Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

খালি হাতে ফিরছেন বেশিরভাগ মানুষ

ওএমএসের দীর্ঘ লাইন

অর্থনৈতিক রিপোর্টার : | প্রকাশের সময় : ১৩ ডিসেম্বর, ২০২২, ১২:০১ এএম

সোমবার বেলা ১১টা। মিরপুর-২ এলাকার ওএমএসের একটি ট্রাকের লাইনের সামনে শতাধিক নারী-পুরুষের জটলা। তারা সবাই খাদ্য অধিদফতরের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় ওপেন মার্কেট সেলের (ওএমএস) চাল ও আটা কিনতে এসেছেন। অধিকাংশই বৃদ্ধ। ভিড় ঠেলে শক্তি প্রয়োগ করে যারা সামনে যেতে পারছেন, তারাই জয়ী হচ্ছেন। অনেকে ভিড়ের মধ্যে পড়ে যাচ্ছেন। তবু সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন চাল-আটা কিনতে। সরেজমিনে গতকাল সকালে এমন ভিড় চোখে পড়ল।
মিরপুর-১১ এলাকার একটি বস্তির বাসিন্দা ইউসুফ বিশ্বাস। গতকাল সকাল পৌঁনে ৭টায় তিনি এসে দাঁড়ান মিরপুর-২ এলাকার ওএমএসের একটি ট্রাকের লাইনে। দীর্ঘ সাড়ে চার ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে শেষমেষ লাইনের পাশে বসে পরেন তিনি। তার দেখাদেখি দিনমজুর শাহজাহান মৃধাও লাইনে বসে পড়েন। ইউসুফ বিশ্বাস বাসাবাড়িতে রংমিস্ত্রির কাজ করেন। কয়েক মাস আগে তিনি অটো দুর্ঘটনায় কোমরের হাড়ে ব্যথা পেয়েছেন। এ কারণে নিয়মিত কাজ করতে পারেন না তিনি। তার মেয়ে পুঁথির মালা বিক্রি করে মাসে হাজার তিনেক টাকা আয় করেন। সব মিলিয়ে মাসে প্রায় ১৩-১৫ হাজার টাকায় চলে ইউসুফ বিশ্বাসের পাঁচ সদস্যের সংসার।
জানতে চাইলে ইউসুফ বিশ্বাস বলেন, আগে তো এ রকম লাইনে আসতাম না। কিন্তু অভাবের কারণে পড়ে দুই তিন মাস ধরে এখানে আসতে হচ্ছে। কোমরে ব্যথার জন্য দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না। মাঝেমধ্যে বসে বিশ্রাম নিতে হয়।
একই এলাকায় ওএমএসের ট্রাকের লাইনে দাঁড়ান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সরকারি কর্মচারি। তিনি জানান, বাজারে আটার দাম বেড়ে যাওয়ার পর গত দুই মাস যাবৎ ওএমএসের ট্রাক থেকে পণ্য কিনছেন তিনি। সপ্তাহে একদিন দুই ঘণ্টার জন্য ছুটি নিয়ে এসে লাইনে দাঁড়ান। তিনি বলেন, এখানে দুই কেজি আটার প্যাকেট কিনতে পারি ৫৫ টাকায়, বাজারে যার দাম ১৫০ টাকা। নিরুপায় হয়েই এখানে আসি। আরো বেশ কয়েকজন সরকারি কর্মচারিও ওএমএসের ট্রাক থেকে পণ্য কিনেন বলে জানালেন তিনি।
কয়েক ঘণ্টা পর ওএমএসের চাল আটা কিনতে পারলেন গোলাপী খাতুন। ততক্ষণে পাঁচ বছরের ছেলেটিক্ষুধার জ্বালায় কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছে। চাল পাওয়ার পর ফুটপাতে বসে ছেলের কান্না থামানোর চেষ্টা করছেন।
লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা একাধিক নারী-পুরুষ জানান, তাঁদের বেশির ভাগই সকাল ছয়টা থেকে সাতটার মধ্যে চলে আসেন। তখন থেকে লাইনে ওএমএসের পণ্যের জন্য অপেক্ষা করেন। নির্ধারিত ওই স্থানে সকাল নয়টার দিকে দোকান খোলা হলে সবাই একসঙ্গে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। যে বেশি জোর খাটাতে পারে, সেই জয়ী হয়।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা বলছে, বস্তিবাসী মানুষের আয়ের প্রায় অর্ধেক চলে যায় ঘরভাড়ায়। এর মধ্যে কড়াইল বস্তিতে বসবাসকারীদের আয়ের প্রায় ৬৬ শতাংশ ব্যয় হয় বাসাভাড়া বাবদ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নিত্যপণ্যের বাড়তি দাম।
এ ছাড়া বেসরকারি সংগঠন পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (বিআইজিডি) গত জুনের অন্য আরেক জরিপে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় ২১ লাখ মানুষ নতুন করে গরিব হয়েছে। আর মাসে অন্তত এক দিন বস্তিবাসীর ৫ শতাংশ মানুষ অভুক্ত থাকে।
এদিকে প্রতিনিয়ত ওএমএসের ট্রাকের সামনে মানুষের সারি দীর্ঘ হচ্ছে। পাশাপাশি পণ্য কিনতে না পেরে বহু মানুষ খালি হাতেও ফিরছেন। সরেজমিনে দেখা গেছে, বেশিরভাগে এলাকায় ওএমএসের ট্রাকে দুপুরেই আটা বিক্রি শেষ হয়ে যায়। আর বিকেল চারটা পর্যন্ত চলে চাল বিক্রি। তবে শেষ পর্যন্ত অনেকেই চাল-আটা কোনোটাই না পেয়ে খালি হাতে ফিরে যান।
গত এক মাসে ঢাকা শহরের বেশ কয়েকটি এলাকায় ওএমএসের ট্রাকে পণ্য বিক্রি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষার পরও প্রায় প্রতিটি ট্রাক থেকে পণ্য না পেয়ে খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষকে। এ অবস্থায় রাজধানীতে ওএমএসের ট্রাকের সংখ্যা ২০টি বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ৭০টি ট্রাকে করে ওএমএসের পণ্য বিক্রি হচ্ছে।
জানতে চাইলে ওএমএসের দায়িত্বে থাকা ঢাকা রেশনিং দফতরের প্রধান নিয়ন্ত্রক সুরাইয়া খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, আগে তো এত লোক হতো না। এখন প্রতিদিনই লোক বাড়ছে। তাই ওএমএসে চাল ও আটার বরাদ্দ বাড়াতে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করব।
বাজারে চাল ছাড়া আটা, ময়দা, ডাল, চিনি, সয়াবিনসহ প্রায় সব নিত্যপণ্যের দাম চড়া। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে নিত্যপণ্যের বাজার অস্থির। লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে পণ্যের দাম। তাতে গত আগস্টে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১৩৫ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে উঠে যায়। অবশ্য নভেম্বরে তা কিছুটা কমে ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। তবে বাজারে এখনো স্বস্তি নেই।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