বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
মুহাম্মদ রেজাউর রহমান
দেশে ’৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের অমর শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর পবিত্র কর্তব্য হিসেবে সর্বস্তরে বাংলা চালু হওয়ার পথে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। কিন্তু তারপরেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিদেশি ভাষার, আমাদের ঔপনিবেশিক ভাষা ইংরেজির প্রাদুর্ভাব এখনো রয়ে গেছে। আপনি লক্ষ করবেন কিছু বিপণিবিতান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট তাদের সম্মুখস্থ ইংরেজি সাইনবোর্ডটি কালো বা সাদা কাপড়ে ঢেকে দিয়েছে। এটা তারা করে বিশেষ করে একুশে ফেব্রুয়ারি আসার প্রাক্কালে। ফেব্রুয়ারি মাস শেষ হলেই এসব পর্দার আড়াল থেকে আবার আবির্ভূত হয় তাদের বহু ব্যয় করে নির্মিত সুদৃশ্য ইংরেজি সাইনবোর্ড। এ খেলাটি চলছে বহু বছর ধরে। ধারণা করা অত্যন্ত সহজ, বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যারা অকাতরে প্রাণ দিয়েছিলেন, তাদের পুণ্য স্মৃতির প্রতি দোকান বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকরা কতখানি শ্রদ্ধাশীল যে, একুশে ফেব্রুয়ারি এলে কিছু দিন আগেই তারা নিজেদের বহু ব্যয়ে নির্মিত ইংরেজি সাইনবোর্ড ঢেকে দেয়ার প্রতি অনেক যতœশীল। দেশের শতকরা শতভাগই যেখানে বাঙালি এবং বাংলা ভাষায় কথা বলেন, বাংলায় পড়াশোনা করেনÑতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য বাংলায় লেখা সাইন বোর্ড যেন অকার্যকরÑকদাচিৎ আনুমানিক প্রতি এক লক্ষ পথচারী বা সম্ভাব্য ক্রেতাদের মধ্যে একজনও যদি বাংলা ভাষাভাষী না হন, তার জন্যেই কি দোকানের অধিকাংশ ব্যয়বহুল সাইনবোর্ড ইংরেজিতে লেখা হয়?
সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনে মহানগরগুলোর সিটি কর্পোরেশনেরও রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ কার্যকর ভূমিকা। ব্যবসা-সনদ বা ট্রেড লাইসেন্স দেয়ার অন্যতম শর্ত থাকা উচিত সব সাইনবোর্ড ইংরেজির বদলে বাংলায় লিখতে হবে।
এ ছাড়া ইংরেজি হরফে লেখা প্রতিটি সাইন বোর্ডের জন্য অতিরিক্ত ফি আদায় করা যেতে পারে। সিটি কর্পোরেশনগুলো তাদের নিজ নিজ মহানগর এলাকার সড়ক নির্দেশিকাসমূহে অবশ্যি বাংলার সঙ্গে ইংরেজি ব্যবহার করতে পারে।
দেশের সর্বত্র চলাচলকারী বাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ইত্যাদিতে অত্যন্ত দৃষ্টিকটুরূপে যা দৃশ্যমান, তা হলো পরিবহনের নাম বাংলায় রাখা হলেও সাধারণত বাসগুলোর সামনের কাচে বড় করে লেখা হয় ইংরেজিতে। নাম বাংলায় তাই এর সঠিক ইংরেজি বানান অধিকাংশ সময়েই সঠিক বাংলা উচ্চারণের প্রতিনিধিত্ব করে না। অনাবিল একটি শ্রুতিমধুর বাংলা শব্দÑতাই ইংরেজিতে লেখা হলে যে কেউ এটাকে ‘আনাবিল’ও পড়তে পারে। বাসের নাম ‘আল্লাহ ভরসা’ কিন্তু ইংরেজিতে লেখা বলে পড়া যায় ‘আল্লাহ ভারাসা’। এখানে পরিবহনের সনদ প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ ও অন্যান্য সব সনদ প্রদানকারী কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই সতর্ক ও সজাগ থাকতে হবে, যাতে যানবাহন নামকরণের ক্ষেত্রে আল্লাহ, বিসমিল্লাহ, লাব্বায়েক ইত্যাদি শব্দ সনদ না পায়। আর একটি বহুল প্রচলিত নামকরণ হচ্ছে মা-বাবার দোয়া ও মায়ের দোয়া। এসবের ইংরেজি বানান যে কেউ মায়ের দয়া হিসেবেও পড়তে পারে। পরিবহন মালিকরা কী কারণে তাদের বাসের নাম বা কাভার্ড ভ্যানের নাম ইংরেজিতে লেখেন, তা খুব একটা যুক্তিগ্রাহ্য না। দেশের অভ্যন্তরে যে কোনো স্থানে চলাচলকারী বাস বা ট্রাকের নাম বা পরিবহনের নাম বাংলায় অবশ্যই লিখতে হবেÑএটা হচ্ছে সনদ প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ বা বিআরটিএ’র জন্য সময়ের একটা চ্যালেঞ্জ। যেমন সিটি কর্পোরেশনগুলোর জন্য চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মহানগরের সব বাণিজ্যিক ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম বাংলায় লেখা বাধ্যতামূলক করা। সরকারি সংস্থার ইংরেজি নাম : যেমন উল্লেখ করা হলো বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির নামের কথা, তেমনি রয়েছে আরও কিছু সরকারি সংস্থা, যেগুলো এখনো ইংরেজি নামেই পরিচিত। এগুলোর মধ্যে রয়েছে : বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশন বা বিআরটিসি, বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন বা বিটিআরসি ইত্যাদি। কর্পোরেশন শব্দটি আরও অনেক ইংরেজি শব্দের মতোই বাংলা ভাষায় বোধগম্য হয়ে পড়েছে। তবে অনেক কর্পোরেশনের আগে ইংরেজি শব্দগুলোর পরিবর্তে বাংলা প্রতিশব্দ চালু করা উচিত।
ভাষা হচ্ছে একটি চলমান বহতা নদীর মতো। সময়ের পালাচক্রে অনেক ভাষার শব্দই দেশীয় ভাষায় ব্যবহৃত হতে শুরু করে এবং দেশীয় ভাষায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। এখানে যা উল্লেখ করা সর্বাধুনিক দৃষ্টান্ত, তা হচ্ছে মোবাইল ফোন। এর আগে টেলিফোন কথাটির বাংলা প্রতিশব্দ দূরালাপনী শতকরা ১% লোকও ব্যবহার করত কিনা সন্দেহ। পরবত এখন মোবাইল ফোন শব্দটি ব্যবহৃত হচ্ছে এবং শতভাগ লোক শিক্ষিত বা নিরক্ষর মোবাইল ফোন বলতে কী বোঝায়, তা জানেন ও বোঝেনÑ এটা নিঃসন্দেহেই বলা যায়। বরং কয়েক দশক আগে টেলিফোনের যুগে বাংলা শব্দ ‘দূরালাপনী’ বললে অনেকেই বিশেষ করে যারা স্বল্প শিক্ষিত বা নিরক্ষর তারা কেউ-ই বুঝতেন না। এখনও অনেক সংবাদপত্রেই ‘মুঠোফোন’ শব্দটি ব্যবহৃত হলেও মনে হয় না ‘মুঠোফোন’ বাংলা শব্দটি ‘মোবাইল’ ইংরেজি শব্দটিকে হঠিয়ে দিতে পারবে।
বিভিন্ন ভাষা থেকে নিজের ভাষায় বিভিন্ন শব্দের অনুপ্রবেশকে তাই সংকীর্ণ দৃষ্টিতে দেখলে চলবে না। বরং অন্য ভাষার শব্দের ব্যবহার ভাষাকে সমৃদ্ধ করে তোলে।
পঞ্চাশের দশকে মরহুম গল্পকার মিন্নাত আলীর একটি গল্পে আমরা পাই যে, ঢাকায় নেমে লেখক রিকশা ভাড়া করে অনেক ঘুরেছেন, কিন্তু রিকশাচালক তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে যেতে পারেনি। একবার তার মুখে ইউনিভার্সিটি শব্দটি চলে এলে রিকশাচালক আক্ষেপ করে বলেছিলÑ এতক্ষণ ‘বাংলা ইউনিভার্সিটি না বলে বিশ্ববিদ্যালয় বলছিলেন। উঠুন, ইউনিভার্সিটিতে পৌঁছে দিই।’ তাই কোনো বিদেশি শব্দের সফল অনুপ্রবেশ ঘটলে তার পরিবর্তে ওই শব্দের বাংলা প্রতিশব্দটি জোর করে প্রচলিত করার চেষ্টা করাও ঠিক নয়।
