Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

খুলনায় প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর নির্মাণে পুকুর চুরি, ভেঙে ফেলা হচ্ছে ২০ টি ঘর

খুলনা ব্যুরো | প্রকাশের সময় : ৩ ডিসেম্বর, ২০২২, ৭:৩৬ পিএম

মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে খুলনার ফুলতলা উপজেলার গৃহহীন ও ভূমিহীনদের জন্য আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় নির্মাণাধীন ঘরে নিম্নমানের উপকরণ ও নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার এবং সিডিউল বহির্ভূতভাবে ঘরগুলো তৈরীর ঘটনা ঘটেছে। অভিযোগ উঠেছে অর্থ লোপাটের। শেষ পর্যন্ত ঘরগুলো ভেঙে ফেলা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার নিজ খরচে পুনরায় ঘর তৈরি করে দিয়ে ঘটনার দায় এড়ানোর চেষ্টা করছেন। এদিকে, এসব অনিয়মে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাদিয়া আফরিন (সদ্য বদলীকৃত) সরাসরি জড়িত বলে অনেকেই মনে করছেন। কয়েকদিন আগে অভিযুক্ত এই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে যশোরের কেশবপুর উপজেলায় বদলি করে দেয়া হয়েছে। অসহায় ভূমিহীনদের জন্য খোদ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এমন একটি মহতী প্রকল্পে অনিয়ম দূর্ণীতির যথাযথ তদন্ত ও জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন এলাকার মানুষ।

সূত্র জানায় খুলনার ফুলতলা উপজেলার দামোদর ও আলকা মৌজায় আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় ২০২২-২৩ অর্থ বছরের ২ কোটি ৭৪ লাখ ৪৭ হাজার ৫০০ টাকা ব্যয়ে ২ দশমিক ৬৬ একর জমি কেনা হয়। কেনা জমিতে গৃহহীন ও ভূমিহীন ৭০টি পরিবারের আবাসনের জন্য ২ শতাংশ জমিসহ ৭০টি ঘর নির্মাণের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়। নকশা অনুযায়ী সাড়ে ১৯ ফুট ও ২২ ফুট ৮ ইঞ্চি আকারের দুই রুম বিশিষ্ট মুল ঘরের সাথে বারান্দা, রান্নাঘর ও টয়লেট থাকার কথা। এর জন্য ২ লাখ ৮৪ হাজার ৫০০ টাকা ছাড়াও মালামাল পরিবহনের জন্য অতিরিক্ত ৫ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের ৯ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রকল্পে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সভাপতি, এসিল্যান্ড, উপজেলা প্রকৌশলী ও সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সদস্য এবং উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সদস্য সচিব হিসাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত। প্রকল্প সভাপতি তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাদিয়া আফরিন কর্তৃক বোরহান ট্রেডার্সের মালিক ফুলতলার বুড়িয়ারডাঙ্গা গ্রামের শেখ বোরহান উদ্দিন নির্মাণ কাজের দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। সদ্য বিদায়ী ইউএনও সাদিয়া আফরিনের তত্ত্বাবধানে গত ১ নভেম্বর ৪র্থ পর্যায়ের ঘরের নির্মাণ শুরু হয়। ইতোমধ্যে ২০টি ঘরের গাথুনি ও পলেস্তারা শেষ হয়ে ১০টি ঘরের লিনটন পর্যন্ত এবং ৫টি ঘরের গ্রেটবীমের ঢালাই সম্পন্ন হয়েছে। গত মঙ্গলবার নবাগত ইউএনও খোশনূর রুবাইয়াৎ আশ্রয়ণ প্রকল্পের নির্মাণাধীন ঘর পরিদর্শনে গিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে রডের ব্যবহার দেখার উদ্দেশ্যে একটি গ্রেটবীম ভাঙ্গতে নির্দেশ দেন। হাতুড়ি দিয়ে সামান্য আঘাত করতেই ঢালাই ভেঙে হয়ে বীমের ভিতরের রড বেরিয়ে আসে। এসময় দেখা যায় ১২ মিলিমিটিার রডের পরিবর্তে ১০ মিলিমিটার রড এবং ৬ ইঞ্চি দূরত্বের রিং আড়াই ফুট দূরত্বে গাথার বিষয়টি বের হয়ে আসে। ঠিক একই অবস্থা পিলার ও অন্যান্য লিনটনে। তাৎক্ষণিকভাবে তিনি নির্মাণ কাজ বন্ধের নির্দেশ দেন।

