Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

বলুহর বাওড়ের সর্বোচ্চ দরদাতা কোটচঁদপুর মৎসজীবি সমবায় সমিতি দুই মাস পার হলেও বাওড় হস্তান্তর করা হয়নি বাওড় বুঝে না পেলে আত্মহত্যার হুমকি মৎসজীবীদের

কালীগঞ্জ (ঝিনাইদহ) উপজেলা সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ৫:৩৩ পিএম

ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর বলুহর বাওড় মৎসজীবি সমিতির নামে একটি মহল কয়েক দশক ধরে ভোগ দখল করে আসছে। ফলে প্রকৃত হালদার সম্প্রদায়ের শত শত মৎসজীবিরা জলমহাাল থেকে বঞ্চিত হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। জাল যার জলা তার নীতিতে মাছ চাষ হলেও প্রায় ৪০ বছর কয়েকশত মৎসজীবি পরিবারকে বলুহর বাওড়ের জলার ধারে কাছেও ভিড়তে দেয়নি ওই মহলটি। নানা দুর্নীতি ও লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ায় ২০২২ সালের ২০ মার্চ সরকারের ভূমি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বাওড়টি মৎস বিভাগের কাছে নবায়ন না করে ওপেন টেন্ডারের মাধ্যমে ইজারা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করলে বিষয়টি সামনে আসে। ১৯৭৯ সাল থেকে “জাল যার জলা তার” সরকারের এমন নীতির উপর ভর করে একটি মহল গুটিকয়েক মৎস্যজীবীদের সামনে দিয়ে বলুহর বাওড়টি দখলে রেখেছিলেন। ফলে দির্ঘ প্রায় ৪০ বছর ধরে বঞ্চিত হয়ে আসছিলেন বাওড়পাড়ের পাঁচ শতাধিক জেলে পরিবার।
অপরিকল্পিত মৎস চাষ, বাওড়ের ভূমি বেদখল, বাওড় ম্যানেজার ও হ্যাচারীর সহকারী ম্যানেজারের দূর্নীতির কারনে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হওয়ায় সরকারের ভূমি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে স্থানীয় প্রশাসন ওপেন টেন্ডারের মাধ্যমে বাওড় ইজারা দেওয়ার নির্দেশ দেয়। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পেয়ে জেলা প্রশাসন টেন্ডার প্রক্রিয়া শুরু করে। বলুহর বাওড়টি পেতে তিনটি মৎসজীবি সমিতি টেন্ডারে অংশ নেয়। টেন্ডারে অংশ নেওয়া কোটচাঁদপুর মৎসজীবি সমবায় সমিতি ২ কোটি ৩৭ লাখ, বাজেবামনদাহ মৎসজীবি সমবায় সমিতি ১ কোটি ৭০ লাখ এবং বলুহর মৎসজীবি সমবায় সমিতি বাৎসরিক ৬৭ লাখ টাকা দরে ইজারা নেওয়ার জন্য কাাগজপত্র জমা দেন।
এরপর ১৫/১২/২০২৩ ইং তারিখ কোটচাঁদপুর মৎসজীবি সমবায় সমিতি বাৎসরিক ২ কোটি ৩৭ লাখ টাকা সর্বোচ্চ দরদাতা হিসাবে কাগজপত্র জমা দেওয়ায় ছয় বছরের জন্য বলুহর বাওড়টি মাছ চাষের জন্য ইজারা দিতে সুপারিশ করে মন্ত্রণালয়ে পাঠায় জেলা প্রশাসন। তবে সর্বোচ্চ দরদাতা কোটচাঁদপুর মৎসজীবি সমবায় সমিতিকে এখনো বাওড়টি হস্তান্তর করা হয়নি। এরমধ্যে ৬৭ লাখ টাকা দর জমা দেওয়া বলুহর মৎসজীবি সমিতি দির্ঘ ৪০ বছর বাওড় ম্যানেজারের সাথে যোগসাজস করে ভোগদখল করে আসছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
