হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
আফতাব চৌধুরী : হযরত মুহাম্মদ (সা.) শুধু একজন শ্রেষ্ঠ ধর্ম প্রচারক বা সমাজ সংস্কারক ছিলেন না, তিনি ছিলেন অপ্রতিহত এক জাতির জনক ও প্রতিষ্ঠাতা, যে জাতি সমগ্র পৃথিবীর অর্ধেকটাই আপন পতাকাতলে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিল। তিনি মদিনার মাটিতে (৬২২) পদার্পণ করে একটি আদর্শ রাষ্ট্র স্থাপন করেন। সবাই তখন একবাক্যে তাঁর মহোত্তম চরিত্র লক্ষ্য করে তাঁকেই প্রথম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করেন। সঙ্গে সঙ্গে সেখানকার সকল গোত্রের সঙ্গে একটা সম্পর্ক গড়ে তোলেন তিনি। সে সম্পর্কে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কোনো ধরনের বাধাবিপত্তি ছিল না। কারণ তিনি উপলব্ধি করেন, সকলের ঐকান্তিক সদিচ্ছা, সহযোগিতা ও শুভেচ্ছা ছাড়া একটি শক্তিশালী কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গড়ে উঠতে পারে না। তাই তিনি মদিনায় প্রথম প্রতিষ্ঠা করেন ‘রিপাবলিকান’ (জবঢ়ঁনষরপধহ) এমন একটা সরকার, যে সরকার পরিচালিত হবে কোনো জনগণের প্রতিনিধি দ্বারা। জগতের বুকে প্রথম এ নিরঙ্কুশ গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলো। জাতি-ধর্ম- বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে প্রথম প্রতিষ্ঠা করেন ‘জাতিসংঘ’। দেড় হাজার বছর পর মানুষ যা চিন্তা করছে, তার প্রবক্তা ছিলেন তিনি। তিনি রচনা করেন এমন কতকগুলো বিধিবিধান, যা বিধিবিধানে সকলেই ছিল সমান। মানুষ যে সম্প্রদায়েরই হোক না কেন, আইনের চোখে সামাজিক মর্যাদার কোনোরূপ ব্যবধান সৃষ্টি করতে দেননি। তিনি মদিনার বিশ্বাসঘাতী ইহুদি ও প্রতারক খ্রিস্টানদের যে সুযোগ-সুবিধা দান করেন, তা রাজনীতির ইতিহাসে শুধু দুর্লভই নয়, অচিন্তনীয়ও বটে।
তিনি বলেন, সন্ধি বা চুক্তি ভালো, যা সমাজে শান্তি স্থাপন করতে বিশেষ সহায়তা করে। তাই তিনি রাষ্ট্রশাসনে খ্রিস্টান, ইহুদি ও অন্যদের সঙ্গে শান্তি ও সন্ধি চুক্তি করেছেন। এ চুক্তির শর্ত ছিলÑ (১) মুসলমান এবং অমুসলমান সকলেই এক জাতি হিসেবে বসবাস করবে। (২) প্রত্যেকেই স^াধীনভাবে আপন ধর্ম পালন করবে, কেউ কারো ধর্মে আঘাত করতে পারবে না। (৩) যে কোনো পক্ষ আক্রান্ত হলে সকল পক্ষ মিলিতভাবে শক্রদের বাধা প্রদান করবে। (৪) অন্য কারো সঙ্গে সন্ধি করার প্রয়োজন হলে সকল পক্ষ মিলিত হয়ে পরামর্শ করে সন্ধি করবে। (৫) মদিনায় নরহত্যা বা রক্তপাত অবৈধ বলে ঘোষিত হলো। (৬) হযরত মুহাম্মদ (সা.) এ সাধারণতন্ত্রের সর্বসম্মতিক্রমে সভাপতি নির্বাচিত হলেন। (৭) যে পক্ষ যে কোনো একটি শর্ত ভঙ্গ করবে, তার ওপর আল্লাহর অভিসম্পাত। (৮) কোনো পক্ষই মক্কার কুরাইশদের সঙ্গে গোপনে মিলিত হবে না।
হিজরির ষষ্ঠ বছরে হযরত মুহাম্মদ (সা.) সকল খ্রিস্টানদের নির্ভয়ে বসবাস করার জন্য একটি সনদ দান করেন, যখন মদিনা ইহুদিমুক্ত হলোÑ (১) তাদের ওপর অন্যায়ভাবে কোনো কর বসানো যাবে না। (২) খ্রিস্টান ধর্মযাজকগণ তাদের পদ থেকে অপসারিত হবেন না। (৩) কোনো খ্রিস্টানকে তার ধর্ম ত্যাগ করতে বাধ্য করা হবে না। (৪) কোনো সন্ন্যাসীকে তার ধর্ম ত্যাগ করাতে বাধ্য করা হবে না। (৫) কোনো তীর্থযাত্রীকে তার তীর্থ গমনে বাধা দেওয়া হবে না। (৬) কোনো গির্জাকে মসজিদে রূপান্তরিত বা ধ্বংস করা হবে না ইত্যাদি। এ ছয় দফা রাষ্ট্রনীতি থেকে সহজেই অনুমেয় যে, তিনি কত বড় দক্ষ ও অদ্বিতীয় রাজনীতিবিদ ছিলেন।
মদিনার বুকেই নির্মিত হয় ঐতিহাসিক মসজিদে নববী। এটাই ছিল এ রাষ্ট্রের প্রশাসনিক ভবন, সংসদ ভবন, সুপ্রিম কোর্ট। মহানবী (সা.) মদিনায় পৌঁছার পর দেখেন, এখানে তিন শ্রেণির মানুষের বসবাস রয়েছে। (১) মদিনার আদিম পৌত্তলিক সম্প্রদায়। (২) বিদেশি ইহুদি সম্প্রদায় এবং (৩) নুব বায়আতপ্রাপ্ত মুসলিম সম্প্রদায়। তাদের মধ্যে আদর্শগত কোনো মিল ছিল না, ছিল গোষ্ঠীগত হিংসা- বিদ্বেষ। তাই তিনি একটি সংবিধান প্রণয়ন করেন, যা ‘মদিনা সনদ’ নামে প্রসিদ্ধ। সর্বমোট ৫৩টি ধারা ছিল এ সনদের। বিশ্বের ইতিহাসে এটাই ছিল প্রথম লিখিত চুক্তি বা সংবিধান। কাক্সিক্ষত রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি প্রণয়ন করেন ইতিহাসখ্যাত অনন্য সাধারণ এ সংবিধান। এ চুক্তিপত্র বা সংবিধান মানবিক ও সর্বজনীন উদারনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। তার কয়েকটি আলোচিত হচ্ছেÑ (১) বিন আউফের ইহুদিরা মুমিনদের সঙ্গে একই উম্মাহ। ইহুদিদের জন্য তাদের ধর্ম আর মুসলমানদের জন্য তাদের ধর্ম। তাদের মাওয়ালি বা আশ্রিত এবং তারা নিজেরাও। অবশ্য যে-ই অন্যায় বা অপরাধ করবে, সে নিজের এবং তার পরিবার-পরিজনদের ক্ষতিই করবে। (২) আশ্রিতরা আশ্রয়দানকারীদের নিজেদের মতোই, যে পর্যন্ত তারা কোনো অন্যায় বা বিশ্বাসঘাতকতা না করে। (৩) বন্ধুর দুষ্কর্মের জন্য কেউই দায়ী হবে না, আর মজলুম বা অত্যাচারিতকে করা হবে সাহায্য। (৪) পাপাচার নয়, পুণ্যই কাম্য। (৫) সালাবার মাওয়ালি বা আশ্রিত ব্যক্তিবর্গ তাদের মতোই। (৬) ইহুদিদের বন্ধুরা (চুক্তিবদ্ধ) তাদের মতোই। (৭) ইহুদিদের মধ্য থেকে যারা আমাদের (চুক্তি অনুযায়ী) অনুসরণ করবে তাদের জন্য সাহায্য-সহযোগিতার হাত প্রসারিত করা হবে। তাদের সঙ্গে করা হবে সদাচরণ। তাদের ওপর অত্যাচার-নিপীড়ন তো হবেই না, অধিকন্তু তাদের শক্রদেরও সাহায্য করা হবে না। (৮) আল্লাহ প্রদত্ত জিম্মা বা নিরাপত্তা একটাই। অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে সর্বাপেক্ষা দুর্বলকেই আশ্রয় দেওয়া হবে...।
