Inqilab Logo

শক্রবার ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ কার্তিক ১৪৩১, ০৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রাতের আঁধারে বন উজাড় করছে প্রভাবশালীরা

ফুলবাড়িয়ার বনাঞ্চলে অর্ধশত অবৈধ করাতকল

| প্রকাশের সময় : ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

শহিদুল ইমলাম, ফুলবাড়িয়া (ময়মনসিংহ) থেকে : ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার বনাঞ্চলে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে  উঠেছে কমপক্ষে শতাধিক অবৈধ করাতকল। এসব করাতকলে  প্রভাবশালী  বনখেকোদের দৌড়াত্ম্যের হিড়িক পড়েছে নির্বিচারে বন উজাড়ের। এদিকে সব দেখেও যেন প্রভাবশালীদের ভয়ে নিরুপায় হয়ে মুখে কুলুপ দিয়ে বসে থাকতে হয় বন বিভাগের বিটকর্মকর্তার। বন আইনে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ৮ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো কাঠ চেড়াই স’ মিল বা করাতকল অনুমতি বন বিভাগের না থাকলেও, প্রভাবশালী কাঠচোরদের অনেকেই সন্তোষপুর বন বিভাগসহ আশপাশের সংরক্ষিত বনাঞ্চল কেশ্বরগঞ্জ, বালুঘাট, শিবগঞ্জ, এনায়েতপুর, সোয়াইতপুর এলাকায় চিহ্নিত প্রভাবশালী কাঠ চোরেরা প্রায় শতাধিকেরও বেশি করাতকল গড়ে তুলেছে। যার একটিরও সরকারি কোনো অনুমোদন নেই বলে জানা গেছে। স্থানীয়রা জানান, কাঠচোরেরা রাতের আঁধারে বন বিভাগের লাগানো সামাজিক বনায়নের বনজ কাঠ কেটে বিভিন্ন যানবাহনযোগে স’ মিলে এনে প্রকাশ্যে এসব বনের কাঠ চেড়াই করছে। প্রতিটি স’ মিলে প্রচুর পরিমাণ বনের শাল, গজারি, সেগুন, আকাশমনি কাঠের স্তূপ পড়ে আছে। বনের গোল কাঠ সরাসরি পরিবহন করা ঝুঁকিপূর্ণ বিধায় কাঠ চেড়াই করে এসব কাঠ দেশের বিভিন্ন স্থানে ট্রাকযোগে পাচারসহ চড়া মূল্যে বিক্রি করে রাতারাতি কালো টাকার মালিক বনে যাচ্ছে স্থানীয় প্রভাবশালী বনখেকোরা। এছাড়া অবৈধ করাতকল মালিকরা ইটভাটায় মৌসুমি ইট পোড়ানো কাজে কয়লার পরিবর্তে কাঠের যে চাহিদা পূরণ করছে, তার সবটাই আসে বনের চোরাই কাঠ থেকে। এসব চোরাই কাঠের লাভের একটি অংশ চলে যাচ্ছে সংশিষ্ট বন কর্মকর্তাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পকেটে। অথচ এবিষয়ে বনবিট বিট কর্মকর্তার অভিযোগ, বিভাগীয় অফিস বারবার বিষয়টি জানালে আজ অব্দি এর কোনো সুরাহা করেনি। এবিষয়ে বন বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা আব্দুল কুদ্দুছ জানান, ফুলবাড়িয়ায় কি পরিমাণ করাতকল রয়েছে এ বিষয়ে সঠিক তথ্য আমাদের কাছে নেই। তবে বনাঞ্চলের ভেতরের অবৈধ করাতকলগুলো দ্রুত বন্ধের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া হবে। বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, কাগজে-কলমে ফুলবাড়িয়া উপজেলার সন্তোষপুর সংরক্ষিত বনাঞ্চল প্রায় ৪ হাজার একর বনের জায়গা থাকলেও বন উজাড় হয়ে যাওয়ায় বর্তমানে প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। অপরদিকে, এনায়েতপুর মৌজায় বন বিভাগের  সংরক্ষিত বন ঘোষণা করার পর ২ হাজার ৮শ’ একর জায়গা থাকলেও বিট