হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
জামালউদ্দিন বারী : সিরিয়ার সরকারি বাহিনী, রাশিয়া, ইরান ও হেজবুল্লাহর যৌথ সামরিক ব্যবস্থায় অবশেষে আইএস, আল নুসরাসহ পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ট সরকারবিরোধী বিদ্রোহীদের মূল ঘাঁটি আলেপ্পো দখলমুক্ত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে চাপিয়ে দেয়া গৃহযুদ্ধ অবসানে আলেপ্পোর দখলদারিত্বের পতন একটি বড় অগ্রগতি হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। গত ৫ বছরে সিরীয় গৃহযুদ্ধে অন্তত ৫ লাখ মানুষের মৃত্যু এবং কয়েক কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে মধ্যপ্রাচ্যে একটি মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো সিরিয়ায় সরকারবিরোধী বিদ্রোহ ও গৃহযুদ্ধের প্রেক্ষাপট সৃষ্টির আগের এক দশকে ইরাক, আফগানিস্তান, মিসর, লিবিয়া এবং সাম্প্রতিক সময়ে ইয়েমেন, নাইজেরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার মুসলমান অধ্যুষিত দেশগুলোতে ব্যাপক রক্তাক্ত সংঘাত সৃষ্টি করা হয়েছিল রিজিম চেঞ্জ’র মধ্য দিয়ে সর্বত্র বশংবদ ক্রীড়নকদের ক্ষমতায় বসানোর জন্য। ওয়ার অন টেররিজম, ওয়েপনস অব মাস ডেস্ট্রাকশন, আরব রেভ্যুলেশনের নামে সিআইএ পরিচালিত বিদ্রোহ ইত্যাদি অভিধা ব্যবহার করে ইরাকের সাদ্দাম হোসেন, আফগানিস্তানের তালেবান সরকার এবং লিবিয়ার শক্তিমান শাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে নির্মমভাবে হত্যা করে সেখানে যে অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে, সর্বোচ্চ ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা নিশ্চিত করে তা সিরিয়ায় ঠেলে দেয়া হয়েছিল অনুরূপভাবে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে হত্যা ও ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষ্যে। পশ্চিমা দেশগুলোর কোটি কোটি ডলারের বাজেট, অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র, প্রোপাগান্ডা মেশিনারিজ এবং গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে এক সময় বাশার আল আসাদ সরকারের নিয়ন্ত্রণকে অনেকটাই অকার্যকর করে তুলতে সক্ষম হয়। ইরাককে কয়েকটি ভাগে ভাগ করার পরিকল্পনা অনেক আগেই চূড়ান্ত হয়েছিল। বাশার আল আসাদ সরকারের পতনের পর সিরিয়াকেও আরো কয়েকটি ভাগে ভাগ করে মধ্যপ্রাচ্যে কোনো বৃহৎ রাষ্ট্রশক্তির অস্তিত্ব ও তাদের মধ্যকার অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক ঐক্যের সম্ভাবনা নস্যাৎ করে ইসরাইলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই এসব ধ্বংসাত্মক সামরিক আগ্রাসন ও গৃহযুদ্ধের মূল লক্ষ্য বলে প্রতীয়মান হয়। মধ্যপ্রাচ্য ও ইসলামী দুনিয়ার কোনো দেশই জায়নবাদী মহাপরিকল্পনার বাইরে নেই। সামগ্রিক আঞ্চলিক রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সা¤্রাজ্যবাদী পরিকল্পনায় যুদ্ধের চূড়ান্ত লক্ষ্য ইরান ও তার সহযোগী দেশ ও সামরিক সংগঠনগুলো, এই ধারণা অনেকটা বদ্ধমূল হয়ে গেছে। কষ্টার্জিত ছয় জাতির পারমাণবিক সমঝোতার পরও ইরানের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের