়াব) থাকা গভীর সমুদ্র বন্দরের সুবিধা পাবে। তখন আর তারা বাংলাদেশের উপর নির্ভর করবে না। তখন হয়ত এ সুযোগও আমরা হারাব।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চট্টগ্রামে


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