‘বয়তুল মাল’ উদ্বোধনের দিনে মহানবী (সা.) ঘোষণা করেন, ‘রাষ্ট্রে যদি কোনো ব্যক্তি ঋণগ্রস্ত অবস্থায় মারা যায়, তার ঋণ পরিশোধের মতো সম্পদ না থাকে তবে তার ঋণ পরিশোধ ও স্ত্রী-সন্তানের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব আমি মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ আমার কাঁধে তুলে নিলাম।’ রাস্তা দিয়ে তিনি হাঁটছেন, বিধবাদের জিজ্ঞেস করছেন বাজারের প্রয়োজন হবে কিনা। আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেছেন, তিনি হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে সালাম দিয়েছেন, সালামের জবাব দিচ্ছেন, মুখ নড়ছে অথচ আওয়াজ বের হচ্ছে না। পরে জানতে পারলেন তিন-চার দিন কিছুই খাননি। হযরত মুহাম্মদ (সা.) অসহায়-সর্বহারা মানুষের মধ্যে জাকাত-ফিতরা-সদকা ইত্যাদি বিতরণ করে দিচ্ছেন। নিজের দিকে তাকাবার একটুও সময় নেই। হযরত ওমর (রা.) বর্ণনা করেছেন, একবার তিনি দেখতে পেলেন, হযরত মুহাম্মদ (সা.) চাটির ওপর শুয়ে আছেন। তিনি সালাম দিলেন, হযরত উঠে বসলেন। দেখতে পেলেন হযরতের পিঠে বেতের নানা দাগ রয়েছে। অশ্রুসজল নয়নে হযরতকে বললেন, আপনি অনুমতি দিলে আপনার জন্য একটা বিছানা তৈরি করে দেই। তখন হযরত ওমরকে বললেন, ‘ওমর, আমি পৃথিবীতে আরামের জন্য আসিনি, এসেছি শান্তি ও মানবতার মুক্তির জন্য।’ এমন নবী ছিলেন মানবতায় মুক্তির মহান অগ্রদূত হযরত মুহাম্মদ (সা.)।
বিশ্বনবীর মহান ব্রতের একদিকে ছিল আল্লাহর উপাসনা, অন্যদিকে ছিল গরিবের সংরক্ষণ। সুদকে অবৈধ ঘোষণা করেন তিনি। জাকাত, ফিতরা, সদকা ইত্যাদি দানের প্রচলন করে জাতীয় অর্থনীতির একটি কাঠামো গড়ে তোলেন, যাতে অসহায়রা রক্ষা পায়। অন্যদিকে ধনীদেরকে ব্যবসা ও চাষে অনুপ্রাণিত করে প্রচুর অর্থ উপার্জনের পথও দেখান। কম্যুনিজমে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় ব্যক্তিসত্তার কোনো স্থান নেই। রাষ্ট্র যেখানে একটা সর্বগ্রাসী রাক্ষস। মানুষের ব্যক্তিসত্তাই একদিন মানুষকে মুক্তচিন্তার অধিকারী করে তোলে। কিন্তু সত্তা যেখানে বন্দি, সেখানে কি করে স^াধীন চিন্তার উšে§ষ ঘটবে। আগের পুঁজিবাদী গণতন্ত্রে সম্পদ বাড়ারও কোনো শেষ নেই। ব্যক্তি যেখানে সর্বগ্রাসী, সেখানে একেকজন অর্থলোলুপ ব্যক্তি একেকটি পাহাড়ে পরিণত হয়। এ ব্যবস্থা সমাজে তৈরি করে অতি ধনী ও অতি গরিব। ইসলাম রাষ্ট্র ও ব্যক্তি দুটোকেই স^াধীন সত্তা দিয়েছে। কোনোটাকেই লাগামছাড়া করেনি। মানুষকে স^াধীন চিন্তার অধিকারী করেছে কিন্তু সে^চ্ছাচারী হতে দেয়নি। ইসলামী রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় কোনোক্রমেই কেউ অতি ধনী ও অতি গরিব থাকে না। এটাই ইসলামী অর্থনীতির মূলকথা।
