বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
ড. আবদুল হাই তালুকদার : মাহাথির মোহাম্মদের দেশ মালয়েশিয়ার উদাহরণ দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের কর্তাব্যক্তিরা খুশি হন। বাংলাদেশকে মালয়েশিয়া স্টাইলে উন্নতি করে বিশ্বকে চমকে দিতে চান। মাহাথির মোহাম্মদ বাংলাদেশ সম্পর্কে সম্প্রতি দৈনিক মানবজমিনের সাথে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে যে মন্তব্য করেছেন তাতে স্পষ্ট যে, বাংলাদেশ সত্যিকার উন্নয়নের সড়ক থেকে বিচ্যুত হয়ে চলেছে। এখানে নেই আইনের শাসন, শান্তিশৃঙ্খলা, স্থিতিশীলতা, জনগণের অধিকার ও মর্যাদা। উন্নয়নের বাগাড়ম্বর প্রচারণা জোরেশোরে চললেও প্রকৃত পক্ষে উন্নয়ন ঘটছে সীমিত সংখ্যক কিছু সুবিধাভোগী মানুষের। দুর্নীতি লুটপাট ও হরিলুটের স্বর্গরাজ্যের সাধারণ মানুষ নিঃস্ব ও হতদরিদ্র থেকে যাচ্ছে। এখানে জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তাহীনতা মানুষকে সদা ভীত, সন্ত্রস্ত ও অনিরাপদ রাখছে। ঘরে বাইরে কোথাও নিরাপত্তা নেই। গুম, খুন, রাহাজানি, অপহরণ, ছিনতাই, শিশু অপহরণ ও শিশু হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন প্রভৃতি কর্মকা- আশঙ্কাজনক হাড়ে বেড়েছে। সামাজিক, রাজনৈতিক আর্থিক খাত প্রভৃতি ক্ষেত্রে সুশাসনের প্রচ- অভাব। এসব খাতে অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতা চরমভাবে বিরাজমান। টেকসই ও সুষম উন্নয়নের পূর্বশর্ত হিসেবে সামাজিক শান্তিশৃঙ্খলা, আইনশৃঙ্খলা উন্নয়ন, আর্থিক খাতে দুর্নীতি হ্রাস, রাজনৈতিক অঙ্গনে স্থিতিশীলতা অপরিহার্য। বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থা মালয়েশিয়ার তৎকালীন অবস্থার বিপরীত। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটানোর পূর্বশর্তগুলো মাহাথির মোহাম্মদ প্রথমে যেসব সংস্কার কর্ম করেছিলেন বাংলাদেশ সরকার তা করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।
৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়েছে। গণতান্ত্রিক স্পেস সঙ্কুচিত হওয়ায় সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, খুন, জখম, অপহরণ, ছিনতাই বৃদ্ধি পাওয়ায় আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি হয়েছে। বিনা ভোটে ১৫৩ জন ও ৫%, ১০% ভোটে ১৪৭ জন নির্বাচিত হওয়ায় দেশ বিদেশের গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষ ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনকে তামাশায় ও কলঙ্কিত নির্বাচন মনে করে। দেশ-বিদেশে সরকারকে কেউ বৈধ মনে করে না। উপজেলা নির্বাচন বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে। সব দলের অংশগ্রহণে উপজেলা নির্বাচনটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু করে সরকার সংসদ নির্বাচনের কলঙ্ক মুছবে বলে সবাই আশা করেছিল। প্রথম দুই ধাপে দেশের বৃহত্তম দল বিএনপি অনেক এগিয়ে ছিল। পরের ধাপগুলোতে সরকারি দল স্বমূর্তি ধারণ করে ও বিজয় ছিনিয়ে নেয়। ডিজিটালাইজড এ যুগে ব্যাপক ভোট জালিয়াতি, কারচুপি, ব্যালট বাক্স ভরাট করা, বিরোধী দলের এজেন্টদের মারধর করা, কেন্দ্র থেকে এজেন্টদের বের করে দেওয়া প্রভৃতি কর্মকা- উপজেলা নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করে। দেশ-বিদেশের মানুষের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে অস্বীকার করে নির্বাচন কমিশন যখন ওই নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন বলে সার্টিফিকেট দেয়, তখন দেশ-বিদেশের গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষ মুখ টিপে হাসে। ওই নির্বাচনের পর এক লেখায় বলেছিলাম, আওয়ামী লীগ সরকার একটি সুযোগ হাতছাড়া করেছে। বিএনপি ভোট কারচুপির আশঙ্কায় দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন বয়কট করেছিল। উপজেলা