বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
আহমেদ জামিল : রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে যখন দলীয়করণ এবং স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে ভূমিকা পালন করতে না দিয়ে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ও হস্তক্ষেপ অতিমাত্রায় করা হলে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির উদ্ভব হয় অনিবার্য নিয়মে। বর্তমান সময়ে উচ্চ আদালতের চলমান ঘটনা প্রবাহের দিকে নজর দিলে এ বাস্তব চিত্রের সন্ধান মিলবে। গত ৮ ফেব্রুয়ারি দৈনিক ইনকিলাবে ‘পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে উত্তপ্ত বিচারাঙ্গণ’ শিরোনামে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, “অবসরে যাওয়ার পর রায়ে স্বাক্ষর করা নিয়ে বিচারপতিদের পাল্টা বক্তব্য : বিচার বিভাগের ওপর আস্থা হারাচ্ছে জনগণ। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ও অবসরে যাওয়া বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরীর পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিচার বিভাগ।”
প্রধান বিচারপতির সাথে আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর দ্বন্দ্ব বহুদিনের। উচ্চ আদালতে বিচারপতি থাকাকালীন সময়ে শামসুদ্দিন চৌধুরী প্রধান বিচারপতি সিনহাকে অপসারণের জন্য প্রেসিডেন্টের কাছে ধর্ণা দিয়েছেন। অবসরের পর শামসুদ্দিন চৌধুরী বাংলাদেশের প্রথম হিন্দু প্রধান বিচারপতি সিনহা পাকিস্তানের দালাল ও পিস কমিটির সদস্য ছিলেন বলে অভিযোগ করেছেন। শুধু তাই নয়, প্রধান বিচারপতি সিনহা প্রকৃত প্রধান বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার মুখপাত্র হয়ে বিএনপির এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন বলেও অভিযোগ করেছেন। সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন সম্প্রতি আওয়ামী ঘরানার লোকদের সাথে গুলশানস্থ বেগম জিয়ার কার্যালয় ঘেরাও করতে গিয়েছিলেন। এই সাবেক বিচারপতির সব থেকে গুরুতর অভিযোগ হলোÑপ্রধান বিচারপতি সামরিক বাহিনীর সাথে আঁতাত করে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র করছেন।
এসব তথ্য থেকে এটিই প্রতীয়মান হয় যে, আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের অভিযুক্ত করে যে ভাষায় কথা বলে থাকেন ঠিক একই ভাষায় কথা বলছেন। এ ধরনের দলবাজ ব্যক্তির কাছ থেকে দায়িত্ব পালনকালীন এবং অবসর যাওয়ার পর সঠিক ও নিরপেক্ষ রায় আশা করা অর্থহীন। হয়তো এ দিকটি বিবেচনা করে প্রধান বিচারপতি সিনহা মিডিয়ায় বক্তব্য না দিয়ে ফাইল ফেরত না দেয়ার জন্য সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীকে নির্দেশ দিয়েছেন। বর্তমান প্রধান বিচারপতি সিনহার সাথে আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর বাহাসের মধ্য দিয়ে যে গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রশ্ন বেরিয়ে এসেছে তা হলোÑঅবসরে যাওয়ার পর রায়ে স্বাক্ষরদান কতটা সংবিধানসম্মত। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার দৃষ্টিতে অবসর গ্রহণের পর বিচারপতিদের রায় লেখা ও স্বাক্ষর প্রদান অসাংবিধানিক।
