Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট

ড. এ এস এম আজিজুল্লাহ | প্রকাশের সময় : ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

পূর্ব প্রকাশিতের পর
সেদিন পূর্ব বাংলা থেকে নির্বাচিত সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজির সাথে বাংলাকেও গণপরিষদের অন্যতম সরকারি ভাষা করার প্রস্তাব করেন। তুমুল বিতর্কের মধ্যে শেষ পর্যন্ত ২৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার দাবি গণপরিষদে বাতিল হয়ে যায়। এতে সাথে সাথে ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী মহল ক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং গণপরিষদের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে পরের দিন ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ধর্মঘট আহ্বান করা হয়। এ সময় বিশেষ করে ঢাকার ছাত্র সমাজ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রাজপথে বিভিন্ন শ্লোগান দিতে দিতে শহর প্রদক্ষিণ করে।
আন্দোলনকে আরো বেগবান করার লক্ষ্যে ২ মার্চ ’৪৮-এ ফজলুল হক হলে ছাত্র, শিক্ষক, রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের সমন্বয়ে এক সভার আহ্বান করা হয়। কমরুদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে উক্ত সভায় শহীদুল্লাহ কায়সার, তাজউদ্দিন আহমদ, শেখ মুজিব, শওকত আলী, অলি আহাদ প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। উক্ত সভায় পূর্বের সংগ্রাম পরিষদ বিলুপ্ত করে ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’, ‘গণআজাদী লীগ’, ‘তমদ্দুন মজলিশ’, বিভিন্ন হল সংসদের দু’জন করে প্রতিনিধি নিয়ে শাসসুল আলমকে আহ্বায়ক করে গঠিত হয় ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। নবগঠিত সংগ্রাম পরিষদে প্রথম কর্মসূচি ছিল ১১ মার্চ পূর্ব বাংলায় সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান। ঐদিন ধর্মঘট চলাকালে সচিবালয়ের ১নং গেটে পিকেটিং রত অবস্থায় পুলিশের সাথে তুমুল বাকবিত-ার এক পর্যায় শামসুল হক, শেখ মুজিব, অলি আহাদ, শওকত আলীসহ বহু ছাত্রনেতাকে রাজপথ থেকে গ্রেফতার করে। প্রথমে তাদের ওয়াইজঘাটের কোতোয়ালি থানায় এবং পরে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেয়া হয়। নেতাকর্মীদের গ্রেফতারের ফলে আন্দোলনের গতি শতগুণে বৃদ্ধি পায়। তাদের গ্রেফতার-নির্যাতনের প্রতিবাদে পরের দিন ১২ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের আহ্বায়ক নঈমুদ্দিন এক বিবৃতি প্রদান করেন এবং ১৩ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা বাংলায় পুনরায় হরতাল পালিত হয়। এক পর্যায় ৪ দিনের মাথায় ১৫ মার্চ ’৪৮ পূর্ব বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের প্রদত্ত ৮ দফা দাবি মেনে নেয়ার ভিত্তিতে ‘বর্ধমান হাউসে’ বসে চুক্তিবদ্ধ হয়ে আটোক সকল নেতাকর্মীকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন। মুক্তি পাবার পর নেতৃবৃন্দদের একটি ট্রাকে করে সারা শহর প্রদক্ষিণ করে সন্ধ্যায় ফজলুল হক হলে তাদের সংবর্ধনা দেয়া হয়।
পরের দিন ১৬ মার্চ সংগ্রাম পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। উপস্থিত সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের প্রস্তাবে সেদিন উক্ত বৈঠকের সভাপতিত্ব করেন শেখ মুজিব। বৈঠকের কার্যক্রম শেষে শেখ মুজিব বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার স্বপক্ষে এক জ্বালাময়ী বক্তৃতা প্রদান করেন। বক্তৃতা শেষে উপস্থিত সকল ছাত্রছাত্রী মিছিল বের করলে পুলিশ মিছিলে লাঠিচার্জ, কাঁদোনে গ্যাস ও বন্দুকের ফাঁকা গুলি করে মিছিল ছত্রভঙ্গ করে দেয়। সেদিন শওকত আলীসহ ১৯ জন ছাত্র মারাত্মকভাবে আহত হন। পুলিশী নির্যাতনের প্রতিবাদে পরের দিন ১৭ মার্চ ঢাকায় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়। ১৯ মার্চ ’৪৮ বিকেলে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় আসেন। ২১ মার্চ তিনি রেসকোর্স ময়দানে এক ভাষণ দান কালে তিনি বলেন, ‘একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। যারা এ ব্যাপারে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছেন তারা বিদেশি রাষ্ট্রের অর্থভোগী চর তথা পাকিস্তানের শত্রু’। তার এ বক্তব্যের সাথে সাথে জনসভায় উপস্থিত ছাত্ররা ‘না’ ‘না’ বলে প্রতিবাদ করে। অতঃপর ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে অনুষ্ঠিত সমাবর্তনে জিন্নাহ আবারো বলেন, ‘টৎফঁ ধহফ টৎফঁ ংযধষষ নব ঃযব ড়হষু ঝঃধঃব খধহমঁধমব ড়ভ চধশরংঃধহ’। এবার উপস্থিত সকল ছাত্রের কণ্ঠে একযোগে ধ্বনিত হলো ‘হড়’ ‘হড়’। এমনিভাবে ভাষা ও জাতীয় ইস্যুতে পূর্ব পাকিস্তানে দিনের পর দিন আন্দোলন জোরালো হতে থাকে। ইতোমধ্যে ১১ সেপ্টেম্বর ’৪৮ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মৃত্যুবরণ করেন। প্রধানমন্ত্রী হন লিয়াকত আলী খান। কিন্তু বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। বরং উতরোত্তর নতুন নতুন ফন্দির উদ্ভাবন ঘটানো হচ্ছিল, যেমন আরবি বর্ণে বাংলা লেখা। এর প্রধান প্রবক্ত ছিলেন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুল