Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভেজাল ওষুধ রুখতে ‘মডেল ফার্মেসি’

রোগীরা সঠিক ধারণা পাবে : আজ আরো পাঁচটির উদ্বোধন

| প্রকাশের সময় : ৪ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

হাসান সোহেল : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা নিয়ে ওষুধ কিনতে ধানমন্ডির লাজ ফার্মায় এসেছেন মনিরা বেগম। শাহবাগে প্রায় শতাধিক ফার্মেসি থাকলেও লাজ ফার্মায় কেন? জানতে চাইলে মনিরা বেগম জানান, সরকার সম্প্রতি ‘মডেল ফার্মেসি’ চালু করেছে। এর মধ্যে লাজ ফার্মাও একটি। এই ফার্মেসিগুলোতে ভেজাল ওষুধ বিক্রি করা হয় না শুনেছি। তাই ভেজাল ওষুধ থেকে বাঁচতে এখানে এসেছি। একই সঙ্গে এসব ফার্মেসিতে ফার্মাসিস্টরা রয়েছেন। তাই ভালো মানের ওষুধের নিশ্চয়তা পাচ্ছি। এছাড়া ওষুধ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় ধারণাও পাচ্ছি। মনিরা বেগমের মতো একই অভিব্যক্তি জানালেন একাধিক ওষুধ ক্রেতা। তাদের মতে, সরকারের এ উদ্যোগের ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে ওষুধ কেনার ক্ষেত্রে একটি আস্থার স্থান তৈরি হলো।
সূত্র মতে, রেজিস্ট্রেশনবিহীন ওষুধ বা ভেজাল ওষুধ ক্রয়-বিক্রয় ও বিতরণ প্রতিরোধে ‘মডেল ফার্মেসি’ ব্যবস্থা চালু করেছে ওষুধ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ। ‘পাইলট’ প্রকল্পের জন্য ইতোমধ্যে একটি নীতিমালাও তৈরি করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে রাজধানীতে ৪০-৫০টি, প্রতিটি বিভাগে ১৫০ থেকে ২০০টি এবং জেলায় ২ হাজার মডেল ফার্মেসি স্থাপন করা হবে। এরই অংশ হিসেবে গত ২২ ডিসেম্বর মডেল ফার্মেসি কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। ওই দিন রাজধানীর ধানমন্ডির লাজ ফার্মা এবং গ্রীন রোডের বায়োমেড ফার্মেসিকে নতুন আঙ্গিকে চালু করার মাধ্যমে দেশে প্রথমবারের মতো মডেল ফার্মেসির কাজ শুরু হয়। এরই অংশ হিসেবে আজ বুধবার রাজধানীর গুলশান ও বনানী এলাকায় আরো ৫টি মডেল ফার্মেসির উদ্বোধন করা হবে। স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক মডেল ফার্মেসিগুলোর উদ্বোধন করবেন। এগুলো হলোÑ গুলশান-২ সার্কেলে মেসার্স আল-মদিনা ফার্মেসি, মেসার্স ইসলাম ফার্মা, মেসার্স সাফাভি ফার্মেসি, গুলশান-১ সার্কেলের তামান্না ফার্মেসি এবং মেসার্স প্রেসক্রিপশন এইড-১ ফার্মেসি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মডেল ফার্মেসি ব্যবস্থার মাধ্যমে ক্রেতারা ওষুধের গুণগতমান, কার্যকারিতা ও সঠিক ব্যবহারবিধি  সম্পর্কে ধারণা পাবেন। এতে করে দেশে ভেজাল ওষুধ প্রস্তুতের চিন্তা দূর হবে। ফার্মেসিগুলোও সাধারণ মানুষের আস্থায় পরিণত হবে। তবে ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও ফার্মেসিতে ফার্মাসিস্টের উপস্থিতি নিশ্চিত করার কথা জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের সূত্র মতে, তিনটি ক্যাটাগরিতে মডেল ফার্মেসিকে ভাগ করা হয়েছে। ‘এ’ ক্যাটাগরিতে সফিসটিকেটেড ওষুধ থাকবে, ‘বি’ ও ‘সি’ ক্যাটাগরিতে সাধারণ ওষুধ থাকবে। এক্ষেত্রে ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’ ক্যাটাগরিতে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রিধারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে নিয়োগ দেয়া হবে। এজন্য তাদের যথাযথ সম্মানির ব্যবস্থাও করা