বর্তমান বিশ্বে দেশে দেশে চলছে শ্রমিক ধর্মঘট। তাদের প্রকৃত মজুরি নিয়ে চলছে টালবাহানা। চলছে শোষণ। অথচ কত পূর্বেই না তিনি এসব সমস্যার সমাধান করে গেছেন। বলেছেন, ঘাম শুকানোর আগেই শ্রমিকের মজুরি প্রদান করতে হবে। বলেছেন, শ্রমিক আর মালিকের সম্পর্ক গোলাম আর মুনিবের নয়, সম্পর্ক ভাই-ভাই এর। ইসলামের মহান শিক্ষা, এ জগতের উত্তম কাজ হচ্ছে মানুষকে ভাই বলা। মৃত্যুর প্রাক মুহূর্তেও তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়, ‘সাবধান অসহায় গরিব মানুষ, বিশ্ব স্রষ্টার বান্দা।’ তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, দান দ্বারা তুমি তোমার রোগের চিকিৎসা কর।’ অর্থাৎ তুমি গরিবকে দান কর, আল্লাহ তোমাকে আরোগ্য দান করবেন। এভাবে বিশ্বনবী ধর্মকে গরিবের রক্ষাকবচ রূপে ব্যবহার করেছেন। তিনি কঠোরভাবে ঘোষণা করেন, মানুষে মানুষে কোনো পার্থক্য নেই, কৌলিন্যের কোনো দাম নেই, বংশের কোনো গর্ব নেই, দেশ-কাল-পাত্রে কোনো ভেদাভেদ নেই। মর্যাদা কেবল পরহেজগারীর ভিত্তিতে। প্রচার করলেন স্রষ্টার নিকট সব মানুষই সমান। তাঁর কাছে সে মানুষই উত্তম, যিনি মানুষের নিকট উত্তম। তিনি এমন এক ভ্রাতৃত্ব বন্ধন গড়ে তোলেন, যা ধনী-নির্ধন, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, উঁচু-নিচু, সাদা-কালো সকলকে এক ডোরে আবদ্ধ করে। বিশ্বনবীর সুদূরপ্রসারী চিন্তাধারায় ছিল এক বিশ্ব, এক জাতি।
মহা নবী (সা:) কেবল পরলোকের সুখ-শান্তির কথা নির্ধারণ করে যাননি, ইহলোকে মানুষ কী করে সুখ-শান্তিতে বসবাস করতে পারবে, তার চূড়ান্ত নীতিনির্ধারণ করে গেছেন। ব্যক্তি-জীবন থেকে পারিবারিক জীবন, পারিবারিক জীবন থেকে সামাজিক জীবন, সামাজিক জীবন থেকে জাতীয় জীবন ও জাতীয় জীবন থেকে আন্তর্জাতিক জীবনের নীতিমালা নির্ধারণ করে গেছেন। দেওয়ানি আইনের ধারায় ইসলামের দান, ওয়াকফ, জীবনস^ত্ব অছিয়ত (উইল), উত্তরাধিকার আইন, নারীরক্ষণ আইন, প্রতিবেশী আইন, দেশ পরিচালনার আইন, আবার দ-বিধি আইনের সকল ধারাই সমানভাবে স্থান পেয়েছে তাঁর দৃষ্টিতে। আন্তর্জাতিক আইনের ক্ষেত্রেও তিনি সব সুন্দর নীতি ধারাবাহিকভাবে দিয়ে করে গেছেন। সমাজ, সভ্যতা ও রাজনীতিতে তিনি যে কী অপরিসীম দান করে গেছেন, তা আজও বিস্ময়ের উদ্রেক করে।
হযরত মুহাম্মদের (সা.) সমরনীতি কত মানবিক ও উদারতার ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল, তা আজকের জেনেভা চুক্তির সঙ্গে ‘খানিকটা তুলনা’ করা যেতে পারে। (১) তিনি ঘোষণা করেন, যুদ্ধের উদ্দেশ্য অত্যাচার নয়, অত্যাচারীকে দমন করা, ধ্বংস নয় সৃষ্টি, হিংসা নয় ভালোবাসা, অশান্তি নয় শান্তি ...। (২) সৈন্যদের মধ্যে ধর্ম ও নৈতিকতা রক্ষার কঠোর নির্দেশ ছিল। ব্যভিচার, মদ্যপান ও লুটতরাজ একেবারেই নিষিদ্ধ ছিল। (৩) যুদ্ধে মুসলমানদের প্রথম