রহমান। আরবি বর্ণমালায় বাংলা লেখার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ১৯৪৮ সালের ২৭ ডিসেম্বরে নিখিল পাকিস্তান শিক্ষক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। উক্ত সম্মেলনে শিক্ষা সচিব খোঁড়া যুক্তির মাধ্যমে আরবি বর্ণে বাংলা লেখার পক্ষে বক্তব্য প্রদান করেন। এর উপর ভিত্তি করে ১৯৪৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারিতে পেশোওয়ারে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ডের সভায় আরবি বর্ণমালাকে পাকিস্তানের একমাত্র বর্ণমালা করার জোর সুপারিশ করা হয়। সরকারের এই কাজে সর্বাত্মক সহযোগিতার জন্য ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকে নিয়োগ করা হয়। তিনি সরকারের সে প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন।
২৩ জুন ১৯৪৯ সালে মুসলিম লীগের প্রগতিবাদী নেতা-কর্মীরা মিলে ‘রোজ গার্ডেনে’ এক সম্মেলনের আয়োজন করেন। উক্ত সম্মেলনে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি করে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ গঠিত হয়। এদিকে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম চলতে থাকে। ১৯৪৯-৫০ সালে পূর্ববঙ্গে খাদ্য সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করে। যার ফলে প্রায় ২০ হাজার নিরীহ দরিদ্র লোক মারা যায়। এর প্রতিবাদে আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১৪ অক্টোবর’ ৪৯ আওয়ামী মুসলিম লীগ ‘ভুখা মিছিল’ বের করে। উক্ত মিছিল থেকে শাসকগোষ্ঠী মওলানা ভাসানী ও শামসুল হককে গ্রেফতার করে। সেদিন সুকৌশলে মিছিল থেকে সরে পড়ে শেখ মুজিব গ্রেফতার এড়াতে পারলেও ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারী আবার গ্রেফতার হন। পরে ’৫০-এর জুন মাসে মওলানা ভাসানীসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দকে মুক্তি দিলেও শেখ মুজিব মুক্তি পান ’৫২র ২৬ ফেব্রুয়ারিতে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী আততায়ীর গুলিতে নিহত হওয়ার পর খাজা নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। তিনি ক্ষমতা গ্রহণের পর ২৬ জানুয়ারি ’৫২ প্রথম ঢাকায় এসে ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানের জনসভায় পূর্বসুরিদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলেন, ‘একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। একথা শোনার সাথে সাথে ছাত্র সমাজ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং জরুরি ভিত্তিতে মধুর ক্যান্টিনে এক সভায় মিলিত হয়। উক্ত সভায় ৩০ জানুয়ারি ছাত্র ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত হয়। ৩০ জানুয়ারি ধর্মঘট পালন শেষে আবার ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরে ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়। ঐদিন সর্বাত্মক হরতাল পালনের শেষে গাজীউল হকের সভাপতিত্বে বিশাল ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় ১১ ও ১৩ ফেব্রুয়ারি ‘পতাকা দিবস’ এবং ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘দাবি দিবস’ পালনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ২১ ফেব্রুয়ারির প্রোগ্রামকে লক্ষ্য করে সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি মাইকিং করে সারা শহরে ১ মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে। রাতে সংগ্রাম পরিষদ জরুরি মিটিং করে ১৩/৩ ভোটে সিদ্ধান্ত নেয় যে, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা যাবে না। কিন্তু ছাত্রসমাজ সেদিনের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেনি। গভীর রাতে গাজীউল হকের নেতৃত্বে কিছু ছাত্র গোপনে বৈঠক করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। পরের দিন সকালে পরিকল্পনা মাফিক দশ জন দশ জন করে প্রায় ১৫/২০ হাজার ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এসে জমায়েত হয়। সমাবেশের এক পর্যায় গাজীউল হক ২০ তারিখের সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের গৃহীত সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। বেলা ১১টার দিকে সমবেত হাজার হাজার ছাত্র ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ লেখা প্লাকাড হাতে নিয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বিশাল মিছিল সহকারে রাজপথে নেমে আসে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকার আকাশ-বাতাশ মুখরিত হয়ে ওঠে। এক পর্যায় পুলিশ মিছিলে লাঠি চার্জ করে। শুরু হয় পুলিশের সাথে ছাত্রজনতার খ-যুদ্ধ। একদিকে পুলিশের হাতে লাঠি, কাঁদোনে গ্যাস অপর দিকে ছাত্র-জনতার হাতে ইটপাটকেল। একপর্যায় বিকেল বেলা পুলিশ মিছিলে সরাসরি গুলি বর্ষণ করলে সালাম, বরকত, জব্বার, রফিক প্রমুখের রক্তে সেদিন রাজপথ রঞ্জিত হয়। সৃষ্টি হয় ঐতিহাসিক একুশে ফেব্রুয়ারি।
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট

২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬
২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬
আরও পড়ুন