Inqilab Logo

শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আমলাদের বিরুদ্ধে বাড়ছে মামলা

টেবিলে ফাইলের পাহাড় তদন্ত হলেও বিসিএস ক্যাডারদের বিচার হয় না

পঞ্চায়েত হাবিব | প্রকাশের সময় : ১৬ অক্টোবর, ২০২২, ১২:০০ এএম

প্রশাসনে বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলা বাড়ছে। নিয়োগ, পদায়ন, বদলি, প্রেষণ,ছুটি, সিনিয়রিটি নির্ধারণ, পদোন্নতি, অতিক্রম, গ্রেডসেলেশন,কর্মকর্তাকর্মচারীদের হয়রানী, নারী নির্যাতন শ্লীতাহানি, ক্ষমতা অপব্যবহার, মর্যাদা নির্ধারণ এবং বিভাগীয় মামলা রয়েছে বিএসএস ক্যাডার কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে। এদিকে বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তাদের মামলা বাড়লো তাদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো বিচার হয় না। জেলায় প্রভাবশালী মন্ত্রী বা এমপিরা তাদের অনুগত বা আস্থাভাজন ব্যক্তিদের প্রশাসনের কর্মকর্তা হলে তাদের বিচার হয় না এবং অভিযুক্তদের ফাইল আর নড়ে না। ফলে অনেক কর্মকর্তার পক্ষে রাজনৈতিক বলয় থেকে বের হওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এসব কারণে দুর্নীতিমুক্ত, ন্যায়পরায়ন এবং স্বচ্ছ মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা, দক্ষ ও কার্যকর জনপ্রশাসন গড়ে উঠেনি বলে মনে করছেন প্রশাসন বিশেষজ্ঞরা। সরকারের বিরুদ্ধে কোনো মামলা স্থগিতাদেশ হলে তা দ্রুত এড়িয়ে যাওয়া হয়। তবে আমলাদের মামলার ক্ষেত্রে তা হয় না। গত কয়েক বছরে যেসব বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তারা বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তার বেশিরভাগেই কর্মকর্তা মামলা থেকে খালাস পেয়েছেন আবার পদোন্নতি পেয়ে তারা চাকরি করছেন বলে জানা গেছে। এছাড়া তথ্য অধিকার আইনে তথ্য চেয়ে আবেদন করা হলেও কোন তথ্য পাওয়া য়ায় না। গত ২০০৯ সাল থেকে ৫৮টি আদেন পড়েছে। তার মধ্যে ৪৬টি তথ্য প্রদান করা হয়েছে আংশিক। আর ১২টি আবেদনের বিষয়ে অপারগতা প্রকাশ করা হয়েছে।তা প্রতিবেদনে বলা হয়। মধ্যরাতে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায় আলোচিত কুড়িগ্রামের সাবেক ডিসি সুলতানা পারভীনকে শাস্তি থেকে রেহাই দিয়েছে জনপ্রশাসন। আবার তাকে পদোন্নতি দিয়ে বদলী করা হয়েছে।এমন ঘটনা প্রশাসনে শত শত র্কমকর্তার বিরুদ্ধে রয়েছে। তারপরও তারা বিচার থেকেই বেড়িয়ে আসছে এবং পদোন্নতি পেয়ে সচিব পর্যন্ত হচ্ছেন বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে জনপ্রমাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কে এম আলী আজম ইনকিলাবকে বলেন, প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে সব বিষয় জানা নেই। পযালোচনা করে আপনাকে বলবো। আপনী আমাদের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করেন। তিনি সবল তথ্য দিবেন।

সরকারে সাবেক সচিব প্রশাসন ও রাজনীতি বিশ্লেষক আবু আলম মো. শহীদ খান ইনকিলাবকে বলেন, বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলা হয় এবং হবে। সে গুলোর মধ্যে নিয়োগ, পদায়ন, বদলি, প্রেষণ, জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ, পদোন্নতি, অতিক্রম, গ্রেড সেলেশন,কর্মকর্তা কর্মচারীদের হয়রানী, নারী নির্যাতন, শ্লীতাহানি, ক্ষমতা অপব্যবহার, মর্যাদা নির্ধারণ এবং বিভাগীয় মামলা। বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তাদের মামলা বাড়লো তাদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো বিচার হয় না এ ঠিক না তাদের বিচার হয়। আগে বেশি বিচার হতো এখন হয় না। দক্ষ ও কার্যকর জনপ্রশাসন গড়ে উঠেনি। জনগণের জন্য যেমন অপরাধ করলে আইন আছে, কর্মকর্তাদের বেলায় এর ভিন্ন কিছু নয়। তবে যারা অপরাধ করার পর না শুধরাবেন তারা শীর্ষ পর্যায়ে গেলে সেটা হবে জাতির জন্য অভিশাপ।

সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক বলেন, সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে আসবে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করা যাবে না। চাকরিবধিতেও এসব বিষয়ে স্পষ্ট করে বলা আছে। বিভিন্ন সময় অপরাধ করেও সরকারি চাকরিতে বহাল থাকা ঠিক না। চাকরিবিধি অনুসারে দোষী হলে অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

সম্প্রতি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ২০২১-২০২২ বাষিক প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয়েছে। এতে এসব দুর্নীতির চিত্র ফুটে উঠেছে। এদিকে শৃঙ্খলা ও তদন্ত অনুবিভাগের প্রতিবেদনে বলা হয়, শৃঙ্খলা ও দুনীতিজনিত ১৫ হাজার ৫৭টি প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। প্রশাসনে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মোট অভিযোগ ৯৫৩টি রয়েছে। গত ২০২০-২১ অর্থ বছরে বিভাগীয় মামলা হয়েছে ৭৭টি এর মধ্যে ৪৫টি নিম্পতি হয়েছে এবং ৩২টি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আইন অনুবিভাগের মামলার বিবরণে বলা হয়, গত ২০২০-২২ বছরে দায়েরকৃত জনপ্রশাসনের মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট্র মামলা সংখ্যা রিট, ৪ হাজার ৮২০টি, এর মধ্যে জনপ্রশাসনের ৩৩টি, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অধীন ও সংযুক্ত দপ্তর ও সংস্থার মামলা ৪১টি এবং অন্যন্যা মন্ত্রণালয়ের মামলা ২৯৯টি এর আগের বছর গুলোর অনিম্পন মামলা রয়েছে ৫ হাজার ৮৩৯টি। এর মধ্যে লিভ টু আপিল মোট ১১৩টি এর মধ্যে গত ২০২১-২২ অর্থ বছরে মামলা হয়েছে ১৩টি এবং ২০২১-২২ অর্থ বছরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে অধীনে ২টি এবং এর আগের মামলা ছিল ৯৮ টি। রিভিউ পিটিশন মামলা আগে ছিল ৬টি গত দুই বছরে হয়েছে ৬টি। কন্টেপ্ট পিটিশন আগে ছিল ৩২৩টি, গত দুই বছরে হয়েছে ৩৯টি, প্রশাসনিক ট্রাইবুন্যালে মামলা আগে ছিল ১৮০টি বর্তমানে তা বাড়িয়ে ২০৬টি রয়েছে। প্রশাসনকি আপিল ট্রাইব্যুালে মামলা আগে ছিল ১৯টি বর্তমানে রয়েছে ৩১টি এবং লিভ টু আপিল ( এএটি থেকে উদ্ভুত থেকে) মামলা আগে ছিল ১৯টি বর্তমানে বাড়িয়ে হয়েছে ২৩টি।

সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালার ২৭ নম্বর বিধিতে বলা হয়েছে, ‘সরকারি কর্মচারী সংকীর্ণতা, প্রিয়তোষণ, বেআইনিভাবে ক্ষতিগ্রস্তকরণ এবং ইচ্ছাকৃতভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করিতে পারিবেন না।’ আর সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২২(২)-এ উল্লেখ আছে, ‘সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।’ সম্প্রতি সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো সরকারের কর্মচারী আচরণ বিধিমালা পরিপন্থী তো বটেই সেই সঙ্গে সংবিধানেরও সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