সমিতিটি সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থ বছরে মৎস আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ২০০ মেট্রিকটন থাকলে ও তারা অর্জন দেখিয়েছেন মাত্র ৪৫.৪০ মেট্রিক টন। এখান থেকে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৯০ লাখ টাকা থাকলেও তারা সরকারের কোষাগারে জমা দিয়েছেন মাত্র ২০ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। জেলার বাকি চারটি বাওড় লক্ষ্যমাত্রার শতভাগ অর্জন করলেও ব্যতিক্রম বলুহর বাওড়টি। তারা অজ্ঞাত কারনে লক্ষ্যমাত্রার ধারে কাছেও যেতে পারেনি। তবে বাওড় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাওড় ম্যানেজার ও বলুহর মৎসজীবি সমিতির যোগসাজসে লুটপাটের কারনে এমনটি হয়েছে। যদিও এর আগের বছর ২০১৯-২০ অর্থ বছরে লক্ষ্যমাত্রার ৯০ লাখ টাকার শতভাগই অর্জন দেখিয়ে সরকারের কোষাগারে জমা দেন। এছাড়া ২০২২ সালে বলুহর বাওড়ের টোপাফেনা বা পট পরিস্কার জন্য ৪৫ লাখ টাকা বরাদ্দ আসে কিন্তু বাওড় ম্যানেজার সিদ্দিকুর রহমান কাজ না করেই সে টাকা উত্তোলন করে নেয়।
চলতি বছর ইজারার মাধ্যমে বাওড় বরাদ্দ দেওয়ার সিদ্ধান্তের ফলে প্রতিবছর এখান থেকে সরকারের কোষাগারে ভ্যাট ও করসহ প্রায়৩ কোটি টাকা জমা হবে। যা বাওড়টির রেকর্ডে সবথেকে বেশি আয়। তবে ইজারা পাওয়া সৎসজীবি সমিতির সদস্যরা অভিযোগ করেছেন এতদিন বাওড় ভোগদখল করে রাখা চক্রটির ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। সরকারের টেন্ডার প্রক্রিয়ায় আগামি ছয় বছরের জন্য আমরা পেলেও এখনো বাওড়টি বুঝে পায়নি। ইতোমধ্যে সর্বচ্চ দরদাতা হিসাবে কোটচাঁদপুর সৎসজীবি সমিতি ২ কোটি ৩৭ লাখ টাকা সরকারের কোষাগারে জমাও দিয়েছি। কিন্তু একটি মহলের ষড়যন্ত্রের ফলে সংশ্লিষ্ট কর্তপক্ষ বাওড় বুঝিয়ে দিতে গড়িমসি করছে। ইজারা পাওয়া মৎসজীবি সমিতির সদস্যরা বলছেন, আমরা ঘরের ছাগল গরু বিক্রি করে, বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণসহ বাড়ির সব সম্পদ বেচাকেনা করে ইজারার টাকা জমা দিয়েছি। এখন বাওড় বুঝে না পেলে আমাদের আত্মহত্যা করা ছাড়া উপায় থাকবে না।
মৎসজীবীরা জানান, সরকারের ভূমি মন্ত্রনালয় অধিনে ঝিনাইদহের পাঁচটি বাওড় রয়েছে। বাওড়গুলো হচ্ছে ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার কাঠগড়া, ফতেপুর, কোটচাঁদপুরের বলুহর, জয়দিয়া ও কালীগঞ্জের মর্জাদ বাওড়। এ সব বাওড়ের মোট জলাকার হচ্ছে ১১৩৭ হেক্টর। এসব বাওড় এলাকায় ৮০০ পরিবারের প্রায় ৫ হাজার সদস্য বাওড় থেকে আয়ে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন।
এরমধ্যে ফতেপুর ও কাঠগড়া বাওড়ে ১৫০ জন মৎস্যজীবী, বলুহর ও জয়দিয়া বাওড়ে ৪৭২ জন, মর্জাদ বাওড়ে ১৪৫ জন ও বেড়গোবিন্দপুর বাওড়ে ২১০ জন মৎস্যজীবী মাছ চাষ ও ধরা সমিতির সদস্য।