নির্বাচনটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠান করে সরকার বাহবা নিতে পারত। এতে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ত ও তারা জোর গলায় দাবি করতে পারত যে দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান হতে পারে। উপজেলা নির্বাচনটি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিকে ন্যায্যতা দিত ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির অন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত করতে পারত। আওয়ামী লীগ এমন একটি দল যে দল সুযোগ পেলে কিছুতেই সুযোগ হাতছাড়া করতে পারে না। মানুষ যতই ওই কাজকে অন্যায্য, অনৈতিক ও অগ্রহণযোগ্য মনে করুক তারা ছলে বলে কৌশলে ক্ষমতা কুক্ষিগত করবে। নিশ্চিত বিজয় দেখেও তারা ভোট জালিয়াতির সুযোগ পেয়ে হাতছাড়া করে না। যার উদাহরণ আমরা ১৯৭৩ সালের সংসদ নির্বাচনে দেখেছি। উপজেলা নির্বাচনে সরকারের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার প্রচ- অভাবে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হতে পারেনি।
সংসদ নির্বাচনের পূর্বে অনুষ্ঠেয় রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, গাজীপুর প্রভৃতি কয়েকটি সিটি নির্বাচনের ফলাফল দেখে সরকার গণতন্ত্রের লেবাস খুলে ফেলে। তাই তারা ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে প্রথম থেকেই সতর্ক অবস্থান নেয়। এ দুটো সিটি নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে বিরোধী দলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকদের পাইকারি হারে ধড়পাকড় শুরু করে। এ সময় প্রতিদিন শত শত নেতাকর্মী গ্রেফতার হয় ও অনেকে গ্রেফতার বাঁচাতে গা-ঢাকা দেয়। হামলা, মামলা ও গ্রেফতার আতঙ্কে নেতাকর্মীরা কোণঠাসা হয়ে পড়েন। অর্থাৎ তারা যাতে নির্বাচনী প্রচারণা ও কর্মকা-ে অংশ নিতে না পারে তার যাবতীয় প্রস্তুতি নেয়া হয়। ভোটের দিন নেতাকর্মীরা ভয়ভীতি ও গ্রেফতার আতঙ্কে ভুগতে থাকে। ঢাকা-চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনের আগের রাতে ভাড়াটে গু-াবাহিনী নির্বাচনী তৎপরতা শুরু করে। ভোটের দিন এই বাহিনী শত শত নির্বাচনী কেন্দ্র দখলে নেয় ও নির্বিচারে সিল মারতে থাকে। বিরোধী দলের এজেন্টদের ভোটকেন্দ্রে প্রবেশে বাধা ও ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া প্রভৃতি কর্মকা- দেশের মানুষের সঙ্গে বিদেশিরাও প্রত্যক্ষ করেছে। বন্ধুপ্রতিম দেশগুলো ভোটের অনিয়ম ও জালিয়াতি দেখে নিরপেক্ষ তদন্ডের আহ্বান জানায়। সরকার কারও কথায় কর্ণপাত না করে জালিয়াতি ও কারচুপির নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান বলে প্রচার করে। বন্ধু রাষ্ট্রগুলো নির্বাচনের অনিয়ম, প্রভাব বিস্তার ও জালিয়াতি দেখে নিবাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ বলে মত দিয়েছে। বড় দুটো সিটি নির্বাচন এতটা কলুষিত হয়েছে যে, সরকারি বাহিনীর জোরজবরদস্তির মোকাবেলা করতে না পেরে সকাল ১০-১১টার দিকে বিরোধী দল প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন।
সর্বশেষে আমরা পৌরসভা নির্বাচনে ব্যাপক ভোট ডাকাতি ও জালিয়াতি প্রত্যক্ষ করেছি। পৌরসভা নির্বাচনের অনিয়ম জালিয়াতি, ভোট ডাকাতি ও ভোট চুরি, আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরাট করা, জাল ভোট প্রদান, জোর করে কেন্দ্র দখল ও এজেন্টদের ভোটকেন্দ্রে প্রবেশে বাধা দেওয়া, ভোটকেন্দ্র থেকে ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে বের করে দেওয়া প্রভৃতি কর্মকা- মানুষ ইলেকট্রোনিক মিডিয়া ও প্রিন্ট মিডিয়ার কল্যাণে জানতে পেরেছে। পৌরসভা নির্বাচনের জালিয়াতি ও অনিয়ম এত প্রকাশ্য ছিল যে মানুষ বহু কেন্দ্রের ভোট জালিয়াতির প্রত্যক্ষ সাক্ষী। মামলা, হামলা, গ্রেফতার প্রভৃতি কারণে নেতাকর্মীরা ভীতসন্ত্রস্ত ছিল যে, তারা অনিয়ম ও