দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
মাওলানা সাদিক আহমদ
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
বক্ষমান নিবন্ধের আলোচিত মনীষী পীরে কামেল আলহাজ্জ্ব আল্লামা শাহ্ আব্দুল মান্নান শায়খে গুনই (রাহ.)ও ছিলেন সেই ধারাবাহিকতারই অন্যতম ব্যক্তিত্ব। কেননা শায়খে গুনই (রাহ.)- এর মেহনত মোজাহাদা ও ইসলাহী কর্মতৎপরতার বরকতে অনেক বেনামাজী নামাজী হয়েছে, অনেক মদখোর ও জুয়াড়ি মদ-জুয়া ছেড়ে দিয়েছে, তায্কিয়া বা আত্মশুদ্ধির মেহনত থেকে দূরে সরে যাওয়া অনেক আলেম-উলামা ও ধর্মপ্রাণ মুসলমান তার সোহবতে এসে তায্কিয়ার মেহনত ও যিকির-শোগলে অভ্যস্ত হয়েছেন।
বিশ্ববিখ্যাত আলেমেদ্বীন ও বুযুর্গ, আওলাদে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, শায়খুল ইসলাম সায়্যিদ হুসাইন আহমদ মাদানী (রাহ.) -এর সাহচর্যধন্য ও তারই অন্যতম খলীফা হযরত শায়খে গুনই (রাহ.) সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি, তিনি ছোটবেলা থেকেই ছিলেন একজন মুত্তাকী-পরহেজগার, আমানতদার ও ইবাদতগুজার মনীষী। সৌম্য, শান্ত ও নূরানী চেহারার এ মানুষটিকে দেখলেই কী যেন এক প্রকার অপার্থিব ভালোবাসায় দ্রষ্টার মনপ্রাণ ভরে উঠতো। আল্লাহ্ রাসূল ও আখেরাতের কথা মনে পড়ে যেতো। সর্বদা তাস্বীহ হাতে তাসবীহ্পাঠে নিমগ্ন ও যিকিররত এ বুযুর্গের দরবারে সর্বস্তরের মানুষের আনাগোনা লেগেই থাকতো। কেউ আসতো মুরীদ হওয়ার জন্য, কেউবা আসতো হযরতের সোহ্বতে এতেকাফ করা কিংবা কিছু সময় সান্নিধ্য নেয়ার আশায়, আবার অনেকেই আসতো, পানিপড়া, তেলপড়া, ঝাড়-ফুঁক ও দোয়া নেয়ার জন্য। এতে লোকেরা খুবই উপকৃত হতো। তাই দিন দিন হযরতের ভক্ত মুরীদের সংখ্যা বেড়েই চলছিল এবং তার সুনাম সুখ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ায় দূর-দূরান্ত থেকেও অনেক সাক্ষাতপ্রার্থী এসে তার দরবারে ভিড় জমাতো।
আধুনিকতার ছোঁয়ায় ভেসে যাওয়া ক্ষণভঙ্গুর এ সমাজে ধর্মপ্রাণ মানুষ হিসেবে পরিচিত লোকেরাও যখন আল্লাহ্ওয়ালাদের সোহ্বত থেকে এবং ইসলামের প্রাণশক্তি আত্মশুদ্ধির মেহনত ও যিক্রুল্লাহর আমল থেকে ক্রমান্বয়ে দূরে সরে পড়ছিল ঠিক সেই মুহূর্তে হযরত শায়খে গুনই (রাহ.) মানুষকে আত্মশুদ্ধির গুরুত্ব বুঝিয়ে তাদের পেছনে মেহনত করে তাদের আত্মশুদ্ধ জীবনগঠনের ব্যাপারে জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। এ লক্ষ্যে তিনি এলাকার কোন কোন মসজিদকে কেন্দ্র করে স্বীয় মুরীদ-মুতাআল্লিকীনদের নিয়ে প্রতি বছরের শা’বান মাসের শেষ দশক থেকে ঈদুল ফিতরের পূর্ব পর্যন্ত পূর্ণ রমজান মাস সহ মোট চল্লিশ দিনের জন্য চিল্লায় বসতেন। মুর্শিদে কামেলের সোহ্বত ও সরাসরি তত্ত্ববাধানে থেকে মুরীদ-মুতাআল্লিক্বীন ও মুহিব্বীনেরা যিকির-শোগলের তা’লীম তথা আত্মশুদ্ধির দীক্ষা গ্রহণ করে নিজেদের জীবনকে ধন্য করেছেন। উল্লেখ্য যে, উপরোক্ত চিল্লা আদায়ের স্থান হিসেবে তথা আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণালয়ের জন্য তিনি জীবনের বেশিরভাগ সময় বানিয়াচং সদরের ‘বায়তুল আমান জামে মসজিদকে বেছে নিয়েছিলেন। জীবনের শেষ পর্যায়ে যখন বার্ধক্যজনিত রোগাক্রান্ত হয়ে চলাফেরা করা মোটেও সম্ভব হচ্ছিলো না তখনো তিনি নিজ গ্রাম গুনই (ফকিরবাড়ী)র নতুন মসজিদ ‘বায়তুল আহ্রার জামে মসজিদ’ এ এতেকাফ ও চিল্লা আদায় করেছেন এবং তদীয় নতুন বাড়ির বাংলা ঘরে একটি অস্থায়ী ‘খানকা’ কায়েম করে যিকির আয্কারের আমলের প্রশিক্ষণ চালু রেখে গেছেন।