সম্পর্কের টানাপোড়েন অব্যাহত থাকা, ইউক্রেনকে ঘিরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে মুখোমুখি অবস্থান, দক্ষিণ চীন সাগরে চীন ও মার্কিনিদের মুখোমুখি সাংঘর্ষিক অবস্থান ইত্যাদি ঘটনা বিশ্ব পরিস্থিতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো জোটের পাশাপাশি রাশিয়া, চীন, ইরান, পাকিস্তান ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর নতুন অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তামূলক ঐক্য বিশ্বে একটি নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ নিশ্চিত করেছে।
আলেপ্পোর যুদ্ধ সমসাময়িক বিশ্বের সামরিক ইতিহাসের সবচেয়ে জটিল, রক্তাক্ত ও ধ্বংসাত্মক ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক কোয়ালিশনের সহায়তায় বিদ্রোহী গ্রুপগুলো চার বছর ধরে সাফল্যের সাথে আলেপ্পোর দখল বজায় রেখেছিল। পশ্চিমা সামরিক প্রযুক্তি, সমরাস্ত্র, সুপ্রশিক্ষিত জনবল এবং সুরক্ষিত সরবরাহ লাইনের মাধ্যমে তারা একদিকে তাদের অবস্থানকে অজেয় করে তুলেছিল, অন্যদিকে নতুন নতুন এলাকা নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে দামেস্কের দিকে অগ্রসর হয়ে দামেস্ক দখলের চূড়ান্ত প্রস্তুতিও গ্রহণ করছিল। বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর হাতে সিরিয়ায় সরকারি বাহিনীর পতন ঘটলে নিশ্চিতভাবেই সিরিয়া এতদিনে ইরাক, লিবিয়ার মতো নৈরাজ্যকর অবস্থায় পতিত হতো। এ পরিস্থিতি মধ্যপ্রাচ্যের চলমান সংঘাত-সহিংসতা ও অস্থিরতাকে আরো প্রলম্বিত বিশৃঙ্খলার মধ্যে ঠেলে দিত, যা এক সময় হয়তো ইরান ও তুরস্ককে পর্যন্ত গ্রাস করত। সিরিয়া, ইরাক, ইরান, তুরস্ককে বিশৃঙ্খল, দুর্বল ও নানাভাবে বিভক্ত করে তোলতে পারলে জায়নবাদীদের স্বপ্নের গ্রেটার ইসরাইল গড়ে তোলা অনেকটা সহজ হয়ে উঠতে পারে। আলেপ্পো দখলমুক্ত করার মধ্য দিয়ে সেই নীলনকশা আপাতত ব্যর্থ হয়ে গেল। সিরীয় গৃহযুদ্ধের সবচেয়ে কঠিন অফেনসিভ অপারেশনের শেষ প্রান্তে এসে রাশিয়া ও ইরানের সহযোগিতায় আলেপ্পো মুক্ত করার কয়েক সপ্তাহের শ্বাসরুদ্ধকর যুদ্ধকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার স্তালিনগ্রাদ যুদ্ধের সাথে তুলনা করা হচ্ছে। ১৯৪২-২৩ সালে জার্মান নাৎসি বাহিনীর দখল থেকে রাশিয়ার স্তালিনগ্রাদ মুক্ত করার লড়াইয়ে সামরিক-বেসামরিক ২০ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মধ্য দিয়ে স্তালিনগ্রাদে হিটলারের বাহিনীর পরাজয়ের মধ্য দিয়েই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার-মুসোলিনীদের পরাজয় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। সিরিয়া যুদ্ধের পরিস্থিতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাথে তুলনীয় না হলেও আলেপ্পোর স্থলযুদ্ধে মার্কিন নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন বাহিনীর সরাসরি সম্পৃক্ততা আবারো প্রমাণিত হওয়ার মধ্য দিয়ে অভিযোগের অনেক কিছুই বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। বিশেষত ১৫ ডিসেম্বর পূর্ব আলেপ্পোর একটি বাঙ্কার থেকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন বাহিনীর ১৪ জন