Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

এগিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমের কৃষি

উৎপাদিত ফসলের উপযুক্ত মূল্য চান চাষিরা

| প্রকাশের সময় : ৯ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মিজানুর রহমান তোতা : গ্রামীণ অর্থনীতির প্রাণশক্তি কৃষিখাত এগিয়ে চলেছে খাদ্যে উদ্বৃত্ত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল। কৃষিপণ্য উৎপাদনে রেকর্ডের পর রেকর্ড সৃষ্টি হচ্ছে। আসছে বিরাট গতিশীলতা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী সারাদেশের মধ্যে সবজি, ফুল, রেণুপোনা, খেজুরের গুড়, সাদা সোনা চিংড়ি, মশুর, মরিচ ও মটরসহ বিভিন্ন কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। ধান, ভুট্টা উৎপাদনে রয়েছে এলাকাটি দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ে। শীর্ষ অবস্থান ধরে রাখার প্রাণান্ত চেষ্টা চলছে। কর্মবীর কৃষকদের কোনো পেনশন নেই, নেই অবসর কিংবা ছুটিছাটা। দিনরাত পরিশ্রম করে চলেছেন কৃষাণ-কিষাণী। তবুও
কৃষিপণ্যের উপযুক্ত মূল্যপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা নেই। হাড়ভাঙা পরিশ্রমের ফসল অনেক সময় ঘরে তুলতে পারেন না বিনা পূজির ব্যবসায়ী মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো বিশেষ নজর দিলে কৃষিখাত আরো এগিয়ে যেত। কৃষির সাথে জড়িতদেও আর্থিক অবস্থার উন্নতি হতো। সামগ্রিকভাবে গ্রামীণ অর্থনীতি পৌঁছুতো ঈশ্বনীয়পর্যায়ে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ পরিচালক মো: ফয়েজ উদ্দীন দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, সবজি (দু’টি মৌসুমে) এক লাখ ২৩ হাজার ৯৫০ হেক্টর, বোরো পাঁচ লাখ ৭৯ হাজার ৫৭৬ হেক্টর, মশুর এক লাখ ১০ হাজার ২৯০হেক্টর, মরিচ ১০ হাজার ৭২৪ হেক্টর জমিতে আবাদ ও উৎপাদন হয়ে দেশের মধ্যে রয়েছে শীর্ষে। এছাড়া দেশের মোট চাহিদার বেশির ভাগ অবস্থান রয়েছে সাদা সোনা চিংড়ি, রজনীগন্ধা, মাছের রেণুপোনা ও খেজুরের গুড়। পরিকল্পনা রয়েছে যেসব অনাবাদী জমি পড়ে আছে তা আবাদের আওতায় এনে কৃষিজাত আয় আরো বাড়ানো। এটি হলে গোটা অঞ্চলের কৃষিতে আসবে শতভাগ সাফল্য। তবে কৃষিক্ষেত্রে গুণগত পরিবর্তন, আধুনিকায়ণ ও খাদ্য নিরাপত্তা গড়ে তোলার উদ্যোগটি বাস্তবে রূপ দেয়া যাচ্ছে না পুরোপুরিভাবে। মাটি ওলট-পালট করে সোনার ফসল ফলানোর সাথে জড়িত কৃষকরা সরকারের কোনো কোনো পদক্ষেপে মাঝেমধ্যেই আশান্বিত হয়ে উঠেন। সৃষ্টি হয় কৃষিকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নেয়ার আস্থা ও বিশ্বাস। কিন্তু নানা কারণে মাঝেমধ্যেই তারা হতাশ হয়ে পড়েন। যখন দেখেন  উপযুক্ত মূল্য পাচ্ছেন না পণ্যের। মনটা বিষিয়ে ওঠে তখন তাদের। কর্মবীর কৃষকরা রাজনীতি ও অর্থনীতির ঘোরপ্যাঁচ বোঝেন না। তারা চান কৃষির উন্নয়ন ও উৎপাদিত ফসলের উপযুক্ত মূল্য। সেটি নিশ্চিত করা খুবই জরুরি বলে কৃষি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এটি না হলে কৃষির গতিশীলতা মুখ থুবড়ে পড়ার আশঙ্কাও থাকবে।  কৃষি বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতি বিশারদরা বলেছেন, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ গোটা অঞ্চলের কৃষিনির্ভর তৃণমূল অর্থনীতির কাঠামো মজবুত করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। দরকার যথাযথ পদক্ষেপ। তাহলে দেখা দেবে আশার আলো। কৃষিক্ষেত্রে সৃষ্টি হবে সত্যিকারের অভাবনীয় বিপ্লব।  