দেশে প্রচলিত রয়েছে চার প্রকার শিক্ষা ব্যবস্থা। প্রাথমিক পর্যায় থেকেই অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদেরকে কিন্ডারগার্টেন পদ্ধতির ইংরেজি মাধ্যমে ভর্তি করিয়ে দেন। এ মাধ্যমে শিক্ষারতরা বাংলায় দুর্বল থাকে। এর সঙ্গে রয়েছে বাংলা মাধ্যমের কিন্ডারগার্টেন। এ ব্যবস্থায়ও ইংরেজি শেখার প্রতি জোর দেওয়া হয়। দেশে আরও রয়েছে মাদরাসা শিক্ষা পদ্ধতি ও সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থাসহ চারটি শিক্ষা ব্যবস্থার দুটিতেই যথা মাদরাসা ও ইংরেজি মাধ্যমের কিন্ডারগার্টেন ব্যবস্থায় মাতৃভাষা বাংলার প্রতি তেমন গুরুত্ব দেয়া হয় না। উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য প্রকৌশলী, ডাক্তার বা আইনবিদ হওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের যথেষ্ট ইংরেজিতে ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন হতেই হয়, কারণ এখনো বহু পাঠ্যবই শুধু ইংরেজিতে পাওয়া যায়। এসব সমস্যার প্রতি দৃষ্টি রেখে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে।
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা বা ইউনেস্কো বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা ও শহীদ দিবস একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে গ্রহণ করায় পৃথিবীর সব দেশে এখন ২১শে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়। অধিকাংশ বাংলাদেশির ধারণা, এর মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। বিশ্বের সব জাতির নিজ নিজ মাতৃভাষা রয়েছে। মাতৃভাষায় শিক্ষা দিলে শিশুরা সহজেই পাঠ্যসূচি বুঝতে পারে ও জ্ঞান অর্জন করতে পারে। মাতৃভাষা সবার কাছেই প্রিয়। তাই মাতৃভাষার প্রতি গুরুত্ব প্রদান, মাতৃভাষাকে বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ, মাতৃভাষার উন্নয়নের লক্ষ্যে কর্মসূচি গ্রহণ ইত্যাদির প্রতি বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে গ্রহণ করা হয়েছে। ১৯৫২ সালে যেসব তরুণ শহীদ হয়েছিলেন তারাও মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতিদানের দাবিতেই নিজেদের প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন। ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদযাপনের কারণ হিসেবে মাতৃভাষার জন্য আমাদের তরুণদের আত্মোৎসর্গকেই স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। আমরা এ জন্য অবশ্যই গর্ববোধ করতে পারি। কিন্তু দুঃখজনক এই যে, বাংলা ভাষাকে অধিকতর উন্নয়ন, বিশেষ করে যথোপযুক্ত পরিভাষার উৎকর্ষ সাধন করার কাজে তেমন কোনো অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায় না। বরং বৈজ্ঞানিক চিকিৎসাবিদ্যা ও আইন শিক্ষা বিষয়ে বহু ইংরেজি শব্দের অনেক ধরনের বাংলা প্রতিশব্দ ব্যবহৃত হচ্ছে অর্থাৎ সবার দ্বারা স্বীকৃত একক প্রতিশব্দ দেখা যায় না।
যুক্তাক্ষর ব্যবস্থা বাংলা ভাষার একটি প্রধান বিশেষত্ব। অথচ এই যুক্তাক্ষর ব্যবস্থার জন্য মুদ্রণ শিল্পে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনয়নকারী কম্পিউটারের মাধ্যমে বর্ণবিন্যাস বা কম্পোজ করায় প্রতিবন্ধকতা বা ধীরগতির মোকাবেলা করতে হয়। বাংলা ভাষার সংস্কার সাধন করা ও যুক্তাক্ষর পদ্ধতি সহজিকরণ করা এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক॥
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।