গোয়েন্দা কর্মকর্তা সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর হাতে আটক হওয়ার মধ্য দিয়ে তা উন্মোচিত হয়েছে। জাতিসংঘে নিযুক্ত সিরীয় রাষ্ট্রদূত বাশার জাফারি আলেপ্পোতে আটক হওয়া বিদেশি গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের নাম-পরিচয়ের যে তালিকা প্রকাশ করেছেন, সেখানে ৮ জন সৌদি নাগরিকের সাথে তুরস্ক, কাতার, মরক্কো, জর্ডান ও মার্কিন নাগরিক ছাড়াও ইসরাইলি সামরিক গোয়েন্দা কর্মকর্তার নাম রয়েছে। আলেপ্পো পুনরুদ্ধারের যৌথ অভিযানে এসব দেশের অনেক সেনা কর্মকর্তা নিহত হওয়ারও খবর পাওয়া গেছে। সিরিয়া যুদ্ধ গত ৫ বছরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপে বৃহত্তম রিফিউজি ক্রাইসিস সৃষ্টি করলেও যুদ্ধ ও সমস্যা সমাধানে পশ্চিমাদের দ্বৈতনীতি ও সদিচ্ছা শুরু থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল। আইএস দমনের কথা বলে কোয়ালিশন বাহিনী গঠন করে বিমান হামলা অব্যাহত রাখা হলেও তাদের যুদ্ধ মূলত সিরিয়ায় রিজিম চেঞ্জ’র লক্ষ্যেই পরিচালিত হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়েছে। রাশিয়া ও ইরানের সমর্থনে সিরিয়ার বিশেষ বাহিনীর আলেপ্পো পুনরুদ্ধারের মধ্য দিয়ে সে চেষ্টা আপাতত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। চরমপন্থি বিদ্রোহী ও মডারেট গ্রুপগুলোর হাজার হাজার সদস্য আত্মসমর্পণ এবং অস্ত্র ফেলে পালিয়ে যাওয়ার পর পশ্চিমা কোয়ালিশন বাহিনীর সামরিক উপদেষ্টারা আটক হওয়ার মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য হয়তো একটি নতুন ভবিষ্যতের দিকে যাত্রা করতে শুরু করবে।
শুধু মধ্যপ্রাচ্যেই নয়, সমগ্র বিশ্বের প্রাচীনতম সভ্যতার পাদপীঠগুলোর মধ্যে সিরিয়ার আলেপ্পো অন্যতম। গত তিন হাজার বছরের ইতিহাসে গ্রীক, পারস্য, রোমান, অটোমান সভ্যতার উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে অনেক শহর গড়ে উঠেছে এবং বিলুপ্তিও ঘটেছে। তবে আলেপ্পো এ ক্ষেত্রে এক বিরল ব্যতিক্রম, যেখানে আড়াই হাজার বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে জনবসতি ও অর্থনৈতিক বিবর্তন সক্রিয় রয়েছে। আলেপ্পো, মসুলের মতো প্রাচীন ইতিহাস-ঐতিহ্যের নগরীগুলোর ইতিহাসের সাথে গ্রিক, রোমান, বাইজান্টাইন, আব্বাসীয়, অটোমান খলিফা এবং শত বছরব্যাপী ক্রুসেডের অবিস্মরণীয় ইতিহাস রয়েছে। খ্রিস্টীয় একাদশ শতকে ক্রুসেডারদের হাতে জেরুজালেমের পতনের পর মুসলের গভর্নর ইমাদ আদ-দ্বীন জেঙ্গি ১১২৮ খ্রিস্টাব্দে আলেপ্পোর অধিকার গ্রহণ করে তা মসুলের সাথে একীভূত করেছিলেন। এর শত বছর পর সালাউদ্দিন আইয়ুবীর হাতে জেরুজালেম পুনরায় মুক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত আলেপ্পো ও মসুলের মতো ভূ-রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো জনগণের প্রতিরোধের মুখে শত্রুদের দখলদারিত্ব ও আগ্রাসনের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার পথ তৈরি করে। দ্বাদশ শতকের মাঝামাঝিতে পোপ ইউজিনের ডাকে ফরাসি রাজা সপ্তম লুই এবং জার্মান রাজা তৃতীয় কনরাডের বাহিনীসহ ইউরোপীয় রাজশক্তিগুলো দামাস্কাসসহ সিরিয়া দখলের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিল