Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪৩১, ০৫ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সুমন গাইলেন, মাতালেন ঢাকার দর্শকদের

নাভিদ হাসান | প্রকাশের সময় : ১৬ অক্টোবর, ২০২২, ৬:২২ পিএম

হেমন্তের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা শনিবার বিকেলে, ঠিক ১৩ বছর পর বাংলাদেশের মঞ্চে এলেন বাংলা আধুনিক গানের ‘গানওয়ালা’ কবির সুমন। ‘তোমাকে চাই’ অ্যালবামের ৩০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত এই অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কথা ছিল বিকাল সাড়ে ৪টায়। সুমনের গান শুনতে এবং পুরো অনুষ্ঠান উপভোগ করতে বেলা ৩টা থেকেই উপচে পড়া ভিড় ছিল বদলি প্রেক্ষাগৃহ ইঞ্জিনিয়ারিং ইনিস্টিটিউটের বাইরে। তা সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয়েছে আয়োজকদের। আধুনিক বাংলা গানের এই দিকপালকে এক নজর দেখতে অপেক্ষমাণ মানুষের লম্বা লাইন ছাড়িয়ে গেল প্রেক্ষাগৃহ চত্বরের বাহিরেও বহুদূর। মজার তথ্য হচ্ছে সুমন বাংলাদেশে সর্বশেষ গেয়েছিলেন এই ইঞ্জিনিয়ারিং ইনিস্টিটিউটেই। শাড়ির সঙ্গে খোপায় ফুল সজ্জিত নারীদের দেখে মনে হচ্ছিল বসন্ত অনেক আগেই বয়ে এনেছেন ‘ভীষণ অসম্ভবে আমি তোমাকে চাই’ গানের স্রষ্টা।

কানায় কানায় পূর্ণ ইঞ্জিনিয়ারিং ইনিস্টিটিউট মিলনায়তনে বিকাল ৫টার দিকে মঞ্চে উঠলেন বাংলা গানের প্রবীণ প্রেমিক সুমন। সালাম জানিয়ে শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে পরিচয় দিলেন, ‘আমি ভারতের নাগরিক আর বাংলা আমার ভাষা’ এই বলে। কিন্তু যিনি লালন ও আব্বাসউদ্দিনের সুর ছুঁয়ে যান,বঙ্গবন্ধুর আহŸান ও একুশের চেতনাকে স্মরণ করে বাধেন, ‘বাংলা দেখলে আমি এখনও বাংলাদেশকে পড়ি’, সেই শিল্পীর পরিচয় কি আর কাঁটাতারে বাঁধা যায়? সুমন ১৯৯২ সালে নিজের প্রথম স্বরচিত ও স্বসুরারপিত গানের অ্যালমাব ‘তোমাকে চাই’ নিয়ে বাংলা আধুনিক গানের এক নতুন দুয়ার উন্মোচন করেন। তখন তার সিম্বল ছিল গিটার। তার গানের কথাতেও গিটারের কথা এসেছে,‘জানিনা গিটার কেন আমার প্রেমের রাজধানী’। কিন্তু কার্লটন কানেল সিনড্রোমের কারণে তিনি আর গিটার বাজাতে পারেন না। এরপরও কি-বোর্ড বাজিয়ে যতক্ষন গাইলেন, তাতে দর্শক-শ্রোতা কেউই বিন্দুমাত্র বঞ্চিত হলেন না।