জালিয়াতি প্রতিরোধে এগিয়ে যেতে সাহস পায়নি। আমি অনেক লেখায় বলেছি বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের মাঠছাড়া করার সবচেয়ে সুবিধাজনক উপায় হলো বেনামি আসামির তালিকা থেকে গ্রেফতার দেখিয়ে হাজতে ভরে দেয়া। গ্রেফতার বাণিজ্য এত অবলীলায় চলছে যে, এখনো হাজার হাজার নেতাকর্মী জেলহাজতে অনেক কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেলে অন্য একটি মামলায় জেলগেট থেকে গ্রেফতার করে জেলহাজতে ভরা হচ্ছে। বারবার জামিন পেয়েও অনেকে ছাড়া পাচ্ছে না। উৎকট দলীয়করণকৃত প্রশাসন ও ক্যাডার বাহিনীর সহায়তায় তারা নির্বাচনী ফলাফল নিজ দখলে নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। পৌরনির্বাচনে বিএনপি নামক বৃহত্তম রাজনৈতিক দলকে মাত্র ২৩টি আসন দিয়ে বাকিগুলো ছিনিয়ে নেয়। সরকারি দল তাদের ধারণার চেয়ে অনেক বেশি আসন পাওয়ায় উল্লসিত হয়ে নানা রকম বাগাড়ম্বর করতে থাকে। প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন, নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই নিরপেক্ষ আচরণ করলে ও লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড পেলে বিএনপি যে কোনো সময় সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করবে। সরকারি দল বিজয়ের নেশায় উন্মত্ত হয়ে বারবার গণতন্ত্রকে হত্যা করছে, যা আমাদের ভবিষ্যৎকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করছে।
বাংলাদেশের সরকারি কর্তাব্যক্তিরা মালয়েশিয়ার উদাহরণ টানতে ভালোবাসেন। সম্প্রতি আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার ড. মাহাথির মোহাম্মদের একটি সাক্ষাৎকার দৈনিক মানবজমিনে প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশ নিয়ে তার ভাবনা ও আশাবাদ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে রাজনীতি বেশি, উন্নয়ন কম’। বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা অবলোকন করে তিনি আরও বলেন, ‘শাসনতান্ত্রিকভাবে গণতন্ত্রের স্বীকৃতি থাকলেও গণতন্ত্র এখানে কার্যকর হয়নি, স্থিতিশীলতা ও সুশাসন আসেনি।’ মাহাথির মোহাম্মদের সাক্ষাৎকারটি স্পষ্ট বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থার প্রতিফলন। তিনি ১৯৮১ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পূর্বে তিনি শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তিনি দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টির কার্যকরী ও প্রায়োগিক কর্মসূচি গ্রহণ করেন। তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেন যে, জাতীয় উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য শিক্ষা অপরিহার্য। সে কারণে জাতিকে পশ্চিমা জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিত করতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দিয়ে শিক্ষা খাতকে সমৃদ্ধ করেন। একটি দরিদ্র দেশকে সমৃদ্ধশালী করতে হলে বিনিয়োগ অপরিহার্য। সে কারণে তিনি জাতিকে শিক্ষিত করে প্রস্তুত করেন ও দেশের আইনশৃঙ্খলা, শিক্ষা ব্যবস্থা, রাস্তাঘাট ও সুশাসন নিশ্চিত হওয়ায় বিদেশিরা অতি আগ্রহভরে বিলিয়ন বিলিয়ন বিনিয়োগ করতে শুরু করে। মাত্র ২০-২২ বছরে দরিদ্র মালয়েশিয়া পশ্চিমা দুনিয়ার বাজার দখল করে। অতি অল্প সময়ে মাহাথির জনগণের ভাগ্যের অভূতপূর্ব ও অভাবনীয় উন্নয়ন ঘটান। মালয়েশিয়াকে শিল্পসমৃদ্ধ সম্পদশালী ও ধনী দেশে পরিণত করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেন। পৃথিবীর সর্বোচ্চ টুইন টাওয়ার কুয়ালালামপুরে তৈরি করা হয়। ব্যবসা-বাণিজ্যের এমনভাবে প্রসার ঘটান যাতে দেশের মানুষের সবার সমঅধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্যবসা-বাণিজ্য কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর হাতে কুক্ষিগত করার সুযোগ তিরোহিত করে সবার জন্য অবারিত করা হয়। মেধা, যোগ্যতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা বণ্টন করার নীতি মালয়েশিয়াকে এগিয়ে নেয়।
