Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৮ জুন ২০২৪, ১৪ আষাঢ় ১৪৩১, ২১ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

রফতানি বন্ধের শঙ্কা

ফের ভারতীয় ষড়যন্ত্রের কবলে সোনালী আঁশ

| প্রকাশের সময় : ১০ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

ইখতিয়ার উদ্দিন সাগর : ফের ভারতীয় চক্রান্তে সংকটে পড়েছে পাটশিল্প। বর্তমান সরকার পূর্বের মেয়াদে ক্ষমতায় এসেই পাটের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে ব্যাপক কার্যক্রম শুরু করে যার ফল পায় বাংলাদেশ। তবে হারানো ঐতিহ্য ফিরে আসতে থাকায় ‘সহ্য’ হয় না পার্শ্ববর্তী দেশটির। বাংলাদেশের পাট ও পাটপণ্যে এন্টি ডার্ম্পি শুল্কারোপ করে ভারত। এতে বাংলাদেশের পাটের এক পঞ্চমাংশ বাজার হাতছাড়া হওয়ার পথে। কয়েক দশক পূর্বে ভারতীয় ষড়যন্ত্রের কবলে পড়েই সারা বিশ্বে পরিচিত বাংলাদেশের পাট হারিয়ে গিয়েছিল, যে কাজে দেশটিকে সহযোগিতা দিয়েছিল বিশ্বব্যাংক।
বর্তমানে বাংলাদেশের পাট ও পাটজাত পণ্যের মোট রফতানির ২০ শতাংশ ভারতের বাজারে রফতানি হচ্ছে। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার থেকে বাংলাদেশি পাটপণ্যে টনপ্রতি সর্বোচ্চ ৩৫২ ডলারসহ বিভিন্ন হারে অ্যান্টিডাম্পিং শুল্ক আরোপ করেছে দেশটি। এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়ায় ভারতের স্থানীয় পাট ও পাটজাত পণ্যের তুলনায় বাংলাদেশের পণ্যের দাম বেশি পড়ছে। এ কারণে বাংলাদেশের সোনালী আঁশ হিসেবে পরিচিত পাট ভারতে রফতানির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হচ্ছে। এতে ভারতের বাজারে স্থানীয় পাট ও পাটজাত পণ্যের বাজার বাড়ছে, আর বাংলাদেশের পাট বাজার হারাচ্ছে। রফতানিকারকরা বলেছেন, বাংলাদেশের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এটা ভারতের বড় ধরনের যড়যন্ত্র। পাটপণ্যে ভারত যদি অ্যান্টিডাম্পিং শুল্কা প্রত্যাহার না করে, তাহলে ভারতে এ পণ্য রফতানি বন্ধ করা হবে। তাদের চেয়ে ভালো বিকল্প বাজারের সন্ধান করা হবে বলেও তারা জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় গতকাল সংশ্লিষ্ট খাতের উদ্যোক্তাদের নিয়ে বৈঠকের আয়োজন করে। তবে বৈঠকে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন বৈঠকে উপস্থিত এক রফতানিকারক সংগঠনের নেতা। নাম প্রকাশ না করা শর্তে তিনি বলেন, বুধবার আবার এ বিষয়ে বৈঠক বসবে। সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর মাধ্যমে শুল্ক প্রত্যাহারের জন্য আবেদন করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এছাড়া এ পণ্য ভারতে রফতানি বন্ধের বিষয়েও আলোচনা হয়েছে বলে তিনি জানান। এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ভারতের অ্যান্টিডাম্পিং শুল্কারোপের বিরুদ্ধে আপিলসহ অন্য যা যা করণীয় সবই করা হবে। দাপ্তরিকভাবে অবহিত হওয়ার পরই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া বলে জানা গেছে। তবে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের মতামতের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
জানা গেছে, এ ধরনের সিদ্ধান্তের কারণে বাংলাদেশের পাট শিল্প এবং এর সাথে সম্পৃক্ত সাপ্লাই চেইন প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে, পাশাপাশি ভারতের সাথে বাংলাদেশের ৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, মানভেদে প্রতি টন পাটসুতা আগে গড় রফতানি মূল্য ৮শ’ ডলারের মতো ছিল। এখন খরচ পড়বে ১ হাজার ডলারের মতো। এ কারণে ভারতীয় রফতানিকারকরা বাংলাদেশ থেকে পাটপণ্য কিনবেন না। এতে করে রফতানি আয়ে প্রভাব পড়বে।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য মতে, বাংলাদেশ ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রায় ৯২ কোটি মার্কিন ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য বিভিন্ন দেশে রফতানি হয়েছে। এর মধ্যে ২০ শতাংশ ভারতের বাজারে গেছে। ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারের ৮ শতাংশ বাংলাদেশের পাটের দখলে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ৮৬ কোটি ৮৫ লাখ ডলারের পাট ও পাটপণ্য রফতানি হয়েছে। এর মধ্যে ভারতেই রফতানি হয়েছে ১০ কোটি ৪৪ লাখ ডলারের পণ্য, যা ওই অর্থবছরে ১২ শতাংশ। বাংলাদেশ থেকে ভারতে বেশি রফতানি হয় বস্তা। এ দেশ থেকে যত বস্তা ওই অর্থবছরে রফতানি হয়েছে, তার ২৪ শতাংশই গেছে ভারতে। এ ছাড়া শুধু ভারতের বাজারে প্রতি বছর এক লাখ ১০ হাজার টন পাটের সুতা রফতানি করা হয়। চলতি অর্থবছরে এই খাতের রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৯৬ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলার। তবে ভারতের এ ধরনের সিদ্ধান্তের কারণে এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণের কোন সম্ভাবনা নেই বলেও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