শুরুর দিকেই ওস্তাদ আমির খানকে স্মরণ করে গাইলেন জাগে জাগে রাত। চুয়াত্তরে পা দেওয়া সুমনের শরীরে স্বাভাবিকভাবেই জেগে বসেছে নানান জটিলতা। দুটি গান গেয়ে জিরিয়ে নিতে হলো। দর্শকদের মাঝে তখন দুঃশ্চিন্তা। কিন্তু সুমন কি আর এতো সহজে হাল ছাড়ার পাত্র? এরপরই ধরলেন ধরলেন 'হাল ছেড়োনা বন্ধু' গানটি। যখন কবিগুরু ররবীন্দ্রনাথের ‘পুরানো সেই দিনের কথা’ শুরু করলেন তখন সবাইকে সম্পৃক্ত করার জন্য করলেন এক মধুর সা¤প্রদায়িকতা! বললেন, 'মোরা ভোরের বেলা ফুল তুলেছি, দুলেছি দোলায়' গাইবেন মেয়েরা আর ছেলেরা গাইবেন 'বাজিয়ে বাঁশি গান গেয়েছি বকুলের তলায়'। এই না হলে সুমন! আধুনিক বাংলা গানকে ধাক্কা দেওয়া এই শিল্পী গানের মাঝে মাঝেই করেন গল্প। যেমন তোমাকে অভিবাধন প্রিয়তমা গাওয়ার সময় স্মরণ করলেন বাংলাদেশী কবি শহীদ কাদরীকে। জানালেন 'কাদরী আমার বন্ধু। তার কবিতা থেকেই এই গানের সৃষ্টি। আপনারা ওনার কবিতা পড়বেন। তাহলে দেখবেন কবিতা পড়ার বদাভ্যাস তৈরি হয়ে গিয়েছে।' মানুষকে পড়ার প্রতি আগ্রহী করতে এতো সুন্দর কৌশলও যে অবলম্বন করা যায়, তা কেবল সুমনের দ্বারাই সম্ভব।

সবুজ দ্বীপের মত মাঝখানে সুফিয়া কামাল গাওয়ার সময় সকল শ্রোতারাই আবেগঘন হয়ে পড়লেন। পরিবেশ স্বাভাবিক করতে সুমন নিলেন রম্যের সহায়তা। বলেন, 'আমি মিথ্যা একদমই বলি না। তবে সুন্দরী নারীদের সাথে বলি।' কোমরের ব্যাথার কারণে বারবার অন্যদের সাহায্য নিয়ে বসার অবস্থান বদলাতে হচ্ছিল। থমথমে পরিবেশ হালকা করতে তখন রসিকতা করে জানান,‘মাঝে মাঝে মনে হয় শুয়ে শুয়ে গান গাই’। সাথে সাথে হাসির জোয়াড়ে হারিয়ে গেল সকল দুশ্চিন্তা। এরপর আরও কয়েক গান গেয়ে নিলেন একটা বিরতি।

অনুষ্ঠানের দ্বিতীয়ার্ধে পশ্চিমবঙ্গের 'রামধনু' কিভাবে বাংলাদেশের 'রংধনু'তে বদলে গেল, সেই স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শিল্পী তার পূর্বের কর্মস্থল ডোয়েচেভেলে বাংলা বিভাগের বাংলাদেশী বন্ধুদের নাম বলতে লাগলেন, আব্দুল্লাহ ফারুক, ফরহাদ খান, শাহজাহান ফারুক......। এই সময় দর্শকসারি থেকে একজন জানালেন শাহজাহান উপস্থিত আছেন এখানে। পুরনো বন্ধুকে পেয়ে কোমড়ের যন্ত্রণায় দাড়াতে না পারা সুমন অদ্ভুত শক্তিবলে দাঁড়িয়ে গেলেন। মঞ্চেই তৈরি হল এক আবগঘন মুহুর্তের। 'বন্ধু কি খবর বল, কতদিন দেখা হয়নি', দুই বন্ধু কি একথায় বলছিলেন? তা অন্তর্জামী হয়ে জানার উপায় নেই।

