Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

তিনি ছিলেন বাংলাদেশের মহান দূত

খালেদ সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী | প্রকাশের সময় : ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

ইবনে বতুতার মতো মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) তার কর্মময় জীবনে অসংখ্য বার বিশে^র বহু দেশ সফর করলেও তার সফরনামা, এমনকি কোনো একটি সফরের বিবরণও তিনি লিপিবদ্ধ করেননি। সরকারি-বেসরকারি প্রতিটি বিদেশ সফরে অনেকে তার সফর সঙ্গী থাকতেন। তিনি নিজ উদ্যোগে অনেককে হজ¦ ও উমরা করিয়েছেন। বহু আন্তর্জাতিক ইসলামী সম্মেলনে বিশাল বিশাল প্রতিনিধি দল তার নেতৃত্বে অংশগ্রহণ করেছে। অনেক সমাবেশ-সম্মেলনে তিনি ভাষণ প্রদান করে দেশ ও জাতির পরিচয় তুলে ধরেছেন, সুনাম-খ্যাতি বৃদ্ধি করেছেন। তার সান্নিধ্যে এসে নানা পেশা ও শ্রেণির মানুষ বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ লাভ করেছে, যা ছিল অতুলনীয়। মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)-এর প্রতিভা, ব্যক্তিত্ব, মন্ত্রিত্ব বিশেষভাবে বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতিত্ব আন্তর্জাতিক অঙ্গণে তার ব্যাপক পরিচিতি ও খ্যাতি এনে দিয়েছিল। তিনি ব্যক্তি শোহরত বা সুনাম-খ্যাতির পাশাপাশি মুসলিম জাহানে স্বাধীন বাংলাদেশের নামও উজ্জ্বল করেছেন। বিশেষত মধ্যপ্রচ্যের আরব দেশগুলোর সর্বত্র মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) এক নামে পরিচিত ছিলেন।
জানা যায়, মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতি হওয়ার বহু পূর্বেই রাষ্ট্রীয় বা সরকারিভাবে মুসলিম বিশে^ এবং মুসলিম নেতৃবৃন্দের নিকট ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। আরবি ভাষায় পারদর্শী হওয়ায় তার প্রতি আরবদের দৃষ্টি বিশেষভাবে নিবদ্ধ হয়েছিল। পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশ আমলে এ দেশ সম্বন্ধে বিশেষ মহলের নানা বিভ্রান্তি ও অপপ্রচারের বিরুদ্ধে মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) তার জমিয়াত সংগঠনকে সঙ্গে নিয়ে যে ভূমিকা রাখেন, তা অবিস্মরণীয়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশেষত আরবদের সাথে বাংলাদেশের যোগাযোগ দৃঢ়করণে এ ভূমিকা ছিল সুদূরপ্রসারী।
১৯৬৫ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান ইসলামী উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হিসেবে কাজ করেন এবং ঢাকায় ইসলামী আরবি বিশ^বিদ্যালয় কমিশনের সদস্য হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, যার বিশদ বিবরণ রয়েছে ঢাকা সরকারি আলিয়া মাদরাসার সাবেক প্রিন্সিপাল ইয়াকুব শরীফের এক প্রবন্ধে। ১৯৬৮ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের দীর্ঘকালীন সেক্রেটারি মাওলানা উবায়দুল হকের (ফেনী) ইন্তেকালের পর মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)কে উক্ত সংগঠনের সর্ব সম্মতিক্রমে প্রথম সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। রাজনীতিতে পদার্পণ হতে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) এর বিভিন্নমুখী কর্ম তৎপরতা তাকে দেশের বাইরে মুসলিম জাহান পর্যন্ত সুপরিচিত করে তুলে। আরবদের সাথে অনর্গল আরবিতে কথা বলতে পারায় তিনি তাদের নিকট অত্যন্ত সম্মানের অধিকারী হন। পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ, সম্পর্ক উন্নয়ন ও জোরদার করার ক্ষেত্রে বেসরকারি পর্যায়ে বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতি হিসেবে মাওলানা এম এ মান্নানের গঠনমূলক ভূমিকা ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
বড়পীর হজরত আব্দুল কাদের জীলানী (রহ.)-এর নামে মনোরম স্থাপত্য শৈলীর অপূর্ব নিদর্শন হিসেবে রাজধানীর বুকে ‘মসজিদে গাউসুল আজম’ প্রতিষ্ঠা মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)-এর এক অনন্য অবদান। এটি কেবল বাংলাদেশ নয়, মুসলিম বিশে^র ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের বিশেষত ইরাকী মাশায়েখ-ওলামা ও নেতৃবৃন্দের দৃষ্টি কেড়ে নিতে সক্ষম হয়। এ দৃষ্টিনন্দন বিশাল মসজিদ কায়েম করে মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলামপ্রিয় মোমেন মুসলমানদের ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতির প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। এটি এখন বাংলাদেশের শিক্ষক-ছাত্রসহ মাশায়েখ-ওলামা এবং ধর্মপ্রাণ সাধারণ মুসলমানদের মিলনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে, যার সংলগ্নে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের স্থায়ী ‘কমপ্লেক্স’, সেখানে ইসলামের নানা বিষয়ের উপর গবেষণারও বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। তাই বলা যায়, মসজিদে গাউসুল আজম ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান অন্বেষণের এক অপূর্ব ইয়াদগার হিসেবে মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)-এর স্মৃতিধন্য প্রতিষ্ঠান রূপে দন্ডায়মান।