বরগুনায় তিন প্রশাসনিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা গত ১২ সেপ্টেম্বর বরগুনার জেলা প্রশাসক মো. হাবিবুর রহমানসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে দেওয়ানি আদালতে মামলা করা হয়েছে। মামলাটি আমলে নিয়ে ১৫ দিনের মধ্যে জবাব দেয়ার জন্য শোকজ সহ মূল নথি তলব করেছেন বিচারক। মামলার অন্য বিবাদীরা হলেন- বরগুনা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো: কাওছার হোসেন ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. নিজাম উদ্দিন। বরগুনার জেলা প্রশাসক মোঃ হাবিবুর রহমান, ইউএনও (সদর) কাওসার হোসেন এবং এসিল্যান্ড মোঃ নিজাম উদ্দিন সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য সুকৌশলে সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।

বগুড়ার জেলার উপজেলা নির্বাহী অফিসারের (ইউএনও) কার্যালয়ের বাগানে ‘ছাগলে ফুল খাওয়ার অপরাধে’ মালিককে দুই হাজার টাকা জরিমানা করে সমালোচনার জন্ম দিয়েছিলেন বগুড়ার আদমদিঘী উপজেলার ইউএনও সীমা শারমীন। অবলা প্রাণীর ফুল খাওয়ার দায়ে তার মালিককে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে সরকার ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন মহলকেও লজ্জায় ফেলেছিলেন তিনি।

কুমিল্লার বুড়িচংয়ের ইউএনও মোছাম্মৎ সাবিনা ইয়াছমিনকে ‘আপা’ সম্বোধন করায় তিনি স্থানীয় এক ব্যবসায়ীকে ‘মা’ বলে ডাকতে বলেন। মানিকগঞ্জের সিংগাইয়ের ইউএনও রুনা লায়লাকে ‘স্যার’ না বলে ‘আপা’ বলায় পুলিশ দিয়ে ব্যবসায়ীকে পেটানোর খবরও চাউর হয়েছিল।
সম্প্রতি মাঠ প্রশাসনের চার কর্মকর্তার বিতর্কিত কর্মকাণ্ড নতুন করে সেই আলোচনায় যেন ঘি ঢেলেছে। তাদের একজন বান্দরবানের আলীকদমের ইউএনও মেহরুবা ইসলাম। তিনি ফুটবল খেলার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে খেলায় চ্যাম্পিয়ন ও রানার্সআপ দলের ট্রফি বিতরণ না করে সবার সামনে ট্রফি আছড়ে ভেঙেছেন। এমন কাণ্ডের পর ওই কর্মকর্তাকে তিরষ্কার না করে উল্টো তাকে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে বদলি করা হয়েছে। বগুড়া সদরের ইউএনও সমর কুমার পালের বিরুদ্ধে অভিযোগ এলজিইডির চতুর্থ শ্রেণীর এক কর্মচারীকে পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে দিয়েছেন। কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার ইউএনওর বিরুদ্ধে এসএসসির পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ রয়েছে। টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) অমিত দত্ত ভূমি নিজ অফিসের দুই কর্মচারীকে মারধর কার অভিযোগ ওঠে।

এছাড়া নিজের স্ত্রীকে যৌতুকের জন্য মারধর করা, একাধিক বিয়ে, পরনারীর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক থাকার জেরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বাঞ্জারামপুর উপজেলার তৎকালীন সহকারী কমিশনার (ভূমি) সারোয়ার সালামের বিরুদ্ধে মামলা করেন স্ত্রী। সেই মামলা মহানগর হাকিম আদালতে চলমান থাকলেও ওই কর্মকর্তা নরসিংদীতে এখনো কর্মরত আছেন। কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এমন ভুরিভুরি অভিযোগ রয়েছে, যার বেশির ভাগই অমীমাংসিত বা সঠিক বিচার হয়নি।

মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে স্থানীয় সরকার ও শাসন বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ বলেন, ইউএনও হোক কিংবা সহকারী কমিশানার (ভূমি) হোক, এসব বিষয়ে উপজেলা চেয়ারম্যানের তরফ থেকে অভিযোগ হওয়া উচিত, জেলা প্রশাসন সেগুলো দেখবে। সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তাদের চাকরি বিধি-বিধান রয়েছে, সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। সেগুলো সঠিক বাস্তবায়ন হলেই এ ধরনের সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান ইনকিলাবকে বলেন, প্রশাসনের কর্মকর্তারা মানুষের বিচার করে থাকে তাদের বিচার হয় না এটা দু:খজনক। কর্মকর্তারা জনগণের সেবার জন্য নিয়োজিত কিন্তু তারা সেই বিষয়টি ভুলে যান।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