কর্মকর্তার হিসেব মতে, বন বিভাগের হাতে জমি আছে মাত্র ১৫০ একর। বাকি জমি স্থানীয় প্রভাবশালীরা এবং বিভিন্ন দালাল চক্রের মাধ্যমে শুধু বনের জায়গাই না বরং বনে সামাজিক বনায়নের সৃজনকরা গাছশুদ্ধ দখল করে নিয়ে দেদার সেই গাছ কেটে বিক্রি করছে চোরাকারবারিরা। সরেজমিনে উপজেলার এনায়েতপুর ইউনিয়নের সোয়াইতপুর বাজারে গিয়ে দেখা যায়, বনাঞ্চলের পাশে স্থানীয় বনখেকো নুুরু মেম্বারের করাতকলে প্রচুর পরিমাণে বনের বিভিন্ন প্রজাতির গাছের স্তূপ। শ্রমিকরা তা চিড়াই করে ট্রাকে তুলে দিচ্ছে। পাশেই হোসেন মিয়া করাতকলে বন বিভাগের সিলমারা গাছ করাতকলে চিড়াই করছে। জানা যায়, করাতকলের মালিক নুরু মেম্বার নিজেও বন বিভাগের জায়গা দখল করে বসে আছে। উপজেলার সোয়াইতপুর বাজারের অবৈধ করাতকল মালিক নুরু মেম্বার দম্ভ করে বলেন, আমার করাতকলের কোনো লাইসেন্স লাগেনা, সারাদেশে সবজায়গায় এইভাবেই করাতকল চলে, তাই আমিও চালাই। আর গাছ আমি আমার টেকা দিয়ে গেরস্থের কাছ থেকে কিনে বেচাকেনা করি তাতে কার কি! দক্ষিণাঞ্চলীয় অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি ফুলবাড়িয়ার সন্তোষপুর বনাঞ্চল। ঐতিহাসিক ভাওয়াল মধুপুর গড়ের সাথে সম্পৃক্ত এ বনাঞ্চল একসময় উদ্ভিদ ও প্রাণীকুল রক্ষায় ছিল দক্ষিণ ময়মনসিংহের এক অনন্য ভাস্কর। বয়োবৃদ্ধসহ বিভিন্ন লোকমুখে শোনা যায়, এ বনাঞ্চলে একসময় বন্য হাতি ছাড়াও দুর্লভ অনেক বন্যপ্রাণীর বসবাস ছিল। কালের বিবর্তন, অবৈধ দখল, অসাধু বন কর্মকর্তাদের হেয়ালিপনা, বনদস্যুদের অবাধে বনজ গাছ কাটার ফলে বিশাল বনাঞ্চল প্রায় রূপান্তর হয়েছে সমতল ভূমিতে। সংরক্ষিত বনাঞ্চলের সাথে সৃজিত বনাঞ্চল এবং রাবার বাগান। বনের কাঠ উজাড়ের পাশাপাশি বাগানের রাবার অবাধে পাচার করে লাভবান হয়েছে রাবার চোর সিন্ডিকেট। বার বার গাড়িভর্তি রাবার জনতা এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে ধরা পড়েছে। এ নিয়ে মামলা, হাজতবাস এমনকি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা উৎকোচের বিনিময়ে ছেড়েও দিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। মামলা হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এ সকল বনদস্যুরা আদালতের মাধ্যমে ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। বনধ্বংসকারী অনেকের বিরুদ্ধে ৫ থেকে শুরু করে শতাধিক বন মামলা থাকার পরও এ সকল প্রভাবশালী কাঠচোরের দল দিব্যি ঘুরেও বেড়াচ্ছে। এ ব্যাপারে এনায়েতপুর বিট কর্মকর্তা মো. নুরুল ইসলামের সাথে কথা বললে তিনি স’মিলের বিষয়ে বলেন, আমি এই বিটের দায়িত্ব নিয়েছি মাত্র কয়েক মাস, এখানে এসে দেখি বনের জমির সুকিভাগ বনের দখলে নেই, আমার থাকার মেসে চলে অফিসের কার্যক্রম। আমার বনের জায়গা থেকে গাছ কেটে বনদস্যুরা ট্রাক-ভ্যানে করে নিয়ে যায় করাতকলে চিড়াই করে অথচ আমি এসব বাধা দেব আমার সেই ক্ষমতা নেই। স্থানীয় ভূমিদস্যু আর লোভী বনখেকোদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে এইএনায়েতপুর বনবিট এলাকা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