এর আগে, নির্মাণাধীন ঘরে নিম্নমানের ইট, খোয়া ও বালু ব্যবহার হচ্ছে এমন অভিযোগের ভিত্তিতে গত ১৩ নভেম্বর খুলনা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) পুলক কুমার মন্ডল সরেজমিনে এসে কাজ পরিদর্শন করেন। পরদিন ১৪ নভেম্বর বিকালে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোঃ শহিদুল ইসলাম ঘরের কাজের অগ্রগতি ও নির্মাণ কাজ দেখতে আসেন। নির্মাণ সামগ্রী ও কাজের ব্যপারে ওই সময়ের প্রকল্প সভাপতি ইউএনও সাদিয়া আফরিন নিম্নমানের ইটের কথাটি স্বীকার করে জানান, খারাপ ইট ফেরত দিয়ে ভালো ইট আনা হয়েছে। এ সময় কাজের মান নিয়ে উপস্থিত সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার বলেন, নির্মাণ কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোন মন্তব্য করা যাবে না।

এদিকে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, শুক্র ও শনিবার সরকারি ছুটির দিনে ঠিকাদারের নিজস্ব লোকেরা প্রহরায় গোপনীয়তার সাথে নির্মাণ শ্রমিকদের শাবল ও হাতুড়ির মাধ্যমে নির্মাণাধীন কিছু সংখ্যক ঘরের পিলার, লিনটন ও গ্রেটবীম ভাঙ্গতে দেখা গেছে। তবে ঠিকাদারের নিযুক্ত লোকের বাধার মুখে সাংবাদিকেরা ছবি না তুলেই স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। পাশর্^বর্তী বাসিন্দা মাকিদ সরদার বলেন, সঠিক তদারকির অভাবে নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী এবং পরিমানের তুলনায় কম নির্মাণ সামগ্রী দিয়ে ঘর গুলো তৈরী করা হচ্ছে। আবার নির্মাণ কাজ চলার সময় আশপাশের কোন লোককে প্রকল্পের ধারে কাছে আসতে দেয়া হয় না।

প্রকল্পের সদস্য উপজেলা প্রকৌশলী ইয়াছিন আরাফাত বলেন, প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার আগে থেকেই ফাউন্ডেশনের ট্রেনিং এ বাইরে ছিলাম। যে কারণে কাজের বিষয়ে আমার কিছুই জানা নেই। গত সপ্তাহে কর্মস্থলে যোগদান করেছি। চলতি সপ্তাহে কমিটির মিটিং এবং কাজের দেখভাল করা হবে। প্রকল্পের সদস্য সচিব ও উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোঃ রফিকুল ইসলাম বলেন, প্রকল্প সভাপতি ইউএনও সাদিয়া আফরিন কমিটির মিটিং ছাড়াই এমনকি আমাকে বাদ দিয়েই মৌখিকভাবে ঠিকাদার নিয়োগ দিয়েছেন। তিনি এবং ঠিকাদার মিলেই নির্মাণ সামগ্রী ক্রয়সহ সকল কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন।

সদ্য বিদায়ী ইউএনও সাদিয়া আফরিন মুঠোফোনে বলেন, মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে সকল ঘর নিয়ম মাফিক ও মানসম্মত ছিল। বদলি হয়ে আসার পর নির্মাণের বিষয়টি কেমন হয়েছে আমার জানা নেই। ঠিকাদার নিয়োগের বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, নির্ধারিত কমিটি যাচাই বাছাই করে মালামাল কিনেছে।

প্রকল্পের কথিত ঠিকাদার শেখ বোরহান উদ্দিন নির্মাণ কাজের অনিয়মের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, আমার অনুপস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট শ্রমিক ও মিস্ত্রীদের ভুলে কাজে সঠিক নিয়ম রক্ষা করা হয়নি। সে কারণে নিজের দায়িত্বে কিছু ঘরের অংশ বিশেষ ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে।

এ ব্যাপারে বর্তমান প্রকল্প সভাপতি ও নবাগত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খোশনূর রুবাইয়াৎ বলেন, বিষয়টি খোঁজখবর করা হচ্ছে। এখনই কোনো মন্তব্য করা সম্ভব হচ্ছে না।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