Inqilab Logo

শুক্রবার ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

প্রকাশ্যে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ ফসলি জমির টপসয়েল

শীতলক্ষ্যার দুই তীরে ৩০ ইটভাটা

| প্রকাশের সময় : ১১ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

খলিল সিকাদর, রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) থেকে : নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জেও শীতলক্ষ্যার পানি গড়িয়ে বর্ষার বিদায় ঘণ্টা বাজতে না বাজতেই ইটভাটার মৌসুমি শ্রমিকদের ব্যস্ততা বেড়ে গেছে। তবে ক্ষতিকর ধোঁয়ার কবলে পড়ার আশঙ্কায় ফের আতঙ্কে স্থানীয় কৃষি ও সামাজিক পরিবেশ। বর্ষার পানি কমে যাওয়ার সময় রূপগঞ্জের দাউদপুরের ৩০টি ইটভাটায় চলে আসে বাড়তি কর্মযজ্ঞ। হুমকির মুখে পড়ে স্থানীয় কৃষি ফসলের উৎপাদন। তাই প্রতি বছর কৃষক ও ইটভাটা মালিকদের মাঝে চলে চাপা ক্ষোভ। কখনো তা সংঘাতে রূপ নেয়। তবু পাকা আবাসন গড়ার প্রধান কাঁচামাল ইট প্রস্তুতে তাদের প্রস্তুতিও থাকে সবকিছু মাথায় রেখেই। স্থানীয় কৃষকরা জানান, ইটভাটায় আগুন দেয়ার পূর্ব পর্যন্ত কিছুটা স্বস্তি হলেও আগুন দেয়ার পর কৃষি ফসলের ভয়াবহ বিপর্যয় দেখা দেয়। এই এলাকার আমগাছগুলোতে মুকুল এলেও তা আম পর্যন্ত ফলনের মুখ দেখে না। নারকেল গাছের ডগাগুলো থুবরে পড়ে। কলাগাছগুলোর পাতাও এ সময় মরে যায়। কৃষকরা আরো জানান, ইটা প্রস্তুতে ফসলি জমির উর্বর মাটি কেটে ভাটায় ম- তৈরি করে। ফলে জমির উর্বরতা হ্রাস পায়। এতে ফসল উৎপাদনে পড়ে ভাটা। সরেজমিন দেখা যায়, দাউদপুরের  লক্ষ্যা শিমুলিয়া থেকে বেলদী, দেবই, খৈসাইর, খাস দাউদপুর, খাস কামাল কাটিসহ  শীতলক্ষ্যার দুপারেই রয়েছে ৩০টির অধিক ইটভাটা। এসব ইটভাটায় প্রকাশ্যে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। কয়লার দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় সহজ জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহার হচ্ছে হরদম। ফসলি জমি ও নদী তীরের বসতিঘরের পাশেই গড়া এসব ইটাখোলায় নানা অনিয়মের মাধ্যমে চালাচ্ছে তাদের কার্যক্রম। শুধু তাই নয়, ইটা খোলার ইট বহনের কাজে ব্যবহার হয় শ্যালোচালিত ইঞ্জিন দিয়ে তৈরি নছিমন, ভটভটি ও ইছার মাথা নামে পরিচিত ঝুঁকিপূর্ণ ট্রাক্টর দিয়ে। এসব ইছার মাথা গ্রামের সরু রাস্তা দিয়ে চলাচল করায় পাকা রাস্তার স্থায়ীত্ব থাকে না। ফলে অল্পদিনেই রাস্তা-ঘাট নষ্ট হয়ে খানাখন্দে পরিণত হয়। অপরদিকে, ইটভাটাগুলোর চিমনি পরিবেশ অধিদফতরের  নিয়ম না মেনে স্থাপন করায় কালো ধোঁয়া প্রবেশ করে গ্রামের বসতঘরে। এতে করে গ্রামের শিশু ও বৃদ্ধ শ্রেণীরা নানা বায়ুবাহিত রোগে ভোগে থাকেন। বিদ্যমান আইনে ইটভাটার চুলায় কাঠ পোড়ানো নিষিদ্ধ থাকলেও রূপগঞ্জের এসব ইটভাটায় তা মানা হচ্ছে না। কয়লা না পুড়িয়ে গাড়ির টায়ার, গার্মেন্টের ধুনা বা কাপড় পোড়াতেও দেখা গেছে। বিষাক্ত কালো ধোঁয়া আতঙ্কে কেউ কেউ এই এলাকা থেকে বসতঘর সরিয়ে নিয়েছেন। ইটা প্রস্তুতের মৌসুমে এই এলাকায় হয়ে পড়ে ধুলো-ময়লা ও ধোঁয়াচ্ছন্ন নগরী। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেলদী এলাকার ইটভাটার ম্যানেজার জানান, ভারত থেকে আমদানিকৃত কিছু কয়লাও রয়েছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি। এসব কয়লার দাম কম থাকায় অনেক ভাটায় তা পোড়ানো হচ্ছে। সূত্রে জানা যায়, রাজধানী ঢাকার কোল ঘেঁষা এই রূপগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে ইটভাটা। এসব ইটভাটার কালো ধোঁয়া ঢাকার বায়ু দূষণের কারণ কিনা তা খতিয়ে দেখার দাবিও করেন স্থানীয়রা। সূত্রে আরো জানা যায়, ইটভাটার কালো ধোঁয়া থেকে বাতাসের সাথে কার্বন মনোক্সাইড,অক্সাইড অব সালফার মিশে যায়। ফলে মাত্রাতিরিক্ত দূষণ হয় বায়ুর। এর প্রভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে জনজীবন। আইন লঙ্ঘন করে প্রশাসনের নাকের ডগায় একের পর এক ইটখোলা গড়ে উঠলেও  নজরদারি নেই বলে জানান স্থানীয়রা। ফলে পরিবেশ দূষণ ও স্থানীয় রাস্তাঘাট বেহাল দশায় পরিণত হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের অর্থে ব্যয় করা রাস্তাগুলো নিয়ে স্থানীয়দের ক্ষোভের শেষ নেই। এ এলাকার পথচারীরা ধুলা ও ধোঁয়া প্রতিরোধে সচেতনরা রাস্তায় চলাচলের সময় মাস্ক ব্যবহার কেউবা নাক চেপে ধরে পথ চলে। দাউদপুরের দুয়ারা এলাকার মোঘল মিয়া বলেন, ইটভাটার প্রভাবে আমাদের ক্ষেত খামারে ভালো ফসল পাই না। প্রতিবাদ করেও কোনো সুরাহা পাই নাই। একই এলাকার আলী মিয়া জানান, ৬ মাস আগে রাস্তা করেছিল ইউনিয়র পরিষদ। এখন সেই রাস্তাটি ভেঙেচুরে একাকার। চলাচল অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। আগলা গ্রামের কৃষকরা জানান, ইটাখোলার ধোঁয়া আর ধুলো-বালিতে আমাদের ফসল ভালো হয় না। এ সময় তাদের ফসল কম হওয়ায় ভাটা মালিকদের কাছে ক্ষতিপূরণ আদায়ের দাবি জানানো হয়। স্থানীয় কৃষকরা অভিযোগ করে বলেন, থানা প্রশাসন, স্থানীয় সন্ত্রাসীদের নিয়মিত মাসোহারা দিয়ে চলে এসব অবৈধ ইটভাটা। বর্ষা বিদায়ের সময় স্থানীয় প্রভাবশালীরা ইটভাটায় দাদন বিনিয়োগ করে। এসব দাদন নিয়ে দাদন দানকারী ও ভাটা মালিকদের মধ্যে চলে বিরোধ। কোনো কোনো সময় তা সংঘাতে রূপ নেয়। দাদন গ্রহণ করে তা সময়মত পরিশোধ না করে অনেক ভাটা মালিক গা ঢাকা দিয়ে এলাকা ছেড়ে চলে যায়। যুবলীগ নেতা নজরুল ইসলাম বলেন, ফসলি জমি, স্কুল কলেজ, মসজিদ-মাদরাসা ও বসতবাড়ির সীমানায় নদী তীর ঘেঁষেই গড়ে উঠেছে এসব ইটভাটা। লোকালয় ও নদী থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে এসব ভাটা নির্মাণের বিধান থাকলেও তা মানা হচ্ছে না এখানে। অন্যদিকে কৃষিজমিতে ইটভাটা স্থাপনে  আইনি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে শিমুলিয়া এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে আরো ১০টি ইটভাটা। সরেজমিন আরো দেখা যায়, এসব ইটাখোলার সামনে পড়ে রয়েছে টায়ার আর লাকড়ির স্তূপ। যা এসব ইটাখোলায় পোড়ানো হয়। ফলে বায়ু দূষণের শিকার এ এলাকার সাধারণ জনগণ। নদী তীরের পয়েস্তি