আক্রমণ একেবারেই নিষিদ্ধ ছিল। আত্মরক্ষা ছাড়া ইসলামে কোনো যুদ্ধ ছিল না। (৪) ইসলামের যুদ্ধ ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম মাত্র। এ সংগ্রামকেই জিহাদ বলা হয়। (৫) যুদ্ধে বৃদ্ধ, স্ত্রীলোক, কিশোর, রুগ্ন, অসহায় এবং অসামরিক ব্যক্তিদের ওপর আঘাত করা একেবারেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। (৬) প্রকৃতি জগৎ, প্রাণীজগৎ, শস্যক্ষেত্র, বাড়িঘর ইত্যাদির ওপর ধ্বংসযজ্ঞকে পাপ বলে পরিগণিত করেছিলেন। নদীর পানি, পুকুরের পানি কিংবা যে কোনো জলাশয় ভরাট ও বিষাক্ত করা চলবে না। (৭) নিহত শত্রু বা সৈনিকের নাক-কান কাটা বা যে কোনো অঙ্গচ্ছেদ করাটাকে তিনি একেবারেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। অথচ সে যুগে পরাজিত বা নিহত শত্রুর নাক-কান কেটে আনতে পারলে তাকে পুরস্কৃত করা হতো। (৮) শত্রু হোক, সৈন্য হোক, আশ্রয় প্রার্থনা করলে সঙ্গে সঙ্গে আশ্রয় দেওয়ার নির্দেশ করেন। এমনকি নিহত সৈনিকের পশুকেও হত্যা নিষিদ্ধ করেছিলেন। (৯) যুদ্ধকালীন অবস্থায় হোক, পূর্বে হোক, পরে হোক, শত্রু শান্তি-প্রস্তাব দিলে সঙ্গে সঙ্গে তা গ্রহণের আদেশ দেন। (১০) যুদ্ধবন্দিদের প্রতি সদ্ব্যবহার করার জন্য শুধুমাত্র ঘোষণা নয়, যে বিরল দৃষ্টান্ত তিনি আমাদের জন্য রেখে গেছেন, বদর যুদ্ধের বন্দিগণ তার জ্বলন্ত প্রমাণ। (১১) দেশ, জয় ও সম্পদ লাভের জন্য যুদ্ধ নয়, এরূপ যুদ্ধকে তিনি একেবারেই হারাম ঘোষণা করেছিলেন। যুদ্ধ সম্পর্কে পৃথিবীর ইতিহাসে এ রূপ ঘোষণা তিনিই প্রথম করেন।
সুতরাং ইসলামিক রাষ্ট্র বলতে এমন একটি রাষ্ট্রের কথা বোঝায় যা সম্পূর্ণ মানবিক সকল ধর্মের সহাবস্থানে সমৃদ্ধ। যেখানে ধর্ম-বর্ণ নিবিশেষে সবাই এক জাতিতে বিশেষিত হয়ে নিজের ধর্মানুশীলন করতে পারে। ইসলামিক রাষ্ট্র মানে একটি সৃষ্টিশীল রাষ্ট্র, যেখানে আছে আর্ত-মানবতার সম্যক উত্তরণ। এমনকি এ রাষ্ট্রের সমরনীতিতেও আছে মানবতার নান্দীপাঠ, যা আজকের বিশ্ব-বিবেকেরও শুভ সংস্করণ।
ইসলাম বিশ্বমানবতার জন্য এক সর্বজনীন ও শাশ্বত জীবনবিধান। এতে রয়েছে মানব কল্যাণের এক অনির্বাণ পথ-নির্দেশনা। ইসলাম আত্মগঠন ও সুশীল সমাজ বিনির্মাণে যে মহান শিক্ষা বিশ্বমানবের সমীপে উপস্থাপন করেছে, তা এ পৃথিবীর প্রচলিত অন্যান্য ধর্মে সত্যিই বিরল। ইসলাম প্রদর্শিত শিক্ষা ও মহৎ গুণাবলির মধ্যে ক্ষমা ও উদারতা এক অনন্য সাধারণ গুণ। ক্রোধের বহ্নিশিখাকে পদদলিত করে ইসলাম মানব জাতিকে সহনশীল, ক্ষমাপ্রবণ ও উদার হওয়ার উপদেশই শুধু দেয়নি বরং তা কার্যে পরিণত করে এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। মানুষে মানুষে হানাহানি, রক্তপাত, বিদ্বেষ, সংকীর্ণতা ও কদর্যতা পরিহার করে ইসলাম সমগ্র মানব জাতিকে ক্ষমা ও