কোটচাঁদপুর মৎসজীবি স সমবায় সমিতির সদস্য বকুল রানী জানান, আমরা দির্ঘদিন জলাশয়ের অধিকার থেকে বঞ্চিত। এখন সরকারের টেন্ডার প্রক্রিয়ায় সবকিছু বেচাকেনা করে এবং সুদে ঋণ নিয়ে ইজারার টাকা জমা দিয়েছি। সবথেকে বেশি দরদাতা হিসাবে আমরা বাওড়ের ইজারা পেয়েছি। আমরা চাই বাওড়টি আমাদের বুঝিয়ে দেওয়া হোক।
কোটচাঁদপুর মৎসজীবি সমবায় সমিতির সাধারন সম্পাদক উত্তম কুমার বিশ^াস জানান, আমরা হালদার সম্প্রদায়ের প্রকৃত মৎসজীবি হলেও দির্ঘ ৪০ বছর হলো একট মহল আমাদের বাওড়ের পানিতে নামতে দেয়নি। এখন সরকারের ওপেন টেন্ডারে আমরা সর্বোচ্চ দরদাতা হিসাবে বাওড়টি পেয়েছি কিন্তু এখনো বাওড় বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। দ্রুত আমাদের বাওড়টি বুঝিয়ে দেওয়ার দাবি করেন।
কোটচাঁদপুর মৎসজীবি সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি শিতল কুমার মন্ডল জানান, আমরা প্রকৃত মৎসজীবি হলেও একটি মহল হাতে গোনা কয়েকজন মৎসজীবিকে সামনে রেখে ভোগদখল করে রেখেছে। তাদের ষড়যন্ত্রে আমরা দির্ঘ প্রায় ৪০ বছর ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলাম। সম্প্রতি সরকারের ভূমি মন্ত্রনাালয়ের নিদের্শে ওপেন টেন্ডারের আহবান করা হয়। সেখানে আমার কোটচাঁদপুর মৎসজীবি সমবায় সমিতি সর্বোচ্চ দরদাতা হিসাবে বলুহর বাওড়ের ইজারা পায়। কিন্তু অজ্ঞাত কারনে আমাদের আমাদের এখনো বাওড় বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। আমরা সমিতির সদস্যদের সহায় সম্বল বিক্রি করে এবং এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ইজারার ২ কোটি ৩৭ লাখ টাকা জমা দিয়েছি।

বলুহর মৎসজীবি সমবায় সাধারন সম্পাদক মহানন্দ হালদার জানান, আমরা টেন্ডারে অংশগ্রহন করেছিলাম। আমরা ৬৭ লাখ টাকা বাৎসরিক দর দিয়ে কাগজপত্র জমা দিই। এতে আরো দুইটি সমিতি অংশগ্রহন করে। শুনেছি অন্য একটি সমিতি বেশি দর দেওয়ায় তারা বাওড় পেয়ে গেছে। যে কারণে ঝিনাইদহ-৩ আসনের সংসদ সদস্য শফিকুল আজম খান চঞ্চলের কাছে গিয়েছিলাম। আমাদের এত টাকা নেই। তাই এমপি সাহেবের দিয়ে টেন্ডার প্রক্রিয়া স্থগিত করা হয়েছে। এখন দেখাা যাক কি হয়।
বলুহর বাওড়ের ম্যানেজার সিদ্দিকুর রহমানের সাথে এ বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, বিষয়টি জেলা প্রশাসন দেখছে, এখানে আমি কিছু বলতে পানি না।
ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক মনিরা বেগম জানান, আপনারা জানেন জেলায় ৫টি বাওড় রয়েছে। জলমহাল নীতিমালা ২০০৯ অনুযায়ি ২০ একরের বেশি জলমহালগুলো ওপেন টেরন্ডারের মাধ্যমে ইজারা দেওয়ার কাজ সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। উন্নয়ন প্রকল্পের আওতাধীন জলমহালগুলোর টেন্ডার প্রক্রিয়া জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ হলে সুপারিশ আকারে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। তারপর সেখান থেকে সর্বোচ্চ দরদাতাতে ইজারা দেওয়া হয়। জেলা কোটচাঁদপুর উপজেলার বলুহর বাওড়ের টেন্ডার প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে সম্পন্ন করে পাঠানো হয়েছে। এখন আমরা ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