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বিএডিসি সূত্র জানায়, কৃষি ভা-ার হিসেবে খ্যাত অঞ্চলটি বিভিন্ন কৃষিপণ্য উৎপাদনে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে বারবার। কৃষি ইনস্টিটিউটের গবেষণালব্ধ জ্ঞান ও প্রযুক্তি মাঠপর্যায়ে ছড়িয়ে দেয়ার জোরালো পদক্ষেপ দরকার। সংশ্লিষ্টদের দাবি প্রযুক্তি মাঠে যাচ্ছে। তবে নানা কারণে জোরদার নয়, সেটি তারা স্বীকার করেছেন। যশোর, খুলনা, মাগুরা, নড়াইল, ঝিনাইদহ, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া ও মেহেরপুর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের (বর্তমানে যশোরের ছয়টি জেলা ও খুলনার চারটি জেলা নিয়ে গঠিত দু’টি কৃষি অঞ্চল) এই ১০ জেলায় মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ১৩ লাখ ১৪ হাজার ৬৫ হেক্টর। প্রায় তিন কোটি জনসংখ্যার এই অঞ্চলটিতে ৭ হাজার ৮৩০ গ্রাম রয়েছে। প্রতিটি গ্রামেই গড়ে শতকরা প্রায় ৮৫ ভাগ মানুষ কৃষির উপর নির্ভরশীল। ভূমিহীন, প্রান্তিক, ক্ষুদ্র, মধ্যম ও বড় চাষির সংখ্যা প্রায় ২৭ লাখ। মাঠে মাঠে বিভিন্ন ফসলের সবুজের অপরূপ সৌন্দর্য তৈরি করার ধারক কৃষককূল বিভিন্ন ফসল উৎপাদনে বিপ্ল­ব ঘটিয়েছেন। এবার রোপা আমন ধানের বাম্পার ফলন তার বড় প্রমাণ। এ অঞ্চলে খাদ্য চাহিদা রয়েছে ৩০ লাখ ৭৫ হাজার ৬০৯ মেট্রিক টন। গড় হিসাবে ধান ও গমসহ খাদ্যশস্য উৎপাদন হয় ৪১ লাখ ৮ হাজার ২৯০ মেট্রিক টন। খাদ্য উদ্বৃত্ত থাকে ১০ লাখ ৩২ হাজার ৬৮১ মেট্রিক টন। কোনোক্রমেই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে খাদ্য ঘাটতি স্পর্শ করে না। তবে অনেক ক্ষেত্রে ঘাটতি সৃষ্টি করা হয়। ভারত থেকে চাল আমদানি করে বাজার করা হয় অস্থিতিশীল। অঞ্চলটির বেশির ভাগ ভূমি উঁচু ও বন্যামুক্ত। বিভিন্ন ফসল উৎপাদনের জন্য মাটি সমৃদ্ধ।
সূত্র আরো জানায়, এ অঞ্চলে সাময়িক পতিত ও স্থায়ী পতিতসহ অনাবাদী জমি রয়েছে এক লাখ হেক্টরেরও বেশি জমি। যার পুরোটা আবাদের আওতায় আনা সম্ভব হলে কৃষি উৎপাদন আরো বাড়বে। গ্রামে গ্রামে বাড়ির আঙিনায় পরিকল্পিতভাবে সবিজসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্য আবাদের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। তাই সুযোগকে কাজে লাগানোর ব্যবস্থা নেয়ার তাগিদ দিয়েছেন মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তারা। এছাড়া এখন থেকেই নজর দিয়ে কৃষিপণ্যের উপযুক্ত মূল্য নিশ্চিত, হাট-বাজারের বিশৃঙ্খলা রোধ ও মুনাফালোভী মধ্যস্বত্বভোগীদের দাপট কমিয়ে কৃষকদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলানো উৎপাদিত ফসল নির্বিঘেœ বাজারজাতকরণের সুযোগ সৃষ্টির ব্যাপারে সরকারের সংশ্লি­ষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের জোরালো দৃষ্টি দেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে সংশ্লিষ্টদেও পক্ষ থেকে।  অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে পরিচিত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে কৃষিখাতে রয়েছে বিরাট সম্ভাবনা। সাধারণ কৃষকরা কোনোরূপ প্রশিক্ষণ গ্রহণ না করেই অতীত অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে কৃষিতে বিপ্লব ঘটিয়েছেন। বিভিন্ন ফসল উৎপাদনে সৃষ্টি করেছেন রেকর্ড। কিন্তু সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে কৃষি অর্থনীতি চাঙা করার উদ্যোগ বরাবরই অনুপস্থিত ছিল।
বর্তমান সরকার প্রথম থেকেই কৃষির সামগ্রিক উন্নয়নে বিশেষ দৃষ্টি দেয়। তবে আরো কয়েকটি বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে কাজে লাগাতে হবে। সেটি হচ্ছে, সাদা সোনা চিংড়ি উৎপাদন ও রফতানির যেসব সমস্যা আছে তা সমাধান। রজনীগন্ধা ও সবজি রফতানি বৃদ্ধি এবং সংরক্ষণের ব্যবস্থা। দেশের মোট চাহিদার রজনীগন্ধা ও সবজি সরবরা হয় অথচ এই অঞ্চলে পর্যাপ্ত কোল্ড স্টোরেজ গড়ে উঠেনি। সরকারি হিমাগার স্থাপন হলেও টানা ১০ বছরেও তা চালু হয়নি। তাছাড়া যশোরে রেকর্ড পরিমাণ উৎপাদিত সবজিকে ঘিরে কৃষিভিত্তিক শিল্প নগরী গড়ে তোলার দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ হয়নি। রজনীগন্ধা ফুল হিসেবে নয়, সবজি হিসেবে বিদেশে রফতানি হয়। কেন ফুল হিসেবে রফতানি করা যাচ্ছে না তা খতিয়ে দেখা দরকার। সবজি ও রজনীগন্ধাসহ কৃষিপণ্যের বিরাট চাহিদা রয়েছে বিদেশে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো সূত্র জানায়, দুবাই, কুয়েত, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, কানাডা ও জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের বেগুন, শিম, লাউ, পালং শাক, আদা, লেবু, পটল, কচুর লতির গোড়ার অংশ ও কলাসহ সবজি রফতানি হয়। চাহিদা ব্যাপক, কিন্তু নানা কারণে ততটা রফতানি হয় না। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উৎপাদিত কৃষিপণ্য সংরক্ষণ এবং রফতানির ক্ষেত্রে আরো গতিশীল করার উদ্যোগ নেয়া হলে অঞ্চলটি আবার স্বর্ণযুগে ফিরে যেতে পারবে।  
কৃষি উন্নয়নে বর্তমানে চারিদিকে সুস্থ পরিবেশ বিরাজ করছে। কৃষক শুধু নয়, কৃষি সংশ্লি­ষ্টসহ বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের কোনো ভয়-ভীতি পিছু টানছে না। কৃষির উন্নয়ন দরিদ্র ও প্রান্তিক কৃষক, কৃষি সংশ্লিষ্ট স্বল্প ও সীমিত আয়ের মানুষের চেহারায় মাঝেমধ্যে স্বস্তি ও শান্তি, আবার মাঝেমধ্যেই দুর্দশা আর দুশ্চিন্তার ছাপ দেখা যায়। অর্থাৎ কৃষি এগিয়ে যাচ্ছে ঠিকই স্থায়িত্ব আসছে না। সেজন্য দরকার শুধু কৃষকের উৎপাদিত কৃষিপণ্যের উপযুক্ত মূল্যপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা এবং কৃষির সমস্যাদির সমাধান।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কৃষি


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