জমির মাটি, দুর্বল কৃষকের মাটি কেটে জোর করে ইটভাটায় নিয়ে দেয় কিছু সন্ত্রাসী বাহিনী। এ নিয়েও স্থানীয়দের ক্ষোভের শেষ নেই। রোহিলা এলাকার রমজান আলী বলেন, কী কমু বাপ! আমাগে কষ্টের কতা কেউ কয় না। এই দেহেন না গাছ আছে ফল নাই, ইটাখোলায় আগুন দিলেই শুরু হয় গাছের পাতা পোড়া। কোনো কোনো গাছ মইরা শেষ অইয়া যায়, কার কাছে কমু এইসব? একই এলাকার গৃহবধূ স্বপ্না জানান, আমাগো বাড়ির ওঠান ঝাড়– দিতে দিতে সময় যায়। ধুলোবালিতে ঘরের টিনের চালায় জং ধরেছে। স্থানীয়রা আরো জানান, ইটভাটা মালিকরা হয় প্রভাবশালী। তাদের সাথে স্থানীয় সন্ত্রাসী বাহিনীর সাথে গোপন আঁতাত। তাদের বিরুদ্ধে কেউ টু শব্দটি করার সাহস পায় না। অনুসন্ধানে জানা যায়, রূপগঞ্জ উপজেলার দাউদপুর ইউনিয়নেরই রয়েছে ৫০টির অধিক ইটভাটা। এসব ইটভাটার মধ্যে সরকারি হিসেবে পাওয়া যায় কেবল ৩০ টি ইটভাটা। এদের মধ্যে বেশিরভাগ ইটাখোলার নেই বৈধ কাগজপত্র। তারা স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে চালাচ্ছে ইটা প্রস্তুতের ব্যবসা। ইউনিয়ন পরিষদের ট্রেড লাইসেন্স। তাদের রয়েছে ইটাখোলা মালিক সমিতি। এ সমিতির অধীনে চলে এসব ইটভাটা। সমিতি আবার অনিয়মকে নিয়ম করে দেয়ার ব্যবস্থা করে থাকে। প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদফতরের চাপ এড়াতেই এ সমিতির কার্যক্রম চালায়। শুধু তাই নয়, বাইরের মঙ্গা পীরিত জেলার কম মূল্যের শ্রমিক ও মহিলা শ্রমিক দিয়ে চলে ইটভাটার ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। এখানে শিশুরাও ইট পোড়াতে নানা বিভাগে কাজ করে থাকে। শ্রম আইনের বালাই নেই এসব ইটাখোলায়। এসব বিষয়ে ইটাখোলার সমিতির সভাপতি বেলদী এলাকার থ্রি সেভেন স্টার ব্রিক ফিল্ডের মালিক মজিবুর রহমান বলেন, ইটাখোলায় প্রায় ৫ হাজার শ্রমিক সরাসরি কাজ করে। ইটা ব্যবসা ও কাঁচামাল সরবরাহ মিলিয়ে প্রায় ৫০ হাজার লোক এ ব্যবসার সাথে জড়িত। স্থানীয় বেকারদের কর্মসংস্থানও রয়েছে। এ সময় তাদের বৈধ কাগজপত্র বিষয়ে নানা বাধার কথা বললেন। অপর ব্রিকফিল্ড মালিক হেলাল উদ্দিন বলেন, আমরা কারো ক্ষতি করছি না। আমরা ইটা প্রস্তুত বন্ধ করে দিলে ঢাকায় ইটা সংকট দেখা দেবে। তিনি আরো জানান, বড় কিছু করতে গেলে ছোট কিছু ক্ষতি হবেই। স্থানীয়দের সাথে আলাপ করে জানা যায়, পরিবেশ অধিদফতরের কিছু অসাধু কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে কেউ কেউ পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র জোগাড় করেছে। তবে এসব খতিয়ে দেখলে জাল প্রমাণিত হবে বলে দাবি করেন তারা। এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারহানা ইসলাম বলেন, ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন অনুসারে পরিবেশগত বিধি-বিধান লঙ্ঘন করলে ১০ লাখ টাকা জরিমানা ও ১০ বছরের শাস্তির বিধান রয়েছে। এ সময় ইছার মাথা ও ভাটায় অনিয়ম বিষয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করবেন বলে জানান তিনি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