Inqilab Logo

শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১, ০১ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

কক্সবাজারের মায়ানমার সীমান্তে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত পাহাড়ী অরণ্য যেন সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য, মুক্তিপণেই মেলে অপহৃতদের মুক্তি

উখিয়া উপজেলা সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ১২ জানুয়ারি, ২০২৩, ১২:২২ পিএম

কক্সবাজারের সীমান্তবর্তী উখিয়া টেকনাফের পাহাড়ী অরণ্য সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিনত হয়েছে। অভিনব কৌশলে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা (অনেক সময় স্থানীয় দুষ্কৃতকারীদের সহায়তায়) স্থানীয় বাসিন্দাদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করছে । এই অপহরণ-বাণিজ্য ঘিরে সক্রিয় অন্তত ১০ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। অপহরণের পর উখিয়া টেকনাফের গহীন অরণ্যঘেরা পাহাড়ে তাদের আস্তানায় নিয়ে নির্যাতন করে মুক্তিপণ আদায় করছে তারা। এ নিয়ে গত ৪ মাসে মোট ৩১ জনের অপহরণের ঘটনা ঘটলেও অন্তত ১০০ জনের উপরে স্থানীয় ও রোহিঙ্গাদের অপহরণ করেছে সন্ত্রাসীরা। তবে স্থানীয়দের সংখ্যাই শতকরা ৭০ জন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

টেকনাফের বাহারছাড়া, হ্নীলা ও হোয়াইক্যং ইউনিয়নে অপহরণ বাণিজ্য এখন নিত্যদিনের ঘটনা। অনেক পুর্বে উখিয়ার কুতুপালং ও বালুখালী ক্যাম্পেও অপহরণের ঘটনা ঘটলেও এখন তেমন হয়না বললেই চলে। তবে টেকনাফে একের পর এক ঘটনা ঘটলেও কারা এহেন অপহরণ চক্রে জড়িত তা নিশ্চিত করতে পারেনি আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও অন্যান্য সংস্থার সদস্যরা । ফলে এক প্রকার ধরাছোঁয়ার বাইরে অপহরণকারীরা। অপহরণের পর নির্যাতিত হয়ে, পরিবারের কাছে প্রেসার প্রয়োগ করে মুক্তিপণ আদায় করে ছেড়ে দিচ্ছে ভুক্তভোগীদের। এ যেন অলিখিত অপহরণ বাণিজ্য। ফেরত আসা ব্যক্তিরা নিজের, পরিবারের সদস্যদের প্রাণনাশের ভয়ে অপহরণকারীদের সম্পর্কে কিছু বলছেন না বলে সুত্রে জানা যায়। ফলে জনমনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, এসব অপহরণের ঘটনায় কারা জড়িত?
সুত্রে জানা যায়, এসব অপহরণ বাণিজ্য ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরাই জড়িত। পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এসব অপহরণের ঘটনায় অন্তত ১০টি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী কাজ করছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও রাষ্ট্রীয় অন্যান্য বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানের মুখে গহীন অরণ্য ঘেরা পাহাড়ে অবস্থান নেয় এসব সন্ত্রাসীরা। অর্থের সংস্থান পেতে স্থানীয় লোকজনের ঘরবাড়িতে লুটপাট ও লোকজনকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ে নেমেছে তারা। এরই মধ্যে এসব গোষ্ঠীর অনেকের নামের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তারা হলো—জাহেদ হোসেন (৩৩), শফি উল্লাহ (৩২), আবু হুরায়রা (৩৬), আবুল বশর (৩০), মকবুল আহমদ (৩০), মো. রুবেল (২২), আব্দুর রহমান (৩২), মো. ফিরোজ (৩৫), আবু ছিদ্দিক (২৮), মো. হোসেন ওরফে মাছন (৪৫), আয়াতুল তমজিদ (২৫), সিরাজুল মাঝি ওরফে বার্মাইয়া সিরাজ (৩৫), মো. ইসমাইল (২৪), জয়নাল (৩০), ফরিদ আহাম্মদ (৪০), ওসমান গণি (২০), ফরিদ আহমদ (২৬), মো. হাছন (৩৮), শহিদ উল্লাহ (২৫), মো. রিয়াজ (২২), মিজানুর রহমান (২৫), নুর মোহাম্মদ (৩৫), মনির আহাম্মদ (৩০) ও মোহাম্মদ আলী (২২)। তাদেরকে গ্রেফতারের চেষ্টা চালাচ্ছে পুলিশ।
ভুক্তভোগী, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয়রা বলছেন, প্রায় সময়ই রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের হাতে কেউ না কেউ অপহরণের শিকার হন। অপহরণের আগে তারা রেকি করে, কাকে কোথায় থেকে অপহরণ করবে, সে পরিকল্পনা করে। এরপর সুযোগ বুঝে নির্দিষ্ট সময়ে অপহরণ করে নিয়ে যায়। মাঝেমধ্যে দিনদুপুরে অস্ত্রসহ দলবল নিয়ে পাহাড় থেকে এসে স্থানীয়দের ধরে নিয়ে যায়। পরে পাহাড়ের আস্তানায় আটকে পরিবারকে মুক্তিপণের জন্য ফোন দেয়। অনেক পরিবার ধারদেনা, গরু-ছাগল ও ভিটেমাটি বিক্রি করে মুক্তিপণ দিয়ে স্বজনদের ছাড়িয়ে আনছেন। মুক্তিপণ না দিলে চলে ভয়াবহ নির্যাতন। তাদের কাছে রয়েছে ল্যাপটপ, কম্পিউটার ও আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন নানা ডিভাইস।

