Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মুক্ত জলাশয় মাছ চাষে স্বাবলম্বী আত্মপ্রত্যয়ী দুই যুবকের গল্প

| প্রকাশের সময় : ২ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

খলিল সিকদার, রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) থেকে : হারিয়ে যাচ্ছে দেশি প্রজাতির মাছ। এসব মাছ চাষের ও মাছ রক্ষায় সরকারের আশানরূপ অগ্রগতি চোখে না পড়লেও স্থানীয়ভাবে রয়েছে বেশ কদর। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের বাড়িয়াছনি এলাকায় মুক্ত জলাশয়ে মাছ চাষ করে লাভবান হচ্ছেন স্থানীয় মাছচাষীরা। অল্প পুঁজিতে বালু নদীর তীরের ছনির বিলে বর্ষায় আটকে থাকা মুক্ত জলাশয়ে দেশি মাছের চাষ করে আলোর মুখ দেখছেন তারা। এতে আশপাশের গ্রামের লোকজন উৎসাহী হয়ে তারাও গড়ে তুলেছেন মাছের খামার। তাতে যুক্ত হচ্ছে গ্রামের শিক্ষিত বেকার শ্রেণীর লোকজন। তাই শতাধিক শিক্ষিত বেকার এখন মাছ চাষ করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করছেন আনায়াসে। চাকুরি না খুঁজে নিজেরাই এখন চাকরি দিচ্ছেন মাছের খামারে। কেউ পাহারাদার কেউ বা মাছ ধরার শ্রমিক কেউ তা হাটে নিয়ে বিক্রি করে মুনাফা গুনছেন। এভাবে স্থানীয় লোকজন সংঘবদ্ধ হয়ে মাছ চাষ করে সাবলম্বী হচ্ছেন। ফলে তরুণদের মধ্যে দেখা দিয়েছে প্রতিযোগিতামূলক মাছ চাষের হিড়িক। তেমনি দুজন শিক্ষিত বেকার মাছ চাষের মাধ্যমে তাদের বেকারত্ব দূর করে ইতোমধ্যে সাড়া ফেলেছেন রূপগঞ্জে। জেলা যুব উন্নয়ন বিভাগ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজ গ্রামের বাড়িয়া ছনির বিলে শুরু করেন দেশীয় প্রজাতির মাছ চাষ। তাদের মাছ চাষের সাফল্য দেখে স্থানীয়রা এ পেশায় ঝুঁকতে শুরু করেছেন। এসব দেশীয় প্রজাতির মাছ চাষ করে সাবলম্বী হয়েছেন বাড়িয়া ছনি এলাকার আব্দুল হাইয়ের ছেলে সুমন মিয়া ও তার প্রতিবেশী আব্দুল বাতেন মিয়ার ছেলে রুবেল মিয়া। বালু নদীর পানিতে রাজধানী ঢাকার উত্তরা ও গাজীপুরের টঙ্গী ও নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ও আবাসিক এলাকার ময়লা ও কারখানার বর্জ্যে দূষিত হওয়ার পর থেকে এই নদীর পানিতে কেউ মাছ চাষে আগ্রহী হয়নি। দূষণের শিকার এই পানি খাল দিয়ে বিলের অভ্যন্তরে চলে যাওয়ায় এ বিলের পানিতেও মাছচাষ করে কেউ আলোর মুখ দেখেনি। মাছ বড় না হতেই কারখানার বিষাক্ত কেমিক্যাল আর হাজারীবাগের টেনারি বর্জ্যরে প্রভাবে মরে ভেসে ওঠতো। এসব মাছ পাখিরা খেলেও মারা যেত।  ফলে লোকসানের মুখে এতদিন অনেকেই বাড়িয়া ছনির বিলে মাছ চাষ করতে আগ্রহী ছিলেন না। সম্প্রতি সুমন ও রুবেল অভিনব প্রযুক্তির ব্যবহার করে মাছ চাষ শুরু করেছে এ এলাকায়। এতে সফলতাও পেয়েছেন তারা। ছনির বিলে বালু নদীর দূষিত পানি প্রবেশের মুখে কচুরিপানা ও বাঁশের মাচা ও চিকন জাল দিয়ে কৃত্রিম ফিল্টার বাঁধ দিয়েছেন তারা। পরিমাণমত ফিটকারি ও চুন ছেড়েছেন পানির স্বচ্ছতা আনয়নে।   