উদারতার বন্ধনে আবদ্ধকরণের মাধ্যমে জাতিভেদে সকল মানুষকে এক উম্মাহে পরিণত করেছে। মহানবী (সা.) এর নবুয়ত প্রাপ্তির পর ২৩ বছরের নবী জীবনে ক্ষমা ও উদারতার আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে অগণিত মানুষ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছে। পান করেছে ইসলামের সুমহান বারিসুধা। মুসলিম-অমুসলিম সকল ঐতিহাসিক অকপটে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে, তলোয়ারে নয়, উদারতাতেই ইসলামের দিগন্ত অতি অল্প সময়ে আন্তর্জাতিক পরিম-লে ব্যাপ্তি লাভ করেছে। আল-কোরআন একজন আদর্শ মানুষ ও প্রকৃত মুমিন হওয়ার জন্য যে সমস্ত গুণাবলি মানব জাতির সামনে উপস্থাপন করেছে তার মধ্যে ক্ষমা ও উদারতাকে উত্তম গুণ হিসেবে উল্লেখ করেছে। আল-কোরআনে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষিত হয়েছে ‘যারা সচ্ছলতা ও অভাবের সময় ব্যয় করে, যারা নিজেদের রাগকে সংবরণ করে আর মানুষের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে বস্তুত আল্লাহ সৎকর্মশীলদিগকেই ভালোবাসেন। ’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৩৪) অনুরূপভাবে আল-কোরআনের অসংখ্য আয়াতে সংকীর্ণতা পরিহার করে উদারতা ও ক্ষমা করার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। যেমন বলা হয়েছেÑ ‘তাদের মাফ করে দেয়া উচিত ও তাদের দোষ না ধরা উচিত। তোমরা কি চাও না, আল্লাহ তোমাদের মাফ করুন। আল্লাহ ক্ষমাশীল ও মেহেরবান’। (সূরা আন-নূর, আয়াত : ২২) অন্যত্র বলা হয়েছেÑ ‘আমি আসমান ও জমিনকে এবং এ দুটোর মধ্যে যা কিছু আছে সব কিছুই হক ছাড়া আর কোনো ভিত্তিতে সৃষ্টি করিনি। ফয়সালার সময় অবশ্যই আসবে, তাই (হে নবী!) আপনি তাদের ভদ্রভাবে মাফ করে দিন’। (সূরা আল-হিজর, আয়াত : ৮৫)
প্রতিশোধ গ্রহণের ক্ষমতা ও সুযোগ থাকা সত্ত্বেও যাকে ক্ষমা করা হয় তাই প্রকৃত ক্ষমা। এরূপ ক্ষমার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। কেবল এরূপ ক্ষমা প্রদর্শন করেছেন বিশ্বমানবতার মুক্তিদূত প্রিয়নবী মুহাম্মদ (সা.) ও তার সাহাবি (রা.) বৃন্দ। তিনি ছিলেন মহান চরিত্রের অধিকারী। তিনি লোকদের অহেতুক অভদ্র ও অশালীন আচরণ সত্ত্বেও তাদের সঙ্গে সর্বদা ক্ষমা ও দয়া প্রদর্শন করতেন। কখনো প্রতিশোধ গ্রহণ করতেন না। মুখ দিয়ে খারাপ কথা উচ্চারণ করতেন না কিংবা শাস্তিও দিতেন না। এমনকি তিনি কাউকে বদদোয়াও দেননি। ক্ষমা ও উদারতাই ছিল তার চরিত্রের অন্যতম ভূষণ। হযরত আয়শা (রা.) নবীজি (সা.)-এর ক্ষমাগুণের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘তিনি কখনো নিজের ব্যাপারে কারো থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি। তবে আল্লাহর দ্বীন ও তার বিধিবিধানের অবমাননা করা হলে তিনি সেক্ষেত্রে ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন।’ (সহিহুল বোখারি)
