Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বিনা বিচারে হাজতবাস কষ্ট দেখার কেউ নেই

| প্রকাশের সময় : ১২ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

সারাদেশে ৫৮টি কারাগারে ৪৬২ জন বন্দি : শতবার হাজিরা দিয়েও শেষ হয়নি মামলার বিচার কার্যক্রম : বিনা বিচারে কারাগারে রাখার কারণে দায়ীদের শাস্তি হবে -আইনমন্ত্রী
মালেক মল্লিক : আব্দুল হাকিম। ময়মনসিংহের কোতয়ালি থানার মাইজ বাড়ি এলাকার একটি হত্যা মামলায় গ্রেফতার হন ২০০১ সালে। এরপর থেকে তিনি কারাগারে চার দেয়ালের মধ্যে দেড় যুগ ধরে বন্দি রয়েছেন। সর্বশেষ কোর্টে হাজির করা হয় চলতি বছরের ৩ জুন। ২০১৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারীতে পুনরায় কোর্টে হাজিরার তারিখও রয়েছে। একইভাবে বিচারিক আদালতে তাকে অন্তত হাজির করা হয় ৮৪ বার। কিন্তু জামিন মেলেনি। শেষ হয়নি মামলার বিচার কার্যক্রমও। তাই বিনা বিচারে কারাগারেই আটক থাকতে হচ্ছে তাকে। শুধু হাকিম নন, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসহ সারাদেশের ৫৮টি কারাগারে ৪৬২ জন বন্দি বিনা বিচারে দীর্ঘদিন ধরে আটক রয়েছেন। এরা সবাই হত্যা, নারী ও শিশু ধর্ষণসহ গুরুতর ফৌজদারি অপরাধের ঘটনায় বিভিন্ন মামলায় আসামী। এমন তথ্য উঠে এসেছে সারা দেশের কারাগারগুলোর পাঠানো প্রতিবেদনে। গত ৭ ডিসেম্বর কারা উপ-মহাপরিচালক (সদর দপ্তর) বজলুর রশিদ স্বাক্ষরিত প্রতিবেদনটি সুপ্রিমকোর্ট লিগ্যাল এইড অফিসে পাঠানো হয়। সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড অফিসের কো-অর্ডিনেটর রিপন পৌল স্কু বলেন, দেশের সকল কারাগারের পাঠানো প্রতিবেদনটি আমরা হাতে পেয়েছি।
আইনজ্ঞরা বলছেন, বিনা বিচারে কারাগারে এসব বন্দি মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এটা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। কেন এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হচ্ছে না তা শনাক্ত করা সরকারের দায়িত্ব। তাদের এই হাজতবাস কখনোই রাষ্ট্র ফেরত দিতে পারবে না; পারবে না এর ক্ষতিপূরণ দিতেও। মনে হচ্ছে বিনা বিচারে হাজতবাসীদের কষ্ট দেখার কেউ নেই।
এ প্রসঙ্গে আইন মন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরে বিনা বিচারে কারাগারে রাখার কারণে দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহি করতে হবে। তিনি বলেন, তাদের শাস্তিও পেতে হবে। যারা দীর্ঘদিন ধরে বিনা বিচারে কারাগারে আছেন বা কারাভোগ করছেন, এর দায় কার এমন প্রশ্নের উত্তরে আইনমন্ত্রী বলেন, দেখেন, কোনো একজনকে দায়ী করা যায় না। সামগ্রিকভাবে অনেক সময় পদক্ষেপের জন্য বা আইন না জানার জন্য অনেকে পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকেন। কিন্তু আমি সেটা দায় বলব না। অনেক সময় ভুলবশত কারণে কারাগারে থাকতে হয়। আমার কথা হচ্ছে, যারা এই কারণে দায়ী থাকবেন, তাদের জবাবদিহি করতে হবে, শাস্তি হবে। আর এই বার্তাটা ছড়াতে হবে। তাহলেই বিনা বিচারে আটক থাকার মানুষ অনেক কমে যাবে।
সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইডে পাঠানো প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ৫টি, ময়মনসিংহ কারাগারে ২৫টি, কাশিমপুর ১-এর ৪টি, কাশিমপুর ২-এর ৫৭টি, কাশিমপুর মহিলা কারাগারে ৫টি, হাইসিকিউরিটিতে ২১টি। এছাড়া ঢাকার বাইরে ফরিদপুর জেলা কারাগারে ৫টি, টাঙ্গাইলে ৩টি, জামালপুরে ১টি, কিশোরগঞ্জে ৮টি, নারায়ণগঞ্জে ১৮টি, নরসিংদীতে ১১টি, মুন্সিগঞ্জে ৪টি, নেত্রকোনায় ১টি, মানিকগঞ্জে ২টি এবং শরিয়তপুরে ২টি। রাজশাহী বিভাগের রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে ১৭টি, পাবনা ৪টি, বগুড়া ৫টি, সিরাজগঞ্জ ৮টি, নওগাঁ ২টি, জয়পুরহাট ৫টি, নাটোর ৪টি। রংপুর বিভাগের রংপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে ২টি, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ১টি, নিলফামারী ৯টি, দিনাজপুর ১১টি, ঠাকুরগাঁও ৬টি, গাইবান্ধা ৪টি, কুড়িগ্রাম ২টি, চট্টগ্রাম বিভাগের কেন্দ্রীয় কারাগারে ৩৩টি (মেট্রো থানাধীন) অন্যান্য ২৩টি। কক্সবাজার ৩৯টি, খাগড়াছড়ি ৪টি, বান্দরবান ২টি। কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে ১৭টি, চাঁদপুর ৪টি, নোয়াখালী ২টি, ফেনী ৪টি, লক্ষ্মীপুর ৪টি।
সিলেট বিভাগের সিলেট কারাগারে ১৪টি, হবিগঞ্জ ২টি, মৌলভীবাজার ৬টি। এছাড়াও যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে ৭টি, খুলনা  ১০টি, বাগেরহাট ২টি, নড়াইল ১টি, মাগুড়া ১টি, ঝিনাইদহ ৪টি এবং চূয়াডাঙ্গা ১০টি। এছাড়া রবিশালে ৩টি, পটুয়াখালী ২টি, বরগুনা ২টি, ভোলা ৩টি, ঝালকাঠি ১টি ও পিরোজপুর ১টি। প্রতিবেদনে দেখা যায়, ৬৪টি জেলার মধ্যে মাত্র ১০ জেলার কারাগারে বিনা বিচারে আটক একজনও নেই। সেগুলো হল- শেরপুর, মেহেরপুর, গোপালগঞ্জ, লালমনিরহাট, পঞ্চগড়, কুষ্টিয়া, বি.বাড়িয়া, রাঙ্গামাটি, মাদারীপুর এবং রাজশাহী। সবচেয়ে বেশি আটক গাজীপুর কাশিমপুর ২ নম্বর কারাগার। প্রতিবেদনের আসামীদের তথ্য বিশ্লেষণে জানা যায়, ময়মনসিংহের কোতয়ালি থানার মাইজবাড়ির আব্দুল হাকিম একটি হত্যা মামলায় গ্রেফতার হন ২০০১ সালে। এরপর থেকে তিনি কারাগারে বন্দি রয়েছেন। সবশেষ কোর্টে হাজির করা হয় চলতি বছর ৩ জুন। ২০১৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারীতে পুনরায় কোর্টে হাজির তারিখও রয়েছে। বিচারিক আদালতে হাজির করা হয় ৮৪ বার। মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ার কারণ বলা হয়েছে জানা নেই। সুনামগঞ্জ জেলার জাকির হোসেন ও ২০০৭ সাল থেকে মুন্সিগঞ্জ কারাগারে আছেন। এই পর্যন্ত  আদালতে হাজির করা হয় ৮৭ বার। সাক্ষ্য চলছে বলে বিচারের সর্বশেষ অবস্থা কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সিরাজদিখান থানার দক্ষিণ পাউসার গ্রামের মো. জালাল ২০০২ সাল থেকে কারাগারে রয়েছেন। অজানা কারণে ২০১২ সাল থেকে মামলাটির বিচারকার্যক্রম স্থগিত রয়েছে বলে মামলার সর্বশেষ অবস্থান সম্পর্কে বলা আছে। খাগড়াছড়ির সিরাজুল ইসলাম ২০০৫ সাল থেকে অর্থাৎ ১১ বছর যাবত টাঙ্গাইল জেলা কারাগারে রয়েছে। এপর্যন্ত কোর্টে হাজিরার জন্য নেয়া হয় ৯৪ বার। আদালতে সাক্ষী হাজিরা করা হচ্ছে কিনা মন্তব্য বলা হয়েছে হচ্ছে। প্রতিবেদনে আরো দেখা যায়, অধিকাংশ মামলার সর্বশেষ অবস্থা জানা নেই, কোনটি অজানা কারণে স্থগিত, আবার কোনটি সাক্ষ্য নেয়া হচ্ছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। আদালতে হাজিরা করা হয়েছে ৫৫, ৯৪, ৮৭ বারের বেশি। অধিকাংশের বয়স ৪০-এর কাছাকাছি। এছাড়াও জানা যায়, ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর থেকে হাজারীবাগ থানার মামলায় কুমিল্লার হোমনার মোবারক ও মো. সেলিম, তেজগাঁও থানার মামলায় একই বছরের ১৪ এপ্রিল থেকে ঝালকাঠি সদরের সোহেল, কাফরুল থানার মামলায় ওই বছরের ১৬ আগস্ট থেকে গোপালগঞ্জ সদরের শেখ মান্নান, কেরানীগঞ্জ থানার মামলায় নজরুল ইসলাম ১৩ মার্চ থেকে আটক রয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, আসামীদের বিনা বিচারে আটক রেখে তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। আমি মনে করি, সরকারের উচিত দ্রুত বিনা বিচারে আটকদের বিচারিক সহযোগিতা দেয়া। তিনি আরো বলেন, আমি যতটুকু জানি কারা পরিদর্শক নামে একটি কমিটি রয়েছে তারা মাঝে মধ্যে জেলা কারাগারে গিয়ে কে অসুস্থ, বৃদ্ধা অসহায় এবং মামলার সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে কয়েদীরা জানে কিনা তা তদারকি করা। কিন্তু এখন সেটা হচ্ছে খতিয়ে দেখা দরকার। তিনি আরো বলেন, সরকার আইন সহায়তার নামে অনেক পয়সা খরচ করছে। দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পূর্বেই জেল হাজতে আটক রাখা আইনের শাসনের পরিপন্থী। নাগরিকের মৌলিক অধিকার খর্ব করার শামিল। দলীয় বিবেচনায় জেলা লিগ্যাল এইড কমিটি গঠন করায় তারা যথাযথভাবে কাজ করছেন কিনা সেটাও দেখার বিষয়। অথচ সরকার অনেক টাকা পয়সা খরচ করছেন। মনে হচ্ছে বিনা বিচারে হাজতবাসীদের কষ্ট দেখার কেউ নেই।
গত ২৬ জুন গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার পরিদর্শনে যান প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। পরিদর্শনকালে তিনি কারাগারে বিনা বিচারে আটক বন্দিদের বিষয়ে তথ্য জানতে চান। কারা কর্তৃপক্ষ প্রধান বিচারপতিকে জানান, মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় বিনা বিচারে কারাগারে অনেক বন্দি রয়েছেন। পরে কাশিমপুর কারা কর্তৃপক্ষ দীর্ঘদিন বিনা বিচারে আটক বন্দিদের একটি তালিকা সংবলিত প্রতিবেদন সুপ্রিম কোর্টে লিগ্যাল এইডে পাঠায়। ইতোমেধ্য এক বৃদ্ধাসহ উচ্চ আদালত কয়েকজনকে জামিন দিয়েছেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