ভারতের গেজেট অনুযায়ী, বাংলাদেশি পাটপণ্য রফতানিতে আগামী পাঁচ বছর পর্যন্ত শুল্ক দিতে হবে। একই সঙ্গে নেপালের পাটপণ্য রফতানির ওপর বিভিন্ন হারে অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক আরোপ করেছে ভারত। তবে নেপালের পাটপণ্যের ওপর আরোপিত শুল্কের হার বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম। বাংলাদেশ এবং নেপাল হতে পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে ভারত সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয় টন প্রতি ১৯ থেকে ৩৫২ মার্কিন ডলার শুল্কারোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
জানা যায়, ২০১৫ সালের ২০ অক্টোবরে প্রথম দেশটির সংশ্লিষ্ট সংস্থা ডিরেক্টর জেনারেল অব অ্যান্টি-ডাম্পিং অ্যান্ড অ্যালাইড ডিউটিজ (ডিজিএডি) বাংলাদেশকে নোটিশ দেয়। এরপর তারা বাংলাদেশের প্রায় ২৫০ পাট রফতানিকারককে প্রশ্নপত্র পাঠায়। এর মধ্যে ২৬টি কোম্পানি প্রশ্নপত্রের উত্তর দিয়েছে। উত্তরদাতাদের মধ্যে ১২টি  কোম্পানিকে নমুনা হিসেবে ধরে তদন্ত করেছে ডিজিএডি। সে অনুযায়ী ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয় গেজেট প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের রফতানিকারকেরা ডিজিএডির কাছে এখন আপিল করতে পারবে। সেখানে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) কাছে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য যেতে পারবে।
ভারতের গেজেটে ৯টি কোম্পানির ওপর শুল্কহার নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। এর মধ্যে পাটসুতায় প্রতি মেট্রিক টনে প্রাইড জুট মিলকে ১০৪ দশমিক ১৬ ডলার, আশা জুট ইন্ডাস্ট্রিজকে ১৯ দশমিক ৩০, সোনালি আঁশ ইন্ডাস্ট্রিজ ও আলীজান জুট মিলকে ২০ দশমিক ৩৫ ডলার, শরিফ জুট মিলসকে ১৫২ দশমিক ৮৫ ডলার, আনোয়ার জুট স্পিনিং মিলসকে ১০৯ দশমিক ৫৯ ডলার, জনতা জুট মিলসকে ২০ দশমিক ৬৮ ডলার, সিডল টেক্সটাইলস ও সাগর জুট স্পিনিংকে ১০২ দশমিক ৯৩ ডলার শুল্ক দিতে হবে।  
যেসব মিল প্রশ্নপত্রের উত্তর দিয়েছে, কিন্তু নমুনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, তাদের ওপর পাটসুতা রফতানিতে প্রতি টনে ৯৭ ডলার, চটে ৩৫২ ডলার ও পাটের বস্তায় ১২৫ ডলার শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। অন্যদিকে যারা প্রশ্নপত্রের উত্তর দেয়নি, তাদের ওপর পাটসুতায় টনপ্রতি ১৬২ ডলার, চটে ৩৫২ ডলার ও বস্তায় ১৩৯ ডলার শুল্ক আরোপ করেছে ভারত।
এর আগে মুক্ত বাণিজ্য বা সাফটা চুক্তির আওতায় বাংলাদেশের ২৬টি বাদে সকল পণ্যে শূন্য শুল্ক সুবিধা দেয় ভারত, যা ২০১১ সাল থেকে কার্যকর রয়েছে। এ সুবিধার পর পাটজাত পণ্য থেকে প্রতিবছর রফতানি আয় বাড়ছে। এ অবস্থায় ঢাকা চেম্বার মনে করে, দু’দেশ যখন দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য উন্নয়নে কাজ করছে, সে সময় এ ধরনের সিদ্ধান্ত বাণিজ্য সম্প্রসারণের ধারাকে ব্যাহত করবে। ভবিষ্যতে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ব্যবধান আরও বৃদ্ধি পাবে। এ বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে ঢাকা চেম্বার দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
এই বিষয়ে ইন্ডিয়া বাংলাদেশ চেম্বার অফ কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মো: তাসকিন আহমেদ বলেন, ভারত এ ধরনের সিদ্ধান্তে এ দেশের পাট ও পাটজাত পণ্যের সাথে জড়িত সকলের বড় ধরনের ক্ষতি হবে। এছাড়া ভারতের সাথে আরো বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ার সম্ভবনা তৈরী হচ্ছে।
বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএসএ) চেয়ারম্যান আহমদ বলেছেন, ভারতের ওপর নির্ভরশীল অনেক পাটকল বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এছাড়া অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক আরোপের ফলে ভারতে পাটপণ্য রফতানি কমে যাবে যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়বে দেশের পাট ও পাটশিল্পের ওপর।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