এতে বালু নদীর  দূষিত পানি প্রবেশ করতে পারেনি ছনির বিলে। বর্ষা শেষে এসব মাছ বিলের ডোবা ও গভীর অংশে আশ্রয় নেয়। সে সময় তা বিশেষ পদ্ধতিতে ধরা হয়। ফলে স্বচ্ছ পানিতে সুস্বাদু দেশি প্রজাতির মাছ চাষ করে সফল হয়েছেন তারা। বাড়িয়া ছনি এলাকার মাছচাষী রুবেল মিয়া জানান, এই বিলের পানিতে কেউ মাছ  চাষ করতে এলেই লোকসান গুনত। তারা উপজেলা মৎস্য বিভাগের পরামর্শে কৃত্রিম বাঁধ দেয়ার ব্যবস্থা করেন। এতে  সফলতাও পায়। অল্পপুঁজিতে দেশীয় মাছের বিভিন্ন প্রজাতির পোনা সংগ্রহ করে বর্ষার শুরুতে ৩ লাখ টাকার পোনা ছাড়েন। এসব মাছের মধ্যে রয়েছে কৈ, তেলাপিয়া, শিং ও রুই মাছ। কিছু কাতলা, শোল ও বোয়াল মাছও রয়েছে। এসব মাছ চাষের সময় মাছের খাবার দেয়া, শ্রমিক দিয়ে তদারকি, পরিচর্যা করা, জাল কেনা, জেলে নৌকা ভাড়া ও পরিবহন খরচ শেষে বছরে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা আয় করা সম্ভব বলে জানান তিনি। অপর মাছচাষি সুমন মিয়া জানান, ইছাপুরা বাজারে মুদি মনোহারি দোকান রয়েছে তার। সারাদিন বসে থেকে বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করে মুনাফার ভাগ বাকি পড়ে থাকে খাতায়। এতে মুনাফার চাইতে লোকসান গুনতে হতো। এখন বর্ষা এলে এই বিলের কিছু অংশে স্থানীয় জমি মালিকদের কাছ থেকে জলাশয় ভাড়া নিয়ে মাছ চাষ করছেন তারা। এখন বর্ষার পানি শুকিয়ে যাওয়ায় মাছ ধরা শুরু করেছেন। এসব মাছ ঢাকার কারওয়ান বাজার ও যাত্রাবাড়ি, খিলক্ষেতের মাছের আড়তে নিয়ে নিলামে বিক্রি করেন। ফলে নিলামের দামেও বছর শেষে মুনাফা পান আশানুরূপ। সফল মাছচাষি ও ব্যবসায়ী হিসেবে তার কাছে আশপাশের লোকজন আসেন প্রশিক্ষণ নিতে। স্থানীয় লোকজন জানান, সুমন ও রুবেলের মতো পাশের গ্রামের লোকজনও এখন মাছ চাষের আগ্রহী হচ্ছেন। তাদের প্রযুক্তি দেখে অন্যরাও তা প্রয়োগ করছেন। ফলে বাড়িয়া ছনি, টেকনোয়াদ্দা ও ইছাপুরা এলাকার প্রায় শতাধিক পরিবার যুক্ত হয়েছেন এ পেশায়। তারা আরো জানান, সুমন  ও রুবেল মাছ বিক্রির টাকা থেকে আয় করা একটি অংশ স্থানীয় মসজিদ-মাদরাসায় নিয়মিত দান করেন। স্থানীয় গরিব ও অসহায়দের বিনামূল্যে সপ্তাহে একদিন মাছ দান করে আমিষের ঘাটতি পূরণে সহায়তা করেন বলে জানা গেছে। তবে স্থানীয় মাছ চাষিরা মনে করছেন, মুক্ত জলাশয়ে মাছ চাষে রয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতা। এসব প্রতিবন্ধকতার মধ্যে রয়েছে মাছের খাবারের দাম বৃদ্ধি, মৎস্য বিভাগের তদারকির অভাব, দুর্বৃত্তায়নের শিকার ও বিষ দিয়ে মাছ নিধনের মত ঝুঁকি। অন্যদিকে রূপগঞ্জের বিভিন্ন জলাশয় দখল করে আবাসন কোম্পানি তাদের বালু ফেলছে অবাধে। ফলে মাছ চাষের জন্য উপযুক্ত জলাশয় সংকটের দ্বারপ্রান্তে রয়েছেন এ অঞ্চলের মানুষ। তাই মাছ চাষের সম্ভাবনাময় জীবিকার পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পথে। দেশের আমিষের চাহিদা মেটাতো এই প্রাকৃতিক উপাদান সংকট মোকাবিলায় সরকারকে সঠিক সময়ে সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান বিজ্ঞমহল। এসব বিষয়ে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সমীর কুমার বসাক বলেন, দূষিত পানিতের মাছের চাষ লাভজনক হয় না। তাই বালু ও শীতলক্ষ্যা তীরের খাল-বিলের ও পুকুরের মাছ চাষিদের জন্য দূষিত পানির প্রবেশমুখে কৃত্রিম ফিল্টার বাঁধ দেয়ার পরামর্শ দেন তিনি। কৃত্রিম বাঁধ দেয়ার জন্য কেবল যে অংশে নৌচলাচল করে না সেসব এলাকার জন্য এ প্রযুক্তি প্রয়োগ করার কথা বলেন তিনি। তবে সামাজিক মাছ চাষের মাধ্যমে যে কোনো মাছচাষিদের সবরকম সরকারি সহায়তা দিতে প্রস্তুত বলে জানান তিনি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