ইমাদ আদ-দ্বীন জেঙ্গির মতো নেতার অকুতোভয় নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক দক্ষতার কারণে। হাজার বছর পেরিয়ে এসেও পশ্চিমা শক্তিগুলো মধ্যপ্রাচ্যের প্রাচীন জনপদগুলোকে নিজেদের করায়ত্ত করতে নানা কৌশল অবলম্বন করছে। আমরা স্মরণ করতে পারি, ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকায় নিউ ইয়র্কের বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্র ও পেন্টাগনে সন্ত্রাসী বিমান হামলা সংঘটিত হওয়ার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ‘ক্রুসেড’ ঘোষণা করেছিলেন। গত দেড় দশকে প্রমাণিত হয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের তথাকথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’র বা বুশের সূচিত সেই ক্রুসেড ছিল মূলত ইসরাইলকে নিরাপদ রাখতে মধ্যপ্রাচ্যের সম্ভাবনাময়-শক্তিশালী মুসলিম দেশগুলোকে দুর্বল ও ধ্বংস করার একটি জায়নবাদী চক্রান্ত।
বিশ্বরাজনীতিতে রাশিয়া, ইরান ও চীন হাত ধরাধরি করে একটি সমান্তরাল ভূমিকা নিয়ে অগ্রসর হওয়ার পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার একটি নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। যে বিদ্রোহীরা দামেস্ক দখলের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল, রাশিয়ার প্রবল হস্তক্ষেপের পর মসুল ও আলেপ্পো থেকে পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ট বিদ্রোহীরা বিতাড়িত হয়ে সিরিয়ার নিয়মতান্ত্রিক সরকারের নিয়ন্ত্রণ সুসংহত হয়েছে। একই সময়ে আরেকটি সুসংবাদ হচ্ছে- কয়েকটি আরব ও ননআরব দেশের প্রস্তাবে ফিলিস্তিনের অধিকৃত ভূ-খন্ডে ইসরাইল সরকারের বসতি সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব অনেক অনিশ্চয়তা ও উৎরাই শেষে নির্বিঘেœ পাস হওয়া। আরব-ইসরাইল শান্তি প্রতিষ্ঠা, ফিলিস্তিনের ওপর সামরিক আগ্রাসন এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের দায়ে গত অর্ধশত বছরে ইসরাইলের বিরুদ্ধে বিশ্বসম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা অনেক প্রস্তাব উত্থাপন করলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার বশংবদ পরাশক্তিগুলোর চাপ ও ভেটো প্রয়োগের ফলে গুরুত্বপূর্ণ কোনো প্রস্তাবই পাস হয়নি। এবারো তার নমুনা দেখা গেছে শেষ মুহূর্তে মিসরের প্রস্তাব প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট-ইলেক্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হস্তক্ষেপে ফিলিস্তিনে ইসরাইলের অবৈধ বসতি স্থাপনের বিরুদ্ধে আনীত প্রস্তাব থেকে মিসর সরে দাঁড়ালে নিরাপত্তা পরিষদের ভোটাভুটি স্থগিত হয়ে যায়। অবশ্য তাৎক্ষণিকভাবে নিউজিল্যান্ড, সেনেগাল ও মালয়েশিয়ার পক্ষ থেকে অনুরূপ বিকল্প প্রস্তাব উত্থাপন করার পর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ১৫টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে ১৪টি দেশ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আগের মতো ভেটো না দিলেও ভোটদানে বিরত থাকায় প্রস্তাব পাস হওয়া নিশ্চিত হয়ে যায়। ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনের ভূমি দখল করে জবরদস্তিমূলকভাবে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই ইসরাইল আরব প্রতিবেশীদের প্রতি আগ্রাসী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধে পশ্চিমা সামরিক সহায়তায় নতুন করে ফিলিস্তিনসহ কয়েকটি দেশের বিশাল এলাকা দখল করে নেয়। এরপর ১৯৭৩ সালের যুদ্ধে ইসরাইল পতনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে তড়িঘড়ি করে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব পাস করে। তবে ১৯৬৭ সালে মিসরের দখলকৃত ভূমি ফেরত দিলেও ফিলিস্তিনের পশ্চিমতীর ও গাজা উপত্যকায় নতুন করে দখলদারিত্ব কায়েম করে। মিসর ও ইসরাইলের মধ্যে ১৯৭৮ সালে সম্পাদিত ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির আওতায় মিসরের সাথে সমঝোতা করে ইসরাইলের নিরাপত্তা হুমকি কমিয়ে আনা হলেও অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূ-খ-ের ওপর দখলদারিত্ব বন্ধ করতে কোনো আন্তর্জাতিক উদ্যোগই ইঙ্গ-মার্কিন ভেটোর কারণে সফল হয়নি। গত ২৩ ডিসেম্বর পাস হওয়া নিরাপত্তা পরিষদের ইসরাইলবিরোধী প্রস্তাবটি গত কয়েক দশকের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই প্রস্তাবটি এমন সময় পাস হলো যখন মার্কিন নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন ইরাক ও সিরিয়ায় আইএসবিরোধী অভিযানে চরমভাবে ব্যর্থ হওয়ার পর তাদের সমর্থনপুষ্ট বিদ্রোহী গ্রুপগুলোকে রাশিয়া ও ইরান চরমভাবে পরাস্ত করতে সক্ষম হয়েছে। এমনকি সৌদি আরব, তুরস্কসহ আরব দেশগুলোর পাশাপাশি ব্রিটিশ, ফরাসি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের সামরিক গোয়েন্দা কর্মকর্তারাও আলেপ্পোতে সিরীয় বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পর অবনত মস্তকে তাদের ক্যামেরার সামনে হাজির হওয়ার দৃশ্যটি যেন মহাযুদ্ধে অক্ষশক্তির আত্মসমর্পণের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অপ্রত্যাশিতভাবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ের মধ্য দিয়ে বিশ্বপরিস্থিতিতে যখন কিছু নেতিবাচক আশঙ্কার জন্ম দিয়েছে, ঠিক তখন ২০১৬ সালে ডিসেম্বরের শেষার্ধে বেশ কয়েকটি নাটকীয় ও যুগান্তকারী ঘটনা সংঘটিত হলো। এর একেকটি ঘটনা বিশ্বকে বদলে দেয়ার অন্তর্নিহিত শক্তি রাখে। প্রবল শক্তিধর পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ট বিদ্রোহী বাহিনীর হাত থেকে আলেপ্পো পুনরুদ্ধার, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ইসরাইলের নয়া বসতি স্থাপনবিরোধী প্রস্তাব পাস হওয়ার মাঝখানে গত ১৯ ডিসেম্বর তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় একটি আর্ট গ্যালারিতে তুর্কি নিরাপত্তাবাহিনীর এক সাবেক কর্মকর্তার গুলিতে তুরস্কে নিযুক্ত রাশিয়ান রাষ্ট্রদূত নিহত হয়েছেন। একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, টাইস্যুট পরা আততায়ী রুশ অ্যাম্বাসেডর আন্দ্রে কার্লভকে গুলি করার সময় আলেপ্পো ও সিরিয়ায় রাশিয়ার ভূমিকার কথা উচ্চৈঃস্বরে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। বলাবাহুল্য, আলেপ্পো পুনরুদ্ধারের মধ্য দিয়ে একটি প্রলম্বিত