ঘুষ, দুর্নীতি প্রভৃতি কর্মকা-কে কঠোর হস্তে দমন করে দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করা হয়। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ব্যবসা বাণিজ্য, স্বাস্থ্যসেবা, শ্রমবাজার প্রভৃতি খাতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা মাহাথিরের অনন্য অবদান। এসব ক্ষেত্রে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে গণমানুষের হৃদয় কুঠিরে তিনি জায়গা করে নেন। কোটিপতি সৃষ্টিতে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে তিনি মালয়েশিয়াকে সাম্য-স্বাধীনতার মডেলে পরিণত করেন। বলা হয়, মালয়েশিয়াতে গণতন্ত্র ছিল না। মাহাথির মোহাম্মদের শাসনকালের প্রথম দিকে গণতন্ত্র কিছুটা সীমিত আকারে থাকলেও সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, স্বাস্থ্যসেবা, ব্যবসা বাণিজ্য প্রভৃতি খাতে সুশাসন ও ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা ছিল। মানুষের অধিকার ও মর্যাদার পুরোপুরি স্বীকৃতি ছিল। সুবিধাভোগী ও সুবিধাবঞ্চিত দুটো শ্রেণীতে মানুষ বিভক্ত ছিল না। দলীয়করণের বদলে যোগ্যতা ও দক্ষতা বিচারে কর্ম পাওয়ার নিশ্চয়তা ছিল। মালয়েশিয়া শান্তির মডেলে পরিণত হওয়ায় বিশ্বের লক্ষ কোটি বিনিয়োগকারী দলে দলে মালয়েশিয়াতে বিনিয়োগ করতে থাকে। বিশ্বের ধনী দেশগুলোর সঙ্গে গরিব দেশগুলো মালয়েশিয়ার উৎপাদিত পণ্যের বাজারে পরিণত হয়। দক্ষ ব্যবস্থাপনায় ও গুণগত মান সমৃদ্ধ পণ্য ন্যায্যমূল্যে কিনতে বিশ্বের বড়-ছোট বহু দেশ এগিয়ে আসে। রাজনৈতিক সংস্কার করে মাহাথির সব দলমতের জন্য রাজনীতি অবারিত করেন। বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের যথাযথ সম্মান ও মর্যাদার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। রাজনৈতিক মামলা দিয়ে বিরোধী নেতাকর্মীদের কোণঠাসা ও নাস্তানাবুদ করা হয়নি। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের মামলার পর মামলা দিয়ে গ্রেফতার করে জেলখানা ভরাট করা হয়নি। আইনকে তার নিজ গতিতে চলার অবাধ সুযোগ দিয়ে রাজনীতিবিদ ও সাধারণ মানুষকে সুশাসনের গ্যারান্টি দেওয়া হয়। গুম-খুন, মামলা, হামলা, অত্যাচার-নির্যাতন, গ্রেফতার বাণিজ্য প্রভৃতি কর্মকা-কে নিরুৎসাহিত করে মানবাধিকারকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। মানবাধিকারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কর্মসূচি প্রণীত হয়। আর্থিক খাতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা হয়। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্নীতিমুক্ত করে বেগবান করা হয়। ব্যাংক লুট, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, সম্পদ পাচার প্রভৃতি কর্মকা-কে কঠোর হস্তে দমন ও নিয়ন্ত্রণ করে আর্থিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা হয়। মালয়েশিয়াকে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা ও শান্তির আবাসভূমিতে পরিণত করায় দেশের মানুষের সঙ্গে বিদেশিদের জন্য লোভনীয় আবাসভূমিতে পরিণত করা হয়। মালয়েশিয়াকে সেকেন্ড হোম বানাতে বিদেশিরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বাংলাদেশেরও বহু রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী মালয়েশিয়াকে সেকেন্ড হোম বানাতে হাজার হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ করে।
