হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
জামালউদ্দিন বারী : আমাদের রাষ্ট্রীয় সংবিধান সকল নাগরিকের জন্য বিনামূল্যে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষার নিশ্চয়তা দিয়েছে। আর বর্তমান শিক্ষানীতি অনুসারে আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত, যা সার্বজনীন ও বাধ্যতামূলক। অথচ সন্তানদের এই সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে দেশের কোটি কোটি অভিভাবকের দুর্ভার, দুশ্চিন্তা ও হয়রানির অন্ত নেই। গত সপ্তায় দেশের প্রাথমিক শিক্ষা স্তরের দুটি পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হলো। সাধারণ ও মাদরাসা থেকে পিইসি-ইবতেদায়ি, জেএসসি-জেডিসিতে দেশের সব বিভাগ থেকে পাস করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় অর্ধ কোটি। এসব পরীক্ষার গুণাগুণ, ফলাফল নিয়ে দেশে এখনো যথেষ্ট বিতর্ক ও মতভেদ আছে। বিশেষত আমরা যদি শিক্ষাকে সত্যিকার অর্থে একইসঙ্গে কর্মমুখী, জ্ঞানভিত্তিক ও নৈতিক মানদ-ে উন্নীত করতে চাই, তাহলে শিক্ষাঙ্গনে ইতোমধ্যে বেড়ে ওঠা অনৈতিক প্রতিযোগিতা ও শিক্ষাবাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। শিক্ষায় সরকারি বাজেট বাড়াতে হবে যাতে শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যমান বৈষম্যকে কমিয়ে আনতে সহায়ক হয়। সকল নাগরিককে ন্যূনতম শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার পাশাপাশি সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার বিভিন্ন স্তরে প্রয়োজনীয় জনবল, দক্ষ জনসম্পদের প্রাপ্যতা ও কর্মসংস্থানের বিন্যাস নিশ্চিত করতে হলে প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর যে বিন্যাস প্রয়োজন তা নিশ্চিত করার সক্ষমতা আমাদের সরকারের থাকতে হবে। সরকারের সীমাবদ্ধতার প্রতি আমাদের সমাজ যথেষ্ট সচেতন বলেই এ দেশের সমাজপতি ও সচ্ছল ব্যক্তি ও পরিবারগুলোর মধ্য থেকে অনেক বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তিত্ব বেরিয়ে এসেছেন যারা নিঃস্বার্থভাবে নিজেদের সম্পদে দেশের আনাচে-কানাচে অসংখ্য স্কুল-কলেজ গড়ে তুলেছেন। সারা দেশে গড়ে ওঠা হাজার হাজার বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠার ইতিহাসের সঙ্গে অনেক ব্যক্তি ও পরিবারের ত্যাগের ইতিহাস জড়িত। সেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা আলোকিত মানুষেরা তাদেরকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন, তাদের জন্য দোয়া করেন। সমাজকে অশিক্ষার অন্ধকার থেকে মুক্ত করতে এবং আলোকিত করার পথ রচনার মধ্যদিয়ে তারা পারলৌকিক মুক্তির পথ খুঁজেছেন। এই সমাজে এখনো অনেক এমন ব্যক্তিত্ব আছেন, যারা নিজেরা তেমন বিত্তবান-সচ্ছল না হয়েও নিজেদের যৎসামান্য জমিজমা ও সম্পদ দিয়ে স্কুল-মাদরাসা গড়ে তুলছেন। সেই সাথে আরেকটি শ্রেণি বেশ প্রবলভাবেই বেড়ে উঠেছেন, যারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলছেন শ্রেফ বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের উপায় হিসেবে। নিজেদের জমিতে বা ভাড়া করা বাড়িতে স্কুল-কলেজ বা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষাকে বাণিজ্য ও প্রতিযোগিতার বস্তুতে পরিণত করেছেন। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অপ্রতুলতা, মানহীনতা, অব্যবস্থাপনা, অপরাজনীতি ইত্যাদি কারণে এসব বাণিজ্যিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মুখাপেক্ষী হচ্ছেন দেশের সাধারণ মানুষ। নতুন শিক্ষানীতির আলোকে নতুন নতুন পাবলিক পরীক্ষার সূচনা করে বাণিজ্যিক লক্ষ্যে গড়ে তোলা এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে মুনাফাবাজির সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো খেলার মাঠ নেই, লাইব্রেরি নেই, ল্যাবরেটরি নেই, বিনোদনের সুযোগ নেই, সাংস্কৃতিক চর্চা নেই। এত কিছু নেই’র পরও অপেক্ষাকৃত ভালো পরিবেশ, উন্নততর পাঠদান