বিপর্যয় ঠেকিয়ে দিয়ে সিরিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ ত্বরান্বিত হবে। আল কায়েদা, আইএস, আল নুসরাসহ কথিত মডারেট বিদ্রোহী এবং তাদের পশ্চিমা ও আঞ্চলিক সমর্থকরা চরমভাবে হতাশ হয়ে এ ধরনের হত্যাকা- সংঘটিত করে থাকতে পারে বলে কোনো কোনো পশ্চিমা বিশ্লেষক মনে করছেন। আঙ্কারায় রুশ রাষ্ট্রদূত হত্যার ঘটনাকে ‘সারায়েভো মোমেন্ট’ বলে আখ্যায়িত করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক পেপে এস্কোবার। ১৯১৪ সালে সারায়েভোর রাজপথে অস্ট্রিয়ার আর্চডিউক ফ্রাঞ্চ ফার্দিনান্দকে গুলি করে হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রথম মহাযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। একইভাবে ২০০১ সালের নাইন-ইলেভেন বিমান হামলার ঘটনাকেও সারায়েভো মোমেন্ট হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। সর্বশেষ আঙ্কারায় রুশ রাষ্ট্রদূত হত্যার ঘটনাকেও আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও ঘটনাপ্রবাহে বড় ধরনের পরিবর্তনের সূচনাকারী ঘটনা হিসেবে ধরে নিয়ে একে সারায়েভো মোমেন্ট বলে অভিহিত করা হচ্ছে। তবে তীক্ষè মেধাবী রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন জর্জ বুশের মতো কোনো ক্রুসেডের ঘোষণা দেননি। তিনি ইতোমধ্যে যে যুদ্ধে নেমেছেন সেই যুদ্ধকেই একটি সফল পরিসমাপ্তির দিকে নিয়ে যেতে চান। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ইসরাইলবিরোধী প্রস্তাব পাস হওয়ার পর ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ফিউরিয়াস হয়ে বাড়াবাড়ি করেছেন। তিনি ইতোমধ্যে নিউজিল্যান্ড ও সেনেগাল থেকে ইসরাইলি রাষ্ট্রদূতদের প্রত্যাহার করেছেন এবং নিরাপত্তা পরিষদে ভোটদানে বিরত থাকার বিষয়ে কৈফিয়ৎ তলব করতে ইসরাইলে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠিয়েছেন বলে জানা যায়। একইভাবে আরো কয়েকটি দেশের বিরুদ্ধে অনুরূপ ব্যবস্থা নিচ্ছেন বলে জানা গেছে। নিরাপত্তা পরিষদে ইসরাইলবিরোধী প্রস্তাব পাসের প্রতিক্রিয়ায় ২০ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর জাতিসংঘের ভূমিকা বদলে যাবে বলে সতর্ক সংকেত দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট-ইলেক্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি এরই মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরমাণু সক্ষমতা বৃদ্ধিরও আগাম ঘোষণা দিয়েছেন। নেতানিয়াহু ও ট্রাম্পের যুদ্ধবাদী মেলবন্ধন আগামী বছরগুলোতে বিশ্বকে কোথায় নিয়ে যায় তা দেখার জন্য এখন অপেক্ষার পালা। তবে রাশিয়া, চীন, ইরান, সিরিয়া, তুরস্কসহ মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর ঐক্য অটুট ও সুসংহত থাকলে সম্ভবত সিরিয়া পশ্চিমাদের রিজিম চেঞ্জ পরিকল্পনার শেষ ব্যর্থ চেষ্টা হিসেবে ইতিহাসে ঠাঁই পাবে। আলেপ্পোর পতন এবং জাতিসংঘে ইসরাইলবিরোধী প্রস্তাব পাস হওয়ার মধ্য দিয়ে প্রবল শক্তির যুদ্ধবাদী বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে যে আশাবাদ জেগে উঠেছে বিশ্বসম্প্রদায়কে তা রক্ষা করতে হবে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।