Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উল্লাপাড়ায় ফসলি জমির মাটি যাচ্ছে ইটভাটায়

| প্রকাশের সময় : ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

জয়নাল আবেদীন জয়, উল্লাপাড়া (সিরাজগঞ্জ) থেকে : যেদিকেই তাকানো যায়। মাঠের পর মাঠ সরিষা ফুলের সমারোহ। শীতের দিনে বেলা বাড়ার সাথে সাথে মিষ্টি রোদে সরিষা ফুলের হলুদ আগুন যেন ক্রমান্বয়ে বাড়ছেই। হদুলের চাদরে ঢাকা শস্য ভা-ার খ্যাত চলনবিলের দিগন্তজোড়া বিস্তীর্ণ মাঠের পর মাঠ। প্রকৃতির সাথে এই হলুদের লুকোচুরি যে কারো মনকে কেড়ে নেবে মুহূতেই। কিন্তু এই সুন্দরের সৃষ্টি যে উর্বর মাটিতে নির্বিচারে তা পুড়ে আঙ্গার হচ্ছে ইটভাটার দগ্ধ আগুনে। এমনিভাবে প্রতিদিন উল্লাপাড়ার মাঠের পর মাঠ উর্বর ফসলি জমির মাটি পুড়ছে প্রায় ৩০টির মতো ইটভাটায়। প্রতিদিন প্রকাশ্য ফসলি জমির মাঠ থেকে উর্বর মাটি কেটে নেয়ায় আবাদি জমি পরিণত হচ্ছে পুকুর ডোবায়। অন্যদিকে ফসল উৎপাদনের ক্ষমতা হারিয়ে এসব জমি পতিত থাকায় দেশের কৃষি উৎপাদনে অবদান রাখতে না পারলেও ইটভাটা মালিকদের ভয়াবহ এই মাটি সন্ত্রাস বন্ধে স্থানীয় কৃষি বিভাগ কিছুই করতে পারছে না। মাটি সন্ত্রাসের সাথে জড়িত এসব ইটভাটা মালিকদের দম্ভ এসব দেখভালের দায়িত্বে নিয়োজিত স্থানীয়  ও জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন দিবসে তারা মোটা অংকের টাকা চাঁদা দেন এবং তাদের পরিচালনার স্কুল কলেজ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে ইটভাটা থেকে বিনামূল্যে ইট দেয়া হয়। তাই তাদের এই সন্ত্রাস বন্ধে কেউ বাধা দেয়ার নেই। গত কয়েক বছর ধরে এমন কর্মকা- চলছে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলায় প্রায় ৩০টি ইটভাটায়। উল্লাপাড়া কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, উল্লাপাড়ায় মোট কৃষি জমির পরিমাণ ৩২ হাজার ৫৮৫ হেক্টর। আর আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ৩২ হাজার ৭৩৫ হেক্টর। এসব জমিতে প্রতি বছর ব্যাপক পরিমাণ রবি সরিষা, ইরি-বোরো ধান, আমন ধান সহ বিভিন্ন সবজির চাষাবাদ হয়। কৃষির উপর নির্ভরশীল এই উপজেলার মানুষ। উত্তরাঞ্চলের সবচেয়ে বেশি রবি সরিষার উৎপাদন হয় এই উপজেলায়। উপজেলার এই বিশাল কৃষি জমির মাঠেই ৩০টি ইট ভাটা গড়ে উঠেছে। এসব ইটভাটাগুলো বিস্তীর্ণ ফসলী জমির মাঠের মধ্যে এবং আবাসিক এলাকা ঘেঁষে নির্মাণ করা হয়েছে। এসব ইট ভাটার চার পাশের বিস্তীর্ণ ফসলি জমির মাঠ। একদিকে ইটভাটায় তপ্ত আগুনে ইট পোড়ানো হচ্ছে অন্যদিকে ফসলি জমিতে রবি সরিষা, ধান, সবজি সহ বিভিন্ন ফসলের চাষ হচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সবাইকে ম্যানেজ করেই তারা এসব ইটভাটা গড়ে তুলেছে। এসব ইটভাটাগুলোতে এখন ইট পোড়ানো মৌসুম চলছে। তাই তারা ব্যস্ত ইট তৈরির মাটি সংগ্রহে। এই মাটি সংগ্রহে তারা আইন অমান্য করে ফসলি মাঠ থেকে উর্বর ফসলি জমির মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে। কৃষকদের মোটা অংকের টাকার লোভ দেখিয়ে তারা ফসলি জমিতে বেকো মেশিন লাগিয়ে পুকুর কেটে মাটি নিয়ে যাচ্ছে ইটভাটায়। এতে কৃষকের যে জমিতে বছরে ৩টি ফসল ফলতো তা পুকুরে পরিণত হওয়ায় চাষাবাদ করা যাচ্ছে না। অপরদিকে কৃষি জমিতে মেশিন দিয়ে মাটি কাটায় পাশের জমিতে ভাঙন শুরু হওয়ায় বাধ্য হয়ে সেই কৃষকও ইটভাটায় তার জমির মাটি বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। এভাবে একটি মাঠের কৃষি জমির মাটি চলে যাচ্ছে ইটভাটায়। ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন আইন অনুযায়ী কৃষি জমি, আবাসিক এলাকা, সরকারি বা ব্যক্তিগত বনভূমি, অভয়ারণ্য, বাগান বা জলাভূমি ইট ভাটা স্থাপন নিষেধ থাকলেও ইট ভাটার মালিকগণ পরিবেশ অধিদপ্তরের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাধ্যমে ছাড়পত্র নিয়ে আবাসিক এলাকাসহ বিস্তীর্ণ ফসলি জমির মাঝে এই ইটভাটাগুলো গড়ে তুলেছে। প্রধানমন্ত্রী বার বার দেশের কৃষি জমি রক্ষায় হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলেও তা মানছে না এসব ইটভাটা মালিকেরা। সরেজমিনে উল্লাপাড়া পৌর শহরের সবচেয়ে কাছে সদর ইউনিয়নের বগুড়া-নগরবাড়ী মহাসড়কের চৌকিদহ ব্রিজের কাছে শ্রিকোলা মাঠে গিয়ে দেখা যায়, চারিদিকে হলুদ সরিষা ক্ষেতের মাঝ খানে প্রায় দেড় বিঘা জমিতে অন্তত ১০ হাত গভীর করে দুটি বেকো মেশিন দিয়ে উত্তম ফসলি জমির মাটি কেটে ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পাশেই বেবী নামক ইটভাটায়। এই ইটভাটা মালিক গত কয়েক সপ্তাহ হল দিন রাত এভাবে ফসলি জমি থেকে মাটি কেটে তার ইটভাটায় নিয়ে ইট তৈরি করছে। এর পাশেই বেকো মেশিন দিয়ে আরেকটি কৃষি  জমিতে মাটি কাটছিলেন পিবিসি নামক ইটভাটা মালিক। বেকো মেশিন দিয়ে মাটি কেটে ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তার ইটভাটায় ইট তৈরির জন্য। এদের হাত থেকে পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বিলসূর্য নদীর পাড় পর্যন্ত রক্ষা পাযনি। নদীন দুই পাড়ও তারা কেটে নিয়ে গেছে ইটভাটায়। উপজেলার পূর্নিমাগাঁতী ইউনিয়নের গোয়ালজানি মাঠে শতাধিক শ্রমিক দিয়ে ফসলি জমির মাটি কেটে ট্রলিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পাশের রনি নামক ইটভাটায়। একই কাজ করছে পার্শ¦বর্তী সাফাদ নামক ইটভাটায়। এই দুই ইটভাটা মালিক গোয়ালজানি বিশাল ফসলি মাঠের জমিতে গর্ত করে নির্বিচারে মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে তাদের ইটভাটায়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, একইভাবে মাটি কাটা হচ্ছে উপজেলার চড়–ইমুড়ি এলাকার এইচকে বিক্সস, স্মৃতি বিক্সস, চালার আয়শা বিক্সস, পাগলা বোয়ালিয়া এলাকার তাজ বিক্সস, বড়হর এলাকার এফএন্ডএফ বিক্স, রাজমানের ইটভাটাসহ বেশিরভাগ ইটভাটায়। ফসলি জমি থেকে উর্বর মাটি কাটলে প্রশাসনিকভাবে কোন বাধা দেয়া হয় কিনা জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ইটভাটা মালিক সরল স্বীকারোক্তি দিয়ে জানান, জেলা থেকে উপজেলায় বিভিন্ন দিবসে এসব ইটভাটা থেকে মোটা অংকের টাকা চাঁদা দেয়া হয়। এমনকি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রশাসন বিভিন্ন সময় তাদের পরিচালিত শিক্ষা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে মাগনা ইট পর্যন্ত তারা দেন। ফসলি জমি থেকে মাটি কাটা প্রসঙ্গে উল্লাপাড়া উপজেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি মো. নান্নু মিয়া জানান, পুকুর কাটার জন্য জমির মালিকেরা ইটভাটার মালিকদের কাছে মাটি বিক্রি করে। সেই মাটি দিয়ে ইট তৈরি হচ্ছে। উর্বর ফসলি জমি থেকে ইটভাটাগুলোর মাটি কাটা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে উল্লাপাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো.খিজির হোসেন প্রামাণিক জানান, আমরা এ বিষয়ে অবগত আছি এবং প্রত্যেক ইটভাটাকে কৃষি জমি থেকে মাটি না কাটার নির্দেশনা দিয়ে পত্র দেয়া হয়েছে। উল্লাপাড়া সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো.আকরাম আলী জানান, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী কৃষি জমি থেকে এক টুকরি মাটি কাটা যাবে না। তাছাড়া কৃষি জমি রক্ষা সুরক্ষা আইন এবং ইটভাটা স্থাপন আইন অনুযায়ী এভাবে কৃষি জমি থেকে উর্বর মাটি কেটে ইট তৈরির নিয়ম নেই। খুব শিঘ্রই এসব ইটভাটা মলিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