Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কলাপাড়া ভূমি অফিসে সেবার নামে চলছে ঘুষ-লেনদেন

খাস জমিতে বহুতল ভবন নির্মাণ, নিরব কর্মকর্তারা

কলাপাড়া(পটুয়াখালী) প্রতিনিধি | প্রকাশের সময় : ১২ অক্টোবর, ২০২২, ১২:৫৩ পিএম

কলাপাড়া উপজেলা ভ‚মি অফিসে ঘুষ ছাড়া সেবা না পাওয়ার অভিযোগ সেবা প্রত্যাশীদের। ই-নামজারিসহ সকল ধরনের ভ‚মি সেবা পেতে ঘুষ ছাড়া ঘুরতে হয় দিনের পর দিন। ৪ একরের নীচে জমির পরিমান হলে ই-নামজারিতে ১০-২০ হাজার টাকা, ৫ একরের উপরে হলে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ এবং কুয়াকাটা পর্যটনকেন্দ্র, পায়রা সমুদ্র বন্দর ও পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র সংলগ্ন এলাকার মূল্যবান জমি হলে ই-নামজারিতে গুনতে হচ্ছে ৩-৫ লাখ টাকা। তাঁর কাঙ্খিত ঘুষের টাকা ছাড়া যেকোন অজুহাতে হয় ই-নামজারী কেস খারিজ, নয়তো মাসের পর মাস পড়ে থাকছে এসি ল্যান্ডের ই-নামজারি আইডিতে। এছাড়া সরকারী খাস জমিতে বহুতল ভবনসহ স্থাপনা নির্মান কাজ চলছে এসি ল্যান্ডকে ঘুষ দিয়ে। অবৈধ এ ঘুষ লেনদেনে মধ্যস্থতা করছেন সংশ্লিষ্ট তহশিলদার। এসিআর নেগেটিভ দেয়ার ভয়ে মুখ খুলছেন না তাঁর অধীনস্তরা। আর নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট ক্ষমতার দাপটে প্রতিবাদ করতে পারছেনা সাধারন মানুষ।-তথ্য নির্ভরযোগ্য সূত্রের।

জানা যায়, পর্যটন নগরী কুয়াকাটার জিরো পয়েন্টের পূর্ব পার্শ্বে কুয়াকাটা মৌজার বিএস ১ নং খাস খতিয়ানের ৩৪১২ দাগের প্রায় ০.০৫ একর জমিতে এসি ল্যান্ড মো: আবুবক্কর সিদ্দিকী (পরিচিতি নম্বর-১৮২০২) কে ম্যানেজ করে ৫ তলা আবাসিক হোটেল ভবন নির্মান করছেন মো: শহিদুল ইসলাম। উক্ত ভবনটির বেইজে কাজ করার সময় এসি ল্যান্ড আবুবক্কর সিদ্দিকী উপজেলা ভ‚মি অফিসের সার্ভেয়ার, মহিপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তহশিলদার ও এমএলএসএস নিয়ে নির্মান কাজ বন্ধ করে দেন। পরে মহিপুর ভ‚মি অফিসের তহশিলদার মংলাতেন ভবন মালিকের সাথে মধ্যস্থতা করে মোটা অংকের ঘুষ এনে দেন এসিল্যান্ডকে। এরপর খাস জমির উপর নির্বিঘেœ চলে অনুমোদনহীন নকশার ৫তলা ভবনের নির্মান কাজ। যার পলেস্তারার কাজ এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে।

মহিপুর ভ‚মি অফিসের তহশিলদার মো: দেলোয়ার হোসেন ও মীর শহিদুল ইসলাম বলেন, ’কুয়াকাটার ওই ৫ তলা ভবনটির নির্মান কাজ চলছে বিএস খতিয়ানভুক্ত ১ নং খাস খতিয়ানের ৩৪১২ দাগের জমিতে। যা বন্ধে এসি ল্যান্ড স্যারের নেতৃত্বে আমরা দুই বার ষ্পটে গিয়ে কাজ বন্ধ করে দেই। পরবর্তীতে উক্ত স্থানে ভবন নির্মানের কাজ বন্ধে এসি ল্যান্ড স্যার আর কোন নির্দেশনা দেয়নি।’ স্থানীয় এক হোটেল রেস্তোঁরা ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মহিপুর অফিসের তহশিলদার মংলাতেন আমার রেস্তোঁরায় একদিন মধ্যাহ্নভোজে এলে ওই ৫ তলা ভবন মালিক তাকে কয়েকটি টাকার বান্ডেল দেন। তবে তহশিলদার মংলাতেন ঘুষ লেনদেনের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।