পদ্ধতি, বাড়তি অভ্যন্তরীণ তদারকি ছাড়াও বাধ্যতামূলক কোচিং, টিউশনির খরচ চাপিয়ে দিয়ে শিশুকে যেনতেন প্রকারে জিপিএ-৫ পাওয়া নিশ্চিত করার মধ্যদিয়ে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নামিদামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। শতভাগ পাস আর শতকরা সত্তর-আশি ভাগ শিক্ষার্থীর জিপিএ-৫ পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশিরভাগই এ ধরনের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বছরের শুরুতে অভিভাবকরা এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্তানদের ভর্তি করিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চান।
সন্তানকে ভর্তি করিয়েই স্কুলে টিকিয়ে রাখা এবং ভালো ফলাফলের নিশ্চয়তা পাওয়া যে অসম্ভব, খুব তাড়াতাড়িই অভিভাবকরা টের পেয়ে যান। এসব নামিদামি স্কুলে সন্তানদের ভর্তি করানোর মধ্যদিয়ে অভিভাবকরা প্রকারান্তরে ভারবাহী জন্তুতে পরিণত হন। প্রত্যেক সপ্তাহের শ্রেণিপরীক্ষা, মাসিক পরীক্ষা, সেমিস্টার পরীক্ষায় পাসমার্ক ও গ্রেড অব্যাহত রাখতে না পারলে টিসি দিয়ে বিদায় করে দেয়ার ভয় আছে। এ কারণেই প্রতিটি পরীক্ষায় কাক্সিক্ষত ফলাফল নিশ্চিত রাখতে হলে স্কুলের শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত কোচিং সেন্টার অথবা শ্রেণিশিক্ষকদের কাছে প্রাইভেট টিউশনির পেছনে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর অভিভাবককে মাসে হাজার হাজার টাকা ব্যয় করতে হয়। পঞ্চম শ্রেণিতে জিপিএ-৫ গ্রেড নিশ্চিত করার অনৈতিক প্রতিযোগিতা শুরু হয় শিশু শ্রেণিতে ভর্তি প্রক্রিয়া থেকেই। নতুন শিক্ষানীতির আওতায় বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষাকে পঞ্চম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত করা হলেও পঞ্চম শ্রেণিতে একটি প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পাবলিক পরীক্ষা বহাল রাখার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ইতোমধ্যেই বেশ জোরালো প্রশ্ন উঠেছে। এমনকি সরকার এই পরীক্ষা তুলে দিচ্ছে বলেও এক সময় খবর প্রকাশিত হওয়ার পর সে সম্ভাবনা আপাতত স্থগিত হয়ে গেছে। গত সপ্তায় প্রাথমিকের দুটি পাবলিক পরীক্ষার আনুষ্ঠানিক ফলাফল প্রকাশের সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রাথমিকের পাবলিক পরীক্ষাগুলো শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন। এসব পরীক্ষা যে ভবিষ্যতের এসএসসি পরীক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞ ও আত্মবিশ্বাসী করে তোলতে সহায়ক হচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শিশুদের ওপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ এবং অভিভাবকদের ওপর অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টিকারী এসব পরীক্ষার সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক সামাজিক প্রভাব সম্পর্কে দেশের শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্টদের ভাবতে হবে। শিক্ষার মানোন্নয়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া, রাতারাতি তা কাক্সিক্ষত মানে উন্নীত করার কোনো পদ্ধতি কারো হাতে নেই। তবে শিক্ষাব্যবস্থায় ত্রুটি ও গলদ রয়েছেÑ তা বুঝতে না পারলে বা সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল তা অস্বীকার করলে সেসব ত্রুটি-বিচ্যুতি ও গলদ থেকে উত্তরণের কোনো সম্ভাবনা থাকে না। সমস্যা সমাধানের প্রথম অগ্রগতি হচ্ছে সমস্যাটিকে চিহ্নিত করা বা স্বীকার করে নেয়া। সরকারের সংশ্লিষ্টরা শিক্ষাব্যবস্থার সমালোচকদের সমালোচনা না করে তাদের উষ্মা ও অভিযোগগুলোকে আমলে নিয়ে শিক্ষাব্যবস্থার বিচ্যুতি ও গলদগুলো দূর করার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণই হবে উন্নত জাতি হিসেবে আমাদের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের প্রথম দৃঢ় পদক্ষেপ।
