Inqilab Logo

শুক্রবার, ০৫ জুলাই ২০২৪, ২১ আষাঢ় ১৪৩১, ২৮ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

বছরের শুরুতে বই উৎসব নিয়ে শঙ্কা

অনলাইন ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১ নভেম্বর, ২০২২, ১২:১২ পিএম

বই উৎসবের বাকি দুই মাস; কিন্তু সংকট কাটেনি এখনো। পর্যাপ্ত কাগজ নেই মিলগুলোতে। কালির দাম বেড়েছে। রিজার্ভ সংকট, ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে এলসি করতে না পারায় কাগজ তৈরির মণ্ড (পাল্প) আমদানি করতে পারছেন না মিল মালিকরা। সঙ্গে আছে অনিয়ন্ত্রিত লোডশেডিং ভোগান্তি। ফলে মানসম্মত ছাপাসহ নির্দিষ্ট সময়ে বই উৎসব নিয়ে দেখা দিয়েছে শঙ্কা।
অবশ্য সমস্যার কথা শুনতে নারাজ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। সংকট যতই থাকুক, চুক্তি অনুসারে নির্দিষ্ট সময়ে বই চাইছেন তারা। তবে কাগজ সংকটের কারণে ১ জানুয়ারির আগে ৪০ শতাংশের বেশি বই সরবরাহ সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছেন ছাপাখানা মালিকরা।
বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘পাল্প যদি নতুন করে আমদানি করা হয়, হোয়াইট প্রিন্ট বা নিউজ প্রিন্ট কাগজেও যদি বই করা হয়, ১ জানুয়ারির আগে ৩০-৪০ শতাংশ বই দেওয়া সম্ভব হতে পারে। যদি ৪০ শতাংশ বইও দেওয়া যায়, সেটা সরকারের জন্য সৌভাগ্যের বিষয়।’
শতভাগ শুল্কমুক্ত কাগজ আমদানির সুযোগ দিতে আরও দেড় মাস আগে এনসিটিবিকে চিঠি দেয় মুদ্রণ শিল্প সমিতি। শিক্ষামন্ত্রীকেও বিষয়টি জানানো হয়; কিন্তু তারা কোনো পদক্ষেপ নেননি।
এ বিষয়ে জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘বাজারে ভালো মানের কাগজ নেই। ০ শতাংশ প্রেস এখন নিম্নমানের কাগজে বই ছাপছে। মিলগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা আর যে পাল্প আছে, তাতে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩০ শতাংশ কাগজ উৎপাদন করা যাবে। আমাদের ৫০ শতাংশ কাগজ শুল্কমুক্ত আমদানির সুযোগ দিলে ভারত থেকে আমদানি করে সংকট উত্তরণে কাজ করা যায়। তা না হলে ১ জানুয়ারির আগে কোনোভাবেই মানসম্পন্ন বই দেওয়া সম্ভব হবে না।’
আগামী বছরের জন্য প্রায় ৩৪ কোটি ৬১ লাখ ৬৩ হাজার পাঠ্যবই ছাপানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এগুলোর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক থেকে প্রাথমিক স্তরের ৯ কোটি ৯ লাখ ৫৩ হাজার এবং মাধ্যমিক স্তরের জন্য মোট ২৪ কোটি ৬৩ লাখ ১০ হাজার পাঠ্যবই ছাপানো হবে। এবার বই ছাপার কাজ পেতে প্রাক্কলিত দরের চেয়ে গড়ে ২২ থেকে ২৪ শতাংশ কম দাম দিয়েছে মুদ্রণকারীরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদেশি প্রকাশনা সংস্থাগুলোকে ঠেকাতে এবং শত শত কোটি টাকার কাজ বাগাতে মুদ্রাকরদের একটি সংঘবদ্ধ চক্র এত কম দরে টেন্ডার দিয়েছে। আবার সেটি এনসিটিবি হয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদনও পেয়েছে।
প্রাথমিক স্তরের বই ছাপাতে ৯টি এবং মাধ্যমিকের বই ছাপাতে ২০টি লটে দরপত্র আহ্বান করা হয়। প্রাথমিকে তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বই ছাপতে এবং মাধ্যমিকে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণি বাদে অন্যান্য শ্রেণির বই ছাপতে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে সর্বোচ্চ কাজ পেয়েছে নোয়াখালীর অগ্রণী প্রিন্টিং প্রেস। এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আগেও কম দরে কাজ নিয়ে নিম্নমানের বই সরবরাহের অভিযোগ উঠেছিল; কিন্তু কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি এনসিটিবি।