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বেই মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) আন্তর্জাতিক অঙ্গণে নিজস্ব স্থান করে নিয়েছিলেন। ১৯৭৯ সালে তিনি পার্লামেন্ট নির্বাচনে বিপুল ভোটে সদস্য নির্বাচিত হন। তাকে সে সময় ‘দূত পুল’ সদস্য করা হয় এবং বহু মুসলিম দেশে তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৮১ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্টের মন্ত্রিসভায় তাকে শিক্ষা বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী করা হয়। ১৯৮৬ সালে মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) সংসদ নির্বাচনে তার নির্বাচনী এলাকা থেকে বিপুল ভোটে পুনরায় সদস্য নির্বাচিত হন এবং গঠিত মন্ত্রিসভায় তাকে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রী করা হয় এবং পরে তাকে একই সঙ্গে ত্রাণমন্ত্রীও করা হয়। তার গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার বিশদ বিবরণ এখানে সম্ভব নয়। শুধু দেশের সর্বত্র ত্রাণ সামগ্রী দ্রুত নিরাপদে বিতরণের জন্য তারই ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় ইরাক সরকারের কাছ থেকে সাময়িকভাবে ৭টি হেলিকপ্টর আনতে তিনি সক্ষম হয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক পরিম-লে বিশেষত মুসলিম বিশে^ মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) কত জনপ্রিয় ও সুখ্যাতির অধিকারী ছিলেন, এ থেকেই তা প্রমাণিত হয়।
১৯৭৬ সালে মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) জমিয়াতের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করার পর সংগঠন ও মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়নে এক মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং স্মারকপত্র হিসেবে আরবি ও ইংরেজিতে তা প্রকাশ করেন। সে সময় ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত আরব দূতাবাসগুলোতে তা প্রেরণ করেন, যাতে আরবরা বাংলাদেশ ও জমিয়াত সম্পর্কে অবহিত হতে পারে। ঢাকাস্থ আরব দূতাবাসগুলোর সাথেও মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)-এর যোগাযোগ সম্পর্ক বেড়ে যায়। ইতোমধ্যে ‘দৈনিক ইনকিলাব’ প্রকাশ করে মাওলানা সাহেব আরব ও আলমে ইসলামীর সম্পর্কে আরো একটি মাত্রা যোগ করেন এবং পত্রিকার মাধ্যমে আরব ও মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করতে থাকেন। ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকারের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে এবং তার পত্রিকার মাধ্যমে ইরান-ইরাক যুদ্ধ বন্ধ করে শান্তি স্থাপনের ওপর সর্বদা গুরুত্ব আরোপ করতে থাকেন। জমিয়াতও আরব মুসলমানদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে থাকে। মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) স্বাধীন বাংলাদেশকে আরবদের কাছে পরিচিত করার জন্য ঢাকাস্থ আরব দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত ও উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের জমিয়াতের পক্ষ হতে দাওয়াত করতে থাকেন। সউদি আরব, মিশর, লিবিয়া এবং ইরাক প্রভৃতি দেশের নাম এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
আবর বিশে^র সাথে স্বাধীন বাংলাদেশের কূটনৈতিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক, শ্রমশক্তি রফতানি ইত্যাদি বহুমাতৃক সম্পর্ক জোরদার হওয়ার সাথে সাথে মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)-এর সংগঠনের পরিচিতিও আরব বিশ^ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। আরব জাহানের নানা দেশে বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত বহু ইসলামী আন্তর্জাতিক সম্মেলনে পর্যবেক্ষক হিসেবে বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনও আমন্ত্রিত হতে থাকে। এসব সম্মেলন, মহাসম্মেলনে মাওলানা এম এ মান্নানের নেতৃত্বে বৃহদাকারের বহু প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ হতে যোগদান করে, যা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। অনেক সময় তার সফরসঙ্গীরা অবাক হয়ে যেতেন, এসব সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী মুসলিম দেশগুলোর শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সাথে মাওলানা এম এ মান্নানের ঘনিষ্ঠ পরিচয় এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রত্যক্ষ করে। তাদের মধ্যে রাষ্ট্র প্রধানসহ সরকারি, বেসরকারি পর্যায়ের উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন অনেকেই থাকতেন। তার সফরসঙ্গী এখনো যারা বেঁচে আছেন, তারাই তার প্রত্যক্ষ সাক্ষী। মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)-এর বহির্বিশে^ এরূপ প্রভাব, মর্যাদাকে রীতিমত বিস্ময়কর বলা যায়।
বহু আন্তর্জাতিক ইসলামী সম্মেলনে মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। এসব সম্মেলনে মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) বাংলাদেশ সম্পর্কে যেসব আরব নেতার ভ্রান্ত ধারণা ছিল, তা নিরসনে সফল হন। তার সফরসঙ্গীদের রচনাবলীতে বিক্ষিপ্ত কিছু কিছু তথ্য পাওয়া যায়। সেগুলো একত্রিত করলেও জানা যাবে যে, স্বাধীন বাংলাদেশের সুনাম বৃদ্ধিতে এবং এদেশ সম্পর্কে বিদেশিদের ভ্রান্ত ধারণাগুলো দূর করতে তার কতটা বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