হবে। আর এটা পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে। একই সঙ্গে ওষুধের দোকানগুলোকে ফার্মেসি ও মেডিসিন শপ হিসেবে দুই ভাগে চিহ্নিত করে সরকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। সূত্র মতে, মডেল ফার্মেসিকে কমপক্ষে ৩০০ বর্গফুটবিশিষ্ট ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হতে হবে। সার্বক্ষণিক রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগসহ সুনির্দিষ্ট কিছু নীতিমালা মেনে মডেল ফার্মেসি কাজ করবে। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট ড্রাগ লাইসেন্সপ্রাপ্ত ফার্মেসির সংখ্যা ১ লাখ ২৩ হাজার ৫৪২টি। আর লাইসেন্সবিহীন ফার্মেসির সংখ্যা ৯ হাজার ৮০৫টি। এর মধ্যে এ গ্রেড ফার্মেসিগুলোকে স্নাতক সম্পন্ন করা ফার্মাসিস্ট এবং বি গ্রেড ফার্মেসিগুলোকে ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট নিয়োগ দেয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। যাতে করে ওষুধ ক্রয় করতে গিয়েও রোগীরা ওষুধ সম্পর্কে সঠিকভাবে জানতে পারেন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, যে ওষুধ মানুষের জীবন বাঁচায়, সেই ওষুধ বিক্রির ক্ষেত্রে নীতিমালা মেনে ব্যবসা করতে হবে। একই সঙ্গে শিগগিরই প্রতি জেলায় কমপক্ষে একটি করে মডেল ফার্মেসি চালু করা হবে। এর মাধ্যমে মান যথাযথ রাখার পাশাপাশি ওষুধের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিতে ভূমিকা রাখবে। সারাদেশে এটা করতে পারলে ভেজাল ওষুধের সাথে জড়িতরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অন্যদিকে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা লাভবান হবেন। তাই এ ধরনের ফার্মেসি স্থাপনে ব্যবসায়ীদের এগিয়ে আসা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন তিনি। মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ওষুধ নীতি অনুযায়ী প্রত্যেক মডেল ফার্মেসিতে ৩৯টি প্রয়োজনীয় ওষুধ ছাড়া সব ধরনের ওষুধ বিনা প্রেসক্রিপশনে বিক্রি বন্ধ করে দেয়া হবে। ফলে অযথা এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার বন্ধ হবে। রোগীদের জন্য নিরাপদ ওষুধ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। পর্যায়ক্রমে এই উদ্যোগ সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়া হবে বলে জানান মন্ত্রী।
এদিকে সম্প্রতি মন্ত্রী পরিষদে ওষুধ নীতির খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। তাই এখন ওষুধনীতি প্রণয়ন ও মডেল ফার্মেসি চালুর মধ্য দিয়ে নকল ও ভেজাল ওষুধের বিরুদ্ধে সরকারের অভিযান আরো জোরালো হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আবুল কালাম লুৎফুল কবীর। তিনি বলেন, এটা অবশ্যই অনেক ভালো উদ্যোগ। এটি কার্যকর হলে ফার্মেসিগুলোতে ভেজাল ও নি¤œমানের ওষুধ বিক্রি এবং প্রেসক্রিপশনবিহীন ওষুধ ক্রয়-বিক্রয়ের চিন্তা দূর হবে। পাশাপাশি ক্রেতারাও ফার্মাসিস্টদের মাধ্যমে ক্রয়কৃত ওষুধ সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাবে।
ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল ডা: মো: মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে (পিপিপি) এসব ফার্মেসি চালু করা হচ্ছে। এসব ফার্মেসিতে ফার্মাসিস্ট নিয়োগসহ ওষুধ বিক্রির সব ধরনের মান বজায় রাখা হবে। একই সঙ্গে ফার্মাসিস্টরা যে ওষুধ বিক্রি করবে সেই ওষুধ সম্পর্কে ক্রেতারা সংক্ষিপ্ত ধারণাও পাবে। ভেজাল ও নকল ওষুধ বিক্রি ঠেকাতে ‘মডেল ফার্মেসি’ কাজ করবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের পরিচালক মো: রুহুল আমিন বলেন, মডেল ফার্মেসির বিষয়ে ইতোমধ্যে একটি নীতিমালা করা হয়েছে। এতে ফার্মেসিগুলোতে কেমন ডেকোরেশন থাকবে, কতগুলো ফ্রিজ বা এসি থাকবে, ক্রেতাদের ব্রিফ করার জায়গা কোথায় কতটুকু থাকবে এবং ফার্মেসির আকার কেমন হবে তা নির্দিষ্ট করা হয়েছে। মো: রুহুল আমিন বলেন, মডেল ফার্মেসিগুলো সার্বক্ষণিক মনিটরিংয়ের মধ্যে থাকবে। এতে ওষুধ বিক্রির ক্ষেত্রে মান নিশ্চিত হবে। ফলে কোনো অসাধু ব্যক্তি বা ফার্মেসি চাইলেই ভেজাল বা নিম্নমানের ওষুধ বিক্রি করতে পারবে না। কেননা, সবাই মডেল ফার্মেসিতে গেলে অন্যদেরও এ ধরনের উদ্যোগের মধ্যে আসতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. মো: সাইফুল ইসলাম বলেন, বিশ্বব্যাপী  চিকিৎসা ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের পরই ফার্মাসিস্টদের স্থান। উন্নত বিশ্বে স্বাস্থ্যসেবা সঠিকভাবে সম্পাদন করছে চিকিৎসক, ফার্মাসিস্ট ও নার্স। তাই স্বাস্থ্যবিজ্ঞান ও স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে এদেশের ফার্মেসি সেবার মান বাড়ানো অতীব জরুরি, তা না হলে স্বাস্থ্যসেবা আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছবে না। তিনি বলেন, স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও আমরা এ সংস্কৃতিটা চালু করতে পারিনি। দেশের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক ও নার্সদের যেভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়, তেমনভাবে ফার্মাসিস্টদের গুরুত্ব দেয়া হয় না। একই সঙ্গে দেশের এলোপ্যাথিক কোম্পানিতে ফার্মাসিস্ট থাকলেও হোমিওপ্যাথিক, আয়ুর্বেদিক, ইউনানী এবং হারবাল জাতীয় ওষুধ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোতে ফার্মাসিস্টের সংখ্যা মাত্র হাতেগোনা। এ দেশের হাসপাতালগুলোতে ফার্মেসি সেবা বলতে বোঝায়, বাজার থেকে ওষুধ সংগ্রহ করা এবং ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী রোগীর কাছে হস্তান্তর করা। মডেল ফার্মেসি এবং তাতে ফার্মাসিস্টদের নিয়োগ দিলে এটা স্বাস্থ্য খাতের জন্য খুবই চমকপ্রদ হবে।
ড. মো: সাইফুল ইসলাম বলেন, স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে ফার্মাসিস্টদের ব্যবহার আরো আগেই করা উচিত ছিল। তিনি বলেন, বিশেষজ্ঞ ফার্মাসিস্টরা চিকিৎসার জন্য ওষুধ ব্যবহার সংক্রান্ত জটিলতার সমাধান, ওষুধের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিতকরণ এবং ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার নজরদারি ও প্রতিরোধকরণে বিশেষ পারদর্শী। সর্বোপরি রোগীর চাহিদা অনুযায়ী ফার্মেসি সেবা প্রদান করতে হলে ফার্মাসিস্টের কোনো বিকল্প নেই। ফার্মেসি অনুষদের ডিন বলেন, আমাদের মনে রাখতে হবে যে, স্বাস্থ্য পেশাজীবী হিসেবে ডাক্তার, ফার্মাসিস্ট,  মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট এবং নার্স- এই চার শ্রেণীর পেশাজীবীর পূর্ণাঙ্গ টিম যতদিন না গঠিত হবে, ততদিন জনগণের জন্য কল্যাণকর স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া সম্ভব হবে না।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