Inqilab Logo

শুক্রবার ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইতনার নহবতখানা

| প্রকাশের সময় : ৬ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আতিয়ার রহমান, নড়াইল থেকে : এক সময় এ দেশে জমিদারি শাসন ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। জমিদাররা শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। জমিদারি শাসন ব্যবস্থায় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি ছিলেন জমিদার। মূলত জমিদারকে ঘিরেই আবর্তিত হতো জমিদারি শাসন ব্যবস্থা। সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য এবং শাসন ব্যবস্থা পরিচালনায় জমিদাররা এদেশে নির্মাণ করেছিলেন সুরম্য অসংখ্য অট্টালিকা। সুরম্য এসব কারুকার্যময় অট্টালিকার প্রধান আকর্ষণ ছিল প্রবেশদ্বারের ‘নহবতখানা’। সকল বাদ্যযন্ত্রের সম্মিলিত সুর-ঝংকারের অন্যরকম আকর্ষণ ছিল নহবতখানা। জমিদারি বিনোদনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল এই নহবতখানা। এরকমই একটি নহবতখানা কালের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে নড়াইলের লোহাগড়ার ঐতিহ্যবাহী ইতনা গ্রামে। এলাকার প্রবীণ মানুষজনদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, জমিদার বাড়ির বিশাল অট্টালিকার প্রবেশমুখে নহবতখানা নির্মাণ করা হতো। নহবতখানা ছিল সুউচ্চ, যা কাঠ দিয়ে নির্মাণ করা হতো। কাঠের তৈরি নহবতখানার পাশাপাশি ইটের তৈরি সুরক্ষিত নহবতখানা ছিল নজরকাড়ার মতো। দৃষ্টিনন্দন ও নানা কারুকার্য খচিত নহবতখানা ঘিরে গড়ে উঠেছিল বাদ্যকর শ্রেণি। নহবতখানা ও বাদ্যকররা ছিল একে অপরের পরিপূরক। বাদ্যকরদের মধ্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের পাশাপাশি মুসলমান সম্প্রদায়ের বাদ্যকররা সহশিল্পী হিসেবে বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানে অংশ নিত। বাদ্যকরদের কাজ ছিল, সকাল-সন্ধ্যা নানা বাদ্যযন্ত্রের সংমিশ্রণে রাগ-রাগিণীর সুর ঝংকারে জমিদারসহ প্রজাদের মনোরঞ্জন করা। বাদ্যকররা পূজা-পার্বণসহ বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানে প্রতিযোগিতামূলক সুরের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতো। এ জন্য জমিদার কর্তৃক তাদের বিশেষভাবে পুরস্কৃত করা হতো। অট্টালিকার আশেপাশেই এসব বাদ্যকর পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করত। জমিদাররা বাদ্যকরদের বেতন-ভাতাসহ সব ধরনের ব্যয়ভার বহন করত। এখনও এদেশের বিভিন্ন এলাকায় বাদ্যকর সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব এবং উপস্থিতি দেখা যায়। আসলে জমিদারি শাসন ব্যবস্থায় গণবিনোদনের ক্ষেত্রে নহবতখানার গুরুত্ব ও অবদান স্বীকার্য সত্য। সানাই, বাঁশি, ঢাক, ঢোল, খোল, তবলা, হারমোনিয়াম, করতাল, প্রেমজুড়ি, ম্যান্ডলিন, ক্লাইনেটসহ অন্যান্য দেশি-বিদেশি বাদ্যযন্ত্রের সমাহারে নহবতখানা মুখরিত থাকত। যে জমিদারের ঐশ্বর্য, প্রভাব-প্রতিপত্তি বেশি ছিল, সে জমিদারের নহবতখানা ছিল বেশি জৌলুসপূর্ণ। তৎকালীন সময়ে জমিদারি শাসন ব্যবস্থায় বিনোদনের অন্যতম আধার ছিল নহবতখানা। শুধু যে জমিদাররাই নহবতখানা নির্মাণ করত তা নয়Ñ জমিদারদের পাশাপাশি রাজা, মহারাজা, জোতদার, গাতিদার, তালুকদারসহ ধনাঢ্য ব্যক্তিরাও এটি নির্মাণ করতেন। বংশীয় আভিজাত্যের বিকাশ ঘটানোর জন্য অনেকে নহবতখানা নির্মাণ করতেন। জমিদারি শাসন ব্যবস্থা উচ্ছেদ হওয়ার সাথে সাথে নহবতখানার অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়ে। রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের অভাবে নহবতখানা জৌলুস হারিয়ে শ্রীহীন হয়ে পড়ে। এখনও এদেশের অনেক এলাকায় নহবতখানার অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। এরকম একটি নহবতখানা আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার ঐতিহ্যবাহী ইতনা গ্রামে। লোহাগড়া উপজেলার কুন্দশী চৌরাস্তা থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণে মধুমতি নদীর পাড়ে ব্যানার্জি বাড়ির প্রবেশমুখে নহবতখানার অবস্থান। ইটের তৈরি নহবতখানায় রয়েছে শৈল্পিক নানা কারুকার্য। নহবতখানার মালিক ও ধনাঢ্য ব্যবসায়ী বাসুদেব ব্যানার্জি জানান, আমার দাদা মন্মথনাথ ব্যানার্জি রানী রাশমনির স্টেটের অধীনে ‘গাতিদার’ ও ‘তালুকদার’ ছিল। সে সময়ে তিনি নিজের এবং এলাকাবাসীর মনোরঞ্জনের জন্য বাড়ির সম্মুখে একটি কারুকার্যময় নহবতখানা নির্মাণ করেন। জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পর স্থাপিত নহবতখানাটি সংস্কারের অভাবে অস্তিত্ব সংকটে পড়ে। পরবর্তীতে নহবতখানা সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে পরিচয় করানোর জন্য আমি এর সংস্কার করেছি। এখনও দুর্গা পূজাসহ বাড়ির অন্যান্য উৎসব অনুষ্ঠানে এই নহবতখানা থেকে বাদ্যযন্ত্র বাজানো হয়ে থাকে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