Inqilab Logo

রোববার, ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

মহেশখালীর সোনাদিয়া যেন বর্জ্য দ্বীপ

কক্সবাজার জেলা সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ১৪ নভেম্বর, ২০২২, ৬:৫৬ পিএম

কক্সবাজার শহর ও মহেশখালী দ্বীপের মাঝখানে প্রায় ১০ হাজার একর আয়তনের জমি নিয়ে বঙ্গোপসাগরে গড়ে ওঠা সোনাদিয়া দ্বীপটি শহর থেকে মাত্র এক কিলোমিটার চওড়া একটি চ্যানেল দ্বারা বিভক্ত। কক্সবাজার শহর থেকে উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত এই দ্বীপটি ‘স্বর্ণ দ্বীপ’ নামেও পরিচিত। কথিত রয়েছে, এখানে একসময় স্বর্ণ পাওয়া যেতো। ভূ-তাত্তি¡ক জরীপে এখানকার বালিতে মোনাজাইটসহ মূল্যবান খনিজ পদার্থ পাওয়া গেছে। বিশ্বের বিরল প্রজাতির চামচ ঠুঁটো বাটান পাখিসহ বৈচিত্র্যময় পশু-পাখি ও সামুদ্রিক প্রাণির আবাস হিসাবে চিহ্নিত সোনাদিয়া দ্বীপ। তবে গত বছর থেকে বহু পাখির দেখা আর মিলছে না বলে জানান স্থানীয়রা।

সমৃদ্ধ প্রাণবৈচিত্র্য এবং অনাঘ্রাত সৈকতের জন্য বিখ্যাত সোনাদিয়া দ্বীপটি এখন যেন এক প্লাস্টিক বর্জ্যের দ্বীপ। বিরল প্রজাতির পাখ-পাখালি এবং বৃক্ষ ও লতাগুল্মের জন্য বিখ্যাত এই দ্বীপটি ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে মানুষ ও প্লাস্টিক বর্জ্যের দখলে, আর হারিয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা সেই প্রাণবৈচিত্র্য।

গত ৬ ও ৭ নভেম্বর বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) ও সমুদ্র বিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দারের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠানটির একদল পরিবেশবিজ্ঞানীর সাথে সোনাদিয়া দ্বীপ পরিদর্শনে গিয়ে এমন দৃশ্যই চোখে পড়ে।

পরিদর্শনে দেখা যায়, সোনাদিয়া দ্বীপের পূর্ব অংশ থেকে পশ্চিম অংশ পর্যন্ত ৭ কিলোমিটার সৈকতের উচ্চ জোয়ার প্লাবিত অঞ্চল জুড়ে শুধুই খালি মদের বোতল, ভাঙা বোতল, প্লাস্টিকের স্যান্ডেল, ব্যাগ, জাল ও মেডিক্যাল বর্জ্যসহ জৈব-অজৈব নানা ধরনের বর্জ্যের স্তুপ। সামুদ্রিক জোয়ার ও ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ¡াসে সোনাদিয়া দ্বীপে প্রায়ই নানা ধরনের বর্জ্য ভেসে আসলেও গত ২৪ অক্টোবর ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং এর জলোচ্ছ¡াসে টনকে টন প্লাস্টিক বর্জ্য আচঁড়ে পড়ে।

আর এই ধরনের বর্জ্যই সোনাদিয়ার প্রাণবৈচিত্র্য গিলে খাচ্ছে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউটের (বোরি) পরিবেশ বিজ্ঞানীরা।

তারা মনে করছেন, এই ধরনের বর্জ্যের কারণে মাটিতে বিষাক্ততা তৈরি হচ্ছে। মাটির বন্ধন তৈরি বাধাগ্রস্থ হচ্ছে এবং সৈকতে বসবাসকারী বিভিন্ন প্রাণির বাসস্থান ধ্বংস হচ্ছে। এছাড়া সৈকতের প্রাকৃতিক উদ্ভিদের জৈব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও তৈরি হতে পারছে না।

বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক ও সমুদ্র বিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার বলেন, মাটিতে প্লাস্টিক মিশে যাওয়ার কারণে সোনাদিয়া দ্বীপে ভয়াবহ মাটি দূষণের ঘটনা ঘটতে পারে। এটা ছড়িয়ে পড়তে পারে পানিতেও। আবার এই দ্বীপে ভেসে আসা প্লাস্টিকগুলো মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়ে ফের সাগরে মিশে যেতে পারে।

আর এই ধরনের মাটি ও পানি দূষণের কারণে কোন কোন প্রাণি ও উদ্ভিদ পরিবেশ থেকে চিরতরে হারিয়ে যেতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত বিশ্বের প্রথম কম্পিউটার তৈরির কারখানাটি মাটি দূষণের কারণেই বাধ্য হয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।

সিত্রাং এর প্রভাবে সৃষ্ট জলোছ্বাসে সোনাদিয়া সৈকত ছাড়াও কক্সবাজারের সাগর ও নদী তীরবর্তী উচ্চ জোয়ার প্লাবিত অঞ্চলে শত শত টন প্লাস্টিক বর্জ্য আচঁড়ে পড়েছে। এরআগে ২০২০ সালের জুলাই মাসেও কক্সবাজারের কলাতলী থেকে হিমছড়ি পর্যন্ত সৈকতজুড়ে দুই দফায় বর্জ্য-বন্যা দেখা দেয়। ওইসময় নানা বর্জ্যের সাথে মরা কচ্ছপ, সাপসহ আরো বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণির মৃতদেহ ভেসে আসে। সেই সময় জেলা প্রশাসনের বীচকর্মী এবং স্থানীয় পরিবেশবাদী সংস্থাগুলোর কর্মীরা সৈকত থেকে সেই বর্জ্যগুলো পরিস্কার করলেও সোনাদিয়া দ্বীপের বর্জ্য পরিস্কারে গত পক্ষকালেও কারো কোন টেনশন দেখা যায়নি। এমনকি সরকারী-বেসরকারী সংস্থা কিংবা পরিবেশবাদী কোন সংগঠনেরও কোন তৎপরতা চোখে পড়েনি।

সোনাদিয়ার মাঝেরভিটা এলাকার বাসিন্দা আমানউল্লাহ বলেন, সাগর থেকে ভেসে আসা ক্ষতিকর বর্জ্যগুলো পরিস্কারের জন্য সোনাদিয়ায় কোন সংস্থা কাজ করে না। ধীরে ধীরে সেই বর্জ্যগুলো টুকরো টুকরো হয়ে সৈকতের মাটিতেই মিশে যায়।

তিনি বলেন, সোনাদিয়া দ্বীপের প্যারাবন কেটে, সৈকতের সাগরলতা বন ধ্বংস করে প্রভাবশালীদের অনেকেই ব্যবসা-বাণিজ্য ও দখলবাজিতে মাতলেও বর্জ্য পরিস্কার করার কোন লোক নেই।

নেকমের জেলা ব্যবস্থাপক ও মেরিন বায়োলজিস্ট আবদুল কাইয়ূম বলেন, সোনাদিয়ায় পরিবেশ ধ্বংসের কারণে কচ্ছপের ডিম পাড়ার হারও আশংকাজনক হারে কমে গেছে। ২০২০ সাল পর্যন্ত কয়েক প্রজাতির কাছিম এ দ্বীপে বছরে ১০ হাজার থেকে ১২ হাজার পর্যন্ত ডিম পাড়তো। আর গত বছর এই সংখ্যা ছিল এক হাজারের কম। তাছাড়া চলতি মৌসুমে এখনও পর্যন্ত ডিম পাড়তে আসেনি কাছিম। গত মৌসুমে তারা অনেক বিলম্বে ডিম পাড়তে আসে।

সমুদ্রবিজ্ঞানী বেলাল হায়দার প্রায় ৩ যুগের ব্যবধানে সোনাদিয়ার জীববৈচিত্র্য নব্বই ভাগের বেশিই ধ্বংস হয়ে গেছে বলে মনে করেন। আর বিভিন্ন প্রাণির ইকোসিস্টেমস বা বাস্তুসংস্থানতন্ত্র ধ্বংস করার কারণেই সোনাদিয়ায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে তার ধারণা।

তবে পরিকল্পিত পদক্ষেপ নিলে এখনও সোনাদিয়াকে রক্ষা করা এবং আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