আমরা যখন মানসম্মত প্রাথমিক ও উচ্চশিক্ষার কথা বলছি, তখন দেশের লাখ লাখ শিশু ন্যূনতম শিক্ষার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। শিশুদের বিদ্যালয়মুখী করা এবং প্রাথমিক শিক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিদ্যালয়ে ধরে রাখার কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই বললেই চলে। সরকার জনগণের ট্যাক্সের হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে বছরের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক তুলে দেয়ার পদক্ষেপ অব্যাহত রেখেছে, মাধ্যমিক স্তরে লাখ লাখ মেয়ে শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষা উপবৃত্তি প্রকল্পও চালু আছে, কিছু কিছু স্কুলে স্কুল ফিডিং প্রকল্পও চালু করা হয়েছে। এসব উদ্যোগের ফলে বিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার বাস্তবতায় তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। সরকারি তথ্যের ভিত্তিতে ২০১৫ সালে প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যায়, প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার শতকরা ২১ ভাগ। প্রথমত, দেশের সকল শিশুর স্কুলে এনরোলমেন্ট নিশ্চিত করা যায়নি, স্কুলে না যাওয়া শিশুর সংখ্যা কত তা সঠিক পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই, আর ঝরে পড়ার হার সম্পর্কে সরকারি তথ্য সঠিক বলে মেনে নিলে, যারা স্কুলে ভর্তি হচ্ছে তাদের মধ্যে পঞ্চম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই ২১ ভাগ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক হয়ে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত শিক্ষার্থী ঝরে পড়া অস্বাভাবিক নয়। তবে প্রাথমিক স্তরের ন্যূনতম শিক্ষালাভের আগেই স্কুল ত্যাগের এই হার অস্বাভাবিক। ২০১৬ সালের জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষায় যেসব শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেছিল তাদের মধ্যে শতকরা ৯৬ ভাগ পাস করেছে। আর পিইসিতে পাস করেছে শতভাগের কাছাকাছি (৯৮.৫১ ভাগ)। পাসের হারের এই ঊর্ধ্বমুখিতায় সরকার এবং অভিভাবকরা খুশি। তবে পাশাপাশি সরকারি মহলকে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার নেপথ্য কারণ সম্পর্কে অনুধাবন করতে হবে। এ বছর যারা জেএসসি পরীক্ষা দিয়েছে, তারা ২০১৩ সালে পিএসসি পাস করেছিল। প্রকাশিত একটি রিপোর্টে দেখা যায়, ২০১৩ সালে পাস করা পিএসসি শিক্ষার্থীর চেয়ে ২০১৬ সালে জেএসসিতে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা সাড়ে ৫ লাখ কম। অর্থাৎ নিবন্ধিত হিসাব অনুসারেই ৩ বছরে সাড়ে ৫ লাখ শিক্ষার্থী ঝরে গেছে। আর গত ১ নভেম্বরে শুরু হওয়া জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষার প্রথম দিনেই অনুপস্থিত ছিল নিবন্ধিত প্রায় ৬০ হাজার শিক্ষার্থী। পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের শতভাগ পাস করিয়ে দিয়ে আমরা আত্মতুষ্টি ভোগ করছি, কিন্তু লাখ লাখ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার বাস্তবতা নিয়ে তেমন কোনো উদ্বেগ দেখা যাচ্ছে না। যে লাখ লাখ শিশু স্কুলে যেতে পারছে না, তারা কী করছে? এদের বেশির ভাগই দরিদ্র পিতামাতার সাথে নিজেদের অন্ন সংস্থানের জন্য কাজ করছে। কেউ কেউ বিপজ্জনক শিশু শ্রমিক হিসেবেও কাজ করছে। প্রতি বছর লাখ লাখ শিশুকে ন্যূনতম প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত রেখে আমরা জাতিকে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ ও বৈষম্যমুক্ত রাষ্ট্র এবং সমাজ বিনির্মাণের যে টাইমলাইন ও স্বপ্ন দেখাচ্ছি, তা আদতে বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাবনা অতিশয় ক্ষীণ।
শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে গত জুন মাসে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে আয়োজিত এক সেমিনারে শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও বক্তারা যেসব বিষয় তুলে ধরেছিলেন সেখানেও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সংকটের পূর্ণাঙ্গ চিত্র উঠে আসেনি। তাদের বক্তব্যে যেসব সুপারিশ উঠে এসেছিল পত্রিকায় প্রকাশিত এক মতামতে তাকে এভাবে তুলে ধরা হয়েছিল, ১. মাধ্যমিক শিক্ষার আমূল সংস্কার করতে হবে, ২. কোচিং বন্ধ করে স্কুল শিক্ষাকে আরো কার্যকর করতে হবে, ৩. পাঠ্যবইয়ের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়িয়ে গাইড বই বন্ধ করতে হবে, ৪. স্কুল পাঠ্যবই আরো সহজ-সরল ভাষায় লিখতে হবে, ৫. প্রতিটি পরীক্ষার সাথে এমসিকিউ পদ্ধতির প্রশ্ন বাতিল করতে হবে, ৬. সৃজনশীল প্রশ্ন কার্যকর করার জন্য শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দিতে হবে ও সৃজনশীল প্রশ্নের জন্য প্রশ্নব্যাংক গঠন করতে হবে, ৭. মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে, ৮. পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির যে কোন একটি পাবলিক পরীক্ষা রাখতে হবে, পরীক্ষা আর পরীক্ষা দিয়ে শিক্ষার্থীদের ভারাক্রান্ত করা যাবে না, ৯. পরীক্ষা ও প্রশ্ন প্রণয়নের পদ্ধতি পর্যালোচনা করতে হবে, ১০. কারিকুলাম অযথা ভারী না করে পাঠ্যবইকে আরে উন্নত, নির্ভুল ও আকর্ষণীয় করতে হবে, যোগ্য ও দক্ষ লোককে শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করার জন্য বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে। শিক্ষা বিষয়ক আলোচনায় এসব সুপারিশ দীর্ঘদিন ধরে বার বার উঠে এসেছে। খোদ শিক্ষামন্ত্রীও বিভিন্ন সময়ে শিক্ষার মান নিয়ে তার অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। শিক্ষা বিভাগের একশ্রেণির কর্মকর্তার দুর্নীতি সম্পর্কেও তিনি তার ক্ষোভের কথা ইতোপূর্বে প্রকাশ করেছেন, এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটি গঠন ও নিয়োগবাণিজ্যের সাথে সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের সম্পৃক্ততার কথাও বলেছেন। তবে শিক্ষাকেন্দ্রিক আলোচনায় শিক্ষার নৈতিক মান এবং জাতীয় ও সাংস্কৃতিক লক্ষ্য অর্জনের বিষয়গুলো তেমন একটা আলোচনায় আসে না। অন্যদিকে দেশের আলেম-ওলামারা বলছেন, বর্তমান শিক্ষানীতি ও পাঠ্যপুস্তক মুসলমানদের ঈমান-আকিদার পরিপন্থী। আর শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য, নানাবিধ বৈষম্য এবং অনৈতিক প্রবণতার বিষয়গুলো এখন সর্বসাধারণ্যেও প্রকাশ্য হয়ে পড়েছে। একটি জাতীয় শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থার একটি জাতীয় লক্ষ্য থাকতে হবে। সব নাগরিকের আইনসম্মত সম-অধিকারের ভিত্তিতে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক লক্ষ্যকে সামনে রেখেই তা নির্ধারিত ও বাস্তবায়িত হতে হবে। আজ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও পাঠ্যক্রমে যেসব পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তাকে যদি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগোষ্ঠী নিজেদের ঈমান আকিদার পরিপন্থী বলে ভাবতে শুরু করে তাহলে পুরো শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিই জনগণের অনাস্থা অনাগ্রহ তৈরি হতে পারে। এ কারণেও একশ্রেণির ধর্মপ্রাণ মুসলমান নিজেদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে অনাগ্রহী হয়ে উঠতে পারে। সুশীল সমাজের কিছু সদস্য দেশে মাদরাসা শিক্ষার বিস্তারের বিরুদ্ধে কথা বলছেন বটে মাদরাসার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পেছনে যে সাধারণ শিক্ষায় বাণিজ্য এবং শিক্ষাব্যবস্থাকে ধর্মহীন ও সেক্যুলার করে তোলার পরোক্ষ ভূমিকা রয়েছে সে সম্পর্কে তাদের তেমন ধারণা বা চিন্তাভাবনা আছে বলে মনে হয় না। একদিকে শিক্ষাব্যবস্থাকে ধর্মনিরপেক্ষ করার লক্ষ্যে শিক্ষা কারিকুলাম থেকে ইসলামী মূল্যবোধ সম্পৃক্ত পাঠ্যসূচিগুলো বাদ দেয়া হচ্ছে, অন্যদিকে দেশের আনাচে-কানাচে ব্যক্তিগত ও সামাজিক উদ্যোগে যেমন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে একই হারে গড়ে উঠছে নানা ধরনের মাদরাসা। কওমি নেছাবের মাদরাসাগুলো কখনই সরকারি সুযোগ-সুবিধা পায় না, আলিয়া মাদরাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা তুলনামূলক কম সরকারি সুযোগ-সুবিধা পেয়েও পাবলিক পরীক্ষা, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষাসহ সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে সমান তালে পাল্লা দিতে সক্ষম হচ্ছে। মাদরাসা থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা ও মেধাভিত্তিক প্রতিযোগিতামূলক চাকরির সুযোগ রহিত করতেই যেন সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল বেশি উৎসাহী। সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি নির্দেশে বা নীতিগত কারণে পাবলিক পরীক্ষায় পাসের হার অনেক বাড়লেও এক সময় এসএসসি ও এইচএসসি সমমানের পাবলিক পরীক্ষায় মাদরাসা বোর্ডের শিক্ষার্থীদের পাসের হার সাধারণ শিক্ষাবোর্ডের হারের চেয়ে বেশি ছিল। মাদরাসায় অনৈতিক শিক্ষাবাণিজ্য, কোচিং বাণিজ্য টিউশনি বাণিজ্য অনেক কম। পাবলিক পরীক্ষায় ভালো ফলাফল অর্জনকারী মাদরাসাগুলোর কাছ থেকে শিক্ষাবাণিজ্যে নিমজ্জিত তথাকথিত নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অনেক শিক্ষণীয় ও অনুকরণীয় বিষয় আছে।
এক সময়ের প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন এশিয়ার ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায়ও স্থান পায় না। আমাদের গৌরবের উত্তরাধিকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত সারাদেশে শত শত সরকারি-বেসরকারি ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক দলবাজি, দুর্বৃত্তায়নসহ নানাবিধ কারণে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। অন্যদিকে দেশের এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এই মুহূর্তে অর্ধলক্ষাধিক শিক্ষকের পদ খালি আছে। প্রকৃতপক্ষে দেশে বর্তমানে লাখ লাখ শিক্ষকের চাহিদা রয়েছে। আর যারা শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন, তাদের একটি বড় অংশই শিক্ষক হিসেবে অযোগ্য ও অদক্ষ। এই অদক্ষ শিক্ষকদের একটি অংশ শিক্ষাবাণিজ্য ছাড়াও নানা ধরনের অনৈতিক ও দুর্র্নীতিমূলক কর্মকা-ে জড়িত রয়েছে। এদের কারো কারো বিরুদ্ধে শিক্ষা বিভাগে অভিযোগ হয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তদন্তও হয়, অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পরও তাদের শাস্তি হয় না। কেউ কেউ আদালতে রিট করে মামলার দীর্ঘসূত্রতায় টিকে থাকার চেষ্টা করতে গিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। দেশের হাজার হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় চলছে প্রধান শিক্ষক ছাড়াই। প্রতি বছর জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়লেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিও বন্ধ রাখা হচ্ছে বছরের পর বছর ধরে। এ সুযোগে বাণিজ্যিকভিত্তিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত অনিয়ন্ত্রিতভাবে মানহীন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠা, এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষাবাণিজ্য, সার্টিফিকেট বাণিজ্য ও অনৈতিক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়াসহ প্রতিটা ক্ষেত্রেই সরকারের সংশ্লিষ্টদের ব্যর্থতা ও অমনোযোগিতার দায় আছে। অবকাঠামো উন্নয়নে লাখ লাখ কোটি টাকার মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নের চেয়ে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে সঠিকভাবে পরিচালিত করা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিভিন্ন স্তরে শিক্ষকের লক্ষাধিক পদ খালি রেখে, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য শিক্ষাবাণিজ্য ও অনৈতিক প্রতিযোগিতা অবারিত রেখে শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।