যে কুফরি শক্তি ইসলামকে এক ফুৎকারে নির্বাপিত করতে চেয়েছিল, উৎপাটন করতে চেয়েছিল এর শেকড়কে এবং যে সমস্ত কোরাইশ নেতৃবৃন্দ ইসলামকে ধ্বংস করার জন্য সর্বদা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল, মহানবী (সা.) তাদের মক্কা বিজয়ের দিন শর্তহীন সাধারণ ক্ষমা করেছিলেন। তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিশোধ নেই, আল্লাহতায়ালা তোমাদের ক্ষমা করুন।’ হযরত উমর (রা.) বলেন, ‘মহানবী (সা.)-এর এই উদারচিত্ততা দেখে আমি সেদিন লজ্জায় নতমুখ হয়ে গিয়েছিলাম। আমি যেখানে প্রতিশোধ নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি, আনন্দ উল্লাস করছি, তিনি সেখানে চিরশত্রুদের ক্ষমার সুসংবাদ শোনাচ্ছিলেন। ফলে মক্কা বিজয় পরিণত হয়েছিল রক্তপাতহীন এক মহান বিজয়ে। পৃথিবীর ইতিহাসে এ ধরনের ক্ষমা ও উদারতার দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যায় না।’ নবী-জীবনের ক্ষমার এরূপ অনেক দৃষ্টান্ত হাদিস গ্রন্থরাজিতে ছড়িয়ে রয়েছে। হযরত আনাস (রা.) বলেন, ‘একদা জনৈকা ইহুদি নারী নবীজি (সা.)-এর কাছে বিষ মিশ্রিত বকরির ভুনা গোশত আহারের জন্য নিয়ে আসে। রাসূল (সা.) ওই গোশত থেকে খাওয়া শুরু করেন। তাঁর সঙ্গে আরও কিছু সাহাবিও খাওয়া শুরু করেন। একবার মুখে দিতেই নবীজী (সা.) সাহাবিদের খাওয়া বন্ধের নির্দেশ দেন এবং বলেন, এ মাংসে বিষ মিশ্রিত রয়েছে। তৎক্ষণাৎ তিনি (সা.) ইহুদি মহিলাকে ডেকে পাঠান। মহিলা আসার পর নবীজী (সা.) তাকে জিজ্ঞেস করেন, তুমি কেন গোশতে বিষ মিশিয়েছ? সে বলে, আপনাকে কে বলেছে যে, আমি বিষ মিশ্রিত করেছি? তিনি বলেন, আমার হাতের এই গোশতের টুকরোটি সাক্ষী দিচ্ছে। তখন ইহুদি মহিলা বিষয়টি স্বীকার করে এবং বলে, আমি আপনাকে পরীক্ষা করার জন্য বিষ মিশিয়েছি। এরপর নবীজি (সা.) ওই মহিলাকে তাঁর প্রাণনাশের চেষ্টা সত্ত্বেও কোনো শাস্তি দেননি, বরং ক্ষমা করে দেন।’ একবার রাসূলে করিম (সা.)-কে বলা হলোÑ ‘আপনি মুশরিকদের বা মূর্তিপূজকদের জন্য অভিশাপ দিন।’ তিনি উত্তর দেনÑ ‘আমি জগতের রহমতস্বরূপ পদার্পণ করেছি, অভিশাপস্বরূপ নয়।’ (মুসলিম) মানুষ তার দয়া, উদারতা, ক্ষমা ও সহনশীলতার অনুপাতে আল্লাহর কাছে মর্যাদাশীল হবে। এ জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.) একদা হযরত আবু বকর (র.)-কে তার বন্ধুদের অভিশাপ দিতে বারণ করে বলেন, ‘সিদ্দিক বা সত্যবাদী কখনো অভিশপ্তকারী হতে পারে না।’ (মুসলিম)