এই সাংবিধানিক বিতর্ক প্যান্ডরার বাক্স খুলে দিয়েছে। যা থেকে অতীতের বেশকিছু স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ বিচারিক রায় বা সিদ্ধান্ত বেআইনি ও সংবিধানবিরোধী বলে বিবেচিত হয়ে দেশে মারাত্মক সাংবিধানিক সঙ্কট ও জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, অবসরের পর সর্বোচ্চ আদালতের রায় ও নির্দেশনা প্রদান করা যায় না। এ বিষয়ে ১৯৬৪ সালের তৎকালীন সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়কে মোটামুটিভাবে অনুসরণ করছে আমাদের উচ্চ আদালত। উল্লেখ্য, ১৯৬৪ সালে কাজী মেহারদিন বনাম মুরাদ বেগম মামলায় এ বিষয়ে একটি বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল। হাইকোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারক এ মামলার রায় লেখেন এবং তাতে স্বাক্ষর করেন।
এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হলে সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এআর কর্নেলিয়াসের নেতৃত্বে ৫ জন বিচারক একটি রায় দেন। রায়ে বলা হয়, অবসর-পরবর্তী সময়ে একজন বিচারপতির লিখিত ও স্বাক্ষরকৃত রায় কোনো রায় নয়। এ রায় এখনো বহাল রয়েছে। কেননা অন্য কোনো রায় দ্বারা এই রায় পরিবর্তন করা হয়নি। এরই সূত্র ধরে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি সিনহা বলেছেন, অবসরের পর রায় লেখা সংবিধানসম্মত নয়। তিনি আরো বলেছেন, ভারত ও পাকিস্তানে অবসরের পর রায় লেখা যায় না। যদিও সুপ্রিম কোর্টের রুলসে অবসরের পর রায় লেখা যাবে কিনা এ নিয়ে স্পষ্ট করে কিছু লেখা নেই। হয়তো এরই সূত্র ধরে সরকারের তরফ হতে বলা হচ্ছে, অবসরের পর রায় লেখা ও স্বাক্ষর করা অবৈধ নয়।
আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক জানিয়েছেন, অবসরের পর রায় লিখতে সাংবিধানিক কোনো বাধা নেই। আইনমন্ত্রী বলেন, সংবিধানের কোথাও লেখা নেই যে, অবসরের পর বিচারপতিরা রায় লিখতে পারবেন না। তবে সংবিধান বিশারদরা বলছেন ভিন্ন কথা। সংবিধান বিশেষজ্ঞদের কারো কারো অভিমত, অবসরের পর রায় লেখা সংবিধানের ১৪৮ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। কেননা অবসরের পর বিচারপতিদের শপথ থাকে না এবং তিনি একজন সাধারণ নাগরিকে পরিণত হন। এ প্রসঙ্গে কোনো কোনো সংবিধান বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশের সংবিধানের ৯৯(১) অনুচ্ছেদের কথা উল্লেখ করে থাকেন।
সংবিধানের ৯৯(১) অনুচ্ছেদের বিধানে বলা হয়েছে, বিচারপতিরা অবসরের পর আদালতের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবেন না। এতে বলা হযেছে, “অবসর গ্রহণের পর বিচারকগণের অক্ষমতা ৯৯(১) : কোনো ব্যক্তি এই সংবিধানের ৯৮ অনুচ্ছেদের বিধানাবলী অনুসারে অতিরিক্ত বিচারকরূপে দায়িত্ব পালন করে থাকলে উক্ত পদ হতে অবসর গ্রহণ বা অপসারিত হবার পর তিনি কোনো আদালত বা কোনো কর্তৃপক্ষের নিকট ওকালতি বা কার্য করবেন না।” এরপরও অবসরের পর রায় লেখা এবং স্বাক্ষর দান করাকে বৈধ বলা হচ্ছে কীভাবে। মূলত পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্কের কারণেই উচ্চ আদালত নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে এক ধরনের অস্পষ্টতা।
এ প্রেক্ষাপটে সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমিন চৌধুরী বলেছেন, বিচার বিভাগ এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। আমরা চাই না এটা ধ্বংস হয়ে যাক। প্রসঙ্গের সূত্র ধরে তিনি বলেছেন, “আমি মনে করি না যে, অবসরের পর রায় লেখা বেআইনি হবে। তবে অবসরের পর রায় লিখতে হলে একটা যুক্তিসঙ্গত সময়ের মধ্যে কাজটি করতে হবে। এক মাসের মধ্যে যদি দিয়ে দেন, তবে তা বৈধ হবে। তবে অবসরের পর রায় লিখতে হলে কোনোভাবেই আদেশ অংশ পরিবর্তন করা যাবে না। আদেশ অংশ পরিবর্তন করতে হলে রিভিউ করতে হবে।”
