Inqilab Logo

শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

থ্রি-হুইলার চলছেই

মহাসড়কে দুর্ঘটনার প্রধান কারণ ইজিবাইক

| প্রকাশের সময় : ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

নিষেধাজ্ঞা কার্যকরে পদক্ষেপ নেই : এটা তামাশার মতো : প্রফেসর শামসুল হক
নূরুল ইসলাম : দেশের ২২টি মহাসড়কে থ্রি-হুইলার চলাচলে সরকার ঘোষিত নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হচ্ছে না। ২০১৫ সালের ১ আগস্ট সরকার এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপণ জারি করলেও এটি বাস্তবায়নে জোরালো কোনো পদক্ষেপ নেই। মহাসড়কে আগের মতোই চলছে সিএনজি অটোরিকশাসহ ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও মোটরচালিত রিকশা। এতে করে দূর-পাল্লার যান চলাচলে বিঘœ ঘটার পাশাপাশি দুর্ঘটনাও বেড়েই চলেছে। যানজটে আটকা পড়ে যাত্রীদের সীমাহীন ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) হিসাব মতে, ২০১৫ সালে সারাদেশে ২৩৯৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৩৭৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ হিসাবে মাসে গড়ে মৃত্যু হয়েছে ১৯৮ জনের। চলতি বছরের সাত মাসে ১৪৮৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছে ১৪২২ জন। গড়ে মাসে মৃত্যু হয়েছে ২০৩ জনের। বিআরটিএ-এর হিসাব থেকে বোঝা যায়, যে উদ্দেশ্যে মহাসড়কে থ্রি-হুইলার নিষিদ্ধ করা হয়েছিল তা সফল হয়নি। পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো দুর্ঘটনা কমাতে মহাসড়কে থ্রি-হুইলার চলাচল নিষিদ্ধ করার দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করে এখন ক্লান্ত। দুর্ঘটনা বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষক প্রফেসর ড. শামসুল হক এ প্রসঙ্গে ইনকিলাবকে বলেন, মহাসড়কে থ্রি-হুইলার চলবে না এটা সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে যখন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল তখন সেখানে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। এটা তাদের জন্য একটি ম্যান্ডেটরি ফাংশন। এখন তারা এর দায় এড়াতে পারেন না।
তিনি বলেন, আমরা উন্নতির কথা বলবো, বড় বড় সিদ্ধান্ত নিবো কিন্তু সেটা বাস্তবায়ন করতে পারবো নাÑ এটা অনেকটা তামাশার মতো হয়ে যাচ্ছে। প্রফেসর শামসুল হক বলেন, পুলিশ এগুলো বন্ধ করতে না পারলে বলতে হবে কেনো তারা পারছে না।  
মহাসড়কগুলো এখন যেনো মৃত্যুফাঁদ। প্রতিদিনই ঝরছে তাজাপ্রাণ। আহত হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করছে শত শত মানুষ। মহাসড়কে চলাচলরত সিএনজি অটোরিকশাসহ বিভিন্ন রকমের থ্রি-হুইলারের কারণে দুর্ঘটনা কমছে না।  আগে মহাসড়কে শুধুমাত্র সিএনজি অটোরিকশা, নসিমন, করিমন, ভটভটিসহ ব্যটারিচালিত থ্রি-হুইলার চলাচল করতো। এখন তার সাথে যুক্ত হয়েছে অসংখ্য মোটরচালিত রিকশা। এসবের কারণে দুর্ঘটনার পাশাপাশি বাড়ছে যানজট, ভোগান্তি। পরিবহন মালিকরা মহাসড়কে এসব অবৈধ যান চলাচলের জন্য স্থানীয় প্রশাসন ও হাইওয়ে পুলিশের নির্লিপ্ততা, রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাব এবং কার্যকর তদারকির অভাবকে দায়ি করেছেন। সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল বাস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম বলেন, মহাসড়কের দুর্ঘটনার প্রধান কারণ এসব অবৈধ যানবাহন। এসবের কারণে যানজট হয়, বাস স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারে না। সময় নষ্ট হয় বলে খরচ বাড়ে। তাই আমরা চাই এগুলো বন্ধ হোক। এজন্য সরকারের সাথে মালিক সমিতির বহুবার আলোচনা হয়েছে। কিন্তু কিছুতেই এসব বন্ধ হচ্ছে না। বুয়েটের শিক্ষক প্রফেসর ড. শামসুল হক জানান, তিনি ক’দিন আগে বঙ্গবন্ধু সেতু এলাকায় গিয়ে দেখেছেন, সংরক্ষিত এলাকাতেও নসিমন, করিমনসহ ব্যটারিচালিক রিকশা চলছে। তিনি সেগুলোর ছবি তুলে এনেছেন। বুয়েটের এ শিক্ষক আক্ষেপ করে বলেন, একটা সংরক্ষিত এলাকাতেও যদি এসব যানবাহন অবাধে চলাচল করে তাহলে শৃঙ্খলা আসবে কিভাবে? তিনি বলেন, মহাসড়কে এসব যানবাহন থাকা মানে দুর্ঘটনার ঘটার সবগুলো উপকরণ থাকা। এমতবস্থায় দুর্ঘটনা ঘটবে এটাই স্বাভাবিক। না ঘটলে সেটা হবে সৌভাগ্যবশত।   
সরেজমিনে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-মাওয়া মহাসড়ক ঘুরে দেখা গেছে, সরকারি নিষেধাজ্ঞাকে পাত্তা না দিয়ে এ দুটি  মহাসড়কে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত থ্রি-হুইলার (ইজিবাইক) ও মোটরচালিত রিকশা অনেকটা অবাধেই চলাচল করছে। আলাপকালে কয়েকজন অটোরিকশার চালক জানান, মাঝে মধ্যে পুলিশের অভিযানের মুখে এগুলো বন্ধ রাখতে হয়। তবে অভিযান থেমে গেলে পরিস্থিতি ফিরে আসতে আর সময় লাগে না। অটোরিকশার চালকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, অবৈধ যান মহাসড়কে চলাচলের নেপথ্যে সরকারদলীয় এক শ্রেণির নেতারা জড়িত। তারাই দলীয় প্রভাব খাটিয়ে এসব চলাচলের ব্যবস্থা করে দেয়। এজন্য মালিক অথবা চালকদের কাছে থেকে নিয়মিত মাসোহারা আদায় করেন তারা। এই মাসোহারার ভাগ পায় সংশ্লিষ্ট এলাকার পুলিশ। ঢাকা-মাওয়া সড়কের সিএনজি অটোরিকশা চালক খালেক ব্যাপারী বলেন, টাকা না দিলে পুলিশ কখন ওই মহাসড়কে উঠতে দেয় না। আগে বিচ্ছিন্নভাবে টাকা নিলেও এখন সপ্তাহচুক্তিতে টাকা দিতে হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কুমিল্লার ১০০ কিলোমিটার এলাকা, কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহাসড়কে কুমিল্লার ময়নামতি থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল পর্যন্ত প্রায় ৭০ কিলোমিটার এলাকায় নিয়মিত অটোরিকশা চলাচল করে। কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার পদুয়ার বাজার বিশ্বরোড ও সুয়াগাজী, চৌদ্দগ্রাম উপজেলার মিয়াবাজার, আদর্শ সদর উপজেলার নন্দনপুর, আলেখারচর ও ময়নামতি সেনানিবাস এলাকা এবং বুড়িচং উপজেলার সাহেববাজার এলাকায় মহাসড়কে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও মোটর লাগানো রিকশা চলাচল করে। এমনকি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং পরিকল্পনামন্ত্রীর গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা-নোয়াখালী মহাসড়কেও অবাধে সিএনজি অটোরিকশা ও ইজিবাইক চলাচল করে বলে স্থানীয়রা জানান। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে নারায়ণগঞ্জ, ফতুল্লা, সিদ্ধিরগঞ্জ, বন্দর, রূপগঞ্জ, আড়াইহাজার ও সোনারগাঁয়ে হাজার হাজার সিএনজি অটোরিকশা ও ইজিবাইক চলাচল করে। সুযোগ পেলেই এসব থ্রি-হুইলার মহাসড়কে উঠে যায়। ঢাকা-নোয়াখালী রুটের বাস চালক আব্দুল করিম বলেন, ঢাকা থেকে নোয়াখালীর দিকে যেতে মেঘনা-গোমতি সেতুপাড় হলেই মহাসড়কের উপর শত শত অটোরিকশা, থ্রি-হুইলার, মোটরচালিত রিকশার ভিড়। এসবের ভিড়ে গাড়ি চালানোই কষ্টকর। এগুলো মহাসড়কের মাঝখান দিয়ে অবাধে চলে। হর্ণ দিলেও সাইড দিতে চায় না। ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের আরেক বাস চালক করম আলী বলেন, মহাসড়কে এখন অটোরিকশার সাথে মোটর লাগানো রিকশার সংখ্যাও বেড়ে গেছে। এগুলো খুবই বিপজ্জনক। এগুলোকে সাইড দিতে গিয়ে কয়েকদিন আগেও একটা দূর-পাল্লার বাস দুর্ঘটনায় পড়েছে।
অন্যদিকে, ঢাকা-টাঙ্গাইল ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুর অংশে নির্বিঘেœ থ্রি-হুইলার চলাচল করে। স্থানীয়রা জানান, মাঝে মাঝে পুলিশ এই এলাকায় অভিযান চালিয়ে সিএনজি অটোরিকশাসহ ইজিবাইক আটক করে। তখন সরকারদলীয় অনেক নেতাই তৎপর হয়ে ওঠেন সেগুলো থানা থেকে ছাড়াতে।
গাজীপুরের পরিবহন মালিক সমিতির এক নেতা জানান, মহাসড়কে আগের তুলনায় অটোরিকশা চলাচল অনেকটাই কমে গেছে। সে কারণে দুর্ঘটনাও কমেছে। যদিও গাজীপুর এলাকায় প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, মহাসড়কে থ্রি-হুইলার বন্ধের জন্য  আমরা সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে বহুবার বলেছি। এগুলো বন্ধের জন্য অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে। হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি আব্দুল মালেক বলেন, আমরা চেষ্টা করছি। মহাসড়কে থ্রি-হুইলার চলাচল পুরোপুরি বন্ধ না হলেও আগের তুলনায় পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।
গত বছর ১ আগস্ট দেশের ২২টি মহাসড়কে থ্রি-হুইলার, অটোরিকশা, অটোটেম্পো ও অযান্ত্রিক যানবাহনের চলাচল নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপণ জারি করে সরকার। সে সময় এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়েছে কি-না তা দেখার জন্য সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের নিজেই রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। নিজে সিএনজি অটোরিকশা আটক করেছেন। মন্ত্রীর একান্ত প্রচেষ্টায় শেষ পর্যন্ত অনেকটা ঘটা করেই মহাসড়কগুলোতে থ্রি-হুইলার চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল ক্রমবর্ধমান সড়ক দুর্ঘটনা রোধে এই সিদ্ধান্ত কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হবে। প্রয়োজনে মহাসড়কে থ্রি-হুইলারের জন্য আলাদা লেন চিহ্নিত করে দেওয়া হবে। কিন্তু গত ১৬ মাসে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। বরং পুলিশের ঢিলেমিতে মহাসড়কে অবৈধ এসব যানের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে দুর্ঘটনা।



 

Show all comments
  • শাহজাহান ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৬, ৭:১৬ এএম says : 0
    বাংলাদেশ জন্য স্বাভাবিক।
    Total Reply(0) Reply
  • রুবেল ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:৪৬ পিএম says : 0
    প্রশাসন এই দায় এড়াতে পারবে না।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: থ্রি-হুইলার

১৫ জানুয়ারি, ২০২২
৩১ ডিসেম্বর, ২০১৬

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