খোলাফায়ে কেরাম : খলীফায়ে মাদানী শায়খে গুনই (রাহ.)-এর নিকট আধ্যাত্মিক দীক্ষা গ্রহণ করে যারা চার তরীকার খিলাফত ও ইজাযত লাভ করেছেন তাদের ক’জন হলেন-আল্লামা মুফতী তালিব উদ্দীন আহমদ (রাহ.), শায়খুল হাদীছ আল্লামা ফজলুর রহমান দা.বা., শায়খুল হাদীছ মাওলানা হেলাল আহমদ দা.বা. (গোলাপগঞ্জ), শায়খুল হাদীছ মাওলানা আহমদ আলী দা. বা. (মুহাদ্দিছ, সৈয়দপুর টাইটেল মাদ্রাসা), মাওলানা শায়খ জাকির হুসাইন দা.বা. (মুহাদ্দিছ, দরগাহপুর মাদ্রাসা, সুনামগঞ্জ), মাওলানা শায়খ মুখলিছুর রহমান দা.বা. (বানিয়াচঙ্গ), মাওলানা শায়খ আবুল ফজল কাটখালী দা. বা. এবং মাওলানা শায়খ সিরাজুল হক দা. বা. (নেত্রকোনা) প্রমুখ।
উল্লেখ্য যে, পীরে কামেল আলহাজ্জ্ব আল্লামা শাহ্ আব্দুল মান্নান শায়খে গুনই (রাহ.) বিগত ১৯২৭ ঈসায়ী সনে বৃহত্তর সিলেটের বর্তমান হবিগঞ্জ জেলাধীন বানিয়াচং উপজেলার ঐতিহ্যবাহী গুনই (ফকিরবাড়ি) গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত ও দ্বীনদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মরহুম আলহাজ্জ^ শাহ্ মোহাম্মদ শফিক আলী এবং মাতার নাম মরহুমা মালিকজান বিবি। হযরত শায়খে গুনই (রাহ.) হযরত শাহ্জালাল ইয়ামনী (রাহ.)-এর সহচর ৩৬০ আওলিয়ার অন্যতম সদস্য হযরত শাহ্ তাজউদ্দীন কুরাইশী (রাহ.)-এর অন্যতম বংশধর ছিলেন বলে জানা যায়। খলীফায়ে মাদানী হযরত শায়খে গুনই (রাহ.) ধর্মপ্রাণ জনসাধারণের আধ্যাত্মিক রাহ্বার হিসেবে আজীবন দ্বীনি দায়িত্ব অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে পালন করে গেছেন। তার ইখলাস, তাক্ওয়া, বুযুর্গী এবং মেহনত মোজাহাদার বরকতে এলাকা থেকে র্শিক-বিদআত, গান-বাজনা, মদ-জুয়া ও যাবতীয় কুসংস্কার দূরীভূত হয়েছে। হযরত শায়খে গুনই আজ আর আমাদের মাঝে নেই। তবুও তার রেখে যাওয়া শিক্ষা ও দীক্ষা ধর্মপ্রাণ
জনগণের মাঝে দীর্ঘদিন পর্যন্ত চর্চিত হবে এবং তিনি ইতিহাসের পাতায় চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন এতে কোন সন্দেহ নেই। এ মহান বুযুর্গ দীর্ঘদিন পর্যন্ত বার্ধ্যক্যজনিত নানান রোগভোগের পর বিগত ৭ এপ্রিল ২০১৫ ঈ. রোজ মঙ্গলবার সকাল সাড়ে দশ ঘটিকার সময় অসংখ্য অগণিত মুরীদ-মুতাআল্লিকীন, মুহিব্বীন ও আত্মীয় স্বজনকে শোক সাগরে ভাসিয়ে পরম মাওলাপাকের সান্নিধ্যে চলে যান। ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিঊন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। ওই দিন বা’দ আসর গুনই গ্রামের বড় মাঠে শত শত উলামায়েকেরামসহ লক্ষাধিক ধর্মপ্রাণ জনগণের উপস্থিতিতে জানাযা নামাজ শেষে মরহুমের নতুন বাড়ির পার্শ্বস্থ পারিবারিক কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়। মদীনার আলো, শিক্ষক : আল-জামিয়াতুল ইসলামিয়া দারুল কোরআন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।