সর্বশেষ গত ৮ জানুয়ারি সকালে হ্নীলা ইউনিয়নের লেচুয়াপ্রাং এলাকা থেকে চার কৃষককে অপহরণ করে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। তারা হলেন লেচুয়াপ্রাং গ্রামের আবদুস সালাম, আবদুর রহমান এবং দুই ভাই মুহিব উল্লাহ ও আবদুল হাকিম। এর মধ্যে মঙ্গলবার রাতে হ্নীলা পাহাড়ি এলাকা থেকে তিন জন ছয় লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে এসেছেন বলে জানিয়েছেন। বুধবার (১১ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় আবদুস সালাম ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেয়েছেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছে আবদুস সালামের পরিবার।
এর আগে গত ১৮ ডিসেম্বর-২২ বিকালে টেকনাফের জাহাজপুরা পাহাড়ের খালে মাছ ধরতে গেলে কলেজশিক্ষার্থীসহ আট জনকে অপহরণ করে পাহাড়ে নিয়ে যায় রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। পরে নির্যাতনের শিকার হয়ে তিন দিন পর ছয় লাখ ৪০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পান তারা। এদের মধ্যে মুক্তিপণ দিয়ে ফেরত আসা একজন নুরুল আবছার। তিনি বলেন, ‘মুক্তিপণের জন্য আমাদের যে ধরনের নির্যাতন করা হয়েছিল, তা অবর্ণনীয়। এখনও আমার পুরো শরীর ব্যথা। ঘুমের মধ্যে শিউরে উঠি। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা খুব ভয়ঙ্কর। মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখেছি। তাদের কাছে ল্যাপটপসহ বিভিন্ন প্রযুক্তি আছে। তাদের বড় নেটওয়ার্ক রয়েছে। পাহাড়ে থাকলেও সব খবর রাখে তারা।’
অপহরণের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও জনপ্রতিনিধিরা আমাদের উদ্ধারে গেলে নির্যাতন বাড়িয়ে দেয় জানিয়ে নুরুল আবছার বলেন, ‘আমাদের হাত-পা ও চোখ-মুখ বেঁধে মারধর করা হয়। মুক্তিপণ আদায়ে যত ধরনের নির্যাতন আছে, সবগুলো প্রয়োগ করেছে তারা। অভিযানের কারণে যদি মুক্তিপণ না পায় তখন হত্যার হুমকি দিয়ে অপহৃতদের ছেড়ে দেয়।’
পুলিশ ও অপহৃতদের পরিবারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, টেকনাফে গত সেপ্টেম্বর থেকে ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত ৫২টি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ১২টি অপহরণের বিষয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ দিয়েছে ভুক্তভোগীদের পরিবার।
ভুক্তভোগী কয়েকজনের পরিবার জানায়, বেশিরভাগ ঘটনায় অপহরণকারীদের সঙ্গে দফারফা শেষে মুক্তিপণ দিয়ে অপহৃতদের ছাড়িয়ে এনেছেন স্বজনরা। পুলিশের কাছে অভিযোগ দিয়েও অপহৃতরা উদ্ধার না হওয়ায় মুক্তিপণ দিতে বাধ্য হয়েছেন তারা।
অহরহ অপহরণের ঘটনায় স্থানীয় বাসিন্দারা আতঙ্কে রয়েছেন উল্লেখ করে হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী বলেন, ‘আমরা সবাই আতঙ্কে আছি। গত কয়েক মাসে আমার এলাকায় ২০টির মতো অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। এদের সবাই মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে এসেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিষয়টি জানালেও কোনও ব্যবস্থা নেয়নি।’
পুলিশকে জানালে কিংবা মুক্তিপণ দিতে দেরি হলে অপহৃতদের ওপর রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা নির্যাতন বাড়িয়ে দেয় উল্লেখ করে চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী বলেন, ‘৮ জানুয়ারি আমার এলাকার চার কৃষককে অপহরণ করা হয়। তাদের উদ্ধারে আমরা পাহাড়ে যাই। খবর পেয়ে অপহৃতদের ওপর নির্যাতন বাড়িয়ে দেয় রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। ওই সময় সন্ত্রাসীরা আমাদের বলেছিল, “এখানে পুলিশ ও জনপ্রতিনিধির কাজ কি? এরপর এখানে এলে অপহৃতদের হত্যা করে লাশ গুম করে দেওয়া হবে। তাদের নির্মূল করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যৌথ অভিযানের বিকল্প নেই।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তির সমন্বয়ে কয়েকটি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী গঠিত হয়েছে। বর্তমানে এসব গোষ্ঠী টেকনাফের উনচিপ্রাংয়ের জুম পাহাড়, মিজ্জির পাহাড় ও গহীন অরণ্যে অবস্থান করছে। সেখানে আস্তানা গড়ে রোহিঙ্গা ও স্থানীয় বাসিন্দাদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করে যাচ্ছে। একইসঙ্গে মাদক ও মানব পাচার চালিয়ে যাচ্ছে। এসব কাজে তথ্যপ্রযুক্তি ও ভারী অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করছে তারা। এ পর্যন্ত শতাধিক ব্যক্তিকে অহপরণ করেছে। যাদের বেশিরভাগ মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে এসেছেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