মর্যাদা ও ঐতিহ্য বৃদ্ধির উপায় হিসেবে রাসূল (সা.) বর্ণনা করেছেন, ‘তোমার সঙ্গে যে দুর্ব্যবহার করে, তুমি তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার কর। অত্যাচারীকে ক্ষমা কর। যে তোমাকে নিঃস্ব করল তুমি তাকে দান কর। যে তোমার সঙ্গে আত্মীয়তা ছিন্ন করে তুমি তার সঙ্গে আত্মীয়তা রক্ষা কর।’ (তাবারানি)
মহানবী (সা.) মাহারিবে খাফসা নামক স্থানে বনু-গাতফানের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য অবস্থান করছিলেন। কাফেররা মুসলমানদের অসর্তকতার সুযোগ খুঁজছিল। এমন সময়ে নবীজী (সা.) একটি গাছের নিচে বিশ্রাম করছিলেন। একজন অবিশ্বাসী চুপিসারে এসে তলোয়ার নিয়ে তাঁর শিয়রে দাঁড়িয়ে বলেÑ ‘এখন তোমাকে কে রক্ষা করবে?’ তিনি বলেন, ‘আল্লাহ’। তৎক্ষণাৎ কাফেরের হাত থেকে তরবারিটি পড়ে গেল। এবার মহানবী (সা.) তরবারিটি নিয়ে তাকে হত্যা ব্যতীত ছেড়ে দিলেন। সে তার শিবিরে গিয়ে সঙ্গীদের বলে, আমি সর্বোত্তম ব্যক্তির হাত থেকে মুক্তি পেয়ে এসেছি। এরপর সে ইসলামের ঘোষণা দিয়ে মুসলমান হয়ে যায়। এরূপ অসংখ্য ঘটনা রয়েছে, যা প্রমাণ করে মহানবী (সা.)-এর ক্ষমা ও উদারতার বিশেষ গুণের। জাহেলি বর্বরতা দূরীকরণার্থে ক্ষমা ও উদারতার প্রবর্তন করে মানবতা ও নৈতিকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি।
ক্ষমা ও উদারতা দৃঢ় চরিত্রের প্রধান অঙ্গ। এই মহৎ গুণ দ্বারা অনেক ক্ষেত্রেই লাগামহীনভাবে বশীভূত করা যায়। এই মহিমান্বিত মর্যাদা শুধু মনোনীত ব্যক্তিদের আল্লাহ দান করেন। যুগে যুগে এই মর্যাদার অধিকারীবৃন্দ অমর ব্যক্তিদের অধিকারী হয়েছেন, রাষ্ট্র-স্রষ্টা হয়েছেন। তাই সর্বদা লক্ষ্য করা দরকার, অন্যায়ের শাস্তি দিতে আমরা যেন ত্বরান্বিত না হই। কেননা, আজ যে অন্যায়ে প্রবৃত্ত হলোÑ কাল সে মহৎ গুণ কিংবা মহৎ মানুষে ছোঁয়া পেয়ে মহৎজনে পরিণত হতে পারে। সমাজের সকল পাপ ও অন্যায়র বিরুদ্ধে আপসহীন আমরণ একনিষ্ঠ সংগ্রামই হলো জেহাদ। জেহাদের যে পবিত্র উদ্দেশ্য তা কোনো রাজ্য বা রাজত্ব নয়, বরং পাপ ও অন্যায়কে পরাস্ত করা। হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, অত্যাচারী শাসনকর্তার সামনে সত্য কথা বলাই সর্বশ্রেষ্ঠ জেহাদ। তাই জেহাদের নামে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালিয়ে রক্তাক্ত ইতিহাস রচনা করে ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ কায়েম করা যায় না, বরং ইসলাম বিপন্ন হয়। অমুসলিমদের মনে ইসলাম সম্পর্কে একটা বিরূপ ধারণা গড়ে ওঠে। তাই ইসলাম তথা বিশ্ব- মানবতার বৃহত্তর স^ার্থে জেহাদিদের নতুন করে আত্মসমালোচনা করতে হবে। কারণ ইসলাম সন্ত্রাসের নয়, ইসলাম শান্তির। হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, আত্মসমালোচনার মধ্য দিয়ে যার আত্মার উত্তরণ ঘটে, সে-ই উৎকৃষ্ট মুসলমান।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।