মুদ্রণ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিগত বছরগুলোতে নভেম্বরের শুরুতে এক-তৃতীয়াংশের বেশি বই ছাপানো হয়ে গেলেও এবার এনসিটিবির দর অনুযায়ী টেন্ডার দেওয়া হয়েছে মে মাসে। সে আলোকে মাধ্যমিকের কাজ শুরু হয়েছে অক্টোবরের মাঝামাঝি আর প্রাথমিকের মাসের শেষ সপ্তাহে। দরপত্রের শর্তানুযায়ী, প্রাথমিক স্তর ও ইবতেদায়ির বই ০ জিএসএমের কাগজে ৫ শতাংশ উজ্জ্বলতা থাকতে হবে। নবম-দশম শ্রেণির বিজ্ঞানের বই চার রঙা মুদ্রণে ৭০ জিএসএম কাগজে এবং অন্য শ্রেণির বই ৬০ জিএসএম কাগজে ছাপতে হয়। আর বইয়ের কভারে ২৩০ জিএসএমের আর্ট কার্ড ব্যবহার করতে হয়; কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে এই মানের কাগজ দিয়ে বই ছাপানো সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন একাধিক মুদ্রাকর।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন প্রেস মালিক বলেন, ‘১০০ শতাংশ পাল্প দিলে ৫ শতাংশ উজ্জ্বলতা আসে। ৬০ জিএসএমের কাগজের ৫ শতাংশ উজ্জ্বলতা কমিয়ে ০ শতাংশ করার জন্য আমরা এনসিটিবিকে মৌখিকভাবে বলেছি। এটা করলে আরও কিছু মিল উৎপাদনে আসতে পারবে। তা না করলে সরকার যতই চাপ দিক, সবাই যেনতেনভাবে কাজ শেষ করে বাঁচার চেষ্টা করবে।’
কাগজ সংকট : রাজধানীর মাতুয়াইল ও কাজলার কয়েকটি ছাপাখানা ঘুরে পুরোদমে বই ছাপার কাজ চলতে দেখা গেছে। প্রেসভেদে দৈনিক দেড় থেকে দুই লাখ বই ছাপা হচ্ছে। এসব প্রেস মালিক জানান, দেশীয় মিলগুলোতে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় কাগজের দামও বেড়েছে; কিন্তু তার পরও গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে মিলগুলো আগের মতো কাগজ উৎপাদন করতে পারছে না। ফলে ০ জিএসএমের ৯০ থেকে ৯৫ হাজার টাকা দামের এক টন কাগজের দাম এখন ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। ৬০ জিএসএমের ০ থেকে ৫ হাজার টাকা দামের কাগজ এখন লাখ টাকার বেশি।
এনসিটিবি কর্মকর্তা ও প্রেস মালিকরা জানিয়েছেন, এবার প্রায় ৩৫ কোটি বই ছাপাতে এক লাখ টন কাগজ লাগবে; কিন্তু দেশে এ মুহূর্তে এত কাগজ নেই। ফরাজী প্রিন্টিং প্রেসের মালিক মো. শাহজাহান ফরাজী বলেন, ‘আমি যে বরাদ্দ পেয়েছি, সে বইগুলো ছাপানোর জন্য এক হাজার টন কাগজ লাগে। ৪০০ টন কাগজ সংগ্রহে আছে। আরও তিনশ টনের জন্য টাকা দিয়ে রেখেছি; কিন্তু এরপর কী করব জানা নেই।’
বিদ্যুৎ বিভ্রাট : কাগজ সংকটের পাশাপাশি প্রেস মালিকদের ভাবাচ্ছে বিদ্যুৎ বিভ্রাট। একটানা বিদ্যুৎ না থাকায় কাগজ নষ্ট হচ্ছে, মেশিনে বেশি গ্লু ব্যবহার করতে হচ্ছে। জেনারেটর দিয়ে কাজ চালাচ্ছেন অনেকেই। তবে ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেকেই সেই খরচের ভার বহন করতে পারছেন না। এ ছাড়া রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায় এলাকাভিত্তিক নির্দিষ্ট সময়ে ‘বাধ্যতামূলক’ শিল্পকারখানা বন্ধ রাখা হচ্ছে। ছাপাখানাগুলোও আছে এর আওতায়। বিষয়টি বিবেচনায় এনে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বিদ্যুৎ বিভাগে চিঠি দেওয়া হয়েছে। প্রেস মালিকরাও একটানা বিদ্যুৎ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি এবং পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ ও বিপণন সমিতির সভাপতি তোফায়েল খান বলেন, ‘এবার চারটি ধাপে টেন্ডার হয়েছে। এর কার্যাদেশও হয়েছে কাছাকাছি সময়ে। সে কারণে বাজারে একই সময়ে কাগজের চাহিদা তৈরি হয়েছে। এই চাহিদার জন্য বাজার প্রস্তুত ছিল না।’
এ বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আজিজ আল মাসুদ ও কোষাধ্যক্ষ মোস্তফা আজাদ মহিউদ্দিনকে ই-মেইল করা হলেও তারা জবাব দেননি।
তবে এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম বলেন, ‘দেশে কাগজের সংকট আপাতত নেই। তার পরও প্রেস মালিকরা পূর্বপ্রস্তুতির অংশ হিসেবে আগে থেকে ৩০-৪০ শতাংশ কাগজ কেন কিনে রাখলেন না! তারা যদি প্রতিবছর এমনই করে, তাহলে আমরা কেন এর মধ্যে থাকব। এই সময়ে ভারতও যদি ৩-৪ কোটি বই ছাপাতে সহযোগিতা করত, তাহলেও কিছুটা চিন্তা লাঘব হতো। বই আমরা যে কোনো মূল্যে দিবই। মন্ত্রী বলে দিয়েছেন, দেশীয়রা না দিলে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক টিম ডাকব।’



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