বালিয়াতলি এলাকার খালিদ হোসেনের ০.১২ একর জমির ই-নামজারী, কেস ৪৪৮/২০২১-২২, মঞ্জুর হয় খেপুপাড়া তহশিলদার মো: কাইউমের মাধ্যমে ১৩ হাজার টাকায়। অথচ একই তারিখের ওয়ারিশ সনদ সংযুক্ত করেও তার অপর ৭.২৮ একর জমির ই-নামজারী কেস ২৩১১/২০২১-২২, নয়াকাটা তহশিলদার মো: কামরুল ইসলামকে ২৫ হাজার টাকা দিয়েও মঞ্জুর হয়নি, এসি ল্যান্ডকে ১ লক্ষ টাকা না দেয়ায়। বালিয়াতলি এলাকার ৫ একরের উপরে একাধিক ভুক্তভোগীর জমির ই-নামজারী এভাবে ২৫-৩০ হাজার টাকা সহ সকল বৈধ কাগজপত্র দিয়েও মঞ্জুর হয়নি। পরে তহশিলদার কামরুল টাকা ফিরিয়ে দিয়েছেন ভুক্তভোগী আবেদনকারীদের। মহিপুর ইউনিয়নের খাপড়াভাঙ্গা গ্রামের মো: রেজাউল ইসলাম ফোরকান’র ৯.৫৯ একর জমির ই-নামজারি, কেস-৫১৮-২০২২-২৩, মঞ্জুর হয় তহশিলদার শহিদুলের সাথে এসি ল্যান্ডের কাঙ্খিত ঘুষ লেনদেনে। ই-নামজারি প্রতি ঘুষের এসকল টাকা বন্টন হয় জারিকারক ৫০০ টাকা, কানুনগো ১০০০, নাজির ২০০০, এল আর ফান্ড ১০০০, তহশিলদার ৩০০০ টাকা। বাকী সব টাকা নেন এসি ল্যান্ড। তবে এলআর ফান্ডের জমা টাকা খরচ হয় কুয়াকাটা ভ্রমনে আসা উর্ধ্বতনদের প্রটোকলে, আপ্যায়নে।

জনৈক জাহাঙ্গীর শেখ নামে এক ভুক্তভোগীর লিখিত অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, আলীপুর মৌজার তার ১.২২ একর ভোগদখলীয় জমি ই-নামজারীর জন্য আবেদন করেন ঢাকার উত্তরা এলাকার আবদুস সত্তার, ই-নামজারী কেস নং-৮৮৩/২০২১। যে জমির ই-নামজারীর বিরুদ্ধে পটুয়াখালী সিনিয়র সহকারী জজ আদালতের দে.মো. ৫৭৯/১৪ মামলার রায়, ডিক্রীর কপি, যুগ্ম জেলা জজ আদালতের দে.মো. ৩৭২/১৭, কলাপাড়া সিনিয়র সহকারী জজ আদালতের দে.মো. ৮৪/২০০৬, পটুয়াখালী সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতের সি.আর ৮৩৪/২০১৮ মামলার কপি সংযুক্ত করে লিখিত আপত্তি দাখিল করে শুনানীর পরও উক্ত ই-নামজারী কেসটি মঞ্জুর করেন এসিল্যান্ড। এতে সংক্ষুব্ধ জাহাঙ্গীর শেখ আপীলের প্রস্তুতি সহ বিষয়টি জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয়ের সিনিয়র সচিব, ভ‚মি মন্ত্রনালয়ের সচিবসহ উর্ধ্বতনদের কাছে এসি ল্যান্ড, সার্ভেয়ার ও নাজির উবাসো’র বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দেন। এছাড়া ঢাকার তেজগাঁও এলাকার ফাহমিদা হক’র বৈধ কাগজপত্র থাকার পরও তার ই-নামজারী কেস ২৪৯৯/২০২১-২২ খারিজ করেন এসিল্যান্ড। যা সে পটুয়াখালী জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগ দেয়ায় পুন:রায় মঞ্জুর করেন তিঁনি।