বর্তমান প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা এবং সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমিন চৌধুরীর ব্যাখ্যার প্রসঙ্গের মধ্যে অপর সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায়ের বিষয়টিও চলে আসে। পুরনো ঢাকার মুন সিনেমা হলের মালিকানা নিয়ে মামলার নিষ্পত্তি করতে গিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিকে অবৈধ বলে রায় দিয়েছিলেন বিচারপতি খায়রুল হক। উল্লেখ্য, সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল সংক্রান্ত রিটটি করা হয় ১৯৯৯ সালে। পরে এ রিটটি শুনানির জন্য তিনজন বিচারক সমন্বয়ে একটি বৃহত্তর বেঞ্চ গঠন করা হয় এবং ওই বেঞ্চ সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রবর্তিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে ২০০৪ সালে বৈধ মর্মে রায় ঘোষণা করে। অতঃপর সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে দায়েরের পর দীর্ঘদিন মামলাটি নিষ্ক্রিয় অবস্থায় পড়েছিল এবং বিচারপতি খায়রুল হক ১৯তম প্রধান বিচারপতি পদে আসীন হওয়ার পর এ আপিলটি শুনানির উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
সাবেক ওই প্রধান বিচারপতি যে পূর্ণাঙ্গ রায় দিয়েছিলেন তা পর্যালোচনায় দেখা যায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে সংক্ষিপ্ত রায়ে তিনি যে অভিমত দিয়েছিলেন তার সাথে পূর্ণাঙ্গ রায়ের ভিন্নতা রয়েছে। সংক্ষিপ্ত রায়ে বলা হযেছিল, রাষ্ট্রের বৃহৎ স্বার্থ ও জনগণের নিরাপত্তার প্রয়োজনে আগামী দুটি (দশম ও একাদশ) জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিদ্যমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। সর্বোপরি সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক সুপ্রিম কোর্টের কাছে এতদসংক্রান্ত রায়ে স্বাক্ষর দান করে পেশ করেছিলেন অবসর গ্রহণের ১৬ মাস পরে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা এবং সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমীন চৌধুরীর ব্যাখ্যা এবং সংবিধানের উপর্যুক্ত ধারা অনুযায়ী সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ের কার্যকারিতা থাকে না।
বর্তমান সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করার সময় সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের দোহাই দিয়েছিল। যে কারণে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো দাবি করছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা এখনো আইনগতভাবে বহাল রয়েছে এবং দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং এর মাধ্যমে গঠিত সরকার অবৈধ। এ পটভূমিতে বলা চলে, দেশ এখন শুধু সাংবিধানিক নয়, গভীর রাজনৈতিক সঙ্কটেও নিমজ্জিত। এ প্রেক্ষাপটে কেউ কেউ সুপ্রিমকোর্টে রিট পিটিশনের পরামর্শ দিচ্ছেন। অবশ্য আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ইউসুপ হোসেন হুমায়ুন বলেছেন, রিট পিটিশন হলে সাংবিধানিক জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। তা সত্ত্বেও এই জটিলতা নিরসনে সুপ্রিমকোর্টের বিকল্প নেই। কারণ যে কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সুপ্রিমকোর্ট হলো সর্বোচ্চ আইন সংবিধানের চূড়ান্ত ব্যাখ্যাদাতা।
য় লেখক : কলামিস্ট
লধসরষ২০১৩১২@ষরাব.পড়স
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।