আধুনিক বাংলা গানের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে বাংলা খেয়াল বা বান্দিস নিয়ে কাজ করছেন সুমন। কেন খেয়াল গাইছেন বা বাধছেন তার যথার্ততা প্রমাণের জন্য মজার ছলেই টেনে আনলেন চুনী গে¦াস্বামীকে। বললেন চুনী যদি ভারত জাতীয় ফুটবলের অধিনায়কত্ব করে,পরে রঞ্চি ক্রিকেটকে বাংলার হয়ে খেলতে পারেন তাহলে আমি কেন আধুনিক বাংলা থেকে খেয়াল করতে পারব না? একই সঙ্গে আচার্য আজাদ রহমানের বাংলা খেয়াল নিয়ে করা লড়াইয়ের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন। ১৮ অক্টোবর তিনি একই প্রেক্ষাগৃগে গাইনবেন ‘খেয়াল’।

‘বয়েস আমার মখুরে রেখায়’ গাইতে গাইতেই গল্পের ছলে জানান,‘এই কথাটা আমি বাংলাদেশকে বলছি। আমার সময় ফুরিয়ে আসছে। আমি আর একবার বাংলাদেশে আসতে চাই। কোন সুরগুলো কোন গানগুলো আমায় পুষ্ট করল? সেই স্মৃতির কথা বলব সে অনুষ্ঠানে। আমি আরেকবার বাংলাদেশে আসব। তবে সেবার কোনো টাকা নেব না। দায় থেকে গাইব। আমার গান শোনানোর দায়।’ বাংলাদেশের শ্রোতাদের প্রশংসা করে দাবি করেন, ‘পরিচিত গানগুলো সবাই গায়। কিন্তু যখন ‘কন্ঠে নিলেম গান, আমার শেষ পারানির কড়ি’র মত এত অপরিচিত রবীন্দ্রসঙ্গীত কলকাতায় গাই, সবাই চুপ থাকে। অথচ আপনারা গাইলেন। কিছুদিন আগে বাংলাদেশ থেকে একজন বলেছিলেন আমাদের ওখানে মানুষ গান খাই। আপনারা আসলেই গান খান, গান যাপন করেন।’ ধন্যবাদ জানাতে ভুলেননি অনুষ্ঠানের আয়োজক পিপহোলের ফুয়াদ ও আরিফকে। অবশ্যই গেয়েছেন 'তোমাকে চাই', তবে শেষে।

সুমন বাংলা গানের জন্য এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। গানের কথা, সুর, উপস্থাপনা, চিন্তা-ভাবনা সবকিছু মিলিয়ে বাংলা গানকে তিনি নিয়ে গিয়েছেন এক অনন্য পর্যায়ে। তার গান বুঝতে হলে জানতে হবে তার ব্যক্তিত্ব, রাজনৈতিক দর্শন, রবীন্দ্র ও নজরুল সংগীতের প্রতি তার বোধ সহ আরও অনেক কিছুকেই। সুমন সেই আধুনিক নাগরিক যিনি প্রকাশ্যে বলেন সত্য, সবার সামনে বলতে বাঁধে না তার ব্যক্তিগত জীবনের কথা। নব্বইয়ে বেড়ে উঠাদের কাছে সুমন এক ‘নস্টালজিয়ার’ নাম। তবে শনিবার সন্ধ্যায় উপস্থিত ছিলেন তিন প্রজন্মের শ্রোতা এবং দর্শক। যখন ধরলেন,‘ও গানওয়ালা আরেকটা গান গাও’ তখন উপস্থিত প্রতিটি মানুষ গলা মেলালেন। তা দেখে জানান,‘ঈশ যদি বাবা-মাকে এই দৃশ্য দেখাতে পারতাম!’ আর তার অগণিত দর্শকদের মন তখন আনন্দ এবং বিষাদের মিশ্র অনুভ‚তিতে পুর্ণ। কোভিড পরবর্তী ঢাকায় আবারও সাংস্কৃতির দোলা লাগায় উচ্ছ¡াসতো আসবেই। তবে ‘ছেলেবেলার সেই বেহালা বাজানো লোকটা’ একটু পড়েই যে সব গুটিয়ে চলে যাবে। বিষাদটাও তাই স্বাভাবিক। ভক্তদের কেউ কেউতো বলছিলেন, ও গানওয়ালা তুমি গেয়েই যাও।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