ধানখালী বাজারের রাস্তার উত্তর পার্শ্বে শিমুল মৃধা নামের এক ব্যবসায়ীকে খাস জায়গায় পাকা ভবন উত্তোলনের সুযোগ দিয়ে সার্ভেয়ারের মাধ্যমে মোটা অংকের ঘুষ নেন এসি ল্যান্ড। একই বাজারে শহিদ প্যাদাকেও গোপন লেনদেনে খাস জায়গায় ঘর উত্তোলনের মৌখিক অনুমতি দেন তিঁনি। মহিপুর মৎস্যবন্দর বাজারে শালো ফরাজী, জলিল, স্বপন, শহিদ, মন্নান, আইয়ুব আলী, অশোক কর্মকার, অসীম, নজরুল, জাহাঙ্গীর মাষ্টার কে খাস জায়গায় অবৈধ স্থাপনা উত্তোলনের সুযোগ দিয়ে ৩-৫ লক্ষ টাকা করে সার্ভেয়ার হুমায়ুন’র মাধ্যমে ঘুষ নেন এসি ল্যান্ড। যা সংশ্লিষ্ট বাজারগুলোতে দৃশ্যমান। উৎকোচের বিনিময়ে সরকারী খাস জমি দখলে সুযোগ দেয়ার কথা উর্ধ্বতনদের কাছে তাঁর বিরুদ্ধে প্রেরিত উক্ত অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে।

এদিকে ঘুষ লেনদেনের মধ্যস্থতাকারী ছাড়া সরাসরি কোন সেবা প্রত্যাশী উপজেলা ভ‚মি অফিসে এলে তাকে জেরার মুখে পড়তে হয় এসিল্যান্ডের। অফিসে এসে কেউ যাতে বসতে না পারে এজন্য অধীনস্ত কর্মকর্তাদের টেবিলের সামনে থেকে চেয়ার সরিয়ে রাখেন এসি ল্যান্ড। এছাড়া শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে ঘুষের টাকায় অফিসে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করেন তিঁনি।

এর আগে ভ‚মি অফিসে প্রতিকার পেতে এসে উপজেলার গামুরবুনিয়া আশ্রয়নের দুস্থ নারী রেহেনা (২৫) এসি ল্যান্ডের অশ্রাভ্য ভাষা নির্যাতনের শিকার হন। যা গনমাধ্যমে প্রকাশের পর সংশ্লিষ্ট গনমাধ্যমকর্মীর উপর ক্ষুব্ধ হন এসি ল্যান্ড মো: আবুবক্কর সিদ্দিকী। এছাড়া ইউপি নির্বাচনে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা থেকে তাঁকে প্রত্যাহার করে নেয় জেলা প্রশাসন। বিষয়টি গনমাধ্যমে উঠে এলে সংশ্লিষ্ট গনমাধ্যমকর্মীকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার হুমকী দেন তিঁনি।

ঘুষ লেনদেনে এসি ল্যান্ডের মধ্যস্থতাকারীদের মধ্যে সার্ভেয়ার মো: হুমায়ুন কবির বিত্তবানদের নামে দেয়া ৭২ একর খাস জমি বন্দোবস্ত কান্ডে দুদকের মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে রয়েছেন। তবে তহশিলদার মংলাতেন, শহিদুল, কাইউম ও কামরুল ঘুষ লেনদেনের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।

কলাপাড়া এসিল্যান্ড মো: আবুবক্কর সিদ্দিকী ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, যারা মিথ্যাচার করছে তাদের আমার সামনে নিয়ে এসে প্রমান দেন। গায়েবী তথ্য নিয়ে আপনি আমাকে বলতেছেন, অফিসে এসে এগুলোর প্রমান দেতে হবে আপনাকে। আমি এসি ল্যান্ড, সরকারী স্বার্থ দেখার জন্য এখানে এসেছি। ই-নামজারিতে যারা দুর্নীতি করেছে তাদের বদলী করা হয়েছে।

কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শংকর চন্দ্র বৈদ্য বলেন, বিষয়টি না জেনে, তদন্ত না করে কোন কিছু বলা যাচ্ছে না। আমি খোঁজ খবর নিয়ে এ বিষয়ে পরে আপনাকে বক্তব্য দেবো।

পটুয়াখালী অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো: ওবায়দুর রহমান বলেন, যেই দোষী হোক যথাযথ শাস্তি সে পাবে। কাউকে ছাড় দেয়া হবেনা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