মানব দরদী ও মানবিকতা বোধে উদ্বুদ্ধ বিশাল হৃদয়ের অধিকারী মাহাথির মোহাম্মদ স্বাস্থ্যসেবা খাতকে সমৃদ্ধ করেন। আধুনিক চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতকরণে কার্যকরী পদক্ষেপ হিসেবে আধুনিক যন্ত্রপাতিসমৃদ্ধ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। বিশ্বের অন্যতম নামিদামি ও আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসমৃদ্ধ হাসপাতাল মালয়েশিয়ার আকর্ষণ বাড়িয়ে তোলে। পশ্চিমা দুনিয়ার মতো আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করে দেশবাসীর বিদেশমুখিতা প্রতিরোধ করেন। ক্ষমতালাভের পর তার একটি বড় অপারেশনের দরকার পড়ে। তিনি সেসময় দেশেই অপারেশনটি করায় হৈচৈ পড়ে যায়। সীমিত সুযোগ-সুবিধার মধ্যে নিজ দেশে একজন প্রধানমন্ত্রীর অপারেশন করা দেখে ক্ষমতাবান ও ধনাঢ্য ব্যক্তির বিদেশমুখিতা বহুলাংশে হ্রাস পায়। বাংলাদেশের ধনাঢ্য ব্যক্তি ও ক্ষমতাবানরা সর্দি কাশি হলেও মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও পশ্চিমা দুনিয়ায় দৌড়ঝাঁপ শুরু করে। স্বাস্থ্যসেবার করুণ দশা সাধারণ মানুষের মরণফাঁদ। ধনীদের জন্য স্বর্গরাজ্য হলেও বর্তমান বাংলাদেশ গরিবের জাহান্নাম। ন্যায়বিচার, মানবাধিকার ও সাধারণ মৃত্যুর গ্যারান্টি নেই। ক্রসফায়ারের নামে শত শত নাগরিককে বিনাবিচারে হত্যা করা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। মানবাধিকারের চরম মৃত্যু দেখে বিশ্বের মানবতাবাদী সংগঠন ও সংস্থা বারবার প্রতিবাদ জানাচ্ছে। আইনের শাসনের অভাবে সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। মার্কিন গোয়েন্দা প্রধান জেম্স ক্ল্যাপার ৯ তারিখে বৈশ্বিক হুমকি বিষয়ে মার্কিন সিনেটে অনুষ্ঠিত এক শুনানিতে লিখিত বক্তব্যে বলেন, ‘বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে খাটো করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদক্ষেপ দক্ষিণ এশিয়ার সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে উসকে দিতে সহায়তা করতে পারে’। তিনি বিদেশি নাগরিক হত্যা ও সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, ১১ জন প্রগতিশীল লেখক ব্লগার হত্যা প্রভৃতি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ধর্ম নিরপেক্ষতা ও সহনশীলতাসম্পন্ন একটি মুসলিম রাষ্ট্র। তবে দেশটিতে চরমপন্থি কর্মকা- বৃদ্ধি পাচ্ছে। শেখ হাসিনা সরকার ইসলামিক স্টেটের অস্তিত্ব অস্বীকার করে বিভিন্ন সহিংসতার জন্য ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দল ও বিরোধী দলকে দায়ী করছে। বাংলাদেশে ২০১৪ সালের নির্বাচন ও যুদ্ধাপরাধী বিচার নিয়ে অস্থিরতা বিরাজ করছে। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশে বিরোধী দল দমন করায় সন্ত্রাসবাদ বৃদ্ধির আশঙ্কা বেড়েছে। মার্কিন গোয়েন্দা প্রধান ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের বিভিন্ন সময়ে দেয়া বক্তব্য-বিবৃতি বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থার সঠিক চিত্র। আইনের শাসনের অভাবে মানবাধিকার চরমভাবে বিঘিœত। সাগর-রুনী হত্যা রহস্য আটচল্লিশ মাসেও সুরাহা হয়নি। গুম খুনের ফিরিস্তি আর নাই বা দিলাম। এককথায় মালয়েশিয়ার অবস্থার সঙ্গে বাংলাদেশের অবস্থার আকাশ পাতাল পার্থক্য। মালয়েশিয়ার উদাহরণ টেনে লাভ নেই।
কেননা মালয়েশিয়ায় সুশাসন নিশ্চিত করে দেশকে শান্তির আবাসভূমিতে পরিণত করে উন্নয়ন অগ্রগতির ভিত রচনা করে মিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ আকর্ষণ করে মাহাথির মোহাম্মদের মাত্র ২০ বছরে মালয়েশিয়াকে কৃষিপ্রধান দেশ থেকে শিল্পসমৃদ্ধ দেশে পরিণত করেন। তিনি বাংলাদেশের গণতন্ত্র দেখে আক্ষেপ করে বলেছেন শাসনতান্ত্রিকভাবে গণতন্ত্রের স্বীকৃতি থাকলেও গণতন্ত্র এখানে কার্যকর হয়নি, স্থিতিশীলতা ও সুশাসন আসেনি। আমরা মাহাথির মোহাম্মদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই- গণতন্ত্র, শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সুশাসন ছাড়া বাংলাদেশে টেকসই উন্নয়ন ঘটবে না।
য় লেখক : প্রফেসর, দর্শন বিভাগ ও সাবেক ডিন, কলা অনুষদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।