Inqilab Logo

সোমবার, ০১ জুলাই ২০২৪, ১৭ আষাঢ় ১৪৩১, ২৪ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

অসহায় মুক্তিযোদ্ধা মেঘনাদের আর্তনাদ কেউ শোনে না

| প্রকাশের সময় : ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মো. আবুল খায়ের, পীরগঞ্জ (রংপুর) থেকে : স্বাধীনতার পর ৪৫ বছর অতিবাহিত হলেও বীর মুক্তিযোদ্ধা মেঘনাদ বর্মনের (৭৫) আর্তনাদ কেউ শুনতে পায়নি। জীবিকার প্রয়োজনে এই বৃদ্ধ বয়সেও হোটেল শ্রমিকের কাজ করে সংসারের ঘানি টানছেন তিনি। সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পীরগঞ্জ  উপজেলার ভে-াবাড়ি ইউনিয়নের বিশলা গ্রামের মৃত ধনীরাম বর্মনের পুত্র শ্রী মেঘনাথ বর্মণ (৭০) দেশমাতৃকার টানে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন। দেশকে শত্রুমুক্ত ও স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে স্ত্রী, ৩ কন্যা, ১ পুত্র ও বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে রেখে ভারতে গিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে। ১৩নং সেক্টরের অধীনে কমান্ডার আবু সাঈদ-এর নেতৃত্বে জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েন পাক হানাদার বাহিনীর উপর। যুদ্ধ করেন দুপচাঁচিয়া, ক্ষেতলাল, আদমদিঘী, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, হিলির খাংগুর হাটখোলা ও সৈয়দপুরে। সৈয়দপুরে পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে তার ৩ সহযোদ্ধা শহীদ হন। মেঘনাথ বর্মন নিজেও বাম পায়ের উরুতে গুলিবিদ্ধ হন। পরে সহযোদ্ধাদের সহায়তায় ভারতের রায়গঞ্জ হাসপাতালে ২৩ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর সুস্থ হয়ে পুনরায় যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি। এখনো যুদ্ধের সেই ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলেন মেঘনাথ। দেশ শত্রুমুক্ত ও স্বাধীন হওয়ার পর বিজয় উল্লাসে দিনাজপুর ক্যাম্পে অস্ত্র জমা দিয়ে নিজ বাড়িতে চলে আসেন। অক্ষরজ্ঞানহীন, সহজ-সরল এই বীর মুক্তিযোদ্ধা কখনোই কল্পনা করেননি যে, যুদ্ধের পর ক্যাম্পের ছাড়পত্রটি একদিন কাজে আসবে। অযতœ অবহেলায় এক সময় ছাড়পত্রটি নষ্ট হয়ে যায়। মেঘনাথ বর্মনের পৈতৃক সম্পত্তি বলতে শুধু ৩ শতক বাড়ির ভিটেমাটি। অনেক কষ্টে সংসারে স্ত্রী, পুত্র ও পিতা-মাতাসহ ৮ জনের ভরণ-পোষণ করতে হচ্ছে তাকে। রোজগার বলতে তার দিনমজুরি। আর্থিক সংকটের কারণে কোনো ছেলেমেয়েকে স্কুলে পাঠাতে পারেননি। মানুষের কাছে সাহায্য নিয়ে ৩ মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ছেলেও বিয়ে করে আলাদা সংসার করছেন। এখন মেঘনাথ বর্মন বয়সের ভারে ন্যুয়ে পড়েছেন, আগের মতো আর কাজকর্ম করতে পারেন না। শরীরে যখন শক্তি ছিল তখন একাই দিনমজুরি করে ৮ সদস্যের সংসারের ঘানি টেনেছেন। কিন্তু এখন স্বামী-স্ত্রী দুজনের খাবারই সংগ্রহ করতে পারেন না তিনি। ফলে এই বীর মুক্তিযোদ্ধার দিন কাটছে অনাহারে ও অর্ধাহারে। বেঁচে থাকার তাগিদে বৃদ্ধ বয়সেও ভে-াবাড়ি বন্দরের একটি হোটেলে শ্রমিকের কাজ করছেন। সেখানেও ঠিকভাবে কাজ করতে না পারায় সারাদিন মালিকের অনেক বকাঝকা শুনতে হয়। মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট দিয়ে অনেকের অনেক সরকারি চাকরি হয়েছে, কিন্তু মেঘনাথ বর্মনের সরকারি গেজেটে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থাকা সত্ত্বেও তিনি সার্টিফিকেট পাননি অজ্ঞাত এক রহস্যজনক কারণে। সার্টিফিকেট সংগ্রহের জন্য তিনি বছরের পর বছর থানা, জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার, মুক্তিযোদ্ধা হেড কোয়ার্টার, রাজশাহী ও ঢাকায় ধরনা দিয়েছেন। স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৫ বছরেও এই বীর মুক্তিযোদ্ধার করুণ আর্তনাদ কারো কানে পৌঁছায়নি। দুঃখে ও ক্ষোভে অশ্রুভেজা নয়নে বলেন, “এদেশে টাকার বিনিময়ে হাজার হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকিট পেয়েছেন, এমনকি শত শত রাজাকারও মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকিট নিয়ে ঘুরছে বীরদর্পে। বাঁচব আর কতদিন, মরার আগেও যদি সরকারিভাবে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিটুকু পাই তবে মরেও শান্তি পাব।” এব্যাপারে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল মমিন আকন্দ-এর সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, যুদ্ধ না করেও অনেকেই মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট বাগিয়ে নিয়েছেন। আবার অনেকে যুদ্ধ করেও মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট হাতে পাননি। সঠিকভাবে তদন্ত করে সারাদেশে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রণয়ন করা উচিৎ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